‘সুন্দরী গাছের নিচে’: সবুজ পৃথিবীর সাধনায় কবি ওয়াজেদ আলি
দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপের কবি ওয়াজেদ আলি বর্তমানে অসুস্থ শয্যাশায়ী। যিনি আজীবন ধরে সুন্দরবন এলাকা ও সুন্দরবনের জনপদ ও জনজীবনের ছবি কাদা ছেনে বালি মেখে তুলে এনেছিলেন তাঁর কবিতায়, এই মুহূর্তে তাঁর কবিতা নিয়ে আলোচনা করছি, যিনি চিরহরিৎ একটি গ্রহ কামনা করেছিলেন তাঁর কবিমনে, তাঁর লেখনীতে, কবিতায়।
আধুনিক বাংলা কবিতার অবয়বে গদ্যের সরলতা এসেছে, অনুভবে এসেছে হৃদয়-মন-মনন-সমাজবীক্ষণ এমনকি আর্থিকতাও। কখনো তার মধ্যে স্বপ্নচারী কল্পনা-উদ্বেলতা আবার কখনো মেদহীন ঋজু সংযমী কালাতীত গাম্ভীর্য। বাংলা কবিতার চৌহদ্দি বেড়েছে বিস্তর। বিনয় মজুমদারের কবিতায় তো গণিত জ্যামিতি সমীকরণও জায়গা করে নিয়েছে। গহনতাও কম নয়। কিন্তু গদ্যের সরলতা এলেও ভাবনার জটিলতা যন্ত্রণার তীব্র সূচিমুখ একালের কবিতাতে কেমন যেন দুরূহ করে রাখে। অনেক সময় কবিতা ঠিক ভালো লাগার স্তরে থাকে না। ‘সহৃদয় হৃদয়সংবাদী’ পাঠকমনের অপেক্ষায় পড়ে থাকতে হয় কবিতাকে। অবশ্য কবিতার পাঠক তৈরি করে নিতে হয় কবিকে, প্রায় সবকালেই।
একালের (গত শতকের শেষদিকের) কবিদের মধ্যে পড়তে ভালো লাগার মতো কবিতা লিখেছেন যে-ক’জন হাতে গোনা কবি, তার মধ্যে ওয়াজেদ আলি অন্যতম। সত্তর দশকের প্রথম দিকে এই কবির আবির্ভাব। আবির্ভাবেই যে চমকে দেওয়ার মতো কবিতা লিখেছিলেন, তা নয়। বরং ঈষৎ সরল ও অনুচ্চ স্বরে তাঁর যে উচ্চারণ, তা পাঠককে টানতে শুরু করে। স্বল্প সময়েই নিজের সরল অকপট জাঁকহীন আদি-পৃথিবীর-গন্ধ-মাখা মুখটা মেলে ধরেন। তার মধ্যে পরেকার পৃথিবীর বিপন্ন ও ভাঙা-কাচ-ঘষটানো অ্যানিমেটেড মুখাকৃতিও বাদ যায় না। তবে সেটাও আঁকা হয় অকৃত্রিম সরলতায়।
সত্তরের দশকে ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘নিজের বৃত্তের গভীরে’ তাঁর প্রথম কবিতা। কবিতাটি তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘অন্ততঃ একবার‘ (১৯৭৯)-এ ধৃত হয়। তখনকার অমৃত, সাপ্তাহিক বসুমতী প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতো। ‘দেশ’-এর ‘সাহিত্য সংবাদ’ পরিবেশক সনাতন পাঠক (প্রখ্যাত কবি-ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)-এর দৃষ্টি এই নবীন কবিতাপ্রেমীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। “কবিতা রচনা শিখতে তার অনেক কিছুই এখনো বাকি” বলেও একথা জানিয়েছিলেন, তার কবিতা “পড়তে খারাপ লাগে না”। ( সাহিত্য সংবাদ, দেশ, ৪ জানুয়ারি, ১৯৭৫)।
তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা আট। প্রিয়জনের মুখ (১৯৭৪), অন্ততঃ একবার (১৯৭৯), পরিশুদ্ধ মানুষ (১৯৮৫), কেন ফিরে যাবো (১৯৮৭), সুন্দরী গাছের নিচে (১৯৯৮), রক্তঝরা নন্দীগ্রাম (২০০৭) এবং ভোরের বাউল (২০০৮)।
ওয়াজেদ আলির জন্ম কাকদ্বীপ থানার কমলপুর গ্রামে, ১৯৪৯ সালের ৪ ডিসেম্বর। সেই গ্রাম, তার নিসর্গ, ‘নুনফোঁটা ভুরু’-ওয়ালা গ্রামীণ কিশোর, জ্যোৎস্নামাখা স্বপ্ন, ছায়াময় বনভূমি, ভয়ালসুন্দর সুন্দরবনপ্রকৃতি, ‘ঝরাপাতা বনফুল পাখিদের কাছে’ ‘আশৈশব ঘুরে’ বেড়ানো কবি চিরকাল সহৃদয় মানুষের খোঁজে ব্যাপৃত। বলতে গেলে, ভালোবাসার অন্বেষাই তাঁর চিরকাঙ্ক্ষার ধন। তাই তিনি ‘জন্ম-দীন ভিখিরি বালক’। বাউল-মুর্শিদি-ফকিরের মতো তিনি নিজেকে ‘ভিখিরি বালক’ বলতে দ্বিধা করেন না।
নিসর্গ আর প্রেম আর কবিতা একাকার
ক্রমে নিসর্গ আর প্রেম একাকার হয়ে যায় তাঁর কবিতায়। আবার, নিসর্গের চালচিত্রে নিজেকে চিরস্থির রাখা তাঁর পছন্দ। ‘কেন ফিরে যাবো/ তোমাদের ঈর্ষা ঘৃণা নিয়ে/ এই মাটি/ এই জলে/ আমার তো জন্ম-অধিকার।’ নিসর্গ আর প্রেম দু’য়ে মিলে গড়ে ওঠে তাঁর কবিতার ঘরবাড়ি। এখন কবিতা আর প্রেম একাকার হতে চায়। প্রেমেরই মতো কবিতাও তাঁর আঁধার জীবনে পথের দিশারি, তাঁর প্রেরণা। কবিতাকে বলেন তিনি –
‘তুমি তো দেখালে পথ/ আঁধার জীবনে/ তাই আমি নিদ্রাহীন/ শ্রাবণ দু’চোখে/ সময়ের সিন্ধুতীরে/ তোমার প্রতিমা গ’ড়ি।’
সেইসঙ্গে চলতে থাকে মানুষের বিরামহীন খোঁজ। ‘ঘরের ভিতর সোজন আছে কয় জনা, মন মুই জানোং না’ – সহৃদয় সুজন মানুষের খোঁজে নিরন্তর কাটে তাঁর দিন। তাই তিনি জন্ম-বাউল।
‘রাত্রির গহন নিরিবিলি ভেঙে/ আমিও ছুঁয়েছি সেই কিশোরীর হাত/ বালুচরী সমুদ্র-লতায়/ তার সঙ্গে বেঁধেছি এ বাউল হৃদয়।’
এই বাউলমন তাঁর সহজিয়া হৃদয়বত্তার আধেয়।
‘এপারে নদীর পাড়ে আমি এক ভোরের বাউল/ একা একা হেঁটে যাই কবিতার খোঁজে।’
এ-বাউল তার মনের মানুষটিকে কোথায় খোঁজেন? এর উত্তর – কবিতায়। প্রেমে। নিসর্গে। প্রকৃতি-আশ্লিষ্ট নোনাকাদামাখা দুঃখী-দীন মানব-মানবীর জীবনছন্দে, তাদের বেঁচে থাকবার অদম্য যাপনচিত্রে! কোথায় নয়?
স্বপ্নালু দু’চোখ আর অদম্য জীবনতৃষা এই হৃদয়সার মানুষটির সম্বল। অঢেল যন্ত্রণা সত্ত্বেও তাঁর বিশ্বাস টাল খায় না। হেরে যেতে শেখেননি তিনি।
‘সঙ্গীহীন ভাঙা বুকে রক্তকীট হাসে/ দু-দিকে পথের ধারে উঁচু হয়ে হাত/ যন্ত্রণা ছিঁড়ে খুঁড়ে নিশানা ওড়াই/ বিবেকের আত্মশাসন স্থির লক্ষ্যে টানে’ আর তখনই – ‘ভালবাসা মনোদ্বীপে সূর্যবৃষ্টি হয়’। নিঃসঙ্গ কবি, সঙ্গীহীনতায় বুক ভাঙা তাঁর, অতএব অনিবার্য যন্ত্রণা; তবে যন্ত্রণাতেও কবি স্থিত থাকেন বিবেকের আত্মশাসনে। আর তখনই ভালবাসার দ্বীপভূমিতে সূর্য বৃষ্টি হতে থাকে। মানে, আলোর বিপুল বিচ্ছুরণ। প্রেম ও জীবনযন্ত্রণার পাশাপাশি জীবনসংগ্রাম (স্মরণ করি – ‘পথের ধারে উঁচু হয়ে হাত’) আর তা থেকে কবির উত্তরণ, আলোর সাম্রাজ্যে।
প্রেম :
‘প্রিয়জনের মুখ’ (১৯৭৪) ও ‘অন্ততঃ একবার’ (১৯৭৯) নবীন কবির প্রথম দিকের প্রেমকাব্য। ‘অন্ততঃ একবার’ কাব্যটি উৎসর্গ করা হয়েছে–’প্রিয় বিষন্নতা ও হেনাকে’।
হেনা ও হেনাকে তেমন করে না পাওয়ার বেদনা থেকে কবিমনে যে বিষন্নতার অধিষ্ঠান, তা তাঁর রোমান্টিক মনের প্রেমাকুলতাকে তুলে ধরে। ফলতঃ, এই রোমান্টিক কবি এই সময়ের বাংলা কবিতায় এক স্নিগ্ধ প্রেমালু সহজতার জাদু সৃষ্টি করেন।
সবুজ প্রকৃতি, তার আলোছায়া, নদীস্রোত, ‘উদ্দাম দুপুর’, ‘হলুদ রদ্দুর’, জ্যোৎস্না, জোনাকির আলো, কাঁটাঝোপ, বগড়া ( হেঁতালচারার মূল) ও পিছেপাতার (হেঁতালের কচি পাতা) বোঝা মাথায় ঘরে ফেরা গ্রামীণ কিশোরী, ‘গোধূলির নীল চাঁদ’ আর ভয়াল ‘অরণ্যসুন্দর’ –সব নিয়েই তাঁর নিত্য কারবার। তাঁর প্রেমের কবিতাতে এমনি করে একাকার হয়ে যায় প্রকৃতি।
‘পাতা ঝরার শব্দে’ নামের কবিতায় ধরা থাকে কবির প্রেম, তাঁর স্বপ্নের দেশ – যেখানে
‘দূর পাহাড়ের নীল-সন্ধ্যায় পাখিরা গান করে’,
‘মেঘের মানিক থেকে খসে পড়ে শিশির’,
যেখানে
‘আদিবাসী রমণীরা মাঠ থেকে ফেরে/
তাদের নিটোল বুকে ফুটে ওঠে প্রকৃতির অমল সুষমা’!
আর সেই সুষমার মাঝে হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকে কবির প্রিয়া, তাঁর প্রেম। সেখানেই কবিপ্রিয়ার ‘শ্রমের চোখে ভালবাসা জাগে’।
তারপর তাঁর প্রত্যয়নিষ্ঠ উচ্চারণ– ‘ভালবাসা বুক পেতে অরণ্য সাজাই’
কিংবা, ‘ধূসর বালুর চরে যন্ত্রণার ছায়াঘর বাঁধি’
আর সেই ঘরের ভিতর/ বারবার জন্ম নিয়ে আসি/ বারবার জীবনের সফলতা খুঁজি’।
যন্ত্রণার ছায়াঘরে বারবার জন্ম নিয়ে ফিরে আসার মধ্য দিয়েই জীবনের সফলতা খোঁজার অনুষঙ্গে যে হার-না-মানা মানবিক চালচিত্রটা উঠে আসে, তা যে যন্ত্রণায় ধূসর পৃথিবীর হরিদায়ণ ঘটাতে চায়, তাতে আর সন্দেহ কোথায়?
মনে রাখতে হবে এইসব কথার নিমিত্ত কী? নিমিত্ত হলো ‘পাতা ঝরার শব্দে… বুক ভেঙে যায়’ কবির। দেখুন না, না-পাওয়ার যন্ত্রণা থেকেই কবি মানবজীবনের সফলতার অন্বেষণ করছেন! কবি কী অবলীলায় প্রকৃতি থেকে স্বপ্নে, স্বপ্ন থেকে মহাকাশ-মেঘ, সেখান থেকে আদিবাসী রমণীর নিটোল বুকে আশ্রয় নেওয়া, বা শ্রমক্লিষ্ট কবিপ্রিয়া – এ-সবগুলোর মধ্যে যাতায়াত করেছেন। নিসর্গ থেকে স্বপ্নে, স্বপ্ন থেকে বাস্তবে, আবার বাস্তবের যন্ত্রণার ছায়াঘরে থেকেও বারবার জীবনের সফলতা খোঁজার নিরন্তর প্রক্রিয়া চলতেই থাকে।
প্রেমের জন্যই কি কবির এই নিসর্গের আড়াল খুঁজে নেওয়া? যেখানে স্বপ্ন এসে প্রেমের ধরতাইটা ধরিয়ে দেয়? প্রেমের লোকাতীত অমরাবতীর মধ্যেও যেখানে শ্রমশ্রান্ত ভালোবাসার বাস্তবতাটাও আবার হারিয়ে যায় না? ‘অমল সুষমা’র যে রাজ্য কবির অন্বিষ্ট, তা যে এক সবুজ অমলিন গ্রহেরই কথা বলে! দেখা যাবে, রোম্যান্টিক কবির আবেগ এমনই আড়াল খুঁজে নিয়ে থাকে– কখনো প্রকৃতিতে, কখনো কবিতার শব্দে-চিত্রে, কখনো দূরের ইতিহাসের ধূসর আঁধারে। জীবনানন্দের কথা মনে পড়ে না কি, যেখানে কবি আড়াল খুঁজে নিয়েছিলেন ‘রূপসী বাংলা’য় ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে আম-জাম-হিজল-ঘেরা বাংলা প্রকৃতির মধ্যে, ‘চালধোয়া কিশোরীর … ঘুঙুর রহিবে রাঙা পায়’- এর চিত্রকল্পের আধারে! কিংবা, ‘বনলতা সেন’-এ কল্প-প্রকৃতির দারুচিনি দ্বীপে, শ্রাবস্তীর কারুকার্যে‘, কিংবা ইতিহাসের সুমের-মিশর-ব্যাবিলনের আক্কাদীয় নারীদের ধূসর অতীতের মায়ারাজ্যের ছাতায়? নিসর্গ ও ইতিহাস এভাবেই রোমান্টিক কবিদের সংবেদনা-নাট্যের পর্দার কাজ করে থাকে। যে আড়ালের ছাতা ধরে শিল্পের কুশীলবেরা সাজঘর থেকে মঞ্চে আসা-যাওয়া করতে পারে? যার ফলে স্বপ্ন থেকে বাস্তবে, প্রেম ও রতিতে, চেতনা ও সংবেদনায় ব্যক্তিগত সুখদুঃখ ও সবমানুষের চিত্ত-আবেগের মধ্যে অবলীলায় যাতায়াত করা যায়? বোধের সমীকরণ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে?
ওয়াজেদ আলির ‘যেখানে প্রান্তরে সূর্য এসে ছুঁয়ে যায়’ কবিতায় দেখা যায়, পৃথিবীর মনোরম শস্যক্ষেত্রে মানুষ মানুষীরা সযত্নে রেখে গেল সংখ্যাহীন দেহের পুতুল।’ তাঁরা ‘মেখে নেয় পৃথিবীর সব ধুলোবালি’ আর শৈশবের অমল দরজায় ‘সব প্রেম ভালবাসা ঢেলে’ দেয়। তখন –
‘কুমারী-কন্ঠের সুমিষ্ট গানে জ্যোৎস্নায় ঘাসে ঘাসে রঙিন স্বপন/ রমণীর নিটোল তনু বারবার কবিতার শব্দ হয়ে ফোটে।’
আর তখন ‘আশ্চর্য পৃথিবীর স্বপ্ন’ দেখেন কবি, তার সাক্ষী থাকে ইতিহাস, মহাকাল।
‘আশ্চর্য পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি আজ চিত্রলেখা বুকের মলাটে প্রকৃতির/ গোপন প্রণয় সহস্র যুগ ধরে বেড়ে ওঠে মানুষের/ দৃপ্ত চেতনায় ইতিহাসে।’
ইতিহাসে অনেক ঘটনা ঘটে যায় বলতে গেলে ঘটনার পরম্পরা – ‘ইতিহাস মায়াবী হাতে লিখে যায় মানুষের করুণ কাহিনী’, ‘সভ্যতার আলোর ভিতর গোপনে বৃষ্টি হয়’, ‘জীবনের সহস্র মানিক ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃস্ব হয় বোধের ভিতর।’ বোধের ভিতর ‘জীবনের সহস্র মানিকের ক্ষয়’ –এ তো চায়নি মানুষ! এই ক্ষয়ের কথাই ‘ট্রাজেডি’ কবিতায় পথহাঁটার অনুষঙ্গে ফিরে এসেছে –
‘আজকাল সেইভাবে পথ হাঁটে মানুষ/ যেভাবে/ মানুষের বুক থেকে/ ষোল আনা বুক সরে যায়/ শুধু একতিল হাতছোঁয়া – মুখের মিল/ একটানা এগোয়’
‘মানুষের বুক থেকে/ ষোলআনা বুক সরে’ গেলে আর কিই -বা থাকে, ট্রাজেডি ছাড়া? কবির তীব্রতীক্ষ্ণ অনুভবে তাই সভ্যতার ইতিহাস ট্রাজিক হয়ে ওঠে। ‘আমাদের, মানুষের,এই সভ্যতা –/ ট্রাজেডি জীবন নাটক।’
অথচ এই ক্ষয় মেনে নিয়েও পুনরায় একই অমোঘ বৃত্তে মানুষ মানুষী ফিরে ফিরে আসে। এ যেন এক মায়াবী আকর্ষণ, অমোঘ আর অনিবার্য। এই জন্যই ইতিহাসের হাত ‘মায়াবী’ হয়ে ওঠে বুঝি! কিন্তু মানুষ এই ক্ষয়, যা নিঃস্বতার নামান্তর, তা চায় না। কারণ, তার লক্ষ্য অনেক বড়ো। ‘শৈশবে শপথ ছিল একখানা পথ হাঁটার’। সহবোধে একলা চলার, এবং নিরবচ্ছিন্ন চলার। চলতে চলতে মানুষ পেয়ে যাবে পথ ও পাথেয় – দুটোই । এ পথ মানুষকে কী দেখাবে?
– ‘ঋজুরেখ সব বাধা ঠেলেঠুলে দেখাবে সেই পথ/ সেই পথে হেঁটে হেঁটে পৃথিবীর মানব শাবক বুঝে যাবে মানুষের ভালোবাসা।’
তবু, ক্ষয় সত্ত্বেও মানুষকে বাধাগুলোকে মেনে নিতেই হয় নিয়ত। কারণ, ভালোবাসাই তার কাম্য। তাই ইতিহাসের বলা সভ্যতার কাহিনীটা করুণ ও ট্রাজিক হয়ে ওঠে।
অনাকাঙ্ক্ষকে মেনে নিয়ে মানুষ তাদের পুরুষ পরম্পরায় ‘সেই পথ ধরে হেঁটে হেঁটে বারবার ফিরে’ আসে। কেন আসে? কী পাবে সে মানুষ?
‘সেই পথে হেঁটে হেঁটে পৃথিবীর মানব শাবক বুঝে যাবে মানুষের ভালোবাসা।’
তাহলে ভালোবাসাই মানুষকে একই পথে বারবার টেনে নিয়ে আসে। ভালোবাসাই মানুষ-জীবনের ধ্রুবতারা। ‘যেখানে প্রান্তরে সূর্য এসে ছুঁয়ে যায় মানুষের কষ্টের ঘাম।’ এতো মানুষের ভালোবাসার প্রতি সূর্যের সূর্যপ্রণাম!
ভালবাসার জগৎটা আর রোম্যান্সের তুলতুলে আকাশে দোল খায় না; পিছেপাতার বোঝা মাথায় কিশোরী, ‘নুনফোটা ভুরুর আঁধারে’, ‘খাঁচা আর কাঁপি’ নিয়ে কাঁকড়া ধরতে যাওয়া ‘মানুষের কষ্টের ঘাম’ – রূঢ় বাস্তবের এসবের মধ্যে ভালোবাসা চিরচলিষ্ণু থাকতে চায়। তাই তো ‘প্রান্তরে সূর্য এসে…মানুষের কষ্টের ঘাম’ ছুঁয়ে প্রণাম জানায়। এই জন্যেই বলি এক হরিৎ গ্রহায়ণের কবি তিনি। যেখানে মহাকাশ আর মহাপৃথিবী একাকার হতে পারবে নিবিড় আদি-পৃথিবীর ভালোবাসায়! কবিতাটি প্রথমে ‘প্রিয়জনের মুখ’ এবং পরে দ্বিতীয়বার ‘পরিশুদ্ধ মানুষ’ কাব্যে স্থান পেয়েছে।
‘অন্ততঃ একবার’ (১৯৭৯) কাব্যে কবির প্রেমানুভবের মধ্যে তীব্র প্যাশন, নরম আকুলতার জায়গায় এক জেদি ও তেজী বিষন্নতা। ‘প্রিয়জনের মুখ’ কাব্যের কবির ভাষা অনুচ্চ, ভঙ্গি নরম। ‘অন্ততঃ একবার’ কাব্যের কবির প্যাশনের তীব্রতা তার কবিভাষাকে শাণিত করে তুলেছে। এই প্যাশন ও তীব্রতা তাঁর গ্রন্থনামের প্রথম কবিতার মধ্যে লুকিয়ে আছে–
‘অন্ততঃ একবার আমাকে তোমার/ বুকের গোলাপ ক’রে ফোটাও/ আর তোমার ওই পল্লবিত দু’চোখে/ আমার ভালোবাসা নদী হয়ে যাক’– ‘অন্ততঃ একবার’ শব্দদু’টির মধ্যে যে তীব্রতা রয়েছে, তাই-ই প্যাশনটাকে ধরিয়ে দিচ্ছে। রবার্ট ব্রাউনিংয়ের The Last Ride Together কবিতার প্রত্যাখ্যাত প্রেমিক তার প্রেমিকার কাছে ‘শেষ যৌথ অশ্বারোহণে’র মিনতি জানাচ্ছে, সেকথা মনে পড়ে না কি?
আবার–
‘তুমি ঘৃণা কর ব’লে/ আমার স্বপ্নের দিনগুলো একতারা বাজায়/ আমার রক্তের ভিতর/ লক্ষ লক্ষ যন্ত্রণার ঘোড়া ছোটে‘
একতারার বোলের মধ্যে কি বৈরাগীর বীণ বেজে ওঠে? সংসারবৈরাগ্যের? না, বাউলের একতারায় তো প্রেমের কারুণ্য ফুটে ওঠার কথা! আর সেই কারুণ্য কী গভীর আর্তি তুলে ধরে দেখুন –
‘আমি তীব্র অন্ধকার বুকে চেপে/ একা একা অন্ধ হয়ে যাই!’ (তুমি ঘৃণা কর ব’লে)
প্রেম নেই, তাই বুকের মধ্যে ‘তীব্র অন্ধকার’। বাইরের অন্ধকার আলোয় সরে যায়; কিন্তু বুকের মধ্যে আঁধার ঘনিয়ে এলে ‘একা একা অন্ধ’ হতে হয়! হয়ই তো।
এই জন্যই বলছিলাম একটা প্যাশনের তীব্রতা কাব্যটিকে ধারালো করে তুলেছে। কাব্যটির যেমন নামকরণ –’অন্ততঃ একবার’, তেমনি তার উৎসর্গপত্র –’প্রিয় বিষন্নতা ও হেনাকে’! যুগ যুগ ধরে অবিশ্রান্ত পথ-চলার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানবশাবকের যেখানে ‘মানুষের ভালোবাসা’ বুঝে নেবার কথা, সেখানে ভালোবাসার নারীটির দেওয়া আঘাত কবিকে বিষন্ন করে তুলছেই। শুধু বিষন্ন করে তুলছে না, একেবারে অন্ধ করে দিচ্ছে। কেমন অন্ধ? প্রেমান্ধ। এই জন্যই বিষন্নতা এত প্রিয়। বেদনার এত মাধুর্য!
Our sweetest songs are those that tell of saddest thought – নয় কি!
কবি তার হৃদয়ের নারীর পল্লবিত চোখে ‘ভালোবাসা নদী’ পেয়েছিলেন, তার ‘স্বপ্ন-নীল ঢেউ ছুঁয়ে’ ভেসে যেতে চেয়েছিলেন। পরে সে নারী স্মৃতি-অরণ্যের পাখি হয়ে কেবল ডাকতেই থাকে আর … ‘উদ্দাম দুপুরের মতো সে শূন্যতাকে/ সাজায়’ (শূন্যতা)। কখনো সে ‘মনের ভিতর/ গোপন সুখের আলোক জ্বালায়’ … (এখন হেনার চোখের তারায়)। তাই সে তো কবির সঙ্গে সঙ্গেই রয়েছে অনন্ত কাল ধরে। সেজন্যই তো কবির –
‘চোখ খুললেই আগুন/ আগুন ছুলেই বুক’
অতএব কবি ভোগ করেন শ্বাশ্বত মধুর যন্ত্রণা–
‘বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকে/ অনন্য অসুখ’
এ যন্ত্রণা কবিকে নিয়ে খেলা করে অমল চারুতায় –
‘অসুখ মানে ভালোবাসা/ মিষ্টি মেয়ের মুখ/
মুখের আলোয় লুকিয়ে রাখে/ শিশির ফোটা সুখ’ (স্কেচ, অন্ততঃ একবার)
প্যাশনের তীব্রতা এখন গাঢ় প্রেমের গভীরতায় শমিত। এজন্যই বাঙনির্মিতিতে এত সংহতি ও ঋজুতা। অথচ দুই স্তবকের মোট আট পংক্তির এই ছোট্ট কবিতায় রোম্যান্স রয়েছে স্মিত হাসির মতো।
এমনই আরেকটি কবিতা প্রায় শায়েরির মত গাঢ়বন্ধ। ‘পরিশুদ্ধ মানুষ’ কাব্য থেকে সেটি উদ্ধার করতে চাই–
‘ঘুমের ভিতর ঘুম আসে না/ ঘুম আসে না সুখে
ঘুমের নারী বিদেশ গ্যাছে/ ভালোবাসার দুখে
দুঃখ তো নয় পাথরকুচি,/ সূর্যওঠা বুক
বুকের ভিতর উথলপাথল/ আরেকটা অসুখ (ঘুমের ভিতর ঘুম আসে না)
মনে পড়ে, সমকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উর্দু কবি এজাজ আফজলের (কলকাতা) একটি বিখ্যাত শায়েরি–
‘যব নিদ আয়ে, তো খোয়াব আয়ে/ যব খোয়াব আয়ে, তো তুম আয়ে/ মগর জব তুম আয়ে,/ তো না নিদ আয়ে, না খোয়াব।’
‘পরিশুদ্ধ মানুষ’ (১৯৮৫) কাব্যের পনেরোটি কবিতার ছোট্ট সংকলনটিতে কবি প্রেমের গাঢ়তায় পরিণত, চারপাশের সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতন, কবিতার বাঙনির্মিতিতে সংহত ও ঋজু। বলা যায়, ক্লাসিক। বিশেষ করে যেটি বলবার, তা হলো ‘বিবেকের আত্মশাসনে’ স্থিরলক্ষ্য।
‘সঙ্গীহীন ভাঙ্গা বুকে রক্তকীট হাসে/ দুদিকে পথের ধারে উঁচু হয় হাত/ যন্ত্রণা ছিঁড়ে-খুঁড়ে নিশানা ওড়াই/ বিবেকের আত্মশাসন স্থির লক্ষ্যে টানে/ ভালোবাসা মনোদ্বীপে সূর্যবৃষ্টি হয়/ পশুরা আমাকে তবু মানুষ হতে বলে/ মানুষেরা হীনস্বার্থে রক্ত-পুঁজ খায়/ অথচ/
আমার ভিতরে আমি ‘পরিশুদ্ধ’ মানুষ।’(পরিশুদ্ধ মানুষ)
মহাকবি ইকবালের কবিতা মনে পড়ে যেখানে তিনি অহং-কে এত দৃঢ় করে বাঁধতে বলেছিলেন যেন তোমার ভাগ্যরচনার প্রাক্কালে কিসে তোমার সন্তুষ্টি, তা স্বয়ং খোদাই তোমাকে জিজ্ঞেস করে নেন –
‘খুদী কো কর বুলন্দ ইতনা কে/ হর তকদির সে পহলে/ খুদা বন্দে সে খুদ পুছে :/ বতা, তেরি রেযা কেয়া হ্যায়? (অসরারে খুদী)
‘আমার ভিতরে আমি পরিশুদ্ধ মানুষ’-- এই দাবি তখন কবি করছেন, যখন তাঁর সঙ্গীহীন ভাঙা বুক, যখন মানুষেরা হীন স্বার্থে কীটের মতো রক্তপুঁজ খায় এবং পশুরা মানুষকে ‘মানুষ’ হতে বলছে। মানবাত্মার অপমানে আহত কবি সমূহ যন্ত্রণাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে নিশানা উড়িয়েছেন বিবেকের। এজন্যই কবি বিবেকের আত্মশাসনে স্থিরলক্ষ্য। বিবেকের প্রসঙ্গ বারবার তাঁর কবিতায় ফিরে আসে। পরে ‘ভোরের বাউল’ কাব্যের কবিতায় দেখা যাবে–
‘তোমার মনের মধ্যে মন্দির ও মসজিদ/ সেখানে প্রার্থনা জানাও/ ভালোবাসা দীপ জ্বেলে/ দূর করো বিভেদের সব অন্ধকার’
বিবেকের অধিষ্ঠান যে মনোভূমি, সেখানে কবি আমাদের নিয়ে যেতে চান। মনের মধ্যে যে মন্দির মসজিদ, সেখানে ভালোবাসা-দীপ জ্বেলে প্রার্থনা জানাতে বলেন বিভেদের আঁধার কাটাতে। আর বলেন– প্রাণধারণের জন্য সবচেয়ে মহার্ঘ্য বাতাসের মতো উঁচু বিবেকের কথা–
‘মুক্ত বাতাসের মতো উঁচু রেখে বিবেক নিশান/ দেশের সীমানা ভেঙে/ পৃথিবীর এধার ওধার/ পৌঁছে দাও সংহতির শেষ অঙ্গীকার’ (তোমার মনের মধ্যে, ‘ভোরের বাউল’)
আত্মদর্শনের ক্ষেত্রে এক ধরনের ধ্রুবতা তাঁর কবিতায় ক্লাসিক সংযম এনে দিয়েছে, দার্শনিক কবির মতোই আপ্তবাক্যের ঢঙে তাঁর উচ্চারণ–
‘গরিবের রক্তে দুটো প্রজাপতি আছে/ দুটো প্রজাপতি দুটো গান গায়/ একটা বিষাদ/ আর অন্যটা বিপ্লব…/
বিপ্লব আর বিষাদ পাশাপাশি থাকে/ গরিবের রক্তে শুধু শীত-গ্রীষ্ম আছে।’ (সহাবস্থান)
কিংবা,
‘মানুষের কান্না ঝরে প্রখর বৈশাখে/ ব্যক্তিগত দুঃখ সব গোপনেই থাকে।’ (ব্যক্তিগত দুঃখ সব)
আবার, ‘মানুষের ঈর্ষা-হাত’ বা ‘সময়ের কালোহাত’ ছুঁতে পারবেন না বলে কবি নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেন – ‘বরং আমার চোখ দুটো অন্ধ করে দাও’ …। (বরং আমার চোখ দুটো)
‘ধর্মরাজ্যে সকলের সমান অধিকার’-- এই-ই তো ঈশ্বরের ঘোষণা। ‘তবু কেন হিংসে করে তোমার দালাল’-- এই প্রশ্ন রেখে কবির দৃঢ় উচ্চারণ–
‘হে রাজন/ যে দণ্ড দাও তুমি/ মাথা পেতে নেব তবুও/
নেব না তোমার ক্রুর-ভালোবাসা।’ (যে দণ্ড দাও তুমি)
জাগতিক ও সামাজিক সমস্যায় মানুষের ঈর্ষা-নীচতায় ক্ষুব্ধ কবিপ্রাণ নিজের চোখ দুটোকে অন্ধ করে দেওয়ার কামনা জানালেও তিনি যে নদীর স্বপ্ন দেখেন, সেখানে রয়েছে তাঁর চিরকাঙ্ক্ষিত চারু পৃথিবীর হরিৎ গ্রহের প্রতিবিম্ব।
‘যে নদীর নীল জলে আকাশের প্রতিবিম্ব দেখা যায়/ যে নদীর নীল জলে নক্ষত্রেরা করুণা ছড়ায়/ যে নদীর অমোঘ প্রবাহে দিনরাত্রি হয়/ প্রকৃতির প্রতিবিম্ব ভাসে…’
এই সেই স্বপ্নের সবুজ পৃথিবী কিন্তু চারপাশের রক্ত-পুঁজ খাওয়া এ জগৎ কলুষ মেখেছে আভূমি এবং তা কি ক্রমে কবির বিশ্বাসকেও কলুষিত করেছে? তাই কি অবশেষে নেমে এসেছে এই চাবুক? নিজেকে কষাঘাত? সমস্ত বিশ্বাস ধুয়ে মুছে নেবে এমন এক নদীর স্বপ্ন দেখা?
‘এমন একটা নদীর স্বপ্ন দেখি রোজ/ যে নদী আমার সমস্ত বিশ্বাস ধুয়ে মুছে দেবে…’? (প্রতিবিম্ব)
এজন্যই অশেষ যন্ত্রণার মধ্যেও কবির হরিৎ গ্রহায়ণের কাঙ্ক্ষা বেজে চলে, ঝুমুর ঝুমুর।
‘কেন ফিরে যাবো’ (১৯৮৭) ওয়াজেদ আলির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রেমকাব্য। এখানে প্রেম প্রকৃতি আর কবিতা একাকার। কবির ‘তুমি’ কখনো প্রিয়া, কখনো প্রকৃতি, আবার কবিতা স্বয়ংও। ‘কবিতা’ নামের কবিতায় কবিতাকেই তাঁর বলা – ‘তুমি তো দেখালে পথ আঁধারে জীবনে।’ তাই ‘সময়ের সিন্ধুতীরে’ দাঁড়িয়ে কবি তাঁর ‘নিদ্রাহীন শ্রাবণ দুচোখে’ কবিতারই প্রতিমা গড়েন। প্রেম-প্রতিমা আর কবিতা-প্রতিমা এক সুতোয় গাঁথা থাকে। এই যে প্রিয়া আর কবিতার সমার্থকতা, তার সঙ্গে যোগ হলো প্রকৃতির আলোছায়াও। কবির কাছে তাই যথার্থ এ উচ্চারণ–
তুমি তো দেখালে পথ /আঁধার জীবনে …
তুমি তো শোনালে গান /কাঁটার জীবনে …
তুমি তো ফোটালে ফুল /হৃদয় মরুতে …
এই ‘তুমি’ কবির প্রেমস্বরূপিণী, প্রকৃতিস্বরূপা, কবিতা-প্রতিমাও।
এই ‘তুমি’ই কি তাঁর জীবনে আঁধার এনেছে? ফুটিয়েছে কাঁটা? হৃদয়কে করে তুলেছে মরুভূমি? হয়তো! আবার, এই ‘তুমি’ই তাঁকে পথ দেখিয়েছে, শুনিয়েছে গান, মরুতে ফুল ফুটিয়েছে। প্রেমের ধরনই তো এই! প্রেম যে এক ‘অধরা মাধুরী’। তার কাজই এই – ‘সে যে কাছের থেকে দেয় না ধরা, দূরের থেকে ডাকে’ (মহুয়া: রবীন্দ্রনাথ)। তাই বলি– তবু, ভালবাসাটাই জেগে থাকে চারপাশে। আলোছায়ার মধ্যে তার খেলা চলে অবিরাম। তাই ভালবাসাকে ‘প্রিয়নদী‘ সম্বোধন করে কবির কামনা –
‘ভালবাসা প্রিয়নদী,/ তুমিও দুকূল বেয়ে উঠে এসো বুকে/ বিষন্ন পথের ধারে/ নীলছায়া ছায়ার ভিতর।’ (ভালবাসা প্রিয়নদী)
আবার,
‘এইভাবে প্রতিদিন আমাকে পোড়াও/ শব্দের সহস্র যন্ত্রণায়/ সময়ের নীলদীপ পথের উপর/ আমার স্বপ্নের প্রিয় ডাল-পালা/ নুয়ে পড়ে সম্পন্ন ধুলোয়…’
অথবা,
‘আমার স্বপ্নের প্রিয় গানগুলি/ ঝ’রে পড়ে অনন্য ব্যথায়।’
লক্ষ্য করুন, ‘শব্দের সহস্র যন্ত্রণা’ বাক্যবন্ধটি, যা একদিকে কবিতার জন্য কবির ‘সৃজনবেদন’, অন্যদিকে তাঁর প্রেমের ব্যথাকাতর মাধুরীও। (এইভাবে প্রতিদিন)
নিসর্গ, আলোছায়া ও চিত্রলতা
প্রেম আর প্রকৃতি, প্রকৃতি আর কবিতার চিত্রলতা এ-কাব্যের বড়ো দিক। জীবনের যাপনচিত্রের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে যেসব ছবির পর ছবি, তা উঠে এসেছে এ কাব্যে। নানা ছবির ভিড়। শুরুটা বলতে গেলে এখান থেকে। ক্রমে তাঁর পরবর্তী কাব্য ‘সুন্দরী গাছের নিচে’ বা ‘ভোরের বাউল’-এ যাপনছবির স্রোত বয়ে চলেছে, রূঢ় পাথরকুচির ভূমণ্ডল থেকে হরিৎ গ্রহের খোঁজে।
এখন বলছিলাম ছবির কথা। ‘কেন ফিরে যাবো’-র কবিতায় প্রকৃতির ছবির সঙ্গে মিলিয়ে জীবনের ছবি। ফের স্মৃতির চিত্র। আর সেখানে ব্যক্তির স্মৃতির সঙ্গে সাধারণের জীবনবিন্যাসটিও ধরা থাকছে। কবিতাগুলি পাচ্ছে নিটোলতা। একটি ছোট্ট গোটা কবিতায় মুকুলধরা প্রেম, রতি আর ফসল-ঋদ্ধির ছবি কি নিপুণ সংযমে প্রকাশিত হয়েছে–
‘মাঠের ওধারে জেগে ওঠে চাঁদ/ শস্যের সোহাগ নিয়ে/ ঘরে ফেরে নারী/ জ্যোৎস্না-মুকুলিত বুকে তার/ অঘ্রাণের শীতল শিশির/ নবান্নের চুম্বন ফোটায়…’ (মাঠের ওধারে)
চাঁদ জেগে উঠছে, এমনই সময়ে ‘শস্যের সোহাগ নিয়ে ঘরে ফেরে নারী’, জোৎস্নায় তার বুকের জমিনে প্রেমের মুকুল ধরেছে, ফলে হাড়-হাভাতের সংসারে নবান্নের চুম্বন ফুটে উঠেছে!
মাথায় ধানের বোঝা নিয়ে আসছে নারী, তার মনেও সম্পন্ন শস্যের সোহাগ, বুকে প্রেমের মুকুল, নবান্নের চুম্বন – শব্দের কী লিলায়িত বিস্তার! অঘ্রাণের শীতল শিশির– নবান্নের চুম্বন, একাধারে জৈবিক ও নান্দনিক!
‘নদীর ওপার থেকে/ ভালবাসা আসে/ ভালবাসা খুঁজে নেয়/ খড়-কুটো জীবন-পাথর/ এসবের গূঢ় অর্থ/ পাখিরাই জানে/ সহিষ্ণু গাছের ডালে তাই/ গড়ে তোলে হৃদয় সংসার।’ (পাখিরাই জানে)
ভালবাসা খুঁজে নেয় ‘খড়-কুটো’। বাসা বাঁধবার আয়োজন। তবে এই আয়োজন সুখৈক নয় শুধু; অনেক সংগ্রাম, অনেক সহিষ্ণুতার অপেক্ষা রাখতে হয়। ‘খড়-কুটো’ তাই শুধু সুখেরই থাকে না; তা হয়ে ওঠে ‘জীবন-পাথর’। অতএব ‘হৃদয়-সংসার’-এর জন্য ‘সহিষ্ণু গাছের ডাল’ খুঁজে নিতে হয়। কারণ, তাদের ‘প্রথম ডিম জন্মিবার হয়েছে সময়’। জীবনানন্দের ‘পাখিরা’ কবিতাটি স্মরণ করতে বলি। অনিবার্য ‘A Lust for Life’, অমোঘ এ জীবন-তৃষা!
‘জ্যৈষ্ঠের জ্যোৎস্নায়/ তাকে রোপন ক’রেছি/ বৃষ্টি আর রৌদ্রে তাই/ ফোটে তার সবুজ-সুষমা/ এরকম শ্রম আর শিল্পের ভিতর/ বেঁচে থাকে আমাদের জীবন-সংসার/ আর এই সংসারের ধূসর উঠোনে/ খেলা করে আমাদের/ উত্তর পুরুষ’ (উত্তর পুরুষ)।
শ্রম আর শিল্পের অনবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ার ভিতর আমাদের জীবনের বহমানতা –প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। লক্ষ্য করি, জীবন-সংসার শুধু শ্রমের উপরে টেকে না, সেটা বহমান থাকে তাকে শিল্পিত ও নন্দিত করে তোলার উপর। আর এ শিল্পকর্ম উপরতলার শিল্প-আয়েশ তো নয়ই; এ যে প্রকৃতি-রাজ্যের পাখিদের কাছ থেকে শিখতে হয়। ‘খড়-কুটো জীবন-পাথর’ দিয়ে বিরামবিহীন বানিয়ে যেতে হয়, অবিরত রচনা করে যেতে হয়। উত্তর পুরুষের জন্য এই তাঁর অমোঘ দিশাদান।
একটি কাব্য :
সুন্দরী গাছের নিচে (১৯৯৮) কাব্যে প্রকৃতি তার স্বরূপে অবস্থান করছে। প্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত নোনামাটি বাদাবনের মানুষজনের এমন নিবিড় জীবনছবি এ-কাব্যের কবিতায় ফুটে উঠেছে, যা এককথায় প্রাকৃত, মানে প্রকৃতিজ, প্রকৃতি-অশ্লিষ্ট। জীবনানন্দ লিখেছিলেন ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ/ খুঁজিতে যাই না আর।’
বাংলার যে ভিন্নতর রূপ রয়েছে, যা ভয়াল হয়েও নির্বিকল্প সুন্দর, সেই সুন্দরবন প্রকৃতি যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সাপ-বাঘ-কুমিরের নৈমিত্তিক জীবনযুদ্ধ, মরার মধ্যেও প্রতিমুহূর্তে বেঁচে থাকার দুর্ধর্ষ লড়াই– তারই কাব্যরূপ ওয়াজেদ আলির কবিতা। শত অনটনের মধ্যেও কেমন করে খুশির বাঁচা বাঁচা যায়, তারও বহমান স্রোতোবেগ– এই কাব্যের কবিতায় স্বচ্ছন্দ সাবলীলতায় গাঁথা রয়েছে। রাগী কর্কশতার বদলে, উগ্র বিক্ষুব্ধতার বদলে, বাঁচতে জানার এমন অনুচ্চ কৌলীন্য, বলতে গেলে, তেমন চোখে পড়ে না।
জীবনানন্দীয় মগ্নচেতন বিমর্ষতাও নেই এখানে। বিষন্নতা আছে, কিন্তু তা মৃত মনিয়ার চোখের মতো ঘোলাটে ও মনখারাপের নয়; সহজ সাবলীল সুন্দর।
প্রেমের কবি লোরকার কথা আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। যে কবি সেই সুপ্রাচীন আন্দালুশিয়ার গ্রামকে নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে গেঁথে তুলেছিলেন তাঁর অমোঘ কাব্যসৌধ, ওয়াজেদের কবিতা প্রসঙ্গে তাঁর কথা মনে পড়ে। লোরকার কবিতায় আন্দালুশিয়ার গ্রাম, তার মিথ, লোকগাথা, সুপ্রাচীন ঐতিহ্যলগ্ন ও অর্গলহীন প্রকৃতি-আশ্লিষ্ট জিপসি মানুষদের জীবনছন্দ কী অননুকরণীয় কবিভাষায় ব্যক্ত হয়েছে, তারই স্মরণ নিচ্ছি। বিশেষ করে বলবার কথা, লোরকা তাঁর সমূহ আবেগ ও তীব্র প্যাশনের তীক্ষ্ণ ফলাগুলোকে ধারালো ব্যবহার করেছিলেন তাঁর কবিতায়। ওয়াজেদ আলি তাঁর কবিতায় সুন্দরবনের প্রকৃতি, বাদাবনের মানুষ, আদিবাসী জন, গঙ্গারিডি রাজ্যের অতীত ইতিহাস, লোকজীবনের আরাধ্য বনবিবি বা পির বদরের হাজোত-মানত-গান-গাথা, মউলে-মাঝি-জেলে ও সাবাড়কাজের মানুষদের মৌন হাহাকার এবং নিয়ত যাপনযুদ্ধ কবি নিজেরই জীবনযুদ্ধের সঙ্গে মিলিয়ে ব্যবহার করেছেন। তবে তার ভঙ্গি বরাবরই অনুচ্চ, বলতে গেলে, নির্মোহ।
লোরকা যেখানে তীক্ষ্ণ প্রতিবাদী ও কালো মানুষের স্বাধিকারের অগ্রনায়ক, অগ্রনায়ক বলেই কিছুটা উপর স্তরের; ওয়াজেদ সেখানে সহমর্মী ও সহযোদ্ধা, আর সহযোদ্ধা বলেই কবি তাদের সমগোত্রের। তাই তাঁর বলতে কোনো সংকোচ নেই–‘আমি তো লাটের ছেলে‘। বলেছেন তিনি –
‘আমি তো লাটের ছেলে/ নোনামাটি মানুষের কাছে/ আমারও রয়েছে দায়/ জন্মের সুবাদে।’
কবি মিশে যান সেইসব মানুষদের সঙ্গে, যারা প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর থাবা এড়িয়ে কাঠের সন্ধানে বা মৌয়ের খোঁজে মধু সংগ্রহে, ‘নদী-খাল জঙ্গলের দেশে‘ কিংবা অন্যের নৌকায় মেছোশ্রমিক হিসেবে সমুদ্র-তুফান ঠেলে মাছ ধরতে যায়, সাবাড়ে নামে যাদের পরিচয়। – ‘আমিও তাদের সঙ্গে / মিলে মিশে এক হয়ে যাই’।
তাদের করুণ জীবনকথা কবির বুকের ভিতর ‘তীরের ফলার মতো বিঁধে’ থাকে। মইপিঠের রতন কান্ডার তার মা-বউকে নিয়ে ‘ছেঁড়াখোঁড়া কষ্টের সংসার’ চালাতে মধুর আশায় বিশ নম্বরে (২০ নং লাট) চলে গিয়েছিল। কিন্তু ‘রতনের হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয় বাঘের থাবায়।’ কারণ – ‘এই মামুরাও জানে/ মানুষের রক্তে আছে মিছরির স্বাদ।’
কিংবা, ‘খাজুর গুঁড়ির মতো পড়ে থাকা/ কুমিরের অমোঘ কামড়ে/ কত লোক হারিয়েছে প্রাণ ‘, আর জলদস্যুদের হাতে ধন প্রাণ দুটোই হারানো মানুষের কথা ওয়াজেদ আলির কবিতায় বারবার আসে।
‘পুরনো ভূগোল ঘেঁটে/ ইতিহাস উঠে আসে যুগের উঠানে’, যেখানে অতীতের ‘গঙ্গারিডি রাজাদের সুবিশাল গাঙ্গেয় বন্দরে’র কথা, তারপরে ভূগর্ভে সব হারাবার পর ক্রমে সুন্দরবনে পরিণত হওয়ার কথা, ভয়াল-সুন্দর বাঘ-মামুর কথা। এত ভয়, এত নির্মমতার পরেও কবি বলেন – ‘জঙ্গলের নিসর্গ ছায়ায়/ হরিণীর চোখের লতায়/ বারবার বন্দী হয়ে ফিরে আসি বনে।’ (জঙ্গলের ভয়াল নিসর্গে)।
‘উদ্ধত বাঘের থাবা যদিও এখানে/ দিনরাত মনকে শাসায়/ জীবনকে বাজি রেখে/ তবুও আসি ভয়াল নিসর্গে।’ ( তবু আসি ভয়াল নিসর্গে)
এই ভয়াল বনভূমি কবিকে কেন টানে? শত ভয়ের অনুষঙ্গ ছাপিয়ে নিসর্গ-মায়া কবিকে টানে বাঁশির সোহাগ নিয়ে –
‘দিনের ব্যস্ততা শেষে বাসার সন্ধানে/ ফিরে আসে শ্রমিক-সারস/ আর বগড়ার ঝোপ থেকে/ জ্বলে ওঠে বাঘিনীর চোখ’
এমন অবস্থাতেও জীবন চলিষ্ণু থাকে। ‘শ্রমিক-সারস’ সারাদিনের রোজগার সেরে আশ্রয় আর সোহাগ সাধতে বাসায় ফেরে না কি? কারণ, পরের পংক্তিতেই দেখি–
‘হয়তো অদূরে হাঁটে/ ভয়ে ভয়ে হরিণ-যুগল’
এদিকে জোয়ারের জলে ক্ষীরকুলতলা ডুবে যায় আর ‘শীতের বাতাস এসে/ ঢেউ ভাঙে চরে’
কবির মনে হয়– ‘আর ওই জঙ্গলের নিসর্গ মায়ায়/ বাঁশির সোহাগ সাথে অরণ্য-সুন্দর।’ (অরণ্য-সুন্দর)
‘বাঁশির সোহাগ সাধে অরণ্য-সুন্দর’–প্রকৃতি আর মানুষের, প্রেম আর জীবন-তৃষার এমন একাকার, অনুচ্চ অথচ রোমান্টিক প্রয়োগ সত্যি বিরল নয় কি? অরণ্য-সুন্দর বাঁশির সোহাগ সাধছে, বংশীধারী কৃষ্ণের মতো! তীব্র আকর্ষণ সে সুরের।
ভয়াল-সুন্দর সুন্দরবন-প্রকৃতির সঙ্গে কবির সখ্য, কবির প্রেমও । কিশোরী নদীর সঙ্গে কবির প্রেম– ‘রাত্রির গহন নিরিবিলি ভেঙে/আমিও ছুঁয়েছি সেই কিশোরীর হাত/ বালুচরী সমুদ্র-লতায়/ তার সঙ্গে বেঁধেছি এ বাউল হৃদয়।’ (কিশোরী নদীটি জানে)
কখনো সে শুধুই কবিতা-প্রতিমা, ‘শব্দের শরীরী মেয়ে’। ক্রমে হয়ে ওঠে ভালবাসার জন–
‘কে তুমি রয়েছো বসে মোহনার নীলে/ শব্দের শরীরী মেয়ে জলজ জ্যোৎস্নায়/ তোমার লাবণি শুধু একা একা স্নিগ্ধতা ছড়ায়’,
যার সঙ্গে কবি-আকাশের অপার ভালবাসা। থই-হারানো বিস্ময়ে শুধুই চেয়ে থাকা।
‘সীমাহীন অপার বিস্ময়ে এ আকাশ নত হয়ে তোমাকেই দ্যাখে।’ (মোহনার নীলে)
একসময় এই নিসর্গ-প্রীতি দুরন্ত-দুর্ধর্ষ শরীরী প্রেমকেও হার মানায়। কবি এমন এক অলৌকিক মায়াজগৎ রচনা করেন যে, পাঠকের প্রতীতি হয়, ‘সেই বুনো মেয়ে’ দুর্ধর্ষ যৌবনবতী এক মদালসা নারী, তারই প্রেমিক এই কবি। যে নারী রোদ-ছায়া পাতার আড়ালে নিয়ে গিয়ে শরীরের গোপন নির্যাস সঞ্জীবনী আসব পান করায় তার প্রেমিককে।
‘সেই বুনো মেয়ে/ রোদ-ছায়া পাতার আড়ালে/ শরীরের ভাঁজ খুলে/ একদিন আমাকেও দিয়েছিল গোপন নির্যাস’
কবি আর কী পেয়েছিলেন তার কাছ থেকে?--
‘আমাকেও দিয়েছিল/ আধভাঙ্গা আবির আকাশ…! (সেই বুনো মেয়ে)
‘সেই বুনো মেয়ে’ কবিতাটি বাংলা কবিতায় এক অসাধারণ রোমান্টিক কবিতা হিসেবে চিহ্নিত থাকার যোগ্য। নির্জন দুপুরে ছেঁড়া-ছেঁড়া রোদ-ছায়া পাতার আড়ালে সরল একলা-মেয়ের খেলা, মহুয়ার মউ-মউ সুগন্ধ বাতাস দক্ষিণের নদী থেকে বারবার উঠে এসে ছুঁয়ে যায় তার সবুজ আঁচল। কবির মনে তার ভালোবাসা জাগে ‘নিবিড় স্বপ্নের মতো।’ ‘শুধু ভালবেসে তার সেই অধরা শরীর’ কবি একদিন নিজেকেই হারিয়ে ফেলেন। নিজেকে হারিয়ে তবে তাকে পেয়ে যান কবি। তারপর একসময় সেই সরল একলা-মেয়ের সঙ্গে কবির বাঞ্ছিত মিলন ঘটে আর সে মিলন-সুষমায় কবিকে সে আবির-গোলা আধভাঙা আকাশ উপহার দেয়।
এই প্রেম-নাট্যের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে ক্রমানুসারী সিকোয়েন্স। একলা-খেলা মেয়েকে কবিপ্রেমিকটির ভালোবাসায় পূর্বরাগ থেকে মিলন পর্যন্ত নানা স্তরের পরত। মাঝখানে সুগন্ধ বাতাস নামের প্রতিনায়কটির (না কি উদ্দীপন বিভাব) নায়িকার আঁচল ছুঁয়ে যাওয়া। অন্যদিকে কবির ভালোবাসায় রয়েছে নিষ্ঠা আর হৃদয়গুণ। অভিসার, মিলন, পরিশেষে আধভাঙা আকাশ-প্রাপ্তির বেদন-সুষমা। কাল-প্রতিবেশও বোঝা যায়-- নির্জন দুপুর, বনভূমির আলোছায়া, চলছে অপরূপ কুঞ্জবিলাস ও মিলন, শরীরের ভাঁজ খুলে গোপন নির্যাসের আসব পান করানো – এইসব ঘটনাধারায় শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যে হয়ে এলো, ছড়িয়ে গেল আবির, সন্ধ্যার আকাশে।
হৃদয়বৃত্তি, বিস্ময়, গীতলতা আর নাট্য – এ-কবিতায় একাকার। আর চিত্রলতা? সবটাই তো ছবি, ছবির মালা। রোদ-ছায়ার অপরূপ বর্ণাঢ্যতা এ-কবিতায় সংহত নাট্যগুণের সঙ্গে ঝলসে উঠেছে। অথচ শেষ পর্যন্ত ‘সেই বুনো মেয়ে’ আর কেউ নয়; সুন্দরবনের বনভূমি। সুন্দরবনভূমির সঙ্গে এমন প্রেমের কেলিকথা আর কোথায় পাওয়া যাবে?
সুন্দরবনের মানুষের যাপনচিত্র অকপট ফুটে উঠেছে ওয়াজেদ আলির কবিতায়।
‘কাদামাখা বায়াটাকে চিনি/ যে খাঁচা আর কাঁপি নিয়ে জঙ্গলের ধারে/ সারাদিন কাঁকড়া ধরে/ তার সেই নুন ফোটা ভুরুর আঁধারে/ দ্বিতীয়ার চাঁদ ওঠে যেন/ সে চাঁদের বিষন্ন জ্যোৎস্নায়/ নোনামাটি মানুষের দুঃখ চেনা যায়।’ (কাদামাখা বায়াটাকে)
শুকিয়ে যাওয়া ঘামের পরতে নুন ফুটে বেরোয় যে ভুরুতে, সেখানে দ্বিতীয়ার চাঁদ উঠতে দেখা কম কথা নয়! কাঠফাটা রোদ্দুরের দুপুর না হলে ঘামে নুন ফোটে না যে! সেই নুনফোটা ভুরু যেন দ্বিতীয়ার চাঁদ। নৈকট্য আর একাত্মতা এইভাবে নোনামাটি মানুষের দুঃখ চিনতে সাহায্য করে কবিকে।
‘এপারে নদীর চরে/ পাখিরাও আসে/ খুঁটে নিতে জীবনের স্বাদ’ (প্রাত্যহিকী)
জীবনের স্বাদ খুঁটে নেবার যে আর্ট কবি এখানে দেখিয়েছেন, তা কষ্টের হলেও দুরন্ত জীবন-অভিলাষী।
কীরূপ জীবন? কতখানি জীবন? কিসের অভিলাষ? – জানতে পারলে সংগ্রামের মধ্যে বাঁচতে জানা যে অনিন্দ্য শিল্প, তার প্রতীতি হবে। ‘অমরাবতীর মেয়েরা’ নামের কবিতা থেকে তার একটু ছোঁয়া নিই –
কনকনে মাঘের সকালে/ ওপাশের বকখালি থেকে/ শাঁ-শাঁ করে ভেসে আসে হওয়ার সানাই/
অমরাবতীর মেয়েরা তখন/ উঠোনের রোদে এসে বসে/ আর শুঁটকি মাছ ভাজা ভাজা দিয়ে পান্তা ভাত খায়। আর, খেতে খেতে টুকটাক গল্পের ভেতর/ নিজেদের স্বপ্ন নিয়ে বলাবলি করে’
কী সেই স্বপ্ন? কেমন করে স্বপ্ন দেখা সম্ভব হলো? কারণ,
‘এ-বছর সাবাড়ের রোজগার ভাল/ ঘর ছেড়ে পুরুষ লোকেরা/ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাই/ পড়ে আছে জম্বুর চড়ায়‘
সাগরদ্বীপের দক্ষিণে একটি বসতিহীন দ্বীপের নাম জম্বু। সেখানে মেছোশ্রমিক পুরুষেরা সাবাড়ের কাজে গেছে অপরের নৌকায়।
‘এ মাসের শেষে তারা ফিরে এলে ঘরে/ সাধ ক’রে চেয়ে নেবে/ রঙ-চঙে শাড়ি আর ঝকমকে দুল…’ (অমরাবতীর মেয়েরা)
এইসব অমরাবতীর মেয়ে, তাদের এই আকাশ-ছোঁয়া সাধপূরণের জন্য কোন অসহিষ্ণু তাড়া নেই। পুরুষ ফিরে এলে তারা ‘রঙ-চঙে শাড়ি আর ঝকমকে দুল’ চেয়ে নেবে, ঝিকিয়ে তুলবে স্বর্গ-সংসার। এই হচ্ছে বাঁচতে জানা।
‘সুন্দরী গাছের নিচে’ নাম-কবিতায় ‘চুপিসাড়ে চুমকুড়ি দিয়ে/ সুঁতিখালে জল খায় হরিণের পাল’, যেখানে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের ওপর বিপদ-নিশানের অনিবার্য ভাগটা পড়ে থাকে, বনবিবির জঙ্গলে মানত মেটাতে আসা মানুষ ‘… মাতলার ঢেউ থেকে শোনে/ বাঘে ধরা মাঝিটার মৌন হাহাকার’ – এইসব ছবির মালা গেঁথে এ-কাব্যের দিগন্ত-আলপনা। অথচ, এরকম ভয়াল সুন্দরের মধ্যেও মানুষের বাঁচতে জানার জীবনবেদ হয়ে থাকবে ‘সুন্দরী গাছের নিচে’ কাব্যগ্রন্থটি।
‘ভোরের বাউল’ (২০০৮) কাব্যগ্রন্থটি ওয়াজেদ আলির কবিমানসের সারাৎসার ধারণ করে আছে। প্রেম, নিসর্গ-ব্যাকুলতা, সমুহ বিপদের মধ্যে হার-না-মানা জীবনানুরক্তি, সমকাল-সচেতনা, নোনামাটি মানুষের সঙ্গে একাত্মতা আর সহজাত স্বভাবসুলভ বাউলমন – সবেরই পরিচয় মিলে যাবে এই কাব্যের কবিতাবলীতে। কবিতার জন্য কবির ছুটে বেড়ানো। তারপর, কবিতার সাগরস্নানের সাক্ষী থাকেন কবি-কপিল ওয়াজেদ।
‘এপারে নদীর পাড়ে আমি এক ভোরের বাউল/ একা একা হেঁটে যাই কবিতার খোঁজে/ ওপারে দিগন্ত পারে রাতজাগা নীলাভ আকাশ/ সাগরের ধু ধূ মোহনায়/ কবিতার রূপ ধরে নামে তাই সকালের স্নানে।’ (ভোরের বাউল)
‘নিসর্গ-রমণী’ কবিতায় রয়েছে কালীদাসী ময়নাদের খাঁচা আর হাঁড়ি নিয়ে পাঁকে নেমে মাছ ধরার ছবি।
‘এমন নিসর্গ ছুঁয়ে পড়ে আছে বাদাবনে/ নোনামাটি মানুষের মন/ মধু, মাছ, জ্বালানির লোভে প’ড়ে/ যদিও গিয়েছে কত অমল জীবন‘
কারণ তাদের অপরিমেয় জীবনীশক্তি – ‘এইভাবে খড়ি আর জঙ্গলের দেশে/ সাপ বাঘ কুমির ও কামটের ভয়/ দূরে রেখে লাটের মানুষ/ জীবনের দুঃখ তাপ করেছে সে জয়। (নিসর্গ-রমণী)
‘বেলা পড়ে আসে’ কবিতায় বালি দ্বীপে বসে থাকা মঞ্জুর সময় কেটে যায়, রাখীর অপেক্ষায়। ‘রাখী আর আসে না।’ তাই বলে মঞ্জুর প্রতীক্ষা শেষ হয় না। নিরন্তর মানুষের খোঁজ চলে ‘তবু খুঁজে যাই’ কবিতায় –
‘মনের আকাশে তবু খুঁজে যাই/ একটি পৃথক তারা/ জীবনের তরে জীবনের গাঙে/ তাই তো নৌকো বাওয়া।’
এই নৌকো বাওয়ার শেষ নেই ওয়াজেদ আলির কবিতার গাঙে। জীবনের জন্যই এই শেষহীন নৌযাত্রাই ওয়াজেদ আলিকে সবুজ গ্রহায়ণের কবি-সুজন করে তুলেছে, মানতেই হয়।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন