শুক্রবার, ১ অক্টোবর, ২০২১

এই সংখ্যার কবিঃ কবি সুধেন্দু মল্লিক


 

কবি সুধেন্দু মল্লিক   

কখনো তিনি ‘বিশ্বাসপরায়ণ নাস্তিক’ কখনো বা ‘পতিত পৌত্তলিক বাংলা কবিতার মনস্ক পাঠকের কাছে তাঁর ‘সঙ্গে আমার বালককৃষ্ণ’(১৯৭৯কাব্যটি আধুনিক মনের 

ঈশ্বরভাবনার এক অনন্য নিদর্শন। কেবল আস্তিক্যচেতনা নয়প্রেম-সমাজ এবং শোককবিতার বৃত্তেও তিনি সমান স্বচ্ছন্দ। প্রিয় কবিবন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে লেখেন ‘স্বর্গে বাউণ্ডুলে’ কিংবা বোনের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু তাঁকে 

লিখিয়ে নেয় ‘বোন’ নামের এক অসামান্য এলিজি : ‘আগুনের বসন পরে কোন্‌ সংসারের দিকে ফিরে গেলি বোন যদিও তাঁর কবিতা নিয়ে চর্চা সীমিতবিচ্ছিন্ন কিছু প্রবন্ধ এবং তরুণ মুখোপাধ্যায়ের একটি পুস্তিকা  গৌরশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে বিগত কয়েক বছরে। ১৯৯০ সালে পেয়েছিলেন ভারত সরকার নির্বাচিত জাতীয় কবির সম্মান। ২০২০ সালের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারের শেষ বাছাইয়ে উঠে এসেছিল তাঁর কাব্য ‘পুষ্পিত ধিক্কার’-এর নাম। সমস্ত প্রথম সারির পত্র-পত্রিকায় একদা নিয়মিত লিখেছেন। তবুও আজ পর্যন্ত ছোট বা বড়ো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পুরস্কারে তাঁকে সম্মানিত করেনি রাজ্য সরকার।   

হিরণ্ময় অন্ধকার’ (১৯৬৩থেকে ‘সঙ্গে আমার বালককৃষ্ণ’ (১৯৭৯পেরিয়ে ‘শেষ জানালায়’ (২০১৯এবং ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (২০১৭) –-পর্যন্ত তেরোটি কাব্যের কবি সুধেন্দু মল্লিক (জন্ম ১৯৩৫এই ছিয়াশি বছরেও সমান সক্রিয় পঞ্চাশের সমুজ্জ্বল কবিকুলের অন্যতমস্বভাবত স্বতন্ত্রমৃদুকণ্ঠ এই কবি রক্তে বহন করেছেন কবিতার 
উত্তরাধিকার। পিতামহ পদ্মশ্রী কুমুদরঞ্জন মল্লিকপিতা জ্যোৎস্নানাথ। কয়েকবছর কাটোয়া কলেজে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনার পর বিচারকের পেশাকেই গ্রহণ করেছিলেন। চলতি বছর অর্থাৎ ২০২১- এই প্রবীণ কবিকে তাঁর লেকটাউনের বাসগৃহে কবি দিনেশ দাস স্মারক সম্মান ভূষিত করলেন হাওড়ার 
সারঙ্গ পত্রিকাগোষ্ঠী। এছাড়াও বছরের শুরুতে বাংলা লেখক  শিল্পী মঞ্চের উদ্যোগে সম্মানিত হয়েছেন 
কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার ২০২১’-এ। তাঁকে প্রণাম জানিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা অগ্রন্থিত কিছু কবিতা ভার্চুয়াল মাধ্যমে প্রকাশ করা হলো। সঙ্গে রইল পাণ্ডুলিপি-চিত্রও।






রাজেন্দ্র সঙ্গমে

 

একমাত্র সে রাজার দীপ্ত পদপ্রান্তে

চিরনত শতকোটি শির

প্রেম তার রাজদণ্ড, সব ভীত ভ্রান্তে

স্পর্শ করে ঘোচায় তিমির।

#

স্বচ্ছ মেধা অটল যুক্তির হিমাচল

অভ্রান্ত বেদের মতো সম্মুখে প্রকাশ

সংশয়ের অন্ধ মেঘ লুপ্ত হয়, প্রাণের মঙ্গল

বার্তা তার স্তব্ধ করে অজ্ঞান উচ্ছ্বাস।

#

তাকে দেখি, মন বলে আচার্য শঙ্কর

আরেক আশ্চর্য রূপে সম্মুখে আমার

অমেয় প্রভায় ঢাকে যুগ যুগান্তর

সে- সত্য অবিচল জ্ঞানের সত্তার

#

রাজেন্দ্র সঙ্গমে দীন কি দেব অতুল

চরণে পৌত্তলিক রাখি দুই নয়নের ফুল।





মাধ্যাকর্ষণ অতিজাগতিক বেড়াল

 

সংসার চলমান। যেন কল্পনার নদী। চেতনার চর

তার ভেতরে কণিকা অনুকণিকা রক্তকণিকা

শ্বেরকণিকা পীতকণিকা এলোপাথারি

অন্ধকারে একটি নিছক আলোকিত বাক্স। শূন্যে

ঘূর্ণ্যমান।

#

শুধু লাথি খাওয়া রোঁয়া ওঠা বুড়ো বেড়ালটা

মাধ্যাকর্ষণের পাঁচিল টপকে কখন পালিয়েছে।

বসে আছে মহাশূন্যে ছায়াপথ জুড়ে। ধ্যানী চোখ

স্থির। কিন্তু হাসছে। দেখছে কারখানার মালিক

আগুনে দাঁড়িয়ে ঘাম ছড়িয়ে খাটছে যেন

দাসখতের শ্রমিক।

#

বুড়ো বেড়াল হেসে ওঠে। ফিক ফিক খ্যাক খ্যাক। বিড় বিড়

করে বলেএর মধ্যে বিজ্ঞানের খেলাটা লক্ষ্য করেছো?

আর্কিমিডিসের চিন্তার বিদ্যুৎ। কতো কি এলো আর গেলো।

শূন্য আর অবয়বহীন শূন্য স্থান নেই কাল নেই পাত্র নেই।

শুধু জ্যামিতিক শূন্য অতি জাগতিক শূন্য রিলেটিভিটির

শুন্য, কোয়ান্টাম নৃত্য, লুপ কোয়ান্টাম গ্রাভিটি লেজে লেজে

গিঁট্টু দেয়া হনুমানের পাল। ব্রহ্মাণ্ড বিজ্ঞান। বোঝার

চেষ্টা করছে ছায়াপথের বেড়াল। পরমুহূর্তে টপকে চলেছে

গ্রহান্তর।  


 





প্রত্যাগমন

 

কাল রাতে বাড়ি ফিরছি যখন

অনেক রাত। মাথার ওপর কুয়াশা চাদর

বুকের ভিতর মহাসিন্ধুর ছায়া সাক্ষাৎ  ---

দুটো পা গেলেই নীল আশমান,

              চলো তবে যাই।

কোথা যাবো জানি আন্দাজ মতো। কিন্তু -

কিন্তু কি করে যাই! সামনে ঘূর্ণি পাঁচিলের বাধা

ঘুরে ঘুরে আসে স্বপ্নের বেড়ী। ওদিকে আবার

বুড়ো কুকুরের ভাঙাগলা গান - হেথা নয় প্রিয়

অন্য কোথাও পরীক্ষা করো -- এটা মোর পাড়া

হে ধর্মরাজ সারমেয়বেশী তাহলে আমার

বাড়িটা কোথায় উবে গেল নাকি? এতো আনাগোনা

করেও চিনি না বাড়িটা আমার!

               ঠিকানা রাখিনি। কি হবে উপায়?

লিখিত পড়িত সবকিছু হয়? দলিল কাগজ

মাঝরাত্তিরে খুঁজে পাওয়া দায় এতো পারা যায়!

#                                         #

বাড়িটা কিন্তু ছিল দাঁড়িয়েই। মিচকে ফাজিল

বন্ধুর মতো পিছনে সতত। হয়তো ছিল না।

হয়তো ফিরবে আমার মতোই কোনো একদিন ---

ফিরতে চাইবে। দেখা হয়ে যাবে। হবে কি মিলন

নাকি সংঘাত দুজনে দুমনে! বলো উদাসীন চির উদাসীন

মন্দিরহীন সাগর সোপানে নয়নাঘাত

জগন্নাথ।





তোমার মুহূর্ত


তোমার মুহূর্ত কিন্তু জেগে আছে। শ্বেতপদ্ম

স্মৃতির তিলক গোপীচন্দনের ফোঁটা স্নিগ্ধ মনোহর

প্রীত সদ্যস্নাত সুস্মিত আনন। বাসনা কিংকর

সকলি অস্থির তাকে ঘিরে

ক্ষণবৃত্ত নিবৃত্ত বন্ধন। তবু কুঞ্জে ব্রজবাসে

নিশি জাগরণ। তোমার মুহূর্ত হাসে অনিকেত সিক্তদেহ

প্রসন্ন বৈষ্ণবযেন শুভ্র বিদ্যুন্মালায় আঁকা

আসন্ন মিলন উৎসব।







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন