প্রথম পাড়ি গরুর গাড়ি
১৯৭৯ সালের ঘটনা। আটাত্তরের বানভাসির পরের বছর। ভোর চারটে বাজতে তখনো কিছুটা বাকি। বাতাসে তখনো পুজোর আর্দ্রতা। কান পাতলে ঋত্বিক ভাগবত ভট্টাচার্যের চন্ডীপাঠ যেন শোনা যাবে কিম্বা পুরুতঠাকুর বাঁকাশ্যাম চট্টোপাধ্যায়ের ভরাট গলায় আবেগমথিত স্তোত্রপাঠ। গত পুজোর চারদিন একটানা উৎসবী আমেজের রেশ এখনো সজীব। এবার নিজ নিজ কর্মস্থলে ফেরার পালা। সাধারণভাবে গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্যমন্ডিত সাবেকি পুজো সমাপ্তির পর একাদশী-দ্বাদশী, টেনেটুনে বড়জোর ত্রয়োদশীর দিন গ্রামের পুজোর অস্থায়ী বাসের পাততাড়ি গুটিয়ে ফিরে যাওয়াটাই দস্তুর। কিন্তু আমাদের ঘরে এবার যেন একটু বেনিয়ম হতে চলেছে। একটু ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তই বলা যাক।
এবার পুজোয় আমাদের ঘরে এক নতুন অতিথির আগমন। অনেকটা সেই কারণেই সাঁওতাল পরগণায় (অধুনা ঝাড়খন্ড) আমাদের মামাবাড়ি ‘পালাজুড়ি’তে যাওয়া হবে, এমন সিদ্ধান্ত হলো। মূলত, নতুন বৌ-কে মামাবাড়ির সব আত্মীয়র সাথে পরিচয় করানোই মুখ্য উদ্দেশ্য হলেও এই যে সবাই মিলে একসঙ্গে যাওয়া হবে এতটা পথ, এটা ভেবেই আমাদের আনন্দ। বিজয়ার প্রণাম ও শুভেচ্ছা বিনিময়ও হবে, যেটা ইদানীং হয়ে ওঠে না। এটা আগে একটা রেওয়াজ ছিল বটে বাবা বেঁচে থাকাকালীন কিন্তু সময়ের সঙ্গে আমাদের জীবনযাত্রারও অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে, যা বাবাদের আমলে ছিলনা। মাঝে বেশ কিছুদিন অনিয়মিত হয়ে পড়েছিল এই পূজান্তে সবমিলে গরুর গাড়ি চেপে মামাবাড়ি যাওয়াটা। তার অন্যতম মূল কারণ ছিল অপ্রতুল পরিবহন ব্যবস্থা, স্কুল-পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের ছুটির সমস্যা, শিয়রে পরীক্ষার খাঁড়া ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের ছোটবেলা পুজোর পর মামাবাড়ি যাওয়াটা এক আবশ্যিক রুটিন ছিল। সেই অভ্যেসে ছেদ পড়েছিল উপরোক্ত কারণগুলির জন্য। এজন্য অবশ্য এক বেদনা অনুভব হতো বুকের ভিতর। দিদিমণি খুব কষ্ট পেতেন। কিন্তু মাদের কিছুই করার ছিলনা। কিন্তু এতদিন পর তেমন এক সম্ভাবনা তৈরি হতেই মনটা আনন্দে নেচে উঠল। তখন অবশ্যি গরুর গাড়িই ভরসা ছিল। আবার এতদিন পর এই স্পেস-এজে পৌঁছে গরুর গাড়িতে এতটা পথ যাওয়া যদিও সময়ের গতির বিরুদ্ধে হাঁটা হলেও গরুর গাড়ি চড়ার যে থ্রিল তা অন্য কিছুতে পাওয়া সম্ভব নয়। আর আমার তো সব সময়ের জন্য গরুর গাড়ির জার্নির জন্য আলাদা এক স্থান বুকের মধ্যে রয়েছে। ছোটবেলা গ্রামের স্কুলে যখন পড়তাম, সে সময় অনেক গরুর গাড়িতে জার্নির সুখস্মৃতি রয়েছে। গ্রামের কাঁচা রাস্তা বেয়ে চাকার দাগ কেটে যাওয়া, বলদ-দুটির মন্দাক্রান্ত চলার ছন্দ, এক অলস-মদির গতিবেগ আমাকে বিহ্বল করত। তাছাড়া ছবির মতো গ্রামগুলির জীবনধারার স্পন্দন ছুঁয়ে যেতে পারার মধ্যে এক নিত্য আমেজ পেতাম। তাই এতদিন পর আবার গরুর গাড়ি চেপে এতদূর পথ পাড়ি দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আমি খুব উৎসাহ দেখালাম। মা ও ভাই হর্ষ-র সমর্থন পেলেও ভগ্নী স্তুতির তেমন আগ্রহ দেখতে পেলাম না। আর নতুন বৌ তো ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ অবস্থা। তাহলেও পাঁচ সম্ভাব্য যাত্রীর মধ্যে ভোটাভুটি হলেও গরুর গাড়ির পক্ষে ৩-২ ফলাফলে সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্তি ঘটল। অতএব সিদ্ধান্ত পাক্কা হয়ে গেল যে পরের দিন ভোরে আমাদের ঈপ্সিত যাত্রা গরুর গাড়িতেই হবে। অতএব হাতে সময় নেই বললেই চলে। সবার আগে সম্ভাব্য চালক, আমাদের জমি চাষ করার অন্যতম কিষাণ মতি বাগদিকে তলব করা হলো। যেহেতু দুজন কিষাণের মধ্যে মতিদাই নিকটতম দূরত্বে বাস করে সেই সুবাদে মতি-দাকেই পাইলট বাছা হলো। অর্থাৎ গাড়োয়ানের ভূমিকায় মতিদার নির্বাচন নিয়ে কোনো রকম সংশয় রইল না। মতি-দা হাজিরা দিতেই আমি এক নিঃশ্বাসে তাকে পরের দিন খুব ভোরের বেলা যে আমাদেরকে নিয়ে মামাবাড়ি যেতে হবে তা জানালাম। মতিদা প্রস্তাব শুনে এক কথায় রাজি হয়ে গেল। এদের কথা ভাবলে খুব ভালো লাগত। সেই সময়ের দিনগুলিতে এই জমির মালিক আর কৃষাণদের মধ্যে এক সুন্দর সম্পর্ক ছিল। তারা শুধু কৃষাণ নয়, পরিবারের একজন হয়ে উঠত। মালিকের পরিবারের কাজ কে
নিজের কাজ বলেই মনে করত। এমনকি এই শ্রমসাপেক্ষ লম্বা সফরের জন্য আলাদা কিছু অর্থানুকূল্য মালিকের কাছে আশা করত না। সে মালিক খুশি হয়ে কিছু ‘বখশিস’ দিলে সেটা আলাদা কথা। মতিদা যাবার সময় বলে গেল যে পালাজুড়ি অনেক দূরের রাস্তা তাই এই ‘ছুটুবিলা’-র দিনে ভোর চারটের মধ্যে গাড়ি ছাড়তে হবে। আমরা যেন সব রেডি হয়ে থাকি। স্তুতি তো এমনিতেই বিরোধীপক্ষে, তায় আবার এই কাক-ডাকা ভোরে রেডি হতে হবে শুনে তীব্রভাবে প্রতিবাদ করল। নিচের অংশে স্তুতি আর মতিদার মধ্যে যে কথোপকথন হলো তা হুবহু তুলে দেওয়া হলোঃ-
স্তুতি- ‘আচ্ছা মতিদা, ভোর চারটেতেই গাড়ি ছাড়তে হবে কেন ?’ স্তুতির উষ্মাজড়ানো প্রশ্ন।
মতিদা- ‘তাইলে পৌঁছাইতে সঞ্জে (সন্ধ্যা) বাঁউড়ে (আঁধারি শুরু) যাবেক অর্থাৎ পৌঁছাতে পৌঁছাতে গোধূলি পার হয়ে যাবে’। আরেক দফা ভালোলাগা ছুঁয়ে গেল আমাকে। যাব আমরা কিন্তু আমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে মতিদা আমাদের এই ফরমান জারি করে গেল, সেটা অভিজ্ঞ মতিদার কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য প্রবন্ধ হবে না।
এরপর আর কোনো কথা চলে না। অতঃপর পাইলট-নির্ধারিত সময়ে যাত্রার সময়-সারণি বহাল থাকল। আমরা যে যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পোষাক-আশাক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় নিত্য ব্যবহার্য টুকিটাকি গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। হাতে মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধান। স্তুতি ব্যাজার মুখে বৌদির পাশে গিয়ে বসে পড়ল। এমনিতে তেনার দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার অব্যেস, তায় আবার পুজোর দিনগুলিতে প্রায় প্রতিদিনই সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে পুজোর খাতিরে। ফের পুজো শেষ হতে না হতেই আবার আঁধার ভোরে উঠে চারটের মধ্যে রওয়ানা দিতে হবে- একেবারেই না-পসন্দ স্তুতির। যার পাশে গিয়ে বসা, তার অবস্থা তো আরো করুণ। স্তুতির জন্ম তবু গ্রামে এবং কিছুটা হলেও গ্রামজীবনের হাল-হকিকত সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল কিন্তু বৌদির জন্ম তো কলকাতায়, ভবানীপুরের গোখেল রোডে! জীবনে এই তো প্রথম গ্রামসফর। পুজো ক’দিন না হয় ভালোই কাটল সবার সঙ্গে কিন্তু আমাদের এই যাত্রার বিবরণ শুনে তো তার মুখ দিয়ে কোনো কথাই সরছে না। বাকরুদ্ধ। গরুর গাড়ি বলতে তার অভিজ্ঞতার দৌড় বাংলা সিনেমার ঐসব গ্রামবাংলা নিয়ে সিনেমাগুলি। এখনো চাক্ষুষ পরিচয় ঘটেনি অথচ আর কয়েক ঘন্টা বাদেই প্রথমবার চড়ার সুযোগে শুধু দিনভর যাত্রাই নয়, একেবারে আন্তঃরাজ্য সফর ! নাহ, একটু ওভারডোজ তো বটেই। কিন্তু যা পরিস্থিতি, তাতে কারো কিছু করার নেই।
ক্রমশ...
খুব ভালো লাগলো । অপেক্ষায় রইলাম 🙏🙏
উত্তরমুছুনভালো লাগছে রন্তিদা। এটা চলতে থাকুক।—যযাতি দেবল
উত্তরমুছুন