উড়ে যায় অ্যালবাট্রস
অলৌকিক হাতখানি কোথায় রেখেছ?
প্রসারিত এই মুঠিতলে শুধু
হাওয়া, বালি; আর
বুকের ভিতরে ছল্ছল্ করে ওঠে গাঢ় জল –
উদ্ভ্রান্ত নাবিক;
মাথার উপরে উড়ে যায় অ্যালবাট্রস
––– যা তোমার হাত! (হাত, ও আমার সর্বনাশ, ও আমার সর্বস্ব : ১৯৯০)
‘অ্যালবাট্রস’ নামের এই বিদেশি পাখির সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। বাবার লেখা এই আদ্যন্ত প্রেমের কাব্য যখন প্রকাশিত হয় আমি তখন সাত বছরের বালক। কিন্তু কী এই পাখিটির পরিচয়? বাবার কাছে সেই প্রশ্ন করে জেনেছিলাম ইংরেজি কবি কোলরিজের ‘বুড়ো নাবিকের উপকথা’র গল্প। আসলে সেই বয়সে কোলরিজের কবি পরিচিতির চেয়ে তাঁর কবিতার ভিতরে থাকা অলৌকিক গল্প সে ‘ক্রিস্টাবেল’ হোক কিংবা ‘অ্যানসিয়েন্ট মেরিনার’ অনেক বেশি আকর্ষক ছিলো। সমুদ্রযাত্রায় সুলক্ষণের পাখি অ্যালবাট্রসকে অকৃতজ্ঞ নাবিক মেরে ফেলার পর তার অভিশাপ কীভাবে নাবিকদের উপর নেমে এসেছিলো তাদের যাত্রাপথে, সেই অলৌকিক গল্প সরল বিস্ময়ে শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম। ঐ হাত আর অ্যালবাট্রস কীভাবে প্রেমের হাতছানির মতো একসূত্রে গাঁথা, তা বুঝতে অনেকদিন সময় লেগেছিলো। তবে আরেকটু বড়ো হয়ে ইংরেজির শিক্ষক বড়পিসেমশাইয়ের কাছে জেনেছিলাম কোলরিজের ঐ ঈশ্বরীয় পংক্তিমালা :
He prayeth best who loveth best
All things both great and small;
For the dear God, who loveth us,
He made and loveth all.
(‘সকলের চেয়ে প্রিয়দর্শীর প্রার্থনা সার্থক, / ভালোবেসে যেবা ক্ষুদ্র ও মহীয়ান, / আমাদের ভালোবাসেন দয়াল প্রভু / সবার স্রষ্টা সকলের ’পরে টান’ – ভাষান্তর : অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত)
আমার কোলরিজের এ-কাব্য পাঠ অলোকরঞ্জনের দ্বিভাষিক ‘বুড়ো নাবিকের উপকথা’ সূত্রেই। কাব্যটির উৎসে রয়েছে বন্ধু ওয়ার্ডসোয়র্থের কাছে শোনা উত্তর মেরুতে সংঘটিত এক অভিশাপের বৃত্তান্ত, এক প্রবীণ নাবিক বিনা কারণেই একটি অ্যালবাট্রসকে গুলি করে মারার পর কী করে গোটা জাহাজটার উপর অকূল দুর্ভাগ্য নেমে এসেছিল। বিশাল ডানার সিন্ধুসারস অ্যালবাট্রস নাবিকদের কাছে যে সুলক্ষণ আর নিরাপদ যাত্রার সংকেত বয়ে আনে, এ-কবিতায় তাকে হত্যা করার পর কোলরিজ জীবন-মৃত্যুর দ্বন্দ্বকে দেখিয়েছেন। পরিণাম যদিও মানুষ-পশু-পাখি সকলের প্রতি সমান ভালোবাসার দিব্য উচ্চারণে। অতিপ্রাকৃত রসসিক্ত এ-কবিতায় একটি ভালো পাখিকে হত্যার পরিণামে যে-অভিশাপ নেমেছে, তা থেকে ঐ প্রাচীন নাবিকের মুক্তি ঘটেছে কঠিন প্রায়শ্চিত্ত শেষে। অ্যালবাট্রস পাখি যেন শুভবোধ আর প্রকৃতির মঙ্গলময়তার প্রতীকী রূপ আমাদের কাছে, যাকে অমান্য বামেঘলোকে যুবরাজ
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা জানায়, অ্যালবাট্রস যেমন দীর্ঘপথ আকাশপথে পাড়ি দেয় সহজেই, তেমনি সে নীড়বিলাসীও। এই সিন্ধুসারস জুটি সহজে পরস্পরকে ছেড়ে দিয়ে নতুন সঙ্গী বা সঙ্গিনী খোঁজে না। কোনো একজন অকালে মারা গেলে অপর অ্যালবাট্রস এক থেকে দু’বছর শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে একাই কাটিয়ে
দেয়। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিনফুট ডানা নিয়ে ওঠা ও নামায় তাদের সামান্য সমস্যা হয়, উড়ে বেড়াতেই ভালোবাসে তারা। আর ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যেই ভালো করে উড়তে পারে তারা। মন্দমধুর হাওয়ায় তারা ভেসে থাকে জলে। নাবিকদের দেওয়া খাবারের জন্য তারা জাহাজের সঙ্গী হয় প্রায়শই। অ্যালবাট্রসকে মারলে সমুদ্রযাত্রায় অমঙ্গল ঘটে এই কুসংস্কার সত্ত্বেও অনেক নাবিকই মাংস, পালক, ফাঁপা
হাড় দিয়ে তামাক খাওয়ার পাইপ ইত্যাদির লোভে অ্যালবাট্রসকে খাবার টোপ দিয়ে মেরে ফেলে। যাইহোক নানা প্রজাতির এই সিন্ধুসারস অ্যালবাট্রস আকাশেই সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ আর সুন্দর। তবুও মানুষের লোভ আর হিংসা তাকে বন্দি করেছে, মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। আর এই অনুষঙ্গে ফ্রান্সের বিখ্যাত কবি শার্ল বোদলেয়ারের ‘অ্যালবাট্রস’ (L’Albatros, 1859) কবিতাটি সাহিত্যপাঠকের মনে পড়বেই। তাঁর ‘ক্লেদজ কুসুম’ তথা ‘Les Fleurs du mal’ (1857) কাব্যের দ্বিতীয় সংস্করণের (১৮৬১) ‘বিতৃষ্ণা ও আদর্শ’ পর্যায়ের দ্বিতীয় কবিতা এটি। জানা যায়, এ-কবিতার পিছনে তাঁর ১৮৪১-এ ভারত মহাসাগর যাত্রার স্মৃতি কাজ করেছিলো, প্রকৃতি-সৌন্দর্য ও পাখিদের প্রতি বিশেষ অনুরাগ তখনই শুরু। বিশেষত পার্থিব বন্দিত্ব সুন্দরের দূতী খেচর পাখিদেরকে কুৎসিত করে, তাঁর চোখে তাই অ্যালবাট্রস ‘like exiles, both ridiculous and sublime’। তাই তাঁর কবিতায় দিগন্তের রাজা উড়ন্ত অ্যালবাট্রসকে নাবিকেরা বন্দি বানায় আর তাকে ঠোঁটে পাইপকাঠি
গুঁজে উৎপীড়ন করে এবং ভারি ডানা নিয়ে দুর্বল খুঁড়িয়ে হাঁটাকে নকল করে ভ্যাঙায়। এই মেঘলোকের যুবরাজের সঙ্গে বোদলেয়ার তুলনা করেছেন কবির, যিনি স্রষ্টারূপে আকাশচারী আর সমস্ত
বিরুদ্ধ আক্রমণ হেলায় তুচ্ছ করেন। কিন্তু ধুলোমাটির পৃথিবীতে জোর করে ধরে রাখা অ্যালবাট্রসের মতোই তিনি অবরুদ্ধ ‘মহান ডানার ভারে অবরুদ্ধ হয় তার চলা’। অ্যালবাট্রসের প্রতীকে বোদলেয়ার জনতার জঘন্য মিতালি আর কবির প্রার্থিত নির্জনতার দ্বন্দ্ব যেমন আঁকেন, তেমনি নাবিকেরা হয়ে ওঠে কবির নিষ্ঠুর ও নির্বোধ সমালোচকদের প্রতীক। ক্লেদ, মৃত্যু, হতাশা, গ্লানি আর পাপের ভিতরে যে-সুন্দরের ফুল ফোটাতে চান তিনি, অ্যালবাট্রসের প্রতীকে যেন সেই স্বপ্নচারী কবিসত্তারই পরিচয় ধরা পড়ে।
অনুবাদে নতুন উদ্ভাস
ফরাসি থেকে ইংরেজিতে বোদলেয়ার বহুবার অনূদিত হয়েছেন। সে-তুলনায় বাংলায় বোদ্লেয়ার অনূদিত হয়েছেন কম। নলিনীকান্ত গুপ্ত, শ্রীঅরবিন্দ, মোহিতলাল মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রণোদনা সত্ত্বেও বাঙালির বোদলেয়ার-চর্চায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাম বুদ্ধদেব বসু এবং তাঁর বিখ্যাত এবং বিতর্কিত বই ‘শার্ল বোদলেয়ার : তাঁর কবিতা’ (১৯৬১)। দীর্ঘ ভূমিকা, প্রাঞ্জল অনুবাদ, টীকাভাষ্য, কালপঞ্জি ও জীবনপঞ্জি মিলিয়ে এ-বই সমকালে যুগান্তর এনেছিল বলা চলে। এ-প্রসঙ্গে তাঁর একদা ছাত্র ও পরবর্তীকালে অধ্যাপক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা এইরকম :
শিল্প, আধুনিক জগতে শিল্পীর স্থান, শিল্পীর ভূমিকা ও স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয় প্রথম থেকেই বুদ্ধদেব বসুর রচনায় ছিলো ব’লেই বোদলেয়ারকে ‘আবিষ্কার করা’ তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো। অরুণ মিত্র প্রমুখ ফরাশিজানা অনুবাদকের চেয়েও বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ যে অধিকতর সার্থক, তার কারণ বুদ্ধদেব বসু বোদলেয়ারে দেখেছেন নিজেরই ভাবনার নিজেরই সন্ধানের প্রকাশ – তার ফলে বোদলেয়ারকে আত্মসাৎ বা স্বীকরণ করা, অনুবাদ-কবিতাকেও বাংলা ভাষার ভালো কবিতায় রূপান্তরিত করা, তাঁর পক্ষে অনেকের চেয়ে বেশি সম্ভব হয়েছে। যাঁরা ফরাশি জানেন, তাঁদের পক্ষে তর্ক তোলা সম্ভব যে অনেক ক্ষেত্রেই বুদ্ধদেব বসুর তরজমা আক্ষরিকভাবে মূল ফরাশির মতো নয়। কিন্তু কবিতার ভালো অনুবাদের প্রথম কৃত্য, যে-ভাষায় অনূদিত হচ্ছে সে-ভাষাতেও তাকে প্রথমত ও প্রধানত কবিতা হ’তে হবে – এবং ভালো অনুবাদ একটা গবেষণাকর্মের মতো, মূল কবির অভিপ্রায় তাতে নতুনভাবে আবিষ্কৃত হয়, পাওয়া যায় নতুন অন্তরাখ্যান, নতুন উদ্ভাস। বোদলেয়ার ও দস্তয়েভস্কি যেমনভাবে এডগার অ্যালান থেকে আবিষ্কার ও অনুবাদ করেছিলেন, বুদ্ধদেব বসুর বোদলেয়ার অনুবাদ একদিক থেকে সে-রকম অন্তঃস্বত্ত্ব ও ফলপ্রসূ একটি ঘটনা। মূলের মিলবিন্যাস, ছন্দোবৈচিত্র্য, স্তবকগঠন ইত্যাদির মধ্য দিয়েও বোদলেয়ারীয় আভাস দেবার চেষ্টা অত্যন্ত কার্যকরী হয়েছে। পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধ’রে অনবরত সংশোধন, পরিশোধন ও পরিমার্জনার দ্বারা বোদলেয়ারের অনুবাদককে তিনি বাংলা ভাষারই সম্পত্তি ক’রে তোলার চেষ্টা করেছেন।
(বাংলা কবিতা ও শার্ল বোদলেয়ার, আত্মহত্যার অধিকার ও অন্যান্য সনদ, ২০১২ : ৮৯-৯০)
বোদলেয়ারের ‘ক্লেদজ কুসুম’-এর প্রথম কবিতাতেই ‘পাঠকের প্রতি’ যে-নিবেদন জানিয়েছেন কবি, তার মূল সুর যেন ধরা পড়ে এই একটি স্তবকে :
বীভৎসে বাঁধে রমণীয় নির্বন্ধে,
ত্রিগুণমায়াবী শয়তান, তন্নিষ্ঠ;
সে-বিজ্ঞানীর বিদ্যায় হয় পিষ্ট
কোনো খাঁটি সোনা থাকে যদি সংকল্পে।
(‘It is the Devil who pulls the strings that move us! / In repulsive objects we find enticing lures; / Each day we go down one more step toward Hell, / Without horror, through the darkness which smells rank.’
– translated by Wallace Fowlie)
এই বীভৎসকে রমণীয় করে তোলাতেই কি বোদলেয়ারের সার্থকতা? এ-প্রসঙ্গে ফরাসিজানা অরুণ মিত্র প্রমুখ বলবেন, মূল কবিতা ‘Au Lecteur’-এর অনুসরণ করলে কবিতাটি দাঁড়াবে এইরকম :
শয়তানই তো ধরে থাকে সুতো যা নাড়ায় আমাদের,
জঘন্য সে-সব বস্তু, মনোহর দেখি সেগুলিকে,
প্রতিদিন নামি আমরা ক্রমে ক্রমে নরকের দিকে
অসন্ত্রাসে পুতিগন্ধ অন্ধকারে নামি, পাই না টের।
এ-অনুবাদের বাচনশৈলী অনেকবেশি সরল ও প্রায় বোদলেয়ারীয় হলেও বুদ্ধদেবের অনুসৃজন ‘বীভৎসে বাঁধি রমণীয় নির্বন্ধে’ বাঙালি হৃদয়ে দোলা দেয়। বোদলেয়ারের কবিতারাই যেন ঐ বীভৎস ও রমণীয় – এই দুই সূত্রে বাঁধা পড়ে। এই প্রারম্ভিক কবিতা পার করে আমরা যখন ‘বিতৃষ্ণা ও আদর্শ’ পর্বে প্রবেশ করি, দেখা মেলে অ্যালবাট্রসের। বুদ্ধদেব বসুর পরে দেবকুমার গঙ্গোপাধ্যায় এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমরা এই কবিতা অনুবাদ করতে দেখি। প্রতিটি অনুবাদেই ‘মেঘলোকে যুবরাজ’ ঐ অ্যালবাট্রসকে নাবিকদের খেলার জন্য বন্দি করে উৎপীড়ন কিংবা ব্যঙ্গ করার ছবিটি নিখুঁতভাবেই পাই। আসলে এ-কবিতায় বোদলেয়ার ঐ পাখির প্রতীকে কবিসত্তার পরিচয় ধরে দিয়েছেন, তা আমরা আগেই বলেছি। শব্দচয়নে বুদ্ধদেবের যে-তৎসম প্রীতি তা বাকিদের নেই। মূল ফরাসি ও একটি ইংরেজি তরজমার পরে তিনটি বাংলা অনুবাদ ক্রমান্বয়ে রাখলে ঐ তফাত সহজেই চোখে পড়ে :
Charles Baudelaire (Original French) |
Le Poète est semblable au prince des nuées |
Wallace Fowlie (Eng.translation, 1992) |
The Poet is like the prince of the clouds, Who haunts the tempest and mocks the archer; Exiled on the earth in the midst of the derision, His giant wings keep him from walking.
|
বুদ্ধদেব বসু (বঙ্গানুবাদ : ১৯৫২/৫৮) |
- মেঘলোকে যুবরাজ! এইমতো, কবিও হেলায় তুফানে ঝাপট দেয়, ব্যর্থ করে কিরাতের ফলা; কিন্তু এই মৃত্তিকার নির্বাসনে, উল্লোল মেলায় মহান ডানার ভারে অবরুদ্ধ হয় তার চলা। |
দেবকুমার গঙ্গোপাধ্যায় (বঙ্গানুবাদ, ১৯৯২) |
আলবাট্রসের মতো কবিও তো এক মেঘরাজ; তীর ও গুলি ঘৃণ্য ক’রে দু’ডানায় ঝড়ের আসন আজ এই পৃথিবীতে মানুষের ব্যবহারে তিনি অবরুদ্ধ; বিশাল ডানার ভারে তাঁর নির্বাসন। |
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (বঙ্গানুবাদ, ১৯৯১) |
কবিও ঠিক যেন এই মেঘের যুবরাজের মতন ঝড়ের সঙ্গে অনবরত ঘোরে, তীরন্দাজদের উপহাস করে নির্বাসিত হয়ে আসে পৃথিবীতে, চতুর্দিকে ধিক্কার-বিদ্রূপ প্রকাণ্ড দুটি ছড়ানো ডানার জন্য সে হাঁটতে পারে না। |
আমাদের দীপ্ত মহিমার
অর্থ, কীর্তি, সচ্ছলতা, ঈশ্বর কিংবা আত্মিক সম্পর্ককে গৌণ করে বোদলেয়ারের কবিতা সুন্দরকে খুঁজতে চেয়েছে। চলিষ্ণু মেঘের প্রতি তাঁর নিবিড় ভালোবাসা : ‘আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল’। অ্যালবাট্রসও ঐ মেঘেদের যুবরাজ (prince des nuées), বোদলেয়ার মানেন কবির স্থান ওখানেই। পাপ আর রুগ্নতার কবিতা লিখেও আসলে তো তিনি রোম্যান্টিক কবি-ই। ‘অমৃতের দিব্য প্রতিমা’কে-ই তিনি ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’ করতে চান। ওয়ার্ডসোয়র্থের স্কাইলার্ক যেখানে স্বাধীনচারী হয়ে আকাশ ও নীড় দুই-ই ভালোবাসে; সেখানে নির্বোধ জাহাজীদের হাতে তাঁর অ্যালবাট্রসের করুণ পরিণাম আধুনিকতার গ্লানিকেই ইঙ্গিত করেছে। রোগ-পাপ-মৃত্যুকে চরম সত্য জেনেও তাঁর কবিতা অন্ধকারের রাজত্বকে শ্রেয় মনে করেনি; বরং মৃত্যুর ভিতরেও অমৃতের আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে রেখেছে : ‘অন্ধকার আকাশ ও সমুদ্রের নীচে রয়ে গেছে / আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র – তার দীপ্তিময় মাত্রা।’ (ভ্রমণ, দেবকুমার গঙ্গোপাধ্যায় অনূদিত)। ‘আলোকস্তম্ভ’ কবিতায় মানুষের ‘দীপ্ত মহিমা’ আর ‘অবশেষে লীন হতে অসীমের সৈকতে তোমার’ উচ্চারণ পাই, তাও কিন্তু বোদলেয়ারেরই। বুদ্ধদেব বসু তাঁর একটি স্বল্পালোচিত তুলনামূলক প্রবন্ধে লিখেছিলেন :
…Suffering such as theirs is spiritual, though sometimes externalised in poverty or disease. It would be easy to show that in the modern age, despite or because of its so-called materialism, literature and the arts have acquired a new soul. What has happened? Suffering has invaded them, and made them profoundly spiritual, whether in the conception of love, or beauty, or man. And of this there are no examples nobler than the works of Dostoyevsky and Baudelaire.
(Twins in Suffering: Dostoyevsky and Baudelaire, JJCL,Vol.I, 1959)
‘অ্যালবাট্রস’ কবিতাতে বিনা কারণে নিরপরাধ ঐ সিন্ধুসারসকে যেভাবে দুর্দশাভোগ করতে দেখি আমরা, তা যেন হিসেবী ও হৃদয়হীন সময়ে প্রতিটি সংবেদী মানুষেরই নিত্য দুর্দশাগ্রস্ত জীবনেরই চেনা ছবি। বোদেলেয়ারের ‘প্যাঁচারা’ যেভাবে অন্ধকারের অপেক্ষায় ‘নিথর তারা অসাড় হয়ে কাটায়’, অ্যালবাট্রস সেইভাবে ছায়ার মোহে পাগল নয়, সে তো সুদূর পথের সঙ্গী, নীলিমার সম্রাট। তার আকাশজোড়া বিশাল ডানার শোভার তুলনামেলা ভার, তবু তাকে পীড়িত করে নাবিকেরা ‘বিরাট, করুণ, শুভ্র ডানা তার, ক্ষুব্ধ নিপাতনে / নাড়ে, যেন দাঁড়-ভাঙা, অসহায়, সন্ত্রস্ত তরণী’। আমাদের জীবনানন্দকে এই অবসরে বারবার মনে পড়বেই :
দু-এক মুহূর্ত শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি
হে সিন্ধুসারস,
মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতি দূর তরঙ্গের জানালায় নামি
নাচিতেছ টারান্টেলা— রহস্যের; আমি এই সমুদ্রের পারে চুপে থামি
চেয়ে দেখি বরফের মতো শাদা ডানা-দুটি আকাশের গায়
ধবল ফেনার মতো নেচে উঠে পৃথিবীরে আনন্দ জানায়। (সিন্ধুসারস, মহাপৃথিবী : ১৯৪৪)
আনন্দিত সিন্ধুসারসের বিপরীতে জীবনানন্দ মানবজীবনের যে গহন ক্ষতির ছবি আঁকেন, সৌন্দর্যগ্রাসী অন্ধকার ক্ষুধার বিবরের কথা বলে প্রশ্নাতুর হন ‘বেদনার আমরা সন্তান’? বোদলেয়ারের অ্যালবাট্রসে ততখানি আর্তি নেই যেন। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘ঝড়ের পাখি’র বিপ্লবী গানও সে রচনা করেনি, অথচ তারও আছে তীরন্দাজদের উপহাস করার ক্ষমতা আর ‘দু’ডানায় ঝড়ের আসন’। আবার আরেকটি বিখ্যাত বাংলা কবিতা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কলঘরে চিলের কান্না’য় গগনবিহারী চিলের অসহায় দশা তথা কাপুরুষ মস্তানদের হাতে ঊর্ধ্বচারী মানুষের লাঞ্ছনার যে-ছবি আমরা দেখি, সেখানেও কবি জানান ‘লাঞ্ছনা ও নিগ্রহের ফলে / মানুষের দীপ্তি ও মহিমা আরো বেড়ে যায়’। অতএব চারটি স্তবক জুড়ে ‘অ্যালবাট্রস’-এর গতি ও স্থিতির যে-বিপরীত ছবি বারংবার রচিত হয়, তার কেন্দ্রে থাকে অসীম ক্ষমতাবান একটি পাখির স্বার্থপর মানুষের হাতে বন্দিত্ব, লাঞ্ছনা, নির্বাসন আর অবরুদ্ধ চলা তথা অনভিপ্রেত দুর্দশাভোগ। আবার ইকোক্রিটিকের চোখ দিয়ে দেখলেও এ-কবিতা পথের বন্ধু পাখির প্রতি শিকারী মানুষের নিষ্ঠুরতার চেনা ছবি, যা আসলে উপকারী প্রকৃতিকে খেয়ালখুশি মতো শাসন ও শোষণের চিহ্ন স্পষ্টতই বহন করেছে। লক্ষণীয়, কোলরিজের বুড়ো নাবিকের অ্যালবাট্রস হত্যার পর প্রকৃতির প্রতিশোধ ও শাস্তির পথ পেরিয়ে যে-ইতিবাচক পরিণাম পেয়েছিলাম আমরা, বোদলেয়ারের কবিতায় নেই তেমন কোনো শুশ্রূষা, অনুতাপ আর খ্রিস্টীয় ক্ষমা। বরং বোদলেয়ারের নাবিকদের পাখিটিকে ক্রমিক উৎপীড়নের যে নির্মম-অসহায় আলেখ্য রচিত হয়, তা’ অনিবার্যভাবেই আধুনিক যুগের অবক্ষয় আর ধ্বংসোন্মুখ সভ্যতাকে চিহ্নিত করে। ঐ অবক্ষয় বা ডেকাডেন্স থেকে প্রতীকযানে উত্তরণের নানা চিহ্ন তাঁর অন্যান্য কবিতায় (যেমন : প্রতিষঙ্গ, আলোকস্তম্ভ, ভ্রমণ ইত্যাদি) সমালোচকেরা যদিও খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু বারবার কবি ফিরে গেছেন নরকের দরজায়, গভীর নৈরাশ্যের দিকে। তাঁর ‘ইকারুস-বিলাপ’ কবিতাতেও রয়েছে এক গহন আত্মবিলাপ :
বিরাট শূন্যে বৃথাই দিয়েছি হানা
প্রান্তে, কেন্দ্রে, সবল কৌতূহলে;
জানি না সে কোন আগুন-চোখের তলে
বিচূর্ণ হলো আমার মত্ত ডানা। (বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ)
অ্যালবাট্রস আর পুরাণকথার ইকারুসের কাহিনিতে তেমন সাদৃশ্য নেই। যদিও মেঘপ্রেমিক কবি তথা মেঘলোকের যুবরাজ অ্যালাবাট্রসের ডানা বন্দিত্বের চাপে অক্ষম হয়েছে সুন্দর-অভিলাষী ইকারুসের মতোই। তবু বন্দি অ্যালবাট্রসের একদা আকাশচারিতার ছবি উজ্জ্বল রঙে প্রতিটি স্তবকে এঁকে বোদলেয়ার কবিসত্তার ‘দীপ্ত মহিমার’ ইঙ্গিত দেননি কি?
ঋণস্বীকার
আকর গ্রন্থ
১) শার্ল বোদলেয়ার : তাঁর কবিতা। অনুবাদ-ভূমিকা-টীকা-কালপঞ্জি-জীবনীপঞ্জি : বুদ্ধদেব বসু। নাভানা, ১৯৬১
২) বোদলেয়ার ও র্যাঁবোর কবিতা। অনুবাদ : দেবকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ভাষাপৃথিবী, ১৯৯২
৩) ছবির দেশে, কবিতার দেশে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আনন্দ পাবলিশার্স, অষ্টম মুদ্রণ ২০০৮
৪) বুড়ো নাবিকের উপকথা। স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ভাষান্তরিত। থীমা, ২০০৭
৫) জীবনানন্দ দাশের কাব্যসমগ্র। সম্পাদনা : দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। দে’জ, ২০১৫
৬) ও আমার সর্বনাশ ও আমার সর্বস্ব। তরুণ মুখোপাধ্যায়। গোধূলিমন প্রকাশনী, ১৯৯০
৬) The Flowers of Evil & Paris Spleen (Selected Poems), Charles Baudelaire (Translated by Wallace Fowlie), Dover Thrift Editions, 2010
৭) An Acre of Green Grass and other English Writings, Buddhadev Bose, Edited by Roshinka Chowdhury, Oxford University Press, 2018
সহায়ক গ্রন্থ/পত্রিকা / ওয়েবসাইট
১) শার্ল বোদলেয়ার : অনন্য দ্রষ্টা। সুরভি বন্দ্যোপাধ্যায়। দে’জ পাবলিশিং, ১৯৯২
২) আত্মহত্যার অধিকার এবং অন্যান্য সনদ। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিভাস, ২০১২
৩) দূরের বই। চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৯
৪) কবি বোদলেয়ার। তরুণ মুখোপাধ্যায়। সারঙ্গ প্রকাশনী, ২০২১
৫) তর্জমার জমা খরচ। রাজীব চৌধুরী। স্পার্ক, ২০২০
৬) The Symbolist Movement in Literature, Arthur Symons and Richard Ellamann, ABS Publishers, Reprint 2006
৭) Baudelaire : A Study of his Poetry, Martin Turnell, Hamish Hamilton, London, 1953
৮) Ecocriticism in British Romantic Studies, Kevin Hutchings, Literature Compass (PDF)
৯) দেশ : চিরায়মান (বোদল্যের, দস্তইয়েভস্কি, ফ্লব্যের, প্রুস্ত)। ২ ডিসেম্বর, ২০২১
১০) fleursdumal.org
১২) এছাড়াও উইকিপিডিয়া ও গুগল বুক্স্ থেকে কিছু তথ্য পেয়েছি।
পাঠক-পাঠিকাদের সুবিধার্থে ‘L’Albatros’ কবিতাটির মূল ফরাসি এবং একটি ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদ তুলে দিলাম :
L'Albatros
Souvent, pour s'amuser, les hommes d'équipage
Prennent des albatros, vastes oiseaux des mers,
Qui suivent, indolents compagnons de voyage,
Le navire glissant sur les gouffres amers.
À peine les ont-ils déposés sur les planches,
Que ces rois de l'azur, maladroits et honteux,
Laissent piteusement leurs grandes ailes blanches
Comme des avirons traîner à côté d'eux.
Ce voyageur ailé, comme il est gauche et veule!
Lui, naguère si beau, qu'il est comique et laid!
L'un agace son bec avec un brûle-gueule,
L'autre mime, en boitant, l'infirme qui volait!
Le Poète est semblable au prince des nuées
Qui hante la tempête et se rit de l'archer;
Exilé sur le sol au milieu des huées,
Ses ailes de géant l'empêchent de marcher
(Charles Baudelaire : 1859)
The Albatross
Often, as an amusement, crewman
Catch albatrosses, huge birds of the sea,
Who follow, indolent, compassions of the voyage,
The ship gliding over the salty deeps.
As soon as they have placed them on the deck,
These kings of the sky, awkward and ashamed,
Pitiably let their large white wings
Drag at their sides like oars.
This winged voyage, how gauche and weak he is!
Once so handsome, how comic and ugly he is!
One sailor irritates his beak with a pipestem,
Another mimes, as he limps, the invalid who once flew!
The Poet is like the prince of the clouds,
Who haunts the tempest and mocks the archer;
Exiled on the earth in the midst of the derision,
His giant wings keep him from walking.
(tr. Wallace Fowlie : 1992)
আলবাট্রস
ধীরে-ধীরে সে যখন ক্লান্তিকর খাঁড়ির ভেতরে
উড়ে যায় – তখন অলস সব নাবিকেরা ধরে
আলবাট্রস; সে তো সূদূর পথের চিরসঙ্গী,
সুবিশাল পক্ষিরাজ, জাহাজের আগে-আগে ওড়ে।
দিগন্তের সেই রাজা এখন ঝিমিয়ে প’ড়ে আছে
ডেকের নিস্তব্ধ কোণে, পাটাতনে, লজ্জায় বিহ্বল;
সাদা ও বিশাল ডানা অতি শোচনীয় – যেন নৌকা
দাঁড় ভেঙে থেমে গেছে, হারিয়ে ফেলেছে সব বল।
কি দুর্বল এখন আকাশচারী! কতো ভালো ছিল!
এখন কি বিশ্রী – যেন সঙের মতোন মুখপোড়া!
ছড়ির আঘাত করলো তার ঠোঁটে একজন নাবিক,
বিদ্রূপে আরেকজন তার সামনে ভান করো খোঁড়া।
আলবাট্রসের মতো কবিও তো এক মেঘরাজ;
তীর ও গুলি ঘৃণ্য ক’রে দু’ডানায় ঝড়ের আসন
আজ এই পৃথিবীতে মানুষের ব্যবহারে তিনি
অবরুদ্ধ; বিশাল ডানার ভারে তাঁর নির্বাসন।
(অনু. দেবকুমার গঙ্গোপাধ্যায় : ১৯৯২)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন