চলনবিল
"অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া--
দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া॥"
মন্দ ছিল, মন্দ আছে, মন্দ থাকবে। কিন্তু উত্তুঙ্গ পর্বতশীর্ষ ছাপিয়ে, উদ্বেল সমুদ্র ঢেউয়ের মাথায় চড়ে মন্দের পিঠে চেপে তাকে কাবু করে এগিয়ে চলে আনন্দ।
বাঘ একলা চর। তার কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই, পদলেহন নেই। সে অনুপ্রেরিত নয়, অনুপ্রাণিত নয়। উৎপীড়িত নয়, উৎকোচিত নয়। সে সোজাসাপটা থাবায় নিজের খাবার জোগাড় করে, অন্যের উচ্ছিষ্ট খায় না। বাঘ বহুরূপী হয় না কখনো, তার গায়ের ডোরা দাগ দেখে ভয় পায় অলস লোভী। প্রচারের আলো জোর করে ফেললেও সবাই বাঘ হতে পারে না।
সকাল কি শুরু হলো? সকাল কি শেষ হলো? নাকি শুরুর আগে কিম্বা শেষের পরেও থাকে আরো কিছু? যারা কবিতা লেখে, তাদের কি পাগল ভাবা হয়? কিম্বা অতিমানবীয় স্বপ্নের মূর্ত রূপ? নাকি পাশ ফিরে ঘুরে শোবার নাবাল ভাবনা? টাকার পেছনে ছোটা শুধুই কি নেশা? কিম্বা আচম্বিত ভোগের আর ভোগান্তির আকুল কামনা? নাকি ব্রহ্মান্ড নিয়মে এও ঈশ্বর কণা থেকে ব্ল্যাকহোল, ফের সেই ঈশ্বরকণা?
অগ্রহায়ণের পাতলা হিম জড়িয়ে ধরছে টুপটুপ। ফুরফুরে পপকর্নের মতো শিশির নেমে আসছে মেঘের গর্ভগৃহ থেকে ভিসা পাসপোর্ট ছাড়াই। নরম অন্ধকার পেতে দিচ্ছে নক্সীকাঁথার নক্সাদার আসন। রুক্ষ রাঢ়ের মাটি অভিমানে ক্রমশঃ কালো, ক্রমশঃ শক্ত হয়ে আসছে। আসছে শীতের প্রস্তুতিতে ঝরে যাওয়া সূক্ষ্ম লোমগুলো আঁতিপাঁতি খুঁজেই চলেছে একটানা অধ্যবসায়ে। পাথুরে লাল জীবজন্তুর চলমান ফসিলের দল বিষন্ন নুইয়ে যাওয়া ঘাড় টলমল করতে করতে নিজের একঘেয়ে কালো গর্তে ফিরে আসছে। আকুল সিদ্ধেশ্বরী বাঁশি এখানে বাজেনা। নিশিও এখানে রাতে বেরোতে ভয় পায়। শ্বাপদের শ্বাস হিমেল হাওয়াকে মাইনাস দুশো তিয়াত্তর ডিগ্রির দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। রাত্রির গোল ঢাকনা মিশে যায় নিশ্চুপ সূতপুত্রের স্বপ্নযাত্রায়। সি শার্পে কন্ঠ ভাসিয়ে দিয়ে দেশছাড়া ব্যাকুল ভোজপুরী খুঁজে চলে ফেলে আসা উগ্র রঙের সকাল। 'কোই তো লৌটা দে...লৌটা দে রে মুঝে...বিতি হুই বচপনা সুবহ্...!
নলেন গুড়। শব্দটার মধ্যেই আপসে ফুরফুরে সুগন্ধি একঝলক হাওয়া। আমি আবার একে খেজুর গুড়ও বলি। আসলে ছোটবেলায় ভাবতাম নলেন বোধহয় কোনো অপ্রাকৃত মিষ্টি জাতীয় জিনিসের নাম। দুটোকে মেলানো যেত না কিছুতেই। তবে সেই স্বাদ, সেই গন্ধ এখন আর তেমন করে পাই না। সেই মালভূমির দেশ থেকে সমতলের গঙ্গার পলিমাটির দেশে যখন আসতাম, ভোরের আলো ছুঁই ছুঁই অন্ধকারে বিছানায় মশারি ফাঁক করে একটা গ্লাস এগিয়ে আসতো। কনকনে ঠান্ডা অথচ পৃথিবীর সবচাইতে মিষ্টি আর অদ্ভুত স্বর্গীয় গন্ধের সেই গ্লাসের ভেতরে টলমল করত সদ্য জিরেন কাটের রস। আলো ফুটতে না ফুটতেই উড়তাম। কোত্থেকে কিছু অচেনা কালো মুসকো লোক এসে বাড়ির সীমানা পাঁচিলের বাইরের বাগানে বিশাল কড়াইয়ে ক্রমাগত বিশাল হাতা ঘুরিয়ে চলত। আর ওমনি সেই আশ্চর্য সোনালি আভায় মোড়া হালকা চকলেট রঙের তরলের মধ্যে থেকে সাঁ করে নাকের ভুলভুলাইয়া পেরিয়ে একমাথা কালো চুলে ঘেরা ছোট্ট বাক্সে সারেগামা গাইতে গাইতে সেঁদিয়ে যেত এক ভালো গন্ধের একঝাঁক রেশমি সুতো। এখনকার মতো চালাক হয়নি সেই পৃথিবীর মানুষেরা। চিনির ভেজাল দিয়ে নলেন খুনের বুদ্ধি সেইসব মাথামোটা লোকদের ছিলনা। আমাদের ছোট্ট মুঠোয় এককুচি পাটালি পেয়ে নাচতে নাচতে ফিরতাম কিম্বা দে ছুট্ গঙ্গার পাড়ে। বেলা সামান্য বাড়লে মিষ্টি নলেন রোদ্দুর ঘুঙুর বাজিয়ে হাঁক দিত, "সন্যাসী ময়রার নলেন মাখা সন্দেএএএএশ..."!
মনখারাপ। গভীর বিষাদ জড়িয়ে ধরছে রোজ। বিস্তীর্ণ এক বুজে যাওয়া নদীর চর ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পা ডুবে যাচ্ছে। চেষ্টা করছি পা তুলে আনার। পারছি না। একটা পা তুলতে গেলেই অন্য পা আরোও তলিয়ে যাচ্ছে। বুক পর্যন্ত ডুবে গেছি। বুকের পাঁজর ওঠানামা করছে বিগত শতকের অ্যান্টিক হাপরের মত। হাঁপাচ্ছি আর চোখ ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করছি এমনকি মাথার পেছনেও। আশ্চর্য! এই দিগবিস্তারী চোরাবালির চরে অনেকেই ডুবছে। কারো রং কালো, কারো সাদা, কেউ হলদেটে। মাথা পর্যন্ত, বুক পর্যন্ত, কোমর পর্যন্ত ডুবে আছে। কারো শুধু চুলটুকু দেখা যাচ্ছে। এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু আগাছা। কোনোটা ত্রিশূলের মত, কোনোটা চাপাতির মত, কোনো আগাছার আকার খাঁটি কালাশনিকভ রাইফেলের। বালির চরের রং পাল্টে যাচ্ছে। কোথাও গেরুয়া, কোথাও সবুজ, কোথাও ঘন কালো। আকাশটাও কি কালো হয়ে আসছে!
পুরা সচ জানতে আর জানাতে গিয়ে যে মানুষটাকে গিলে খেয়েছিল বুলেট, তিনি বৃথাই বিশ্বাস করতেন খবরের কাগজ গণতন্ত্রের তৃতীয় স্তম্ভ। তিনি জানতেন না খট্টর খট্টাশ রা ঝাঁ চকচকে বিদেশী জাম্বো লাইফস্টাইলের জন্যে সাপের আর ব্যাঙের গালে একই ঠোঁটে চুমু খায়। তিনি জানতেন না ওই গণতন্ত্রের ধ্বজা উড়ানো গোল বাড়ীর প্রধান মুখ সাটাঙ্গে লুটিয়ে পড়ে অর্থলোলুপ যৌনভাতি চর্চকের লোমযুক্ত পায়ে শুধু দু মুঠো ভোটের জন্যে। তিনি জানতেন না। তাঁরাও জানতেন না, যাঁরা সব্জি মান্ডিতে গেছিলেন, যাঁরা স্কুল অফিস আদালত ফেরতা, যাঁরা হাসপাতাল থেকে ফিরছিলেন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, তাঁরা আর বাড়ী ফিরবেন না কোনোদিন।
নাদির শাহ্ অট্টহাসি হাসছে। তাইমুর লঙ হাসছে ঠা ঠা শব্দে। হুন, শক, ইউরোপের বার্বেরিয়ানরা হাসছে বিকট কাচভাঙা আওয়াজে। দাউদাউ জ্বলছে আগুন। ঈশ্বর শব্দ থেকে অক্ষর গুলো ছিটকে সরে যাচ্ছে। আলাদা হচ্ছে ঈশ্বরের যৌথ পরিবার। আগুন ... আগুন ... চড়চড় করে ফেটে যাচ্ছে তাজমহল, মোনালিসার ছবি, মাইকেলেঞ্জলোর ফ্রেশকো, রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি, সহস্র এক আরব্য রজনী। পুড়ে যাচ্ছে ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন, দ্য কিড, দ্য গ্রেট ডিক্টেটর, পথের পাঁচালী। হানাদারদের ঘোড়ার খুরে উড়ছে ধুলো। ভয়ঙ্কর শ্বেত সন্ত্রাসের মেঘ ঢেকে ফেলছে অরণ্য খন্ড। চোরাবালি গিলে ফেলছে স্বপ্ন।
দ্রুত এগিয়ে আসে ভবিতব্য। দেখতে দেখতে হুশ করে পেরিয়ে যায় লম্বা অ্যাসফল্টের রাস্তা, কত বাড়ি, ফোটা কিম্বা না ফোটা বুনো ফুল। প্রত্যেক সকাল আর প্রত্যেক রাত্রির মধ্যে কিছু সুগন্ধি সময়, বাকি সব যান্ত্রিক। অথচ এই শীত, এই গ্রীষ্ম ফাস্ট ফরোয়ার্ড করা ঋতুচক্র সাঁ সাঁ করে স্থবির দেহ ছুঁয়ে ছুটে যায় পেছনের দিকে, আর ফিরে আসে না কখনো। মিষ্টি গোলগাল শিশু থেকে জীর্ণ ত্বকের সিনিয়র সিটিজেন হয়ে যায় চির রিক্ত মানুষ কখন যেন তার নিজের অজ্ঞাতেই। মাটির কুচির মধ্যে, হাওয়ার পরিধির মধ্যে, মিলিয়ে যেতে যেতে নামানুষ নাঅবয়ব তাকিয়ে দেখে নীচের বাগানে পড়ে আছে কত প্রেম, কত বিসংবাদ। অসহায় চোখ নাকি চোখের রেপ্লিকা ভেঙে চুরে যেতে যেতে সে বুঝতে পারে হিসাবের খাতা বলে আসলেই কিছু হয় না, ছিল না কখনো।
ক্রমশ...

অশেষ ভালোলাগা ও শুভ কামনা প্রিয় রঙিন ক্যানভাস পত্রিকা।
উত্তরমুছুন