শনিবার, ১ অক্টোবর, ২০২২

ঊর্মিলা চক্রবর্তী-র ধারাবাহিক গদ্য : "এসেছো কবিতা"

এসেছো কবিতা

এইসময়ের এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা পাঁঠাবলি দেখতে যাওয়া। একদিন পাড়ায় কোন বাড়িতে কালীপুজো হবেসেখানে পাঁঠাবলি হবে। আমাদের বাড়ি মনুসংহিতা আওড়ানো কট্টর শাক্ত বাড়িপুরোনো ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী। সুতরাং আমরা চিরদিন শুনেছি কালীপুজোর বিশেষ অঙ্গ পাঁঠাবলি। দুই ভাইবোন তো দারুণ উৎসাহ নিয়ে দেখতে গেছি। যদ্দূর মনে হয় তখন আমাদের দুজনের বয়স ছয় আর চার। সে কি ভিড়ঢাক-কাঁসির শব্দে কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়। অনেক চেষ্টায় ভিড় গলে ভিতরের লাইনে আসা গেল। সেখানে এসেই বিপত্তি। কথায় বলে ‘বলির পাঁঠার মতো কাঁপা’, কিন্তু সেকথা তো পরে শুনেছি। সেই প্রথম চোখে দেখলাম বলির পাঁঠা। এক্কেবারে ছোট্ট একটা পাঁঠাগলায় জবাফুলের মালাসিঁদূরে লেপা তার মাথা। সে কি করুণঅসহায় তার চোখআতঙ্কে বিস্ফাড়িতআর তার সে কি থরথর করে কাঁপাতাকে ঘিরে মানুষের কি উল্লাসভাইয়ের হাত ধরে আমি তো দে ছুট। বাড়ি এসেও ভুলতে পারিনা সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য। একটু বড় হয়ে ‘রাজর্ষি’ পড়ে তাই খুব অন্যরকম ভালো লেগেছিল। কিন্তু বাবা খুব রেগে গেছিলেন আমাদের হৃদয়দৌর্বল্যে। বাবার চিরদিনের ইচ্ছে ছিল বাড়িতে কালীপুজো করবেনকিন্তু আমাদের দু-ভাইবোনের একই কথাবাড়িতে বলি দেওয়া চলবে না। কিন্তু বাবা পাঁঠাবলি ছাড়া কালীপুজোর কথা চিন্তাও করতে পারতেন না। সেই জন্য আমাদের বাড়িতে কোনওদিন কালীপুজোই হয় নি। বাবাকে দেখেছিপুরোনো ধারণার কঠিনপ্রাণ ব্রাহ্মণ। তাই জানি রঘুপতির চরিত্র কতটা বাস্তব।

 

লিখতে বসে একটা ঘটনা মনে পড়ছেআর তাতে মনে হচ্ছে যে আমি খুব একটা নরমসরম মেয়ে ছিলাম না। বাড়িতে স্নেহ ছিল নাতাই এমনিতে খুব বাধ্যশান্ত ছিলাম। কিন্তু আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে প্রতিবাদ জাগত মনে। আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা বাগানে খুব বড় একটা শিউলিগাছ ছিল। বেড়ার বাইরে পায়ে চলা রাস্তায় অজস্র শিউলি ঝরে পড়ে থাকত। সেই ফুল তুলে আনলে কারোর কিছু বলার থাকতে পারেনাতাই আমি রোজ সকালে কোঁচড় ভরে ফুল তুলে 

আনতাম। কেন জানিনাসেটুকুও সে বাড়ির লোকেদের গায়ে লাগল। হঠাৎ একদিন আমি যখন ফুল কুড়োচ্ছি তখন এক মহিলা আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলে উঠলেনএই 

মেয়েটা রোজ সকালে ফুল চুরি করে নিয়ে যায়। কথাটা  একান্ত মিথ্যা হলেও প্রতিবাদ করার কথা ভাবিনিকিন্তু আমি সঙ্গে সঙ্গে কোঁচড়ের সব ফুল ফেলে দিয়ে চলে এসেছিলাম। অতটুকু মেয়ের এই আচরণে মহিলা প্রচন্ড রেগে গেছিলেন। তখনকার দিনের মানদন্ডে পাড়ার কাকিমার সঙ্গে এই ব্যবহার ঔদ্ধত্যের পর্যায়েই পড়ত।

 

এইসময়ের দুটো ব্যাপার মনে আছে। একটা বোধহয় যেকোন ছোট মেয়ের বেড়ে ওঠার সময়ের নেহা সাধারণ সাধকিন্তু আমার পক্ষে তার তীব্রতা হয়ত ছিল কিছু বেশি। সে হল নাচবার শখ। পাড়ার মেয়েরা একটু আধটু হয়ত শিখততারা হাত ঘুরিয়ে তালে তালে পা ফেলে নানা গানের সঙ্গে অঙ্গভঙ্গী মিলিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচত। আমার ভেতরে তাই দেখে কি যেন হত। কি এক ছন্দের দোলা লাগত মনেসুরের সঙ্গে দেহছন্দ মিলে এনে দিত কোন এক মোহ যা আমি একটুও বুঝতাম না। কি গভীর এক আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিল মনে যে আমি নাচ শিখব। আজও মনে আছে সে কি প্রচন্ড কষ্ট হয়েছিল মনে যখন জানলাম মা কিছুতেই এই শখ পূরণ করতে দেবেন না। তার বদলে প্রথমে আমার গানের গলা নেইসুরবোধ নেই এই কথা বলে সেতার কিনে মাস্টার রাখা হল (জানিনা সুরবোধ না থাকলে সেতার শেখা যায় কেমন করে) কিন্তু আমার ওই একটা জিনিষ কিছুতেই ভালো লাগল না। তার পিছনে অবশ্য সেতারের মাস্টারমশাইয়ের অবদান কম ছিল না। যাইহোক আমার এত অনিচ্ছায় বেশিদিন সেতার শিখতে হয়নি কারণ একটুও এগুচ্ছে না দেখে মাস্টারমশাই রাগ করে ছেড়ে দিলেন।

 

এবার অগত্যা গানের মাস্টার রাখা হল। দশ টাকা মাইনের ছাপোষা এক ভদ্রলোক। নাম ছিল চিত্তবাবু। খুব ভা্লোমানুষ ছিলেন তিনি। দারুণ ভালো লাগত তাঁকে। কি দিন ছিল তখন। এই চাকরিটুকু রাখবার জন্য তিনি কত ভয়ে ভয়ে থাকতেন আমিও বুঝতে পারতাম। পরে তাঁর টি,বি হয়েছে শুনে তাঁকে যেদিন ছাড়িয়ে দেওয়া হল তখন তাঁর সেই করুণ আবেদন আমি কোনওদিন ভুলতে পারব না। পরে অবশ্য অন্য মাস্টারের কাছে গান শিখেছিলাম। সেই গান শেখার সূত্রেই প্রথম জানতে পারা গেল যে আমি বড় হয়ে উঠছি। চিত্তবাবু নেহাৎ অমায়িক ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। এরপর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের জন্য যিনি এলেন তিনি আমার মামার বন্ধু। আমার তখন সবে বারো আর তিনি তিরিশ পেরিয়েছেন। কিছুদিন ভালোই কাটল। তানপুরায় গান শুরু হল। বছরখানেক শিখলাম। তারপর হঠাৎ একদিন মাস্টারমশাই আমার হাতটা ধরে বললেনতুমি কি কিছুই বোঝো নাআদতে আমি 

মেয়েটা পড়াশুনা গানবাজনার জগতে ছিলামআর কিছু কিছু লেখালেখি তখন শুরু করেছি। আমি এই বড় হওয়াপুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক এসব বিশেষ বুঝতাম না। আমার তো হাড় হিম হয়ে গেল। ভয়ে কিছু বলতেও পারলাম না। পরদিন দুপুরবেলা অনেক ভয়ে ভয়ে মাকে ঘটনাটা বলাতে সেই মাস্টারমশাইয়ের কাছে গান শেখা বন্ধ হয়ে গেল।

 

ক্রমশ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন