শামসুর রাহমানঃ সমসাময়িকতার প্রোফেটিক ভাষ্যকার
শামসুর রাহমান বাংলাদেশের প্রধান কবি। বাংলাদেশ পরিচিতির তিনি অনেকটুকু। তার কবিতায় তীব্র স্বদেশপ্রেম ও সমকাল সচেতনতা, এতে এনে দিয়েছে এক ধরণের চিরকালীন উপাদান। কবিতার ক্ষেত্রে তার স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ এতটা প্রভাবদীপ্ত যে, তিনি যা লিখেছেন, সবই শেষ পর্যন্ত কবিতা হয়ে উঠেছে। রুপক, প্রতীক, চিত্রকল্প ও শব্দ ব্যবহারে তার অনেক কবিতা এতটা ব্যঞ্জনাময় যে, তা যে কাউকে আকৃষ্ট করে। কবিতার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড আত্নবিশ্বাসী কবি নিজেই বলেছেন-
'রাত্রির পীড়নে উন্মথিত আমি নক্ষত্রের ঝড়ের মতো /
শব্দপুঞ্জ থেকে ছিঁড়ে আনি কবিতার অবিশ্বাসী শরীর। '
--( কাব্যতত্ত্ব- প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে)।
কবিতার অবিশ্বাস্য নিপুণ শরীর নির্মাতা, আঙ্গিক ও বিষয় বৈচিত্র্যের নব রূপায়নের একনিষ্ঠ কলম- সৈনিক, হৃদয়গ্রাহী ধ্বনি তরঙ্গের তুর্যবাদক শামসুর রাহমান ১৯ বছর বয়স থেকেই সরাসরি কবিতা লিখতে শুরু করেন।তারপর পেছনে ফেরা হয়নি তার । শুরু হয় অবিশ্রান্ত, গতিশীল পথ চলা- 'কবিতার সঙ্গে গেরস্হলি'। এ পথ চলার একেবারে শুরুর পর্যায়ে টগবগে তারুণ্যের স্পর্শকাতর রোমান্টিকতা তার কবিতায় স্থান করে নিলেও ঢাকা মহানগরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা কবি পরবর্তী পর্যায়ে নাগরিক চেতনায় উদ্ভাসিত হন, যা বিশ্বজনীনতা সমৃদ্ধ। এদিক দিয়ে তিনি আধুনিক কবিতার প্রথম প্রজন্মের কবি তথা ত্রিশের কবিদের সার্থক উত্তরসূরী।
ত্রিশের কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ গ্রামমুখী হলেও বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখ প্রধান কবি সমকাল সংলগ্ন নাগরিক কবি ছিলেন, যাদের প্রাণ স্পর্শে বাংলা কবিতার ভাব, বিষয় ও কাঠামোয় নতুনত্ব আসে, যা বাংলা কবিতাকে সমকাল স্পর্শী, আন্তর্জাতিকতার সাথে সম্পৃক্ত এবং আবহমান ধারা সংলগ্ন করে।শামসুর রাহমান এদের সার্থক উত্তরসূরী।শামসুর রাহমানের জীবনে তিরিশের কবিদের প্রভাব সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন, 'আমি যখন কবিতা লিখতে শুরু করি, তখন রবীন্দ্রনাথের কবিসত্তা আমার পক্ষে কোনো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি, কাজী নজরুল ইসলামকেও সহজে এড়িয়ে যেতে পেরেছি। তিরিশের কবিকূল যেমন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মুশকিলে পড়েছিলেন, আমিও তেমনি মুসিবতে পড়লাম রবীন্দ্রোত্তর কবিগোষ্ঠীকে নিয়ে, বিশেষত জীবনানন্দ দাশ আমার শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ালেন, যদিও আমি গোড়া থেকেই ছিলাম তার একনিষ্ঠ ভক্ত। তার এবং তিরিশের আরও দুজন কবির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে আমাকে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে।
একথা আমাকে কবুল করতেই হবে, তখন আমার মনে রবীন্দ্রকাব্য অতটা আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারেনি, যতটা করেছিল রবীন্দ্র বহির্ভূত পাঁচ প্রধানের কবিতা এবং আমি যৌবনে আত্মজৈবনিক একটি কবিতায় এরকম পঙক্তি লিখতে দ্বিধা করিনি--
'মধ্যপথে কেড়েছেন মন, রবীন্দ্র ঠাকুর নন।/
তিরিশের সম্মিলিত কবি। '
( প্রবন্ধ: আমার চৈতন্যে রবীন্দ্রনাথ - শামসুর রাহমান, দৈনিক ইত্তেফাক, রবীন্দ্র জয়ন্তী সংখ্যা, ২৫ বৈশাখ ১৪১১ বাংলা। ৮মে ২০০৪, পৃষ্ঠা -১২)।
কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন,
' গভীর অনুভূতির স্বাভাবিক প্লাবনই কবিতা।' শামসুর রাহমানের কবিতায় এই অনুভূতির প্রবহমানতা লক্ষণীয়, যা দুকূল প্লাবিত করে পাঠককে মোহাবিষ্ট করে। সুযোগ করে দেয় ভাবনাবিস্তারের। লক্ষ করুন নিচের কবিতা পঙক্তি -
১.
'গ্রন্হের অক্ষর দ্বীপে ক্রুশোর মতন হেঁটে হেঁটে /
পেয়ে গেছি কী উন্মুক্ত অনাক্রমণীয় বাসভূমি।'
-- ( কোথায় মনের মুক্তি / মাতাল ঋত্বিক)
২.
'ভাদ্রের দুপুর চিল্লাচ্ছে পুরানো ঢাকার
কলতলার
ঝগড়াটে যুবতীর মতো।'
-(প্রামাণ্য চিত্রের অংশ /স্বপ্নেরা ডুকরে ওঠে বার বার)
৩.
'শুদ্ধচারী গাছপালা আজও সবুজের পতাকা ওড়ায়,
ভরা নদী কোমড় বাঁকায় তন্বী বেদিনীর মতো।'
-(সুধাংশু যাবে না / ধ্বংসের কিনারে বসো।)
এভাবে তার প্রায় সব কবিতাতেই আছে এক ধরনের প্রবহমান সুর, যা সাবলীল গতিতে স্বাচ্ছন্দ্যে এগিয়ে চলে চঞ্চলা নদীর মতো। তার কবিতায় সময়, সমাজ, রাজনীতি, ঘটনা - সবকিছু উঠে আসে ; এসব তার কবিতাকে করে গণমুখী। তার কবিতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এর প্রবহমান গতিময়তা ও সামসময়িক অনুষঙ্গের যথাযথ প্রয়োগ, যা তাকে বাংলা ভাষাভাষী কবিদের মধ্যে প্রধানতম আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
তার ক্লাসিক হয়ে ওঠা অনেক কবিতার মাঝে উদাহরণ হিসেবে দুটি কবিতার খণ্ডাংশ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য। 'স্বাধীনতা তুমি' কবিতায় আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে তিনি স্বাধীনতাকে দেখেছেন এভাবে -
'স্বাধীনতা তুমি /
রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।/
স্বাধীনতা তুমি /
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো /
মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা- /
স্বাধীনতা তুমি /
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি উজ্জ্বল সভা।/
স্বাধীনতা তুমি /
পতাকা শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল। /
স্বাধীনতা তুমি /
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি। /
স্বাধীনতা তুমি /
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার। /
স্বাধীনতা তুমি /
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্হিল পেশী।/
স্বাধীনতা তুমি /
অন্ধকারে খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক। '
অথবা, 'তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা' কবিতায়--
'তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা, /
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙল,/
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর। /
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,/
শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যান্ক এলো,/
দানবের মতো চিৎকার করতে করতে। /
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,/
ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো।'
তার কবিতায় এ ধরনের সামসময়িক অনুষঙ্গ-সমৃদ্ধ প্রবহমান গতি পাঠকচিত্তকে সহজেই দোলা দেয়।
সামসময়িক ঘটনা প্রবাহ যুগে যুগে সব দেশেই কবিতা রচনায় কবিচিত্ত আলোড়িত করতে দেখা যায়। তা কারো ক্ষেত্রে বেশি, কারো কম। কিন্তু শামসুর রাহমান সমকাল, সামসময়িক ঘটনাপ্রবাহ, জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, উপলক্ষ -- সবকিছুতেই সক্রিয় থেকেছেন তার কবিসত্তা নিয়ে, বারবার কলম ধরেছেন, লিখেছেন অসামান্য সব কবিতা। এজন্য তার কবিসত্তা বেশ দৃষ্টিগ্রাহ্য। জাতির ক্রান্তিকালে তিনি নিস্পৃহ থাকতে পারেন নি। সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের গভীরে প্রবেশ করে তিনি নাগরিকের ভেতরের সুপ্ত সম্ভাবনাকে জাগাতে ব্যবহার করেছেন তার কবিতা। স্বৈরাচারী এরশাদ আমলের প্রথমদিকে জাতি যখন সামরিক শাসনের যাতাকলে পিষ্ট, জাতি স্থবির, তখন তার কলম থেকেই বেরিয়ে আসে 'গুড মর্নিং বাংলাদেশ' কবিতা, যার একস্থানে তিনি বলেন,
'শোনো বাংলাদেশ, স্বপ্নের ফেনা লেগে তোমার চোখ /
এমন অন্ধ হয়ে যায়নি যে, তুমি /
দেখতে পাচ্ছো না শকুনের ঝাঁক বড়শির মতো নখ দিয়ে /
আকাশের উদর ছিঁড়ে খুড়ে হিঁচড়ে টেনে আনছে /
মেঘের নাড়িভুড়ি ; /
দেখতে পাচ্ছো না সংসদ ভবন নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে, /
রাজনীতিবিদগণ জনগণের কাছ থেকে /
বিচ্ছিন্ন হয়ে বনভোজন করছেন দীর্ঘকাল ; /
শাসনতন্ত্র কাটা ঘুঁড়ির মত ভাসমান, /
উন্নয়ন বিশারদগণ পাঁচশালা পরিকল্পনাকে /
কুরে কুরে খাচ্ছেন ঘূণের ধরনে। /
দেখতে পাচ্ছো না বখাটে বুদ্ধিজীবীদের মাথায় /
বেধড়ক উৎসাহে ক্রমাগত হাঁগছে প্যাচা আর বাদুর। /
দেখতে পাচ্ছো না, সাত ঘাট থেকে চেয়ে চিন্তে আনা /
হে ব্যর্থ অন্নপূর্ণা। /
যে, তোমার সন্তানের পাতের ভাত খায় সাত কাকে। /
গুড মর্নিং বাংলাদেশ, সুপ্রভাত /
হাউ ডু ইউ ডু ? /
তুমি কি জেল্লাদার হ্যাট-কোট পরা শাসালো বিদেশিকে দেখে /
তোমার উরুদ্বয় ফাঁক করে দেবে নিমিষে ? ' - (দৈনিক ইত্তেফাক - শহীদ স্মৃতি সংখ্যা, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪)।
অথবা, 'উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ' কবিতায়--
'উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়, মুক্তিযুদ্ধ, /
হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়। '
--(শামসুর রাহমানের রাজনৈতিক কবিতা - প্রথম প্রকাশ, ১ ডিসেম্বর ১৯৮৮, পৃষ্ঠা - ৫৫)।
শামসুর রাহমানের কবিতা উপমা ও চিত্রময়তায় নিসর্গনির্ভর এবং বিষয় ও উপাদানে নগরকেন্দ্রিক। নাগরিক জীবনের ভাঙাগড়া, আশা- আকাঙ্খা, স্বপ্ন- সংগ্রাম তার কবিতায় বাঙময় হয়ে ওঠে। নগরের কোলাহল ও বিভিন্ন অবস্থান থেকে যারা শব্দকে কবিতায় এনে কবিতাকে বিশেষভাবে অর্থবহ করে তোলার চেষ্টা করেছেন, শামসুর রাহমান তাদের মধ্যে অগ্রণী। কিন্তু তাই বলে তার কাব্য প্রতিভাকে নাগরিক জীবনের চার দেওয়ালে আবদ্ধ করার কোনো কারণ নেই। তিনি নাগরিক কবি হয়েও তাঁর সমগ্র কাব্য-ভাবনা মাটিবর্তী। স্বদেশ ও সমাজকে সুন্দরের নৈকট্যে এনেছে তার কবিতা। স্বদেশ- সমাজ ভাবনায় তিনি সামসময়িকতাকে তার কবিতায় উপজীব্য করে তোলেন। বলা যায়, তিনি সামসময়িকতার তুর্যবাদক। তিনি আমাদের সম্ভাবনার কবিতার কবি, বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি।
পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে পঞ্চাশের কবিদের হাতে প্রায় এক নতুন ধারার কাব্যরীতির আবির্ভাব ঘটে, যা 'আত্মজৈবনিক স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা' নামে পরিচিত। এই ধরনের কবিতায় কবি নিজেকেই কবিতার কেন্দ্রে স্হাপন করে নিজেই প্রত্যক্ষভাবে কবিতার বিষয় হয়ে যান। বাংলা কবিতায় এই ধারা এখনো চলছে। পশ্চিমবঙ্গে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও বাংলাদেশে বাংলা কাব্য সাহিত্যের রাজপুত্তর কবি শামসুর রাহমান এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে একে স্থায়িত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেন। অবশ্য এক্ষেত্রে শহীদ কাদরীও কম নন।এছাড়া আল মাহমুদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, হাসান হাফিজুর রহমান, রফিক আজাদ, সিকদার আমিনুল হক, মহাদেব সাহা'সহ আরও একঝাঁক কবিতো আছেনই।
কবি শামসুর রাহমানের জীবনের মধ্যভাগ অতিক্রম পরবর্তীকালে তার কবিতায় এক নয়া বাঁক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এ সময় থেকে কবিতার শরীর বিনির্মান অর্থাৎ আঙ্গিকের দিক দিয়ে তিনি 'টানা গদ্যের কবিতা' রচনারীতি অনুসরণ করেন। ছন্দের কঠিন বন্ধনের বাইরে এসে তার কবিতা মেতে ওঠে শব্দের কারুময় খেলায়। শব্দের করুকার্যখচিত পঙক্তিমালা সাজিয়ে তিনি নির্মাণ করেন কবিতার বহির্কাঠামো। এর মাধ্যমে তিনি অভ্যস্হ কাব্যরীতির বিপরীতে অবস্থান নেন, যা নতুনত্বের ইঙ্গিতবহ। অবশ্য এর আগেও কবিতার উপকরণ ব্যবহার ও আঙ্গিক প্রকরণের বেলায় তার কবিতায় অবস্থান পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। তবে তার কবিতায় এক ধরনের আত্নবিশ্বাস বা আত্ননির্মাণ থাকে, যা আপন স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল।
কবিতা শেষ পর্যন্ত একটা শিল্প। শিল্পের কারুকাজ ব্যতীত কোনো রচনা কবিতা হতে পারে না। পটুয়ার নিপুণ স্পর্শে যেমন শিল্প প্রাণবন্ত হয়, তেমনি শামসুর রাহমানের সৃষ্টিশীল স্পর্শে তার কবিতা হয়ে উঠেছে কারুময় কল্পনার অফুরন্ত সম্ভাবনা জাগানিয়া এক শিল্প। শামসুর রাহমানের জীবনের প্রধান ও একমাত্র অনুষঙ্গ কবিতা এবং কবিতাতেই তিনি নিমগ্ন ও সমর্পিত ছিলেন। জীবনকে তিনি করে তুলেছেন কবিতা। শামসুর রাহমানের মূল্যায়ন করেছেন খান সারওয়ার মুর্শিদ এভাবে, 'যেকোন বড় কবি স্থিতাবস্থা ভেঙে দেন এবং শেষ পর্যন্ত সমাজ তাকে পুরোপুরি গ্রহন করে কিনা, তা একটা প্রশ্ন থেকেই যায়।সমাজের সঙ্গে কবির প্রীতি- প্রত্যাখানের জটিল বহুরৈখিক সম্পর্কের কথা মনে রেখেও বলা যায়, শামসুর রাহমান সেই কবি -- যার কণ্ঠ এই বাংলার দীপ্ত দগ্ধ অশান্ত হৃদয়ে সবচেয়ে বেশি অনুরণন তোলে। কেননা তিনি জাতিসত্বার অন্তঃস্থলের কবি, তার ওপর জীবনেরও কবি, তাঁর সঙ্গে তাঁর এক গভীর নিবিড় তীব্র একাত্মতা কটু-মধুর আত্নীয়তা।শামসুর রাহমান তাঁর হৃদয়ের কথা অনেক বলেন, এর মাধ্যমে পাঠক হৃদয়ের অতি-নিকট প্রতিভূ হয়ে যান। অন্যদিকে একই সময় তিনি আরও একটি কাজ করেন, যা অতি তাৎপর্যপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য ; তিনি একটি সমাজের সৃজন ও ধ্বংসের বিচিত্র নিপুণ সংবেদনশীল, খানিকটা 'প্রোফেটিক' ভাষ্যকারের দায়িত্ব পালন করেন।' (প্রবন্ধ- অপরাজিত শুভবাদের কবি - খান সারওয়ার মুরশিদ। দৈনিক প্রথমআলো, নববর্ষ সংখ্যা, ১ বৈশাখ ১৪১০। ১৪ এপ্রিল ২০০৩)। শহীদ কাদরীর কথায়, 'শামসুর রাহমান মানুষের জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন কোনো বিষয় নেই, যা স্পর্শ করেননি।' রশীদ করিম বলেন, 'তার লেখায় যেমন চণ্ডীদাশ, বিদ্যাপতি, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ উঁকি দিয়ে যান, তেমনি স্পষ্টাক্ষরে গালেব, মীর, দাগ প্রভৃতি দেখতে পাই।কখনও কখনও লালন শাহের মরমী মেজাজে ঝুঁকে পড়েন। এই সার্বজনীনতার জন্যই তিনি একজন বড় ও মহান কবি।' ( দৈনিক যুগান্তর - ১৪ আগষ্ট ২০০৬)।
দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর সৃষ্টিশীল জীবনে কবিতা, উপন্যাস, অনুবাদ, শিশু সাহিত্য ও প্রবন্ধ মিলে তার অর্ধশত পুস্তক বেরিয়েছে। এর মধ্যে সিংহভাগ কবিতার বই। কবিতার জন্য তিনি ১৯৬৩ সালে আদমজী পুরস্কার, ১৯৬৯ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৭৭ সালে একুশে পুরস্কার'সহ অনেক পুরস্কারে সম্মানিত হন। বাংলাদেশ রাইটার্স ফোরাম তাকে 'কবিশ্রেষ্ঠ' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
শামসুর রাহমান বাংলা কবিতার প্রবাদ পুরুষ। বাংলা কবিতার পরিচর্যা তার মতো এত গভীর ও নিবিষ্ট চিত্তে খুব কম কবিই করতে পেরেছেন। তিনি প্রায় তিন হাজার কবিতা লিখেছেন। তার প্রতিটি কবিতাই শিল্পমান উত্তীর্ণ, নান্দনিক -- তা হয়তো কবি নিজেও দাবি করতেন না। কিন্তু তার কবিতার সংখ্যা, কবিতায় উপমা- উৎপ্রেক্ষা- শব্দের ব্যবহার বিচারে তিনি এদেশের প্রধান কবি। আধুনিক নাগরিক জীবনের এই কবি মানুষের প্রাত্যাহিক জীবনের এমন কোনো বিষয় নেই, যা কবিতায় তুলে আনেন নি। তার চিন্তা, মনন, মেধা দিয়ে বাংলা কবিতার সীমানাকে তিনি অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত করছেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন