বৃহস্পতিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০২৩

রন্তিদেব সরকার-এর ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী "প্রথম পাড়ি গরুর গাড়ি"

প্রথম পাড়ি গরুর গাড়ি

আমাদের গ্রাম ছেড়ে আসার পর, এইবার আমরা চলে এসেছি আমাদের প্রতিবেশি গ্রাম- হজরতপুর। এই অঞ্চলের অন্যতম বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র। বসতবাড়ি থেকে দোকানবাড়িই বেশি। আমরা এখন এই গ্রামের উপকন্ঠে এসে গেছি। গ্রামে ঢোকার মুখেই প্রচুর ছোট-বড়ো সুন্দর সব পুকুর। রাস্তার ডানদিকে গ্রামটিকে রেখে আমাদের রাস্তা সোজা। ঐ গ্রামে আমরা ঢুকব না। সাতসকালেই সব পুকুরঘাটগুলি বৌ-ঝিদের দখলে চলে গেছে। গ্রামাঞ্চলে এটাই রেওয়াজ। যত সক্কাল-সক্কাল পুকুরে কাচাকুচি সেরে স্নানটা সেরে নেওয়া যায়। তাতে বেশ কিছু সুবিধে। প্রথমতঃ দিনের কর্মব্যস্ততা, লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়ে যাবার আগেই খোলা পুকুরঘাটে স্নানটা নিশ্চিন্তে সেরে নেওয়া যায়। দ্বিতীয়তঃ পুকুরের জল সা্রারাত বিশ্রাম পায় ফলে জলের যা ময়লা ভাসমান থাকে তা থিতিয়ে তলায় গিয়ে দাঁড়ায় এবং তার ফলে স্নানটা তুলনামূলক ভাবে পরিষ্কার জলে সারা যায়। তৃতীয়তঃ এই হিমের সকালে জলের তাপমাত্রা কবোষ্ণ থাকে, স্নানের আদর্শ। অবশ্য কুয়োর জলও তাই থাকে। শীতকালে উষ্ণ আর গ্রীষ্মে শীতল। এছাড়া সাত-সকালে স্নান সারতে পারলে তাড়াতাড়ি রান্নাবান্নাও শুরু করা যায়। এসব ভেবেই যে যত তাড়াতাড়ি পারে, আগেভাগে ছোটে। ফলে পুকুরঘাট সব হাউসফুল। এক দুর্দান্ত প্রভাতী গেট-টুগেদার। এর-ওর হাঁড়ির খবর, সাত-সকালেই আদান-প্রদান হয়ে যাচ্ছে। তাই নিয়ে যে যার নিজের নিজের সার্কিটে মশগুল।

 

            আমাদের গাড়ির রাস্তা মানে, সরাণ (সরণি-র অপভ্রংশ ?) হজরতপুর গাঁয়ের ডানা ছুঁয়ে বাইরে বাইরে দিয়েই চলে গেছে। গ্রামের মাঝামাঝি আসার আগেই বাঁদিকে লাল মেঠো এক রাস্তা চলে গেছে হজরতপুর হল্ট-এর দিকে। রাস্তা থেকেই দেখতে পাওয়া যায়। ছ’টি প্রায় চারফুট উচ্চতার ইঁটের পিলারের উপর একটি মালগাড়ির ওয়াগন বসিয়ে অফিস বানানো হয়েছে। ওটাই বুকিং অফিস। ওটাই স্টেশন মাস্টারের ঘর, অফিসঘর মায় যা কিছু সব ঐ একটি ওয়াগনের ভিতর। একজন মাত্র স্টাফ। গোপাল মাস্টার। এমনিতে পেশায় হোমিওপ্যাথি প্রাকটিস করেন। ওয়াগনের থুড়ি বুকিং অফিসে ঢোকার কোনো সহজ পথ নেই। ওয়াগনের দরজার দুটো পাল্লা শুধু বন্ধ করে চাবি লাগানো যায় আর সেটা খুলে প্রবেশ করা যায়। কিন্তু সে প্রবেশ গোপাল মাস্টার নিজের স্টাইলেই করতেন। পিলারের কোণাতে এক পা রেখে পুরো ঘোড়ায় চাপার ভঙ্গিতে একটা ঠ্যাং জিমন্যাস্টিকদের দক্ষতায় অন্য পায়ের সমকৌণিক ডিগ্রীতে ওয়াগনের ভিতর পা-টি স্থাপনা করার পর  আবার একই দক্ষতায় অন্য পা-টিকেও যথাস্থানে স্থাপন করার পর, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই টিকিট বুকিং-এর কাজ চালু করে দেন। কারণ সাধারণত ট্রেনটি আপ-লাইনে পলাশথলির দিকে চলে যাবার পর ঠিক দু-ঘন্টা পর হজরতপুর হল্ট-এ ফিরে আসে। আর ঠিক তার ১৫ মিনিট আগে ওয়াগনে পৌঁছে বুকিং কার্যটি সমাধা করেন। অসাধারণ কর্মদক্ষতা। তারপর আবার টিকিট চেকারের কাজটা উনার দায়িত্ব। ট্রেনের টাইম শিডিউল সারাদিনে চারবার। দুবার সকালে, সকাল ৭টার সময় আপে, সকাল ৯টায় ডাউনে। ব্যাস। সারাদিনে আর দেখা নেই। আবার আসবে সেই সন্ধ্যে ৭টায় আর ফেরা রাত্রি ৯টায়। যদিও পোশাকি নাম পান্ডবেশ্বর-পলাশথলি (PP) কিন্তু লোকের মুখে মুখে এই ট্রেনের নাম ‘সাট্টার টেন- ন’টার টেন’। এমন আশ্চর্যের ট্রেন ভূভারতে আর দুটি আছে কিনা সন্দেহ। তখন বৃটিশ আমলে, সবার হাতে হাতে এমন হাতঘড়ির চল ছিলনা। তখন তা ছিল এক মহার্ঘ বস্তু। বিয়েতে নতুন জামাইকে তিনটি মহার্ঘ  জিনিষ দেওয়ার চল ছিল, তা হলো- একটি সোনার আংটি, একটি ঘড়ি এবং একটি সাইকেল। খুব অর্থবান শ্বশুর হ’লে একটি রেডিও জুটে যাওয়া অসম্ভব ছিলনা। তবে এই তিনটি জিনিষ দিতেই হত। তাই সে সময় পান্ডবেশ্বর-পলাশথলির এই ‘সাট্টার ট্রেন- ন’টার ট্রেন সময়ের নিয়ামক হয়ে উঠেছিল। কিছু কমন বাক্যবন্ধ লোকমুখে শোনা যেত –

 

            মা -       (ছেলের প্রতি)- আর কত ঘুমুবি ? উঠ এইবার। দাঁত মেজে আয়। ‘সাট্টার ট্যান’ পেরিঞ গেলো।‘

            মা -       (স্বামীর প্রতি)- মুড়ি খেঁয়ে লাও, ‘ন-টার ট্যান’ পেরিঞ গেল। (ছেলের প্রতি)- ‘ ন’টার ট্যান যে

                    পেরিঞ গেলো, সি খিয়াল আছে ? হাট-কে যারে, ঘরে কুনু আনাজ নাই। রান্না করব কিসে ?’

          বাবা-    (ছেলের প্রতি) – হ্যাঁ রে, সাট্টার ট্যান পাশ হঞ গ্যালো, পইত্তে (পড়তে) বসবি কখন ?’            

          বাবা-     (মা-কে) ভাত হলো ? ন’টার ট্যান যে পেরিঞ গেলো ! খিদে লেগে গেইছে। যা হঁইছে তাই 

                     দাও দিকিনি। আর লারছি।

এই ট্রেনটি নিয়ে একটি বাস্তব রসিকতা খুব জনপ্রিয়। লোকমুখে ঘোরে। একদিন সকালে একটি কিশোর বালক ৭-টার ট্রেন ধরে কোথাও যাবে। তার সন্দেহ, সে বোধহয় একটু দেরি করে ফেলেছে। তাই গাঁয়ের কুলিতে দৌড়তে শুরু করেছে। এমন সময় ছেলেটি দেখল প্রবীন পঞ্চাকাকা উলটো দিক থেকে আসছে। সে পঞ্চাকাকাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে জিজ্ঞেস করল-

 

 -পঞ্চাকাকা পঞ্চাকাকা, হ্যাঁ গ, সাট্টার ট্যান-ট ক’টার সুময় ?’  

 প্রবীণ পঞ্চাকাকা রসিক মানুষ বলে খ্যাতি আছে।

 বললেন -‘হ্যাঁ বাবা, সাট্টার ট্যান-ট যে সাট্টার সুময়।‘ বলেই ঠোঁটের কোণে কৌতুকের হাসি।

 কিশোরটি আবার জিজ্ঞেস করল উতলা হয়ে - ‘হ্যাঁ গ, পাব ?’

 পঞ্চাকাকা – ‘পেলে পেঁয়ে যাবে বাবু। কিন্তু পাশ হঁয়ে গেলে ত পাবে না বাপু।‘- পঞ্চাকাকার সরস জবাব।

 

কিশোর বালকটি সেই কাংক্ষিত সাট্টার টেন পেয়েছিল কিনা জানা নেই কিন্তু এই ট্রেনটি নিয়ে এমন মজার মজার বহু গল্প লোকগাথা হয়ে রয়েছে। সে ট্রেনলাইন এখনো রয়েছে, কিন্তু ট্রেন সার্ভিস সাময়িকভাবে বন্ধ করা আছে।

 

ক্রমশঃ হাট-বসা মাঠের পাশ দিয়ে সোজা এগিয়ে হজরতপুর গ্রামকে ডানদিকে রেখে এগিয়ে চললাম। এখন দিনের আলো, দিনের আলোর মতই পরিষ্কার। দূরে দেখা যাচ্ছে পরবর্তী গ্রাম – রসাগ্রাম। এখানে আগে ব্যক্তিগত মালিকানায় এক উচ্চমানের কয়লার খনি ছিল। এখন তা বন্ধ হয়ে আছে বহুদিন। তার চিমনি, ম্যানেজারের বাংলো এখনো রাস্তার পাশে  বিদ্যমান- অতীতের সাক্ষী নিয়ে। বাঁদিকে বড় একটি আমবাগান। পাশেই একটি ফুটবল মাঠ। এই মাঠটিকে দেখে এক টুকরো সোনালি অতীত সামনে ভেসে উঠলো। আমি যখন ফুটবল খেলতাম, এই মাঠে একাধিকবার আমাদের গ্রামের হয়ে শিল্ড টুর্নামেন্ট খেলে গেছি। আমার সমসাময়িক যে ফুটবলার বন্ধুদের সঙ্গে দুর্গাপুর ফার্স্ট ডিভিশন লিগে খেলতাম, তাদের নিয়ে এসে খেলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে শিল্ড জিতে ফিরেছি। সে সময় ফুটবল নিয়ে কি না উন্মাদনা ছিল। আমার সঙ্গে খেলতে আসা প্লেয়ারদের সে কি সম্মান আর তেমনি তাদের জন্য ভূরিভোজের আয়োজন। ভালো প্লেয়ার গ্রামবাসীদের কাছে দেবতার আসন পেত। তখন গাড়ির এত চল ছিল না কিন্তু গরুর গাড়ির তো অভাব ছিল না। একবার মনে আছে, নাকড়াকোন্দায় একটি ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে আমার সঙ্গে ১২ জন প্লেয়ার এসেছিল। মাঠ ৫-৬ কিলোমিটার দূরত্ব। চার-চারটে গরুর গাড়ি চলল। পাশে পাশে মনে হল গোটা গ্রামই চলল গরুর গাড়ির সঙ্গে। একটা রিয়েল যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব প্রতিটি লোকের মনে জারিত হয়ে গেছিল ঐ গরুর-গাড়ির সফরনামায়। সবাই কি গগনভেদী চিৎকার। ‘হায়ারড’ প্লেয়াররা কি যে মজা পেয়েছিল। এমন অভিজ্ঞতা ওদের আগে কোনো গ্রামে খেলতে গিয়ে হয়নি। একটাও পুরুষমানুষ সেদিন গ্রামে ছিলনা। সেই ম্যাচ আমরা জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। শীল্ড জিতেছিলাম। তাই ফিরতে একটু দেরি হয়েছিল। গ্রামে ফিরে শুনি, গ্রামের দুটি বাড়িতে এই সুযোগে ডাকাতি হয়ে গেছে। সেসব দিনের স্মৃতি আজো মণিকোঠায় উজ্জ্বল।            

                                                           

 

ক্রমশ...


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন