ওপেনহাইমার--গীতা--ক্রিস্টোফার নোলান
'দিবি সূর্য সহস্রস্য ভবেদ যুগপদুথিতা…'শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শনের একটি শ্লোক বলা হচ্ছে। আকাশের বুকে যদি সহস্র হাজার সূর্য একই সঙ্গে রশ্মিজাল বিচ্ছুরিত করে, তবেও এই ঔজ্জ্বলের সমান হবে না । না, অর্জুন না, বেদব্যাসও নন্ । এমন শ্লোক উচ্চারিত হয়েছে অন্য একজনের মুখে। স্থানটা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ময়দান নয় , সময়টাও দ্বাপর নয় । কলি ঘোর কলি , সালটা ১৯৪৫ । লস আলমসের মরুভূমি , নিউ মেক্সিকো । আমেরিকা তথা বিশ্বের প্রথম পরমাণু বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ, তাই প্রত্যক্ষ করলেন সেই প্রজেক্টের কর্ণধার রবার্ট জুলিয়াস ওপেনহাইমার । আর তা দেখেই গীতার সেই শ্লোক মুখ থেকে বেরোলো। সত্য প্রকাশিত বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্র পরিচালক ক্রিষ্টফার নোলানের ওপেনহাইমার রূপী সিলিয়ান মরফি, সেই শ্লোকটি বলেছেন। কিন্তু ওই পারমাণবিক বিস্ফোরণ দেখে নয়, সিলভার স্ক্রিনের ওপেন হাইমার যখন তার বান্ধবী জিন টাটলকের সঙ্গী বিছানায় ঘনিষ্ঠ তখন । যদিও তাই দেখে পুরান বিশেষজ্ঞ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুরী বলেছেন--' অশিক্ষা ও কুশিক্ষার এমন অসামান্য সমন্বয় বড় একটা দেখা যায় না ' । সংস্কৃতে সুপন্ডিত ওপেনহাইমারকেও অসম্মান করা হলো।' হ্যাঁ, মানা যেতেই পারে ওরকম জায়গায়, ওরম একটা মহান শ্লোকের ব্যবহার সত্যিই অদ্ভুত এবং অবান্তর । কিন্তু এটা তো একটা আর্ট ফ্রম। তাই ভুল না ঠিক তা বলা যাচ্ছে না। কেননা সত্যজিৎ রায় পরিচালিত তথ্যচিত্র 'ইনার আই'- তে মানিক বাবুর কলা ভবনের আর্টের শিক্ষক বিনোদবিহারী মুখার্জীর উক্তিটি এখনো কানে বাজে --'বাইজেনটাইন, জৈন, বটপাতা , এ তোমার হিস্টোরিয়ানের কাছে তফাৎ থাকতে পারে , কিন্তু আমার কাছে ,তোমার কাছে, আর্টিস্টের কাছে কি তফাৎ ! একটা জৈনের পাশে একটা ফোক ফিগার দিলে তার বাবার সাধ্যি ধরে!' তাই আর্টিস্ট নোলানের ভুল তা বলা যায় না বলে মনে হয়। কিন্তু একথা ঠিক, ব্যাপারটা সিনটা স্পেক্টাকেল করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে কি লাভ হল, তাই বোঝা দায়। অহেতুক ,অপ্রয়োজনীয় বলেই মনে হয়েছে তা। সে যাই হোক এবার ও সব তর্ক-বিতর্ক ছেড়ে সিনেমাটির তথা ফিল্মটির আলোচনায় ফেলা যাক।
সত্যিই ফিল্ম ! অসাধারণ ফিল্ম। ফিল্ম, তার কারণ আইম্যাক্স ফিল্মে শুট করা হয়েছে গোটা ছবিটাই। আর সর্বোপরি এমন চিত্রায়ন সত্যিই একটা মাস্টারপিস। পরিচালক নোলানের এক সর্বোত্তম কাজ বলেই ধরা যেতে পারে এই ছবিকে।
C.K.Bird ও J.Sherman এর 'American Prometheus: The triumph and Tragedy of J.R.Oppenheimer ' বইকে নির্ভর করে এই বহু প্রতীক্ষিত ছবিটি বানিয়েছেন নোলান। তিন ঘণ্টার ছবির জন্য ৭০০ পৃষ্ঠার স্ক্রিনপ্লেতে একটা সরল রৈখিক পথে চলেনি নোলান। খুব সুন্দর ভাবেই দেখিয়েছেন যে আমেরিকা কিভাবে তার নায়ক কে সৃষ্টি ও ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে , তারই উজ্জ্বল প্রমাণ এই থিওরিটিকাল পদার্থবিদের জীবন। এমিলি ব্লান্ট, ম্যাট ডেমন, রবার্ট ডাউন জুনিয়র ও ফ্লোরেন্স পুগ অভিনীত, ফিলিয়ান মরফি 'ফাদার অফ দ্যা অ্যাটমিক বোম' ওপেনহাইমারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এ ছবি একটি অনুসন্ধানী ঐতিহাসিক চরিত্রের অধ্যয়ন ও ইতিহাসের এক সুস্পষ্ট বিবরণ । নোলানের এছবি হল সেই বুদ্ধিদীপ্ত অনুসন্ধানী ঘরকুনো মানুষটির জীবনের অদ্ভুত থ্রিলার। যিনি লস আলমোসের পারমানবিক বোমা তৈরি করেছিলেন, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে ঠান্ডা যুদ্ধের শুরু করেছিল । কিন্তু এই দুঃসাহসীক বায়োপিকের সবচেয়ে মূল্যবান উপাদানটি হল পারমানবিক অস্ত্রের জন্য রাজনৈতিক আত্মস্বার্থ চরিতার্থের ইঁদুর দৌড় অথবা ফুটবল খেলা। কিন্তু তা গৌণ করে দিয়েছে বিংশ শতাব্দীর উজ্জ্বলতম বৈজ্ঞানিক মনকে, আমেরিকার অস্ত্রচিন্তার বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ করায়। মধ্যশতাব্দীর ব্যবসায়িক পোশাক পরা পুরুষরা অফিস ও ল্যাবে দাঁড়িয়ে কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে অ্যামেটেড আলোচনা করছে। যার মধ্যে মাঝে মাঝে অপদার্থবিদের প্রবেশ হয়তো কিছু সঠিক ব্যাখ্যার অভাব ঘটিয়েছে। প্রথম দিকে দেখানো অস্থির মনস্ক ঘরকুনো ওপেনহাইমার নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কার্যকারণ ও জ্ঞানকে মনের মধ্যে আত্মতস্থ করতে চাইতো । নক্ষত্রের জন্ম থেকে মৃত্যু সবটাই। এক অদ্ভুত বৈপরীত্য কাজ করত সর্বক্ষণ তার ভিতরে আর সেই বৈপরীত্য ফুটে উঠেছে মরফির অভিনয় গুনে, চলচ্চিত্রের মধ্যে তার চোখের ভাষায় । নীলস বোরকে দেওয়া বিষ আপেলই হোক কিংবা পরবর্তীতে প্রাইভেট প্যানেলের সামনে বসা প্রশ্নোত্তরের পর্বেই হোক। প্রায় এক ঘন্টার ক্রমবর্ধমান লাইন আপ ফিউশন বোমার উপাদান ইউরেনিয়াম ও প্লাটেনিয়ামের মধ্যে পার্থক্য বোঝানোর জন্য দুটি কাঁচের পাত্রে ফেলা মার্বেল গুলির মধ্যে দিয়ে ফুটানো অ্যাস্থেটিকস এক কথায় অনবদ্য।
অনস্বীকার্য নোলানের চিন্তাভাবনা বা তার সিগনেচার অ্যাপ্রোচ যা গোটা সিনেমাটি জুড়ে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুটি পৃথক শুনানি ওয়াশিংটনে , পুরো ঘটনা প্রবাহকে দুটি পৃথক ভাগে ভাগ করে এবং ফাইনাল আওয়ারকে উপস্থিত করে। সিনেমার পূর্বাহ্নে ঘটে যাওয়া মরফি অভিনীত ওপেনহাইমার ও টম কন্টি অভিনীত আইনস্টাইনের মধ্যে একান্ত কথোপকথন সেই ফাইনাল আওয়ারে এসে প্রকাশ করে দুটি ব্যক্তির নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গিকে, যা ফিরিয়ে আনে তাদের বিজ্ঞানের শাখার ভিন্ন দৃষ্টিকোণ । চিত্রনাট্যের ফোর অ্যাক্ট কাঠামো যা আমাদের দর্শকদের কাছে চায় ধৈর্য ও একাগ্রতা এবং আমাদের নিয়ে যায় ১৯৪৫ সালের ট্রিনিটি পরীক্ষায়। পথ করে দেয় সেই জঘন্য শিকারের-- হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ঘটিত । নায়কের শিরোপায় ভূষিত হয় ওপেনহাইমার আমেরিকাতে। কিন্তু নৈতিক ক্ষোভ অবক্ষয়ের সূচনাও হয় ওপেনহাইমারের মন জুড়ে, প্রকাশ পায় মরফির মুখের ভাষায় ,চোখের আন্দোলনে। যা কিনা ম্যাকার্থী যুগের সবচেয়ে ঘৃণ্য কৌশলের প্রতিনিধি।
নোলানের দক্ষতা এখানে সত্যি যে কোন চলচ্চিত্র নির্মাতার কাছেই ঈর্ষার কারণ। সে তৈরি করে নাটকীয় সুরে ক্রমবর্ধমান বেদনা ও অপমানকে। নায়ক ও তার সুন্দরী স্মার্ট স্ত্রী কিটি (এমিলি ব্লান্ট) এর মনে প্রকাশিত হয় লাইটিং ফ্রেমিং ও চলচ্চিত্রের নিজের ভাষায়। সংবর্ধনার দৃশ্যে ওপেনহাইমার দেখতে পায় তারই প্রিয় ও পরিচিত জন ও হাততালি দেওয়া মানুষগুলি ওই পরমাণু আঘাতেই শুকনো পাতার মতো চামড়া উঠে ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে, নায়ক পা দিয়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া মৃতদেহকে। পাঁচ বছর পরে যখন লুইস স্ট্রসের বাণিজ্য সচিব হিসাবে মনোনয়নের আগে সেনেটের শুনানির সময়, লস আলমসের সমান্তরালে ঘটে যাওয়া গোপনীয় কিন্তু দিক নির্ধারণকারি ঘটনার ভাঁজ খুলতে থাকে, তখনই আবার নোলান তার স্বকীয়তা দেখান। দেখান তার দক্ষতা চলচ্চিত্র মাধ্যমে আবার এক নাটকীয় ক্রেসেন্ডো তৈরি করে। স্ট্রস হিসাবে ডাউনির অভিনয় যিনি কিনা আণবিক শক্তি কমিশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য , সত্যিই সুন্দর । প্রথমে এক নরম মনের হিতাকাঙ্খী ভদ্র মানুষ বোঝাই যায় না সেই লোকেই শেষ ভাগে এমন উগ্র লোভী ক্ষমতা লিপ্সু এডভোকেট অভিনয় করতে পারেন।
একটি ঘোলাটে ক্যাপিটাল হিল কনফারেন্সে এবং সেনেট চেম্বারের সমান্তরাল ঘটনা প্রবাহ উন্মোচিত হচ্ছে ধীরে ধীরে , যা কিনা লেট অ্যাকশন ষড়যন্ত্রের এক অসাধারণ নিদর্শন । প্রতিটি সংলাপ, সংলাপের পর সংলাপ এক অদ্ভুত টেনশন তৈরি করে চলেছে প্রতিনিয়ত , এতোটুকু ছাড়লেই মুশকিল । দর্শক ঢুকছে গভীরে, আরো গভীরে। উপস্থিত ওই ঘরে ,যেখানে বিশ্বাসঘাতকতা ও আনুগত্যের এক নতুন সংজ্ঞা , নতুন কার্যকারণ তৈরি হচ্ছে ।একদম বন্ধ করা মুহূর্ত । রাজনৈতিক মানুষগুলোর দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ওপেনহাইমার, যারা তাকে অপমানের পর অপমান করছে। পুরনো কমিউনিস্ট যোগ থেকে শুরু করে প্রতিটি কাজের দিকে ও সর্বোপরি আনুগত্যের দিকে প্রশ্ন তুলে । মরফির এক সূক্ষ্ম অভিব্যক্তিপূর্ণ অভিনয় , মিষ্টভাষী ওপেনহাইমারের মানসিক জটিলতাকে ক্রমাগত চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ক্যাসি অ্যাফ্লেক একজন সামরিক বুদ্ধিমান কর্মকর্তা হিসেবে অভিনয় করেন । একজন পরীক্ষামূলক পদার্থবিদের চরিত্রে রামি মালেক আসেন, যিনি স্ট্রসের শুনানির সময় বিজ্ঞানীদের আবেগকে উপস্থাপিত করেন। আর রাষ্ট্রপতির চরিত্রাভিনেতা ওপেনহাইমারকে জানান যে কে বোম ফেলেছিল তা মনে রাখবে লোক , কে বানিয়েছিল তাকে নয় । আর সাদা রুমাল পকেট থেকে বার করে দিয়ে তিনি বলেন হাতের রক্ত মুছে ফেলো ওপেনহাইমার । নোলানের ভাষা ও উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করে অসাধারণ সম্পাদনা করেন জেনিফার লেম আর লুডভিগ গোড়াসনের অসাধারণ হাড় কাঁপানো সাউন্ড ডিজাইন যা প্রতিটি মুহূর্তে চিত্রকে আরো সংবেদন পূর্ণ করে তোলে। বিশেষ করে পারমাণবিক পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের দৃশ্যে নারকীয় নিস্তব্ধতা এক কথায় আবার প্রতিষ্ঠা করল যে নৈঃশব্দ কি পরিমান ইমপ্যাক্ট তৈরি করতে পারে । 'শূন্যের কাছাকাছি' বিশ্বকে ধ্বংস করা সম্ভবনাও এখানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । ওপেনহাইমার এর মনের ফ্ল্যাশে থাকা ছবিও ইঙ্গিত করে ভয়ংকর ভবিষ্যতের । ইতিহাস ভিত্তিক ছবিকে মন খুলে উপভোগ করবে বলেই মনে হয় নোলানের ফ্যানেরা, তার আগের ছবি সে ইনসেপশনই হোক বা ব্যাটম্যান , মিল আছে সামান্যই এর সাথে । শুধু মনে পড়ে বিজ্ঞান ও আবেগের মিলনে তৈরি ইন্টারস্টেইলারকে। বড় ফরম্যাট, আইম্যাক্স 65 মিমি camera আর হয়েটেমা(ডি ও পি) অসাধারণ টেক্সচারও গভীরতা নিয়ে আসে । সবশেষে বলা যায় এক অসাধারণ বুদ্ধিজীবী বিজ্ঞানীর দৈত্যের দ্বন্দ্ব সম্পূর্ণ ভাবে পর্দায় আসে। যা আপনাকে মরে যাওয়া নক্ষত্রের মতো নিজের মধ্যেই প্রচন্ড টানে টেনে নিয়ে এসে আত্মসাৎ করবেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন