দেশভাগ : প্রেক্ষিত পার্টিশন সাহিত্য
১৯৪৭। দেশভাগ। দেশত্যাগ।লক্ষ লক্ষ মানুষের অভিবাসন।অসহায় দিশেহারা উদ্বাস্তুর মিছিল।শেকড় হারানো মানুষের বিপন্নতা।কান্না।আহাজারি।
এই উপমহাদেশের এক অভিশাপ।
সেই দেশভাগ কে কেন্দ্রে রেখে এই উপমহাদেশে তৈরি হয়েছে সাহিত্যের এক নুতন ধারা।দেশভাগের সাহিত্য।পার্টিশন লিটারেচার।
তবে এটাও বলে রাখা ভালো যে "পার্টিশন লিটারেচার"
সারা পৃথিবীর সাহিত্যেই একটা নুতন সংযোজন।যা যথেষ্ট উর্বর।যথেষ্ট সফল।
পাকিস্থান বাংলাদেশে অনেক লেখক তাদের উপন্যাস,ছোট গল্প,স্মৃতিকথায় দেশভাগকেই তাদের লেখার উপজীব্য করে তুলেছেন।
বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা যায় খুশবন্ত সিং এর_"ট্রেন টু পাকিস্থান" কিংবা Mantor কয়েকটি ছোট গল্পের কথা।হাসান আজিজুল হকের_"আগুনপাখির" কথাও বলতে হয়।
তবে আমরা এই লেখায় পশ্চিমবঙ্গের দেশভাগকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যের পরিসরেই সীমাবদ্ধ থাকবো।
২.
হারানো দেশের স্মৃতি উন্মোচনের একজন ট্রমাটিক এসেন্স এর চর্চিত নাম KRISHNA SOBTI একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন_"The partition of India is three generation old.for my generation of writers,it was the most traumatic experience;a kind of encounter between man and reality;a collision between a political agenda and a long tradition of pluralism.writers of both sides soon realised that after so much hatred,violence,and killing,human values had to be affirmed and restored."
এই বিশ্বাসের জায়গা থেকেই এই লেখকেরা দেশ বিভাজনকে তাদের লেখার বিষয় করেছিলেন। আসলে দেশ ভাগের গভীর ক্ষত,খুন,মানুষের অবিরাম পলায়নের অসহায়তা,সর্বোপরি মানবিক বিপর্যয় কে তাদের বিষয় করে তুলেছিলেন এই লেখকেরা।
শিকড় বিচ্ছিন্ন মানুষের হৃদয়ের কান্না আর বিভাজনের আকষ্মিক ট্রমা তাদের সৃজনবিশ্বকে আলোড়িত করে তুলেছিল।ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি অনেক গুরুত্বপুর্ন পার্টিশন লিটারেচার।
উপন্যাস।স্মৃতিকথা।ছোট গল্পের মধ্য দিয়ে যার বহিঃপ্রকাশ।
৩.
দেশ বিভাজনকে বিষয় বা ভিত্তি করে প্রচুর উপন্যাস,স্মৃতিকথা,ছোট গল্প লেখা হয়েছে।এখনো লেখা চলছে।
তবে এই লেখার সীমিত পরিসরে শত শত সেই সব বই নিয়ে,লেখা নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই।তাই কয়েকটি মাত্র লেখা নিয়ে এখানে কথা বলা যায় মাত্র।
আমি প্রফুল্ল রায়ের "কেয়াপাতার নৌকো", অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের "নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে", অমর মিত্রের "ধূলোগ্রাম",প্রবোধকুমার সান্যালের 'হাঁসুবানু" উপন্যাস গুলির পাশাপাশি অমর মিত্রের "বনহংসীর দেশ" ছোট গল্পটি এবং দু একটি স্মৃতিকথা কে কেন্দ্রে রেখেই এই লেখাটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবো।
৪.
দেশভাগ বা পার্টিশন লিটারেচার নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের কথা এখানে উল্লেখ করাটা জরুরি।
তেমন কয়েকটি বই হল_শেখর দাসের "বিন্দু বিন্দু জল",আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের "খোয়াবনামা",গৌরকিশোর ঘোষের "প্রতিবেশী",মিহির সেনগুপ্তের "বিষাদবৃক্ষ","সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম",সুনন্দা শিকদারের 'দয়াময়ীর কথা" প্রমুখ।
লেখকেরা আন্তরিক বয়ানে খুব বিশ্বস্ত ভাবে তুলে এনেছেন শেকড় হারানো দেশ হারানো ভূগোল হারানো
মানুষের যাপন,রক্তপাত আর আবহমান বেদনার গল্প।
পড়তে পড়তে পাঠক উন্মনা হয়ে পড়েন। কান্না এসে তাকে জাপটে ধরে।
৫.
অমর মিত্রের "ধুলোগ্রাম" একটি তিন প্রজন্মের গল্প।দেশভাগ পূর্ববর্তি অতীত গ্রামজীবন।অবনীভূষনের স্মৃতি রোমন্থন।আর অনর্গল আখ্যান বুনে চলেছেন আবহমানের সেই কালোঠাম্মা।
এক জায়গায় অবনীভূষন বলছেন_
"কষ্টের তো নিশ্চয়।তা কি আর জানেন না অবনীভূষন?
শুধু ভিটে কেন,তার হারিয়েছে গ্রাম,মহকুমা,জেলা,দেশ সব।তার খারাপ লাগছিল।ভিটে কিনল কেন নীলরতন?
ওদের বিক্রি করতে বাধ্য করেছে তাঁর ছেলে, তাও টের পেয়েছেন তিনি।...দুটোদিন মনের মধ্যে এক আশ্চর্য খেলা শুরু হয়েছে।হ্যাঁ আনন্দের কথা তো বটে,পিতৃপুরুষের সম্পত্তি ছেড়ে আসার পর আবার ভূসম্পত্তি হচ্ছে এদেশে,ভূসম্পত্তি স্বাদই আলাদা।"
আবার কালোঠাম্মার কাছে আখ্যান শুনছে বালক শুভ_
"আমরা যেমন ছেড়ে এসেছি ধূলোগ্রাম, ধুলোগা। সে ছাড়বে না।এখন অধর যদি চলে আসে তাহলেও সে কেঁদে কেঁদে ঘুরবে।কালোঠাম্মা যখন চলে আসে এপারে,তার কাছে খুব কেঁদেছিল বিদ্যে,তুমাদের নিয়ে আছি পিসি,তুমরা উপারে যাচ্ছ আমি কারে নে থাকবো বল।... ধুলোগা ছেড়ে আসার যেমন কষ্ট;
ভিটে পুকুর,গাছগাছালি, মাঠপথ,সেনবাড়ি,মিত্তিরবাড়ি,কেরামতের বেড়বাগান এসব ছেড়ে আসার যেমন কষ্ট,তেমনি কষ্ট বিদ্যের জন্যও।"
এই বিদ্যে হল অধর পরামানিকের মৃত বউ যার আত্মা থাকে বাড়ির গাবগাছে।
এভাবেই আনরিয়েল সময়ের বিবেকি আত্মার আখ্যান নির্মাণ করেছেন অমর মিত্র।
৬.
দেশভাগ জনিত কারণে উত্তর পূর্বাঞ্চলে আশ্রিত উদ্বাস্তু বাঙালিদের যাপনকথার একটি বিশ্বাসযোগ্য আখ্যান শেখর দাসের "বিন্দু বিন্দু জল"।যদিও এই উপন্যাসটি বহুল পরিচিত নয়।
শেখর দাস একটি বুক নিংড়ে নেওয়া নস্টালজিক জীবনের ছবি এঁকেছেন_
"আজই তো এ ভিটের শেষ সন্ধ্যাবাতি।কত পুরাতন পুরুষানুক্রমের ভদ্রাসন।কত জননী এখানে জন্ম দিয়েছেন বংশের ক্রম।হালকা শিশিরের মতো এসব ভাবনা সুরবালার ভেতর হিমানিপাত ঘটায়। ছোট্ট শ্বাস ফেলায় একবার।স্বল্প শঙ্কায় বারবার লক্ষ করছেন,যতটুকু তেল ভরা হল_সারারাত জ্বলে কাল ভোর অবধি জ্বলবে তো?
সুরবালা বললেন,যতক্ষণ জ্বলে জ্বলুক না।কাল এমন সময় আলো দেওয়ার কেউ থাকবে না এ বাড়িতে।
_কেন?অশ্বিনী কাকা তো থাকছে।
ম্লান হেসে সুরবালা বললেন,শুধু ও কেন,দশরথ,পুতুও থাকবে।
_তাহলে ওরা আলো দেবে না?
_ওরা কী আর তেমন করে আলো দেবে, যেমন আমি দিই।সেজদি দিতেন, তোর ঠাকুমা দিতেন,তোর ঠানদি দিতেন। এমন এরা দেবে না।"
আবার রনবীর পুরকায়স্থের "সুরমা গাঙের পানী" উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র বৈতল কে দেখি সে তার গুরু সৃষ্টিধরকে বলছে_
"_ঠাকুর,দেশ কিতা?
_ভালো কতা কইলায় বাবা। কিতা কইতাম কও চাইন।
দেশ অইল, বুঝছনি,একঝান্ডা।বদমাশির জয়পতাকা।দেখিয়া ডরাইতা।"
এভাবেই ভাঙা বাংলার আখ্যানেরা বহুরৈখিক বিস্তার এনে দেয়।
৭.
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের "খোয়াবনামা" উপন্যাসে দেশভাগ পরবর্তী পর্বে দেখি এক বৃষ্টির রাতে কিভাবে দোকান দখলের উদ্দেশ্যে মেরে ফেলা হল বৈকুণ্ঠ গিরিকে।ইতিহাসের এক ধারাক্রম বহন করে বেঁচে থাকা বৈকুণ্ঠ গিরি মৃত হয়ে পড়ে থাকলো থেতলানো ইঁদুরের ওপর।ভারি মর্মন্তুদ সেই দৃশ্য বর্ণনা।
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের "নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে" উপন্যাসের সেই অমোঘ জায়গাটির কথা মনে পড়ে।
দেশ ছেড়ে চলে যাবার আগে ছোট্ট সোনা তার নিখোঁজ বড় জ্যাঠামশাই(আসলে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে)_ এর উদ্দেশ্যে বাড়ির সামনের অর্জুন গাছে লিখে রাখছে_
"জ্যাঠামশাই,আমরা হিন্দুস্থানে চলিয়া গিয়াছি।"
এটাই তো দেশভাগের মূল যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি।
আবার এই উপন্যাসেই আমরা দেখি,ইশম শেখ;যে তরমুজ পাতার নিচে মৃত হয়ে পড়ে থাকলো।আর সামু মানে সামসুদ্দিন এর সর্বাঙ্গে ঝাপট মারলো এই গদ্যাংশটি_
"বড় বড় অক্ষর কী গভীর ক্ষত নিয়ে এই মহাবৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে। এ দৃশ্যে সামু নিজে বড্ড বেশি অভিভূত হয়ে গেল।মনে হল তার,এই দেশ বাংলাদেশ।এই দেশে অন্য কোনও জাত নেই,ধর্ম নেই, সে মেয়েকে সান্তনা দেবার কোনও ভাষা পেল না।মেয়ের মাথায় হাত রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল।"
কিংবা_
"তারপর থেকেই মাঝে মাঝে আশ্বিনের কুকুর ইশমের
কবরের পাশে ঘোরাফেরা করলে টের পাওয়া যায় মহাবৃক্ষে সেই ক্ষত আবার মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে।অর্জুন গাছটা আরও বড় হচ্ছে।ডালপালা মেলে সজীব হচ্ছে।"
এভাবেই দেশভাগের আখ্যান আমাদের বক্ষদেশ বিদ্ধ করে।আমাদের একটা চিরকালীন দর্শনের কাছে নিয়ে যায়।
৮.
দেশভাগ তৈরি করেছে পার্টিশন সাহিত্য। আর নিঃসন্দেহে এটুকু বলাই যায়,যে আমাদের সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে দেশভাগ এর প্রেক্ষিতে লেখা আখ্যান, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, ছোট গল্প_
এসবের দারা।
এখানেই দেশভাগ আমাদের সাহিত্যে নিয়ে এসেছে এক
নতুন দিকশিন।একটা নুতন জার্নির যাত্রাবিন্দু।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন