রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০২৪

ঐন্দ্রিলা তেওয়ারী-র প্রবন্ধ

রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতা : রূপকথার নবজন্ম

এখুনি জেগে উঠবে না কি রাজকন্যা

জীয়ন-কাঠির ছোঁয়ায়?  (নিশীথ-নগরী, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের শ্রেষ্ঠ কবিতা : ২০০১) 

এই হলো রূপকথা। তবে রূপকথা মানেই শুধু জিয়নকাঠির স্পর্শে রাজকন্যার জেগে ওঠা নয়, রূপকথা মানে আরও অনেক কিছু। ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেনের মতে রূপকথা আসলে অপূর্বকথা বা অপরূপকথা, অবান্তর, অপ্রধান ছোট আখ্যায়িকা। ‘aspiration to a higher life, free and purer life’- রূপকথা সম্পর্কে এমন অভিমত ইংরেজ সমালোচকেরও। বাংলায় যাকে আমরা রূপকথা বলে জানি, সারা বিশ্বে তা নানা নামে পরিচিত : Fairy Tale (ইংরেজি), Marchen (জার্মানি), Conte Populaire (ফরাসি) তবে যে-নামেই ডাকা হোক না কেন, তা আসলে লোককথার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা এবং কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিয়েই বিশ্বের সমস্ত রূপকথা গড়ে ওঠে। সেই বৈশিষ্ট্যগুলি এইভাবে সূত্রাকারে দেখে নেওয়া যেতে পারে :

) রূপকথা লোকমুখে কাল থেকে কালান্তরে প্রবাহিত। লোকসাহিত্যের এই শাখায় সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রকাশভঙ্গি মাধ্যমের পরিবর্তন ঘটলেও একথা ভুললে চলবে না, মানুষের স্মৃতিই এর প্রধান ধারক এবং কথকতার গুণেই রূপকথা মনোহরণ করে। 

) রূপকথা মূলত শিশুদের জন্য রচিত। ছোটবেলায় যখন থেকে গল্প শোনার আগ্রহ জন্মায়, তখনই ছেলেভুলোনো ছড়ার পাশাপাশি রূপকথাও তাদের মনে মায়াজাল বিস্তার করতে শুরু করে। অবাক বিস্ময়ে তারা রাজা-রানি-রাজপুত্র-রাজকন্যা-রাক্ষস-রাক্ষসীর গল্প শোনে, আনন্দ পায়। 

) রূপকথার কোনো কপিরাইট নেই। মৌখিক সাহিত্য হওয়ার কারণে দেশ-কালের বদলের সঙ্গে সঙ্গে কাহিনিতে নানা বদল আসে, ঘটে কথান্তর। -কারণেই থাম্বেলিনার সঙ্গে দেড় আঙুলে কিংবা ঘুমন্ত পুরীর সঙ্গে স্লিপিং বিউটির এমন আশ্চর্য মিল পাওয়া যায়। যদিও কোনো রূপকথারই লেখকের নাম পাওয়া যায় না, পাই কেবল সংকলকের নাম। যথা : গ্রিম ভাইয়েরা, শার্ল পেরো, দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার প্রমুখ। 

) রূপকথার গল্প বাস্তবতার সীমানা মেনে চলে না। এখানে মানুষের পেটে বাঁদর-প্যাঁচা জন্ম নেয়, আবার সেই মানবেতর প্রাণীরা কথা বলতে পারে এবং কাহিনির শেষে তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে রাজকুমার হয়ে দেখা দেয়। এছাড়াও রাক্ষসীরানির প্রাণভোমরা কৌটোয় লুকিয়ে রাখা, মন্ত্রবলে কাউকে পাখি বানিয়ে দেওয়া, মৃত মানুষের মন্ত্রপূত জলে বেঁচে ওঠা, চোখ ফিরে পাওয়া এইরকম অলৌকিক ঘটনার ছড়াছড়ি দেখা যায় রূপকথায়। লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞরা এর মধ্যে সাদা জাদু-কালো জাদুর ব্যবহার লক্ষ করেছেন। আর শেষে আছে ইতিবাচক উপসংহার তথা শুভ শক্তির জয় অশুভ শক্তির বিনাশ।  মোটামুটিভাবে এসবই রূপকথার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তবে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ভাবনাজাগর প্রবন্ধরূপকথা সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন এসব আপাত শিশুতোষ কাহিনির আড়ালে লুকিয়ে থাকা সমাজভাবনার দিকে, তাঁর অভিমত :‘প্রকৃতপক্ষে দেখিতে গেলে রূপকথা অবাস্তব নহে, উহা একটা বাস্তবতার দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। ... রূপকথা কতগুলি অসম্ভব বাহ্যঘটনার ছদ্মবেশ পরিয়া আমাদের মনের সহিত ইহার প্রকৃত ঐক্যের কথা গোপন রাখিতে চেষ্টা করে। কিন্তু ছদ্মবেশ খুলিলেই ইহার সহিত আমাদের যোগসূত্র সুস্পষ্ট হইবে।শ্রীকুমারবাবুর এই আলোচনা আমাদের বুঝিয়ে দেয়, যা পাওয়া যেতে পারত কিংবা যা হলে ভালো হতো তারই কল্পরূপ এই রূপকথা। দাদু-দিদিমা-ঠাকুমা-ঠাকুরদার মুখে পরম্পরা বাহিত এই কাহিনিগুলি আপাতদৃষ্টিতে যতই অলীক হোক না কেন, লোকসমাজের অপ্রাপ্তিগুলি এখানে রাজপুত্রের রাক্ষস মেরে রাজকন্যা লাভের মধ্য দিয়ে সফলতা পায়। একালে ভ্লাদিমির প্রপের আখ্যানতত্ত্ব নতুনভাবে রূপকথার আঙ্গিক ব্যাখ্যা করলেও যে-কোনো ভালো রূপকথাই যে ছদ্মবেশী সত্যকথা, নিয়ে মতান্তর নেই। 

. 

লোককথার জগৎ ছাড়িয়ে যখন আধুনিক সময়ে হান্স আন্ডারসেন, অস্কার ওয়াইল্ড, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমন্তবালা দেবী, নবনীতা দেবসেন প্রমুখ রূপকথা লেখেন, বুঝে নিতে হয় কল্পনার আড়ালে বাস্তবের কথাও সেখানে প্রচ্ছন্ন রয়েছে। এছাড়াও রূপকথার আঙ্গিক উপাদানকে বহুমাত্রিক তাৎপর্যে ব্যবহারের কৃতিত্ব বিদেশের ওয়ার্ডসোয়র্থ, কিটস, কোলরিজের মতোই আমাদের রবীন্দ্রনাথের। বিশেষত, তাঁরবিম্ববতী’, ‘সুপ্তোত্থিতা’, ‘বীরপুরুষ’, ‘রাজার ছেলে রাজার মেয়ে’, ‘নৌকোযাত্রাইত্যাদি কবিতা, লিপিকা- একাধিক রূপকথার কাহিনিপুনরাবৃত্তি’, ‘পরীর পরিচয়’, ‘সুয়োরাণীর সাধ’, ‘বিদূষক’, ‘তোতাকাহিনিকিংবা নাটকতাসের দেশ’, গল্পদালিয়া’ – সর্বত্রই রূপকথার আঙ্গিক, কাহিনি আর মেজাজ-কে কবি ব্যবহার করেছেন যুগোপযোগী করে। প্রয়োজনে কল্পনার তুলি ছুঁইয়ে দিয়ে তিনি মানবচরিত্র এবং সমাজ-সংসারকে রূপকথার মোড়কে ব্যঙ্গ করতেও দ্বিধা করেননি। তাঁরবিম্ববতী নিবিড় পাঠ আমাদের দেখিয়ে দেয় জার্মান রূপকথাস্নো হোয়াইট’-এর কাহিনিকে কীভাবে কবিতায় নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছেন। আত্মরতিপরায়ণা বিমাতা তাঁরম্যাজিক মিররএখানে হয়েছেকনকদর্পণ মূল কাহিনির মতোই এখানেও ঈর্ষাতুরা বিমাতার পরাজয় মৃত্যু ঘটে এবং স্নো হোয়াইট রাজপুত্রের সঙ্গে সুখী দাম্পত্যজীবনের সন্ধান পায় : ‘বিম্ববতী, মহিষীর সতীনের মেয়ে / ধরাতলে রূপসী সে সকলের চেয়ে’ (মূলে ছিল :You, O Queen, are the fairest here, / But Snow white is a thousand times more fair) আবারতাসের দেশনাটকে নিয়মতান্ত্রিকতাকে রূপকথার মোড়কে কবি যেমন আঘাত করেছেন,  তেমনিসুয়োরানীর সাধগল্পে দুয়োরানির দুঃখকে পেতে চায় সুয়ো, সেখানেই আছে সহজ আনন্দের উৎসভূমি।  রবীন্দ্রগানেওপরীর দেশের বন্ধ দুয়ার দিই হানাএই উচ্চারণ রূপকথার জগৎকে অপরূপ করেছে। তবে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এমন চর্চা হয়েছে বিস্তর। 


. 

রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কবিতায় দুই বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত, মার্ক্সীয় চেতনা, ফ্রয়েডীয় মনোদর্শন আর বাস্তবতার নানাবিধ মাত্রা কবিতার আঙ্গিক বিষয়গত বদল ঘটিয়েছিলো। এই পর্বের উল্লেখযোগ্য কবিদের কবিতায় রূপকথা নিছক লোক-উপাদান হিসেবে আসেনি, সমাজচেতনার অংশ হিসেবে তার নবজন্ম ঘটেছে দেখা যায়। মৌখিক সাহিত্যকে এইভাবে সমকালীন করে তোলাকে কবিদের ঐতিহ্যপ্রীতির নিদর্শন হিসেবে আমরা ভাবতে পারি। আবার উত্তরাধুনিকতাবাদেও ঐতিহ্যকে বক্রদৃষ্টিতে পুনর্নির্মাণের প্রয়াসে রূপকথা কবিদের কাছে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রোত্তর কালে জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে একালের ঊর্মিলা চক্রবর্তী, সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, নাসের হোসেন, শিবাশিস মুখোপাধ্যায় প্রমুখের কবিতাতেও এসেছে রূপকথার চরিত্র : কঙ্কাবতী, নীলকমল-লালকমল, রাক্ষস-রাক্ষসী, রাজা-রাণী-রাজকুমার-রাজকন্যা, সুয়োরানী-দুয়োরানী ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ।  কয়েকজন কবিকে বেছে নিয়ে তাঁদের কবিতায় রূপকথার আঙ্গিক উপাদান কীভাবে নতুন তাৎপর্য পেয়েছে কিংবা লোকায়ত ঐতিহ্যকেই পুনর্নব করেছে, তা এবার দৃষ্টান্তসহ দেখা যেতে পারে। প্রথমেই ধরা যাক জীবনানন্দের কথা, তাঁরধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘রূপসী বাংলা’, ‘বনলতা সেনকাব্যে রূপকথা তাঁর কাছে নগরসভ্যতা থেকে গ্রামজীবনের নিবিড় স্বাদ গন্ধকে বয়ে আনে। বাস্তবজীবনে যে-ভালোবাসা তাঁকে ব্যথা দেয়, কবিতার বিশ্বে তিনি খোঁজেন সেই শঙ্খমালা নারীকে :

চোখে তার 

যেন শত-শতাব্দীর নীল অন্ধকার

স্তন তার

করুণ শঙ্খের মতোদুধে আর্দ্রকবেকার

শঙ্খিনীমালার

পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।   (শঙ্খমালা) 

রূপসী বাংলা : ২৮’, ‘সিন্ধুসারসইত্যাদি কবিতাতেও রূপকথার শঙ্খমালা নারীকে খুঁজেছেন কবি। অদ্ভুত আঁধারে দীর্ণ কবিহৃদয় রূপকথার অলীক রাজকন্যাকে ছুঁয়ে শান্তি পেতে চায়।  ঠাকুরমার ঝুলি’-তে এই শঙ্খমালাতেও প্রেম-প্রকৃতির অনুষঙ্গ এবং ইতিবাচক উপসংহার পাই আমরা।  আবার বুদ্ধদেব বসু যেমনকঙ্কাবতী মধ্যে প্রেমের শরীরী রূপ খুঁজে পান, তেমনই কবি অজিত দত্ত লেখেনপাতালকন্যা।পাতালকন্যা ঘুমন্ত রাজকন্যাকে ঘিরে সাপ আর বিষাক্ত বাতাস। তবু রাজপুত্র চায় তাকে পেতে, যদিও কবি জানেন রূপসী কন্যার রূপ বাস্তবের স্পর্শে ম্লান হয়ে যাবে। আরেক মৃদুকণ্ঠ কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্যমেঘকুমারী’, ‘নিশীথ-নগরী’, ‘ভোরএইসব কবিতায় ঘুমন্ত কলকাতা কিংবা ভোরের অনুষঙ্গ হিসেবে এনেছেন সাত ভাই চম্পার পারুল বোনের ডাকে জেগে ওঠার প্রসঙ্গকে। রোম্যান্টিক কবিকল্পনার উপাদান হিসেবে এঁদের কাছে রূপকথা মূলত প্রকৃতি অথবা অধরা প্রেমের রূপক হয়ে উঠেছে। 


তবে মার্ক্সীয় দর্শনে বিশ্বাসী কবিদের লেখায় যে কমিটমেন্ট তথা সচেতন সমাজবীক্ষা থাকে তা রূপকথার পুনর্জন্ম দিয়েছে। আর সেই তালিকায় সর্বাগ্রে আসে বিষ্ণু দে- নাম; এছাড়াও রয়েছে সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কিছু কবিতাও। বিষ্ণু দে- একটি কাব্যেরই নামসাত ভাই চম্পা’(১৯৪৫), আবার লালকমল নীলকমল, রাজার ছেলে, রাজার মেয়ে এইসব রেফারেন্স তাঁর কবিতায় রূপকথাকে অর্থপূর্ণ করেছে।স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ (১৯৫৩) কবিতায় তাই লেখেনরাজার মেয়ে আজ আপিসে খাটে / রাজার ছেলে খোঁজে কাজ রূপকথার যুগের রাজতন্ত্র নয়, আজকের নতুন সমাজে তারাও সাধারণ নাগরিক হয়েছে। তাদের মিলনস্থল রাজপ্রাসাদ নয়, পার্ক-বেঞ্চি-পথ-শান। প্রয়োজনে ধর্মঘটেও যোগ দেয় তারা। স্বাধীনতা-উত্তর স্বদেশের প্রাণময় সত্তার অবক্ষয় দেখে তিনি আবারও লেখেনলালনীল কমলের দেশে আজ বর নেই তাঁর ফ্যাসিবাদ-বিরোধী চেতনা সাম্যবাদের আদর্শে দীক্ষিত হয়ে জন্ম দেয়সাত ভাই চম্পাকবিতা। সেখানে বিষ্ণু দে আমাদের মধ্যে থাকা মুক্তির কামনা, শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে সাত ভাই চম্পার মধ্যে ধরে দেন, আর পারুলের ডাক যেন জাগরণের আহ্বান।সাত ভাই চম্পা’, ‘কাঞ্চনমালা’ ‘লালকমল নীলকমলএকাধিক রূপকথার অনুষঙ্গকে স্বদেশচেতনায় নতুনভাবে সাজিয়েছেন কবি। তাই লেখেন : 

কড়ির পাহাড়ে চম্পা তুমি তো নেই

কাঞ্চনমালা জানে না তোমার খেই;

তবুও তোমায় খুঁজে মরে সারা দেশ

ঘোচাও চম্পা, দুস্থ ছদ্মবেশ,

মাহ ভাদরে ভরা বাদরের শেষে

চকিতে দেখাও জনগণমনে মুখ।

মুক্তি! মুক্তি! চিনি সে তীব্র সুখ,

সাত ভাই জাগে, নন্দিত দেশ-দেশ।।  (কবিতাসমগ্র , ২০০৭) 

তিনটি রূপকথায় বন্ধন গ্লানিমুক্তির ছবি পাই : পারুল বোনের ডাকে সাত ভাই চম্পা নিজের বাবা-মাকে ফিরে পায়, কাঞ্চনমালা ফিরে পায় সূঁচমুক্ত রাজপুত্র রাখাল বন্ধুকে এবং লালকমল-নীলকমল রাক্ষসদের মেরে বিপদ থেকে সবাইকে বাঁচায়। অনুকূল পরিবেশে রাজপুত্র-রাজকন্যারা অবিচারের, ষড়যন্ত্রের প্রতিকার করেছে। কবিও পরাধীন ভারতে জাতির সেই জাগরণ চেয়েছেন। যদিও -কবিতা নেহাত স্বদেশীয় নয়, বৈশ্বিক তাৎপর্য পেয়েছে। 

অন্যদিকে সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর একাধিক কবিতায় লোকায়ত অনুষঙ্গকে অর্থপূর্ণভাবে ব্যবহার করেছেন। সেই উপাদানের মধ্যে রূপকথাও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাইবন্ধুরা কোথায়কবিতায় কবি ষাট-সত্তরের সন্ধিক্ষণে বিশ্বাসঘাতকদের মারতে চেয়েছেন, রূপকথার গল্পের মতো রাক্ষসীদের প্রাণভোমরা যেভাবে সোনার কৌটোয় লুকোনো থাকে সেই তুলনা এনেছেন : ‘তাহলেই সোনার কৌটোয় কালো প্রাণভোমরাগুলো / বুক ফেটে দাপিয়ে দাপিয়ে মরে যাবে তিনি চান বন্ধুদের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া সংগ্রামীচেতনাকে ফিরিয়ে আনতে। আবার সত্তরের শেষের দিকে প্রকাশ পাওয়াএকটু পা চালিয়ে ভাই’(১৯৭৯) কাব্যেরঠাকুরমার ঝুলিকবিতাটি তীব্রভাবে রাজনৈতিক। বামশাসনে সরকারের উদাসীনতায় সুবিধাবাদী মানুষেরা সুয়োরানীর মতো, আর যারা বঞ্চিত প্রতিবাদী তারাঘুঁটেকুড়ুনির ছানা যদিও কোনো প্রতিকার মেলে না, ভালো মানুষেরা যায় নির্বাসনে। কবির বিদ্রুপ :

সাতটি চাঁপা সাতটি গাছে

পারুল বোন রইল কাছে

দণ্ডকে যায় ধর্মরাজার

কলের ডুলি।    (সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ২০০২) 

অন্যত্রও কবি সুভাষ শোষণ বঞ্চনায় পীড়িত দেশকে রাক্ষসপীড়িত রাজপুরী হিসেবে দেখিয়েছেন এবং আশা করেছেন একালে কোনও একক রাজপুত্র নয় বরং জনজাগরণে সুদিন ফিরে আসবে আবার। 

চল্লিশের আরেক অকালপ্রয়াত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যব্যর্থতা  মীমাংসাকবিতাদ্বয় রূপকথাকে বিষয় করেও তাঁর কমিউনিস্ট চেতনারই প্রকাশ ঘটিয়েছে।স্লিপিং বিউটিরূপকথার কাহিনিকে নিজের মতো করে -দুই কবিতায় ব্যবহার করেছেন কবি।ব্যর্থতাকবিতা এক প্রত্যয়ী কৃষকপুত্রের কণ্ঠে রাজকন্যার ঘুম ভাঙানোর আহ্বান আরমীমাংসাএক লুপ্তগর্ব রাজপুত্রের অক্ষমতার কবিতা। দৈত্যদের উৎপীড়ন আসলে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, সুন্দরী রাজকুমারী তথা স্বদেশ তাদের হাতে লাঞ্ছিতাদৈত্যেরা শুধু বিবস্ত্রা করে চায় তাহারে কবিতায় রাজার পুত্রের হাতে ভাঙা তলোয়ার থাকলেও অকুলীন চাষির ছেলে কাস্তে হাতে লড়াই করতে উৎসুক। প্রাজ্ঞ সমালোচকের চোখে -দুই কবিতা একাধারে পরাধীন দেশের মুক্তি আবার বিশ্বমানবের মুক্তির ব্যঞ্জনা বয়ে আনে। কৃষক-শ্রমিকের হাতেই আসবে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি, এই ভাবনা স্বাভাবিক ভাবেই একজন মার্ক্সিস্টের। তাই সোনার কাঠির স্পর্শে ঘুম ভাঙানোর প্রচ্ছন্ন যৌনসংকেত ধানের সোনায় রূপান্তরিত হয়ে যায়, যদিও ধারণাটি রবীন্দ্রনাথ থেকেই পাওয়া। তবে সুকান্তের কৃতিত্ব রাজকন্যার ডাকে কৃষকপুত্রের সাড়া দেওয়ায় এবং এই উচ্চারণে : 

হে রাজকন্যা, ঘুম ভাঙলো না? সোনার কাঠি

কোথা থেকে পাব? আমরা নিঃস্ব, ক্ষেতেই খাটি

সোনার কাঠির সোনা নেই, আছে ধানের সোনা

তাতে কি হবে না? তবে তো বৃথাই অনুশোচনা। 

মীমাংসাকবিতায় যদিও রাজার তনয়ের লড়াইয়ে অগ্রসর হয়েও সন্ন্যাসী হয়ে যেতে চাওয়া অক্ষমতার ইঙ্গিত।  অন্য কবিতাটিতে তাই সমাজের নিচুতলার খেটে খাওয়া শ্রেণির স্বপ্ন সফলতার ইঙ্গিত দিয়েছেন কবি।  

এঁদেরই সমকালীন আরেক কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বিখ্যাত কবিতাউলঙ্গ রাজা’ (১৯৭১) হান্স আণ্ডারসেন রচিত  রূপকথার রাজার নির্বুদ্ধিতা তোষামোদপ্রিয়তার কাহিনিকে প্রতিবাদী চেতনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখা যায়।  রাজা তোর কাপড় কোথায়’? – এমন সঙ্গত প্রশ্ন তুলতে সক্ষম সাহসী, সত্যবাদী শিশুটির প্রয়োজন কবি অনুভব করেছেন বারংবার। 


.

পরবর্তীকালের বাংলা কবিতাতেও এই রূপকথার উত্তরাধিকার অব্যাহত থেকেছে।  যেমন, আশির কবি নাসের হোসেন যেমন লিখেছেনসাহস’-এর মতো কবিতা, যেখানে রূপকথার যাবতীয় আবহ জুড়ে সমস্ত অন্যায়ের প্রতিরোধে অসীম সাহস অভিযাত্রার ছবি খুঁজে পান তিনি। রুশী রূপকথারসিভ্‌কা বুর্কা গল্প, যেখানে বাবার প্রতি দায়িত্ববান ইভান রাজকন্যাকে জাদু ঘোড়ার সাহায্যে জয় করেছিলো, নাসেরেরদ্রুতকবিতায় তেমনই একজন দায়িত্বশীল বিবেকী মানুষের কথা পাই। নব্বইয়ের কবি শিবাশিস মুখোপাধ্যায় তাঁররুপোর কলম, সোনার মেয়ে’ (২০০২) কাব্যটি উৎসর্গ করেনরাক্ষসী’-কে। কাব্যের একাধিক কবিতায় এই রাক্ষসী প্রেমিকার রূপক হয়েছে আসলে।ঠাকুরমার ঝুলিশীর্ষক কবিতায় দুটি পর্যায়ে লালকমল নীলকমল রাক্ষসীর প্রেমে পড়ে, সে তাদের ভালোবাসার মায়ায় ভোলায় এবং বলতে হয়তোমারই প্রেমে পড়েছি রাক্ষসীসে আমার হাঁউমাউ কবিতাকিংবাকবি রাক্ষসী’, ‘রাক্ষসীকবিতাগুলিতেও সেই প্রেম যৌনতার দ্যোতনা। অন্যদিকে নারীচেতনায় দীক্ষিত আশির কবি ঊর্মিলা চক্রবর্তী লেখেনকবির ঘর’, ‘র‍্যাপাঞ্জেল’ ‘বিউটি অ্যাণ্ড দ্য বীস্ট’-এর মতো কবিতা।র‍্যাপাঞ্জেল’- নারী সমকামিতার প্রকাশ যেমন আছে তেমনইবিউটি অ্যাণ্ড দ্য বীস্ট’- নারীর যৌন আবেদনের কাছে পদানত পুরুষের ছবি আঁকেন ঊর্মিলা : ‘আমার পায়ের কাছে কি বশম্বদ জন্তু, / আমারই, আমার একার ডাইনি হাওয়ার পিঠে চড়ে কবি খুলে রাখেন রূপকথার দরজা-জানালা। সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেনঠাকুরমার ঝুলির ভূমিকা’(২০০০) : ‘পায়ের পাতা, বুকে, বিঁধে নেব কাঁটা পুরুষ / আমরাই রাক্ষুসি হব, সৎমা হব, গড়ে তুলব ডাইনি-গোপনতা রূপকথার বয়ানে তিনি খুঁজতে সংকলক পুরুষদের বদলে সেই নারীদের কণ্ঠস্বরযাদের চোখ থেকে না-পাওয়ার আগুন বেরোয় এরা কেউ পুরুষ নয়, এরাই আসলে রূপকথার ডাইনি কিংবা মায়াবিনী; পুরুষশাসিত সমাজ যাদের পুড়িয়ে মারতে চেয়েছে বারবার। তাই সত্তরের কবি কৃষ্ণা বসু  স্লিপিং বিউটিকে নারীচেতনায় দীক্ষিত করে বলেন :

কে চমকায়? কে জাগছে কে? নিদ্রাতুরা নারী

জেগে উঠছে সচৈতন্যে, জেগে উঠতে পারি

কখন আসবে নাগর পুরুষ? কখন করবে দান, -

এই প্রতীক্ষার ভিতরে থাকে সমূহ অপমান!

নিজেই নিজের সোনার কাঠি, রুপোর  কাঠি তুই,

আয় রে মেয়ে স্ববশ হয়ে ভূমি শয্যায় শুই।    (রূপকথার ভিতরের কথা, ‘ভাষানগর : শারদ ২০০৮’)

রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতায় রূপকথার এইসব নবজন্ম আসলে একালের নাগরিক জীবনের আড়ালে ফেলে আসা গ্রামকেন্দ্রিকজীবন তথা লোকসংস্কৃতির প্রতি আমাদের নিবিড় টানকেই ব্যক্ত করেছে। তাই -বিষয় নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা সম্ভব বলেই মনে করি।।      

 

ঋণস্বীকার 

গ্রন্থ  (নির্বাচিত) 


আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলার লোকসংস্কৃতি, এন বি টি, ১৯৮৬  

ঋতম্‌মুখোপাধ্যায়, রূপকথার ছদ্মবেশ এবং বিশ্বসাহিত্য, এভানেল প্রেস, ২০১৫ 

জয়গোপাল মণ্ডল, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার ঘর বাহির, পুস্তক বিপণি ২০০৭ 

বরুণকুমার চক্রবর্তী সম্পাদিত, বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ, দে বুক স্টোর, তৃতীয় সং ২০১৬ 

সুমিতা দাস, রূপকথার আঙ্গিক : রবীন্দ্রনাথের কবিতা গান কলিকাতা লিট্‌ল্‌ম্যাগাজিন লাইব্রেরি, ১৪০৭।


প্রবন্ধ 


অজয় কুমার দাস, রূপকথার উত্তরাধিকার : রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ, প্রতিধ্বনি দ্য ইকো, পিয়ার রিভিউড জার্নাল, জুলাই ২০১৯ (পিডিএফ)

ঋতম্‌মুখোপাধ্যায়, রূপকথার যাবতীয় আবহ : নাসের হোসেন, কলকাতার যিশু, জানুয়ারি ২০২১ 

তরুণ মুখোপাধ্যায়, কতটুকু রূপকথা?,  বাংলা সাহিত্য লোকায়ত মানস, জে এন চক্রবর্তী, ২০১৪

তরুণ মুখোপাধ্যায়, অজিত দত্ত জীবনানন্দ : রূপকথাকার, রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ : বিভাবে-বিভাসে, করুণা প্রকাশনী, ২০০৪  

দিব্যজ্যোতি মজুমদার, বিষ্ণু দে-সাত ভাই চম্পা’ : চিরচেনা লোককথায় মুক্তির অভীপ্সা,  ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায় ঋষি ঘোষ সম্পাদিত, বিষ্ণু দে- কবিতা : নিবিড় পাঠ, বিদ্যা সংস্করণ, ২০১১ 

পল্লব সেনগুপ্ত, সুকান্ত ভট্টাচার্যের রূপকথাচর্যা : সমাজতত্ত্বের দর্পণে, শারদীয়া নন্দন ১৪২৯

প্রমিতি চট্টোপাধ্যায়, রূপকথার অন্দরমহল, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ জুলাই ২০২২ 

মানস মজুমদার, শতবর্ষে ঠাকুরমার ঝুলি, লোকঐতিহ্য চর্চা, দে, ২০১০  

রতনকুমার নন্দী, রূপকথার অন্দরমহল, সৌগত চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, লোককথার বর্ণমালা, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, ২০১৪ 

শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, রূপকথা, ইউনিভার্সিটি বেঙ্গলি সিলেকশন্‌স্‌, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, পুনর্মুদ্রণ ১৯৬৫ 


এছাড়াও সংশ্লিষ্ট কবিদের শ্রেষ্ঠ কবিতা, কবিতাসমগ্র, নির্বাচিত কবিতা, বিচ্ছিন্ন কাব্যগ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি। 

1 টি মন্তব্য:

  1. বিশ্লেষণমূলক খুব প্রয়োজনীয় এবং সুন্দর একটি প্রবন্ধ l👌👌👌

    উত্তরমুছুন