রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০২৪

ঊর্মিলা চক্রবর্তী-র ধারাবাহিক গদ্য : "এসেছো কবিতা"

 

এসেছো কবিতা

বিয়ের পরে অন্য যা একটা সুবিধা হল তা এই যে একেবার ঘরে আবদ্ধ থাকতে হত না। আমি আর আমার স্বামী দূরে বেড়াতে খুব একটা বেশি না গেলেও সমানে শিলিগুড়ি-কলকাতা করতাম, আর কাছাকাছি শিলিগুড়ির এদিকে ওদিকে বেড়াতে যেতাম। সেইসময় থেকেই আমার একটা অভ্যাস হল যার সঙ্গেই দেখা হয় তার সঙ্গেই গল্প করা। হিন্দি আর ইংরেজি জানা ছিল বলে অসুবিধাও কিছু হত না। রাস্তাঘাটে নানা ধরণের নানা দেশের নানা মানুষের সঙ্গে ভাব জমে যেত এমন যে আমার নিজেরই অবাক লাগত। মনে হয় এইসব আলাপ  থেকেই আমার জীবন সম্বন্ধে অনেকখানি জানা হয়ে যেত। মন দিয়ে শুনছেন এমন মানুষ তো পাওয়া কঠিন, তাই তেমন কাউকে পেলে সাধারণভাবে লোকে অনেক কথাই বলতে চায়।  নানাধরণের মানুষের সঙ্গে আলাপ করার এই স্বভাব আমার আজও আছে। এত বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে যে ইচ্ছে করলে টানা লিখে যাওয়া যায়।  শাহবানু মামলায় হেরে যাবার পরপর ট্রেণের কামরায় এক মুসলমান মহিলার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন যে তাঁরা সবাই অনেক আশা করে বসেছিলেন যে মুসলমান মেয়েদের কিছু অধিকার স্বীকৃত হবে ভারতীয় সংবিধানে। তাঁর তিনটি মেয়ে। তারা শিক্ষিত হচ্ছে, গ্র্যাজুয়েশন করছে, কিন্তু কি লাভ? তিনি আমাকে বলেছিলেন যে মুসলমান মেয়েদের যে কতটা অপমান আর অনিশ্চয় নিয়ে বাঁচতে হয় তা হিন্দু মেয়েরা বুঝতেই পারবে না। আশা করি তিনি আজও আছেন এবং নতুন আইনে খুশি হয়েছেন। একদিন  শিলিগুড়ির কাছে এক নির্জন মিলিটারি আউটপোস্টে একটি আঠারো-উনিশ বছরের ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ছেলেটি সুদূর লুধিয়ানা থেকে প্রথম পোস্টিং পেয়েছে শিলিগুড়িতে। আমার সঙ্গে দুটো কথা বলার তার সে কি আগ্রহ! বেশ বুঝলাম, বাড়িতে মা-বোনদের জন্য কতটা মন কাঁদছে। আর একটু বেশি বয়সে একটি তামিল ছেলে ট্রেনে আমাকে অনেক যত্ন করেছিল। সে বারবার দুঃখ করেছিল্ যে মিলিটারিতে ঢোকার পরই তার মা চলে গেছিলেন বলে মাকে সঙ্গে করে বেড়াতে নিয়ে যাবার সুযোগ তার হয়নি। আর খুব মনে পড়ে ঊড়িষ্যায় উদয়গিরির কাছে আলাপ হওয়া সেই বিহারী মেয়েটির কথা। লেখাপড়া শেখার সুযোগ সে পায়নি। দেহাতি হিন্দিতে বহুক্ষণ ধরে সে আমার কাছে তার সুখ-দুঃখের, বিশেষ করে স্বামীর অসহানুভূতির কথা বলেছিল।  যাবার সময় তার হঠাৎ বোধহয় খেয়াল হয় যে আমি বাঙালি, তবু কেমন হিন্দিতে গল্প করলাম। মেয়েটি বেশ সপ্রশংস দৃষ্টিতে চেয়ে বলেছিল, ‘বহেনজি, আপ কিতনা চতুর হো, হিন্দি ঔর বাঙ্গালা, দোনোঁ ভাষায়েঁ জানতি হো


যাঁদের এমনটা অভ্যাস নেই তাঁরা বুঝবেন না এমন রাস্তার আলাপ থেকেও জীবনের কতরকম মুখ দেখা যায়।  কখনও কখনও মানবচরিত্রের অন্ধকার দিকের পরিচয় পেয়ে শিউরে উঠতে হয়। একবারের কথা বলি।  পরিচয় হয়েছিল জয়পুরের এক হীরা ব্যবসায়ীর সঙ্গে।  সঙ্গে তাঁর স্ত্রী আর পাঁচ মেয়ে। বড়টির বয়স বছর চোদ্দ। পুরো রাস্তা তাঁর স্ত্রী একটা কথাও বলেন নি। তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম পুত্রসন্তানলাভের প্রচেষ্টায়ই পাঁচ পাঁচটি মেয়ে কি না। তিনি আমার বেশ কাছে ঘেঁষে এসে খুব দুঃখ করে বলেছিলেন যে সবাই বারবার চেষ্টা করতে বলায় এতগুলো মেয়ে জন্মাল। কিন্তু তাঁরা জৈন, তাঁদের ধর্মে প্রাণিহত্যা বারণ। তাঁর খুব আক্ষেপ যে এইজন্য তিনি ইচ্ছে থাকা সত্বেও ভ্রূণহত্যা করতে পারেন নি। আমি বিস্ময় আর ক্রোধে হতবাক হয়ে দেখলাম যে পাশে বসে দশবছরের আর চোদ্দবছরের মেয়ে দুটি সবই শুনছে। তিনি নিজেই বললেন যে মেয়েদের কোনও ভালো স্কুলে ভর্তি করেন নি। অত্যন্ত নিচুমানের গুজরাটি মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করেছেন, তাদের শিক্ষার বিশেষ ব্যবস্থাই করেন নি। বললেন, কি হবে শিক্ষার ব্যবস্থা করে? রাত্রে একটি মেয়েও কিছু খেল না। জিজ্ঞেস না করে পারিনি কি ব্যাপার।  তখনই জানলাম যে তাঁদের ধর্মে নাকি সন্ধ্যার পর কিছু খাওয়া বারণ। পাঁচবছরের মেয়েটিও কোনও বায়না না করে বিকেলে যৎসামান্য কিছু জলখাবার খেয়ে সারারাত না খেয়ে থাকল। বুঝলাম, ধর্মে প্রাণিহত্যা বারণ, নিষ্ঠুরতা নয়। সারাজীবনে এত বেশি মানুষের সঙ্গে এমন পথের আলাপ হয়েছে যে হয়তো তা লিপিবদ্ধ করতে পারলে মন্দ হত না, কিন্তু সে সম্ভাবনার  কথা ভাবলে কিছু কিছু লিখে রাখতে হত মনে হয়। 


যতদিন বাড়িতে বসে রান্নাবান্না করে সময় কাটাচ্ছিলাম ততদিন একেবারেই লেখার কথা মনে হয়নি তা নয়। একটা পূর্ণাঙ্গ নাটক লিখে ফেলেছিলাম, কমেডি। এখন মনে হয় তত খারাপ হয়নি, কিন্তু সেটা একেবারেই হারিয়ে গেছে, কোথাও ঠিক করে রাখা হয়নি। এছাড়া লিখেছিলাম অনেক ছোটগল্প। সেগুলো একেবারেই ভালো হয়নি। হারিয়ে গেছে আপদ গেছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে পড়াশুনা এত কম ছিল যে তারাশঙ্কর, শরদিন্দু, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়, দুই বিভূতিভূষণ, রাজশেখর বসু, বনফুল ইত্যাদির পরের সারিতে যাঁরা ছিলেন তাঁদের প্রায় চিনতামই না। জগদীশ গুপ্ত, রতন ভট্টাচার্য ইত্যাদির সঙ্গে পরিচয় প্রায় হালে, লেখালেখি আবার শুরু করবার পরে। কিন্তু সে তো আরও অনেকটা পরের কথা। কবিতাও প্রায় তাই, কল্লোল যুগেই মোটামুটি থেমে ছিল। তাঁদের পরে ওই শঙ্খ-শক্তি-সুনীল-অরুণ-প্রণবেন্দু পর্যন্ত। এর উপরে যেটুকু পড়েছি সে অনেক পরে। আমার আজকের লেখক বন্ধুদের কাছে নিজেকে তাই খুব অজ্ঞ মনে হয়। 


এসময় বাড়িতে বসে রান্নাবাড়ির সঙ্গে ঠিকমতো কেন লেখালেখি শুরু করতে পারিনি তার কোনও সঙ্গত কারণ আমার নিজের কাছেই নেই। যে কোনও কারণেই হোক তখন আমি আমার সঠিক পথটা খুঁজে পাই নি। এমনও হতে পারে যে কবিতা লেখার সাহস সংগ্রহ করতে পারিনি, কবিতা লেখার কথা মনেই হয়নি, অথচ আমি মূলতঃ কবিতাই তো লিখেছি পরে। এজন্যই মনে হয় লেখা শুরুই করতে পারিনি। এটা কিন্তু এক অদ্ভুত ব্যাপার। অন্য কারো এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যেমন কোনও মেয়ে বা পুরুষকে অসম্ভব বেশি রকম ভালো লেগে গেলে নিজেকে তার অনুপযুক্ত বলে মনে হয়, তার কাছে যেতে, তাকে মনের কথা বলতে সাহস যোগায় না, তেমনই কবিতা কোনওদিন নিজে লিখতে পারি এমন ঘটনা অসম্ভব বলেই মনে হত। সে যে অসামান্য এক অভিজ্ঞতা, তাকে ধরাছোঁয়ার মধ্যে কেমন করে আনবে আমার মতো এক সামান্য মানুষ? যে বয়সটা কবিতা লেখার জন্য উপযুক্ত বয়স বলে মনে করেন আমজনতা, সেই বয়সটা এমনি কাপুরুষের মতো তাকে দূর থেকে ভালবেসেই কাটিয়ে দিয়েছি।



ক্রমশ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন