সোমবার, ১ নভেম্বর, ২০২১

মৌসুমী চৌধুরী-র ঝুরোগল্প


হাত

জীবনের পাতাগুলো একেবারে দুমড়ে  মুচড়ে গেছে। কখন যে সে ডুবে যাচ্ছে অতল খাদে, আবার কখন যে ভেসে উঠছে, তিস্তা নিজেই জানে না! এই একটি মাসে প্রতিটি দিন যেন ঘোরের মধ্যে কেটেছে তার। যেন সূর্য ওঠেনি, আস্তও যায়নি। শুধু আবছা টের পেয়েছে চারপাশে কতগুলো হাত ... একটা বৃদ্ধ হাত তাকে দলা করে খাইয়ে দিচ্ছে

— " খা মা, খেয়ে নে। শরীরে প্রোটিন ডায়ট না পড়লে বাঁচবি কি করে? কি করে বাঁচাবি তোর শরীরের অংশ ওই একরত্তিটাকে?"

            তুলতুলে ছোট্ট একজোড়া হাত তাকে জড়িয়ে ধরছে। আধো আধো কথাগুলো কানে আসে

— " মাম্মাম, চোখ মেল না। বাবা তো স্টার হয়েই আছে উই আকাশে...উই যে... আছে তো।"

    তিস্তার চোখের সামনে নেমে আসে স্লেটরঙা

অন্ধকার। নিয়ে যাবার সময় বড় অসহায়ভাবে

সেই পুরুষালি হাতদুটি তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল সুগত,

— " আর পারছি না। খুব কষ্ট হচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে, তিস্তা।"

— " ভয় নেই, কিচ্ছু হবে না তোমার... ফাইট সুগত...ফাইট।"

— " আমাকে বাঁচাও তিস্তা.........আ।"

       বহুদিন আগেকার এক জাফরানি বিকেল থেমে গেছে তিস্তার চোখের তারায়। শক্ত পুরুষালি হাতে তার হুইল চেয়ারটা ঠেলে সুগত তিস্তাকে নিয়ে গিয়েছিল তাদের বাড়ির বাগানে। তারপর তার পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে  বসে বাড়িয়ে দিয়েছিল বড় ভরসার সেই হাত,

— " তোমার এই অ্যাক্সিডেন্টটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে আমরা কি একসঙ্গে বাঁচতে পারি না, তিস্তা? অ্যাকসিডেন্টটা যদি বিয়ের পর হত।"

— " আমি তো তোমাকে কিছুই দিতে পারব না, সু?"

— " কে বলল পারবে না? "ন্যাশনাল ইনস্টি -টিউট অফ অর্থোপেডিক্যালি হ্যান্ডিক্যাপ্ট"-

এর ফিজিওথেরাপিস্ট ডঃ নীলেশ পানি বলেছেন একদম ঠিক হয়ে যাবে তুমি।

        তারপর তিস্তা তো হাঁটছিল, ক্র্যাচ নিয়ে হাঁটলেও বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই হাঁটছিল। হুইল চেয়ারে বসে বল নিয়ে ক্যাচ-ক্যাচ খেলছিল ছোট্ট তিতুনের সঙ্গে, তিতুনকে হোমওয়ার্ক করাচ্ছিল , জমিয়ে  রকমারি রান্না করছিল এবং অনলাইনে শাড়ির ব্যবসাটাও চালাচ্ছিল বেশ সফলভাবেই। আর তার কাঁধে প্রতি মাইক্রো সেকেন্ডে অনুভব করছিল একটা শক্ত হাত।

     ঠিক এই মূহুর্তে আর একটি হাত এগিয়ে আসছে তিস্তার দিকে

_ " আমার হাতটা ধর না মাম্মাম। ওঠো নাখেলবে আমার সঙ্গে। এসো।"

   তিস্তা  অনুভব করে সেই পুরুষালি শক্ত হাতদুটো কখন যেন পাখির পালকের মতো বড্ড নরম হয়ে গেছে আর ধীরে ধীরে আগলে ধরে বাবুইপাখির বাসায় পুরে দিচ্ছে তাকে

        টুকটুকে লাল বলটা নিজের হাতে তুলে নেয় তিস্তা। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন