রবিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২৫

আবদুস সালাম-এর প্রবন্ধ

কবিতা এখন

সমকালের কবিতায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে সুদূর প্রসারী বর্ণচ্ছটা।প্রত‍্যন্তগামী ভাবনার বিচ্ছুরণ। ভাবনার মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে  আনতে হয় কবিতার শরীর। ভাবনা থেকে ভাবনায় ডিঙিয়ে যাওয়া শুধু। ভাবনার ভগ্নাংশ জুড়ে তৈরি হয় কবিতার পঙ্ক্তিমালা। ভাবনার রাস্তা খানাখন্দে ভরা। সাবলীল গতি হোঁচট  খাচ্ছে প্রতি পদে।লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে যাওয়া শুধু।

আমরা যারা সাধারণ পাঠক হারিয়ে ফেলেছি খেই। পাচ্ছিনা সঠিক দিশা। প্রায়শই মনে হয় যেনো ভাবনার বুনো হরিণ।একে ধরা যায় না কেবলমাত্র চোখে দেখে যায়। ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবনার স্ফুলিঙ্গ দিয়ে বোনা রাতের আকাশ। শরতের পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো ভেসে যাওয়া  টুকরো টুকরো আশা, আকাঙ্ক্ষা। আধুনিক কবিতা বলতে আমরা উপলব্ধি করছি পেঁজা তুলোর মতো ভাবনা বিহীন ভাবনার জারিত কথামালা। যেমন দেবাশীষ সাহা লেখেন "মহিষ আর মেঘের সঙ্গমে জন্ম নিবে আমার উত্তর পুরুষ "

"কাঠের স্বপ্ন অনুবাদ করছে গৃহ সজ্জা"

"ঘরে ফিরে রং করি পাখিদের ডানা"

 অসাধারণ সব অনুভূতি যা নতুন প্রজন্মকে কবিতার বনে ভ্রমণ করতে যোগাবে নতুন দিশা।


    কবিতায় খুঁজে পাই নির্মাণগত আপাত বিশৃঙ্খলা স্বাধীন কল্প চিত্রের বেহায়াপনা।এখন মিথের ছড়াছড়ি বিশ্বাস অবিশ্বাস মিলে মিশে শব্দেরা নির্বাক। কবিতায় এখন খুঁজে পাই সম্মোহনী ধ্বনি প্রবাহের বিচিত্র বুনন। কবিতায় অজন্তা ইলোরার প্রচ্ছদ ভাবনা। কবিতার প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে খেমটা নাচে পাড়া মাত্  করে। অসাবলীল যাত্রাপথে জীবন ভিত্তিক জীবন যন্ত্রণার নানা অভিজ্ঞতার কথা আঁকে উপলব্ধির চিত্র


আঙ্গিকের পরিবর্তন এই সময়ের কবিদের  বিশিষ্ট লক্ষণ অন্তর্দহনে জর্জরিত মানুষের চলার পথ যেমন সাবলীল হয়না তেমনি কবিদের কবিতা এখন সাবলীল প্রকাশে ধরা দেয় না।মোহময় উল্কি দিয়ে সাজানো হয় কবিতার শরীর।

অনুভূতির বুননকে আমরা অস্বীকার করি কিভাবে?

এই সময়ের একজন  আলোড়ন জাগানো কবি তৈমুর খান এর কবিতায় এখন অন‍্যমনের ছড়া ছড়ি। বাস্তবতার করুন দহনে জর্জরিত ভাষা উগড়ে দেন কবিতার শরীরে।

 "শহরে এসে দেখি,সব মানুষের পিতলের হাত

রূপোলী মুখে বড়  যান্ত্রিক হাসি

আর পা গুলো লোহার,টায়ারের সঙ্গে গড়াতে গড়াতে গোল হয়ে গেছে পিচের রাস্তায়।"

 "হে বিষগাছ, তোমার তলায় আমাকে পুঁতে রাখলাম

কখনো ফুল ফুটৃলে ডেকে দিও"__

"বাতাসের ডানায় মরুভূমি পার হই,

হা অন্ন দু ঠোঁটে ছড়িয়ে  দিই বিষ

বিষাদ আমার ডাকঘর"

"সঙ্গমের খোলা রাস্তায় বাজনা বেজে ওঠে

বিবাহ উৎসবে নেচে ওঠে রাত 

টেবিলে টেবিলে উষ্ণ জল

কামুক কুয়াশার চাউনি

উঁকি দিচ্ছে সালঙ্কারা মেঘ"


  "রোজ মোহ এসে গাভীর মতো দাঁড়ায়/তার দুধের থলি ঝুলে নামে/হামাগুড়ি দিয়ে তার তলপেটের নীচে/হাঁ করে থাকি/জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে চেটে/পান করি অলীক রস___

 রোজ নারীর কাছে যাই/গাছের কাছে যাই/অহংকার নম্রতা তুলে দেখি/সহিষ্ণু সততা হেসে ওঠে/ তার পর বাতাসে ওড়ায় চুমু_"___

পাখি শিকার দেখতে দেখতে অন্ধকার হয়ে এলো

চিনা ভাষার মেয়েদের মতো একটা প্রদীপ জ্বলে উঠলো 

আর কাঁপতে লাগলো তার শিখা

বিড়াল টি লাফালো—-


    আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়  ।এখন কবিতার ভাষা যেন সেতু হীন যাত্রাপথে স্বপ্ন উড়ান , যেটা বড্ড প্রাসঙ্গিক।কবিগণ ছন্নছাড়া আকাশের বুকে এঁকে দিতে চায় প্রাত‍্যহীক আল্পনা। দিন পাল্টে যাচ্ছে, সময় বদলে যাচ্ছে।   কবিতার ভাষা, আঙ্গিকের কেনই বা পরিবর্তন হবে না?

 

রবীন্দ্রনাথ ,নজরুলের বিবরণ ধর্মী কবিতা থেকে বেরিয়ে এসে কল্লোল যুগের কিছু কবি যেমন জীবনানন্দ দাশ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়,অমিয় সেন এর মতো প্রতিভাবান কবি বেরিয়ে এলেন চেনা পথ ছেড়ে অচেনার উদ্দেশ্যে তৈরি করলেন নতুন পথ ।যে পথ  ধরে আমরা পাড়ি দিয়ে চলেছি নতুনের অভিযানে। যতই সমুদ্রের জল লবনাক্ত হোক ,হোক না কেন বিপদসংকুল আমাদের ছোট ডিঙিনিয়ে জয় করবো নতুন দেশ ।তারা আমাদের শেখালেন নতুন কবিতার আঙ্গিক, পরিবেশনের কলাকৌশল। আমরা সেই পথে হাঁটতে দেখলাম নব্য কবিদের। একবিংশ শতাব্দীতে  সেই সব কবিদের অসাধারণ সব পঙ্ক্তিমালা।

 যেমন অভ্র দীপ গোস্বামী লিখেছেন  "ধর্ম বিবেকের গলায় পাওয়া গেল ভাঙা মদের গেলাস"

অমিতাভ দাশ লিখেছেন " মেঘের মতো অভিমান এসে ধাক্কা দিচ্ছে বিষাদ কুটিরে "

রোশনি ইসলাম লিখেছেনমুসলধারে বৃষ্টি হচ্ছে/সবুজ পাতার উপর পিঁপড়ের পরিবার "___

সমীরণ কুন্ডু লিখেছেন "   লিঙ্গের প্রত‍্যয় দেখে/শিবের সৎকার নিষিদ্ধ হল/উত্তর বিশেষ গবেষণা লিখে রাখে কেউ_"___

গোলাম রসুল লিখেছেন"নৌকার তলায় শুকিয়ে গেছে শহরের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী   "

 " কি মারাত্মক ভাবে রাত্রি নামছে/শুধু বেঁচে থাকার জন্য নয় মরার জন্য যে হাসপাতাল বানিয়েছে/আমরা তার উপর প্রচন্ড মেঘ"____

"আমি দেখছিলাম পোশাক খোলা আমার ছায়া"___

ফজলুল হক লিখেছেন"অন্ধকারের অলৌকিক পুরুষ আমি/একান্তে ভিক্ষে চাই সূর্যের আলো/পুড়ে যাবে আকাঙ্ক্ষার জ্বালামুখ/ছায়া হীন পিপাসা কাতর চুম্বন রাত্রি"___

মাসাদুর রহমান লিখেছেন "পৃথিবীর প্রতিটি দিন শান্ত গ্রামের প্রান্তে বসে/দেখে/ধান ক্ষেতে আশ্চর্য বাতাস নিয়ে ফিরে আসছে বিভূতিভূষণ"____

প্রবীর চক্রবর্তী লিখেছেন "কোনো কোনো অসুখের চূড়ায় দাঁড়িয়ে/শহর দেখতে গিয়ে পা হড়কে/পড়ে গেছি মৃত্যুর দিকে/চারপাশে প্রিয় জন বিষন্ন চোখের তারায়/পিছনের পথ"____


সৌরভ হোসেন লিখেছেন"হাসপাতাল থেকে ফিরে আসে যেটুকু সুখ/তার ভেতর আমাদের আকাশ/আমাদের যাপন, আমাদের সংসার /অসুখ কখনো আপনার হয়না/অথচ অসুখের ভেতরেই আমাদের বাস, আমাদের রোদবৃষ্টি/আমাদের নাগরদোলা"__


আবদুস সালাম লিখেছেন"সময়ের স্রোতে বয় শুনশান শূন্য বাতাস/চোখ জুড়ে নেমে আসে গাঢ় অন্ধকার/বিষন্ন উৎসবের আড়ালে খসে অস্তিত্বের খোলশ/অনিবার্য অন্ধকারে ভাসে বিবর্ণতা সংকেত"___

"একটা ধূসর শূন্যতার বুকে মাথা গুঁজে আছি/শিয়রে বসে পাহারা দিচ্ছে মহাকাল/বিবেকের পাঠশালায় ঝর্ণার বিজ্ঞাপন/নষ্ট আকাঙ্ক্ষার আমন্ত্রণে জড়ো হয় পাপ"___


"শরীরের মানচিত্রে লেপ্টে আছে ব‍্যাকুলতা মাখানো আর্তস্বর

ঘৃণার ছায়াপথ জুড়ে হেঁটে চলেছে কেঁদে ওঠা জীবনের সারমর্ম

অগোছালো পৃষ্ঠায় ফণা তুলছে ঔদ্ধত্যের সাপ

যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে বিবেক"



"জীবনের উষ্ণতা ডুবে গেলে নক্ষত্রেরা নেগেটিভ আলো দেখায়  

অপূরণীয় আশারা পড়ে আছে বিপন্ন পথে

পাখিরা কিচিরমিচির ডাকে

 সন্ধ্যা নামে দুঃখের চিলেকোঠায় 


 হৃদয় পুড়ে গেলে লেখা হয় ধূলি  -ধূসরীত মেঘেদের গান

  নেচে ওঠে ছাইয়ের পান্ডুলিপি

করুণার বাঁশি বাজে ----

 থোকা থোকা  অন্ধকার অতিক্রম করে সহবাসের জঙ্গল"  


সাহিত্য চর্চার বিষয় টি এখনো বিছুটি পাতার মতো অচ্ছ‍্যুৎ। সাহিত্যে হেরে যাওয়ার কিছু নেই। সাহিত্য একটা দুরন্ত নদীর মতো চঞ্চল।যখন জেগে ওঠে তখন বসন্ত সমাগত হয়।দুর্ভাগা সুন্দর যেমন মাটি কামড়ে পড়ে থাকে।

কবিতা মনের ভূবনে নানা রকম ফুল ফোটায়। মানুষের মন যেমন ভিন্ন,মনন তেমনি ভিন্ন। কবিতায় কবির ভাবনা তেমনি ভিন্ন। ভিন্নতা আছে বলেই কবিতার ভিন্নতা আমরা লক্ষ্য করি। লক্ষ্য করি ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির, ভিন্ন ভিন্ন রসের কবিতা আমরা দেখতে পাই।  নিমফুলের মধুআমফুলের যেমন ভিন্ন, তেমনি কবিদের  কবিতা তেমনি ভিন্ন ভিন্ন

 বহু প্রতিকূলতার মধ্যেও কবিতা নিজস্ব স্বত্তা বজায় রেখে আপন গতিতে,আপন মনে এগিয়ে চলেছে।শ্রদ্ধার চোরাবালিতে আবেগ মথিত হৃদয়ের যন্ত্রণা মন্ডিত শব্দ মঞ্জরীই কবিতার প্রাণ। গর্ভ যন্ত্রণার মুক্তিই কবিতার স্বরূপ।

 

৪টি মন্তব্য:

  1. আন্তরিকভাবেই ধন্যবাদ জানাই। কবিতা নিয়ে যা ভেবেছেন যা লিখেছেন এবং যে উপলব্ধি ধারণ করেছেন তা যথেষ্টই একজন সংবেদনশীল কবি ও পাঠকের কাজ।

    উত্তরমুছুন
  2. কবিতা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। জটিল অলংকারে যেমন রমনী হতে হতে পাংকু হচ্ছে মেয়েরা তেমন কবিতাও অদ্ভুত আধুনিকতার মোড়কে মুড়ে নিচ্ছে তার অবয়ব।অস্থিরতা ছেঁড়া ছেঁড়া শরীরের কবিতা লেখাচ্ছে। কবির কোন দায় নেই এ হেয়ালি মুখোশ আচ্ছাদিত আচরণে।পরিস্থিতি কবিয়ায় মগ্ন হবার সময় হরণ করছে যেন।

    উত্তরমুছুন
  3. চমৎকার লেখা। শুভেচ্ছা।

    উত্তরমুছুন