ঢেউ এসে মুছে দেবে পদচিহ্নগুলি
তবে কেন সমুদ্র-যাপন?
আয়ত দু’চোখ মেলে দারুমূর্তি তিনি
নীরব দ্রষ্টা শুধু!
চিল্কার জলে জাগে দুরন্ত দুপুর
দু’জনে তবুও একা –
মন্দির-শহরে জমে মানুষের ভিড়। (পুরী বিষয়ক : ১)
সালটা দু’হাজার ষোলো। সেই আমার প্রথম পুরী যাত্রা এবং জগন্নাথের সঙ্গে দেখা। বাবা-মা দুজনেই একদম ভ্রমণপিপাসু নন। তাই কাঁথিতে মামারবাড়ি যাওয়ার সূত্রে দীঘা বা মন্দারমণি একাধিকবার যাওয়া হলেও পুরীর সমুদ্র এবং জগন্নাথ মহাপ্রভুর কাছে পৌঁছতে আমাকে তেত্রিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আমার সহধর্মিণীর আগ্রহেই সেবার মন্দির শহরে পৌঁছে গিয়েছিলাম দীপাবলির ছুটিতে। সমুদ্র, জগন্নাথ, সাক্ষীগোপাল, চিল্কা, কোনারক হয়ে নন্দনকানন কিংবা লিঙ্গরাজ মন্দির, খণ্ডগিরি-ধবলগিরি দেখে ফিরে এসে দু’টুকরো কবিতা লিখেছিলাম। ‘পুরী বিষয়ক’ নাম দিয়ে চন্দননগরের ‘গোধূলিমন’ পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল সেটা, যা এখন আমার ‘নীল দিনলিপি’ কাব্যভুক্ত। তারপরে আবারও গিয়েছি পুরী এই করোনার আবহেই, পুজোর জন্য নিয়ে আসা হয়েছে তাঁর দারুমূর্তিও। জগন্নাথ মহাপ্রভু ক্রমশ জড়িয়ে গিয়েছেন আমার পারিবারিক যাপনে, কলকাতার আবাসনের ছোট্ট সিংহাসনে। দু’হাজার একুশের রথযাত্রায় ‘রোববার’ পত্রিকার ‘জগন্নাথ’ সংখ্যার জন্য লিখতে বসে চৈতন্যদেবের সূত্রে খুঁজে পেয়েছি বাংলা কবিতায় মধ্যযুগ থেকে সাম্প্রতিকেও জগন্নাথ-চর্চার ধারাকে। যে-ধারায় কুমুদরঞ্জন মল্লিক থেকে সুধেন্দু মল্লিক, শেখ মকবুল ইসলাম, তরুণ মুখোপাধ্যায়, বীতশোক ভট্টাচার্য
মানি প্রভু মানি আমি তুমিই হৃদয় স্বামী
ব্যথিতের একান্ত নির্ভর।
কাল মহাকাল লেপি রয়েছো ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী
তুমি কৃপা করুণা সাগর।।
তা না হলে অকস্মাৎ ত্রিদিবেশ জগন্নাথ
কেন মর্মে প্রতিভাত হয়
কেন তবে দৃষ্টিপাতে নক্ষত্রখচিত রাতে
অনন্তের পাই পরিচয়।।
(অমৃত চৈতন্য, এই তো পাওয়া ভীষণ পাওয়া : ২০১১, সুধেন্দু মল্লিক)
তিনি হোন পথগামী নয়নে আমার
মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব, যিনি একাধারে রাধাভাবদ্যুতিসুবলিত প্রেমভক্তিতে আচ্ছন্ন আবার অন্যদিকে তিনিই এক বিরাট গণবিপ্লবের অগ্রদূত হয়ে উঠেছিলেন বৃহত্তর বাংলায়। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে সন্ন্যাসগ্রহণের পর মায়ের ইচ্ছায় জীবনের শেষ আঠারো বছর নীলাচল তথা পুরীতে
জগন্নাথ সান্নিধ্যে কাটিয়েছিলেন মহাপ্রভু। একাধিক চৈতন্যজীবনীকাব্যের কল্যাণে তাঁর জগন্নাথ-দর্শনের ভাবাবেশজনিত মূর্ছা, রথযাত্রার নর্তন-উন্মাদনা কিংবা অন্তিম মুহূর্তে জগন্নাথ-দেহে লীন হয়ে যাওয়ার অলৌকিক কাহিনি আজ আমাদের সকলের জানা। তবু তাঁর জীবনকাহিনি, ঐতিহাসিক ভূমিকা, প্রেমধর্ম এবং আকস্মিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একাধিক
রহস্যকাহিনি চৈতন্য-চর্চার উপাদান হয়ে আছে। গবেষণাগ্রন্থ থেকে জীবনী উপন্যাস – সর্বত্রই তিনি কিংবদন্তী হয়ে উঠেছেন বারংবার। ধর্ম-সমাজ-রাজনীতি এবং দর্শনচর্চার প্রেক্ষিতে চৈতন্যজীবন একাধারে সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিকের আগ্রহের বিষয় হয়েছে। তবে একটা ব্যাপার বিশেষভাবে লক্ষ করবার, জীবনের অন্ত্যপর্ব মূলত জগন্নাথ ও শ্রীক্ষেত্রেকে কেন্দ্র করেই
আবর্তিত হয়েছে। সেই যে আঠারোনালা পার হয়ে মন্দিরে এসে শ্রীজগন্নাথের মুখোমুখি দাঁড়ালেন, সেই আকুল দর্শন তাঁর শেষ
হয়নি কখনো। তাঁর মৃত্যুর কারণ অলৌকিক হোক, অসুস্থতা হোক কিংবা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, চৈতন্যদেবের প্রেমভক্তি
আন্দোলনের কেন্দ্রে তাঁর জগন্নাথপ্রেম গভীরভাবে ক্রিয়াশীল ছিল, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। যে-জগন্নাথদেব আসলে দারুব্রহ্ম, শবরদের দ্বারা পূজিত নীলমাধবরূপী শ্রী বিষ্ণুরই নবরূপ। একদা যিনি যমুনার তীরে কুঞ্জকাননে সঙ্গীতধ্বনি সৃষ্টি করে পরমানন্দে গোপরমণীর মুখপদ্ম আস্বাদকারী ভ্রমর, যাঁর চরণ লক্ষ্মী, শঙ্করা, ব্রহ্মা, ইন্দ্র, গণেশ প্রভৃতিরা অর্চনা করেন সেই : ‘জগন্নাথ স্বামী নয়ন পথগামী ভবতু তে’ – এই ছিল তাঁর মনোবাসনা। এই বিখ্যাত ‘জগন্নাথষ্টক’ রচয়িতা রূপে পুরীতে শংকরাচার্যের নাম প্রচলিত থাকলেও বাঙালির মতে এটি চৈতন্যরচিত কবিতা। উদ্বোধনের স্তবকুসুমাঞ্জলিতে কবি চৈতন্যদেবের নামই উল্লিখিত হয়েছে। এ-কবিতার চমৎকার অনুবাদ করেছেন কবি বীতশোক ভট্টাচার্য, সূচনাংশ এইরকম :
কখনও আনন্দিত কালিন্দীর তটে
অরণ্য করেন যিনি সংগীতে মুখর,
কখনও আভীর-নারী মুখের পদ্মের থেকে
আস্বাদ করেন যিনি যেন মধুকর,
গণপতি সুরপতি শম্ভু ব্রহ্মা রমা
অর্চনা করেন পদ একযোগে যাঁর –
সেই জগন্নাথস্বামী
তিনি হোন পথগামী নয়নে আমার। (শ্রীচৈতন্যর কবিতা, ২০০৯)
আইলা সচল জগন্নাথ নীলাচলে
১৪৮৬-১৫৩৩ : সাতচল্লিশ বছরের ঘটনাবহুল জীবনের শেষ আঠারো বছর (১৫১৫-১৫৩৩) যে-নীলাচলকে কেন্দ্র করে তাঁর জীবন ও কর্ম অতিবাহিত হয়েছিল, তার মূলে ছিল মাতৃআজ্ঞা, চরিতামৃতকারও এ-কথাই বলেন : ‘নীলাচলে নবদ্বীপে সেই দুই ঘর। / লোক গতাগতি বার্ত্তা পাব নিরন্তর’। বৃন্দাবনে অরণ্যসংকুল ভয়ানক পরিবেশে প্রিয় নিমাইকে স্থায়ীভাবে ছাড়তে চাননি শচীমাতা। সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী হয়েও মাকে ছাড়েননি তিনি। নবদ্বীপে এলে দেখা করেছেন আবার পুরী থেকে বস্ত্রাদি পাঠিয়ে কুশলও জানিয়েছেন, মায়ের দেওয়া কাঁথা, পত্নীর পাঠানো পাদুকা গ্রহণ করেছেন। আমৃত্যু নীলাচলেই বাসের অঙ্গীকার করেন চৈতন্য। ততদিনে বঙ্গদেশে তিনি ভক্তি আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। যৌবনের জ্ঞানদীপ্ত, তার্কিক বিশ্বম্ভর মিশ্র প্রেমভাবে মাতোয়ারা একজন প্রেমময় সন্ন্যাসী হয়ে উঠেছেন ক্রমশ। যখন নীলাচলে পৌঁছলেন তিনি, তখন সেখানে হিন্দুরাজার শাসন, সারা দেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে অবিশ্বাসের বাতাবরণ। তবু তারই মধ্যে চৈতন্যের ছয় সঙ্গী নিয়ে নীলাচলযাত্রা গুরুত্বময় হয়ে ওঠে ঐতিহাসিক কারণেও। হেঁটে ও জলপথে শ্রীক্ষেত্রে পৌঁছনোর পথটি সেকালে যথেষ্ট বিপদসংকুল ছিল। তবু কৃষ্ণে বিশ্বাস রেখে জগন্নাথের সঙ্গে মিলনের জন্য ব্যাকুল মহাপ্রভু জলেশ্বরের শিবমন্দির, রেমুণার গোপীনাথ মন্দির, কটকের সাক্ষীগোপাল, শিবক্ষেত্রে ভুবনেশ্বর দর্শন করে পৌঁছলেন কমলপুরে পৌঁছলেন। সেখান থেকে জগন্নাথ মন্দিরের ধ্বজা দেখতে পেয়ে তাঁর আকুল দশা, অবশেষে আঠারোনালা পার করে প্রিয়তম প্রভু জগন্নাথের সঙ্গে তাঁর মুখোমুখি সাক্ষাতের ছবিটি চৈতন্যভাগবতে এইরকম :
হেনকালে গৌরচন্দ্র জগতজীবন।
দেখিলেন জগন্নাথ সুভদ্র সঙ্কর্ষণ।।
দেখি মাত্র প্রভু করে পরম হুঙ্কারে।
ইচ্ছা হৈল জগন্নাথ কোলে করিবারে।।
লাফ দেন বিশ্বম্ভর আনন্দে বিহ্বল।
চতুর্দিকে ছুটে সব নয়নের জল।।
ক্ষণেকে পড়িলা হই আনন্দে মূর্ছিত
কে বুঝয়ে ঈশ্বরের অগাধ চরিত।।
অজ্ঞ পরিহারী সব উঠিল মারিতে।
আস্তে ব্যস্তে সার্বভৌম পড়িলা পৃষ্ঠেতে।। (শেষ খণ্ড, দ্বিতীয় অধ্যায়, চৈ.ভা.)
চৈতন্যচরিতামৃতের মধ্যলীলায় জগন্নাথ আলিঙ্গনের জন্য নিবিড় প্রেমাবেশে আবিষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গটি একটু অন্যভাবে থাকলেও, মূল কথা একই। সেই যে তাঁর জগন্নাথের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা আর প্রেমাচ্ছন্ন হয়ে পড়া, এমন ঘটনা তাঁর জীবৎকালে বহুবার ঘটেছে। ভারতের বহু স্থান ভ্রমণ করেও নীলাচলেই বারবার ফিরে এসেছেন তিনি মূখ্যত জগন্নাথের টানে। যদিও চৈতন্য গবেষক ও বিখ্যাত ঐতিহাসিকের দল, তাঁর এই ওড়িশা তথা নীলাচলবাসের নানা কারণ খুঁজে বের করেন। এ-প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক কালের জগন্নাথ-গবেষক শেখ মকবুল ইসলামের কিছু অভিমত প্রণিধানযোগ্য, তাঁর মতে পুরীতে রাজার জগন্নাথের সেবক হওয়া, সংস্কৃত চর্চা থাকায় শাস্ত্রীয় আচরণের সুবিধে, রাধাবর্জিত দেশে রাধাভাব প্রচারের চ্যালেঞ্জ, দক্ষিণভারত ও উত্তরভারতের যোগসূত্র নীলাচল, ভাষার সহজগম্যতা, সিদ্ধক্ষেত্র হওয়া এবং সর্বোপরি জাতিবর্ণস্পর্শ-বিচারহীন এক ‘স্বপ্নের সমাজবাস্তবতা’ তাঁকে এখানেই প্রেমধর্মপ্রচারে উৎসাহিত করে। (শ্রী চৈতন্য ও ওড়িশা প্রসঙ্গ, উদ্বোধন, ২০১৮ : ৮৩)।
দিনে নৃত্য কীর্ত্তন জগন্নাথ-দরশন
গর্ভগৃহে জগন্নাথমূর্তির কাছে গিয়ে পৌঁছলে তিনি কৃষ্ণপ্রেমে ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়েন বলেই রাজপণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম তাঁকে গড়ূরস্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে একটু দূর থেকে জগন্নাথ দর্শনের পরামর্শ দেন। কিংবদন্তী সেখানে তিনি এমনভাবে ভাবাবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন ও অশ্রুকাতর হতেন, যে তাঁর হাতের আঙুলের ছাপ ওখানে স্থায়ী ভাবে রয়ে গেছে; আজও তা ভক্তদের দেখানো হয়, সংরক্ষিত রয়েছে দাঁড়িয়ে থাকার পাথরটিও। এবার ফেরা যাক রথযাত্রার কাছে। যতদিন জীবিত ছিলেন এই রথযাত্রা তাঁরই কারণে মহোৎসবে পরিণত হয়েছিল। ভাবাবিষ্ট নৃত্য আর অনুগামীদের নামসংকীর্তন এক গণপরিসর সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিল। রথযাত্রা এমনিতেই সকল মানুষের মিলনক্ষেত্রে, চৈতন্যের আবির্ভাবে তা আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। চরিতামৃতের মধ্যলীলায় তাঁর প্রথম রথযাত্রায় অংশ নেওয়ার উন্মাদনার ছবি সযত্নে বর্ণনা করেছেন কৃষ্ণদাস
কবিরাজ। গুণ্ডিচাবাড়ি পরিমার্জনা থেকে রথের সামনে সামনে সদলবলে এগিয়ে যাওয়ার ছবিটি আমাদের আচ্ছন্ন করে। মহাপ্রভুর নীলাচলবাসপর্বে ভক্তরা ‘সচল জগন্নাথ’কে আগে দর্শন করে তবে মন্দিরে দারুব্রহ্মকে দেখতে গেছে, এমন ঘটনা রাজা প্রতাপ্রুদ্রকে বিস্মিত করেছে। তিনিও চৈতন্য-অনুগামী হয়ে উঠেছেন ক্রমে। যাইহোক, সেই প্রথম রথযাত্রায় চৈতন্যের কীর্তন দেখে জগন্নাথ দর্শক হয়ে মাঝে মাঝে থামেন আর চলেন,
চৈতন্য পিছনে গেলেই রথ বন্ধ। এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য পুরীতে সেই প্রথম। আসলে রাধাভাবের আধার শ্রীচৈতন্যে দেখেই যেন জগন্নাথ তাঁকে মুগ্ধ নয়নে দেখেন, আর রাধাভাবে চৈতন্য
পান তাঁর কৃষ্ণকে :
ধীরে ধীরে জগন্নাথ করেন গমন।
আগে নৃত্য করি চলে শচীর নন্দন।।
জগন্নাথে নেত্র দিয়া সবে গায় নাচে।
কীর্ত্তনীয়া সহ প্রভ্য চলে পাছে পাছে।।
জগন্নাথে মগ্ন প্রভুর নয়ন হৃদয়।
শ্রীহস্ত যুগে করে গীতের অভিনয়।।
গৌর যদি আগে যায় শ্যাম হয় স্থিরে।
গৌর আগে চলে শ্যাম চলে ধীরে ধীরে।। (মধ্যলীলা ১৩, চৈ.চ.)
এই নাচের ভাবে মহাপ্রভুর আবৃত্তি করা ‘যঃ কৌমারহর’ শ্লোক গোপীভাবের উদ্বোধন ঘটায় আসলে। শ্রীজগন্নাথের মুখকমলের মধু পান করার এই প্রেমাবিষ্ট ছবিটি বৈষ্ণব তো বটেই সাধারণ মানুষের মনেও ভাবাবেশ জাগায়। এখানেই প্রতাপরুদ্র রাজবেশ ছেড়ে দীনবেশে গোপীগীত গেয়ে চৈতন্যের কৃপা লাভ করলেন। পরবর্তীকালে ওড়িশারাজের এই চৈতন্যময়তাকে ঐতিহাসিকেরা নানাভাবে দোষারোপ করেছেন রাজনৈতিক
কারণেই। তাঁদের মতে এই প্রেমধর্মে অনুরক্তি রাজার শৌর্য-বীর্যকে নষ্ট করে দিলো, তিনি ক্রমশ একাধিক দুর্গ হারালেন , রাজ্যের সীমানাও কমতে লাগলো ক্রমশ। দিগ্বিজয়ী রাজার বিজয়নগর রাজ কৃষ্ণদেব রায়ের কাছে ক্রম পরাজয়ের কারণ যে তাঁর চৈতন্যময়তা, তা
ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে হরেকৃষ্ণ মহাতাব প্রমুখ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন। ফলে চৈতন্যবিরোধী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে ওঠে ক্রমশ। এছাড়া স্মার্ত পণ্ডিতদের সঙ্গে চৈতন্যের মতবিরোধ এবং শাংকর ভাষ্যকে নাস্তিক বলার মতো ঘটনা, বৌদ্ধদের প্রতি রাজার ভুল আচরণ এবং চৈতন্যের সকলকে সমভাবে প্রেমভক্তি বিতরণের উদার বাণী ইত্যাদি কারণে
রাজা কিংবা সাধারণের কাছে তুমুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও শ্রীক্ষেত্রে তাঁর শত্রুও কম ছিল না। রাজার উচ্চপদস্থ কর্মী থেকে মন্ত্রী হয়ে ওঠা এবং পরবর্তী রাজা গোবিন্দ বিদ্যাধর ছিলেন বিরোধীদের নাটের
গুরু, এ-তথ্যও আমরা পাই। যদিও সব ব্যাখ্যা বা কারণ যে যুক্তিপূর্ণ তেমনও নয়। ‘কাঁহা গেলে তোমা পাই’ গ্রন্থে জয়দেব মুখোপাধ্যায় আখ্যানের আদলে এইসব মতামতের বিপক্ষ যুক্তিও দেন
শান্তা মায়ি চরিত্রের মুখ দিয়ে, কোনো রাজা বা রাজ্যই চিরস্থায়ী নয়, প্রতাপরুদ্রর অপ্রতিহত বিজয়রথ থেমে যায় রাজনৈতিক প্রেক্ষিত বদলের কারণে। প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের ইতিহাস-গ্রন্থের সাক্ষ্য টেনে তিনি আমাদের জানান, চৈতন্য ও তাঁর নব্য বৈষ্ণবধর্ম নয়, উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতা এবং
রাজার নিজেরও ত্রুটি, কর্মচারীদের নৈতিক অবক্ষয়, বিশ্বাসঘাতকতাই রয়েছে ওড়িশার রাজনৈতিক শক্তির
পতনের মূলে। তিনি তো ধর্মতন্ত্র নয়, ধর্মের ভিতরে ব্রহ্মজ্ঞান ও ভক্তিপ্রেমের যুগলসম্মিলন ঘটিয়েছিলেন। কলিযুগের পক্ষে সহজ যে-ভক্তিযোগের কথা বলেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ, মধ্যযুগের যুগাবতার শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য তাঁর নীলাচলবাস ও জগন্নাথপ্রেমের মধ্য দিয়ে সেকথাই প্রচার করেছিলেন। রায় রামানন্দের ভাষায় : ‘কান্তাপ্রেম সর্ব সাধ্যসার’। রসজ্ঞ কোকিল হয়ে সেই প্রেমাম্রমুকুলের আস্বাদনের মন্ত্রই চৈতন্যসংস্কৃতির মর্মকথা।
হাটে না বিকায় চাউল
চৈতন্যদেব ও জগন্নাথের অনুষঙ্গ মনে এলেই অনিবার্য ভাবে তাঁর মৃত্যু ও সমাধি নিয়ে চিরন্তন প্রশ্ন জেগে ওঠে। পুরীতে আঠারোনালা, সার্বভৌম ভট্টাচার্যের গৃহ, কাশীমিশ্রের বাড়িতে মহাপ্রভুর বাসস্থান গম্ভীরা গৃহ, গুণ্ডিচা
মন্দির, চৈতন্যভক্ত হরিদাস ঠাকুরের সমাধি, রাজা ও চৈতন্যের লীলাস্থল জগন্নাথ বল্লভ উদ্যান, মহাপ্রভুর
বিশ্রামস্থল, নরেন্দ্র সরোবর, জগন্নাথ ও চৈতন্যের স্পর্শধন্য সিদ্ধবকুল (জগন্নাথের দাঁতন থেকে বেড়ে ওঠা) এসব চৈতন্যবিজড়িত স্থানের
কথা প্রায় সকলেই জানেন। কিন্তু চৈতন্যদেবের সমাধি কোথায়? দীনেশচন্দ্র সেন, নীহাররঞ্জন রায়, জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের মতো গবেষক
এবং চৈতন্য জীবন নিয়ে লেখা অধিকাংশ উপন্যাস লেখক (সমরেশ বসু, দীপক চন্দ্র, রূপক সাহা, শৈবাল মিত্র প্রমুখ) বা পুনর্কথিত জীবনী শীতল চৌধুরীর ‘চৈতন্য সুন্দর’ (২০১৮) তাঁর মৃত্যুকে হত্যা বলেই ভেবেছেন। সিংহাসনলোভী গোবিন্দ বিদ্যাধরকেই মূলত দায়ী করেছেন তাঁরা। ফলে অদ্বৈত আচার্যের পাঠানো সাবধানবাণী ‘বাউলকে কহিহ – হাটে না বিকায় চাউল’-কে তাঁরা চৈতন্যের ভক্তিপ্রেম ও আন্দোলনের থেকে দূরে সরে আসা ও বিরোধিতা যে শুরু হয়েছে সেই সংকেত
বলেন। তার পরিণামে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে কৃষ্ণবিরহে আরো কাতর হয়ে ওঠেন তিনি। শোনা যায়, এসময় গুণ্ডিচাগৃহের মেঝেতে কৃষ্ণের ছবি এঁকে প্রেমাবেগে মুখ ঘষতেন ও রক্তাক্ত হতেন। এই সময়েই নীল সমুদ্রকে কৃষ্ণভ্রমে একদিন জড়িয়ে ধরতে গিয়ে ভেসে যান, তাঁকে ফিরিয়েও আনা হয়। কিন্তু এর অল্পদিন পরেই হঠাৎ তাঁর উধাও হয়ে যাওয়াকে এঁরা হত্যা বলেই ভাবেন। কারণ তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর পর রাজা প্রতাপরুদ্রের উড়িষ্যা ত্যাগ এবং প্রায় পঞ্চাশছর ভক্তদের নামসংকীর্তন বন্ধ হয়ে যাওয়া শোক নাকি ভয়ের কারণে? এ-প্রশ্ন ওঠে। চৈতন্যজীবনীগুলি একেকজন একেক ব্যাখ্যা দিয়েছেন, লোচনদাসের চৈতন্যঙ্গল জানায় আষাঢ় মাসের সপ্তমী তিথিতে ‘তৃতীয় প্রহর বেলা রবিবার দিনে / জগন্নাথে লীন প্রভু হইলা আপনে’, পুরীর পাণ্ডারাও একথাই প্রচার
করেছিলেন। আর অন্যদিকে জয়ানন্দ জানান, ‘আষাঢ় পঞ্চমী রথবিজয় নাচিতে / ইটাল বাজিল বাম পায়ে আচম্বিতে’ আর ঐ আঘাত বিষিয়ে গিয়েই তাঁর জ্বর আসে ও মৃত্যু হয়। ভাগবত বলে ‘জগন্নাথ পরশিয়া হৈলা অন্তর্ধান’, তবে চৈতন্যচরিতামৃতে ইঙ্গিত থাকলেও স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। এছাড়াও দিবাকরদাস, অচ্যুতানন্দ তাঁকে জগন্নাথে লীন বলেন। ওড়িয়া গ্রন্থ বৈষ্ণবচরণ দাসের চৈতন্যচক্ড়া অবশ্য দৈহিক মৃত্যুর ইঙ্গিত দেয়। কেউ বা বলেন তিনি নীল সমুদ্রকে কৃষ্ণভ্রমে সেখানেই ভেসে গেছেন। তবে মহাপ্রভুর গুণ্ডিচাগৃহে অথবা জগন্নাথমন্দিরে ভাবাবিষ্ট হয়ে নামসংকীর্তন করতে করতে একা প্রবিষ্ট হওয়ার পর দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া ও চারটে থেকে এগারোটা মন্দিরের দ্বার বন্ধ থাকার অর্থ কি তাঁকে হত্যা করে গর্ভগৃহে জগন্নাথের রত্নবেদীর নিচে পুঁতে দেওয়া নয়? এরকম প্রশ্ন অনেকেই তুলেছেন। অন্তরঙ্গ পার্ষদ স্বরূপ দামোদরের হৃদয় ফেটে প্রাণ বের হয়ে যাওয়াও তো তীক্ষ্ণ কিছুর আঘাতে হত্যার সংকেত দেয়। গড়ুর স্তম্ভের কাছে তাঁর মৃতদেহ দেখতে পাওয়া এবং তা জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরামের সমাধিক্ষেত্রেই পুঁতে দেওয়ার মতো একাধিক কাহিনি ঘুরে বেড়ায়। সচল জগন্নাথের অচল জগন্নাথে লীন হয়ে যাওয়া বা তোটা গোপীনাথে মিশে যাওয়ার গল্পে অচিন্ত্যভেদাভেদ
রূপক আছে, এই ব্যাখ্যা ভক্তরা বিশ্বাস করলেও চৈতন্যের মৃত্যু-রহস্য এবং গবেষণাকারীদের কারো কারো রহস্যময় মৃত্যু আজও আমাদের ভাবায়। তবু সুভাষের অন্তর্ধানের মতো চৈতন্যের কর্তাভজাদের গুরু আউলিয়া চাঁদ হয়ে বেঁচে থাকার গল্প কেউ বিশ্বাস
করেন, কেউ বা ভাবেন স্বয়ং যে ঈশ্বর তাঁর বিনাশ নেই, তাই থাক না রহস্য কিছু। পুরুষোত্তম জগন্নাথের অপার মহিমার মাঝখানে মধ্যযুগে আমাদের জাতীয় নবজাগরণের প্রাণপুরুষ চৈতন্যদেব ও তাঁর জীবৎকাল প্রেমধর্মের অতুলনীয় নিদর্শন হলেও মৃত্যুরহস্যের মেঘ সরানো যায় না কিছুতেই। তবু রথযাত্রার প্রাক্কালে আমাদের কাছে আজও চৈতন্য-জগন্নাথ একাকার হয়ে যায়।
জগন্নাথ, এ-শরীরে তোমার আঘাত
মধ্যযুগের চৈতন্যজীবনী ছেড়ে যখন আমরা আধুনিক কবিতার দিকে তাকাই, জগন্নাথ সেখানে নিছক ভক্তির উপকরণ হননি দেখা যায়। যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের বিখ্যাত কবিতা ‘ঘুমের ঘোরে’-তে জগন্নাথ আসেন নাস্তিক্যের সূত্রে, যিনি এক অক্ষম দেবতা :
আমরা যখন সুখে সুখী হই – সে নহে তোমার দান,
তোমার বিধান নহে যে – আমরা দুখে হই ম্রিয়মান,
কেন যে এসব আছে,
সে কৈফিয়ত তুমি কোনদিন দেবে না কাহারও কাছে।
সাগরের কূলে পুরী তব, দারু-মুরতি জগন্নাথ; -
রথের চাকায় লোক পিষে যায়, তোমার নাহিক হাত।
তুমি শালগ্রাম শিলা, -
শোওয়া বসা যার সকলি সমান, তারে নিয়ে রাসলীলা।
আমার মনে পড়ে যায়, দু’হাজার দশে সিমা আর্ট গ্যালারিতে দেখা গণেশ পাইনের সেই বিখ্যাত মহাভারত সিরিজের দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের ছবিটি, যার নাম ‘দি মির্যাকল’। সেখানে অবিরল বস্ত্র জুগিয়ে যাওয়া কৃষ্ণসখার বদলে শিল্পী দারুমুর্তি জগন্নাথকে এঁকেছেন, যাঁর অসম্পূর্ণ হাত সহায়তায় অক্ষম। আয়ত দু’চোখ মেলে আজকের নারীর অসম্মানে নীরব দ্রষ্টা তিনি শুধু। যেন এ-ছবির পাশেই রাখা চলে পঞ্চাশের নারীচেতনাদীপিত কবি কবিতা সিংহের ‘অপমানের জন্য ফিরে আসি’ শীর্ষক পুরাণনির্ভর কবিতাটি, যেখানে কবি আঁকেন অসহায় দ্রৌপদী ও তাঁর প্রতিবাদী সত্তাকে :
অপমানের জন্য বারবার ডাকেন
ফিরে আসি
উচ্চৈঃশ্রবা বিদূষক –সভায়
শাড়ি স্বভাবতই ফুরিয়ে আসে
আমার যে
কার্পাসের সাপ্লাই মেলে না।
আধুনিক বিশ্বে ঈশ্বর থাকেন সেই ভদ্রপল্লীতে, সাধারণ মানুষের জন্য তাঁর ভাবনা কোথায়? – এমন প্রশ্ন থেকে জগন্নাথও রেহাই পাননি। তাই অসংখ্য মিথ ও গভীর বিশ্বাস নিয়ে তিনি কবিতার উপকরণ হলেও পঞ্চাশের আস্তিক্যবাদী কবিকে লিখতে হয় :
কোথা পথ? কোথা তুমি মনোরথে যাবে জগন্নাথ?
এ-জলপ্রপাত নিশ্চিত লঙ্ঘন করে যাবে অপলকে
দামিনী চমকে। জগন্নাথ, এ-শরীরে তোমার আঘাত
রক্তপুষ্প হয়ে ফোটে। বলো কোথা বসতি তোমার
দ্বারকায়? মথুরায় – বৃন্দাবনে! নাকি এই হত দরিদ্রের
ধ্বংসের গভীরে দ্বার-ভাঙা ঝড়ের নিস্বনে? (জগন্নাথ ২, মেঘে আশ্বিন হাওয়ায় জন্মদিন : ২০১০, সুধেন্দু মল্লিক)
ধ্বংস ও নির্মাণে জগন্নাথের ভূমিকা স্বীকার করে সুধেন্দু তাঁকে ‘প্রেমময়’ মনে করেন। রবীন্দ্রনাথের মতোই যেন ভাবেন ‘তোমার প্রেমে আঘাত আছে নাইকো অবহেলা’। সত্তরের কবির সাম্প্রতিক কবিতায় তাই জগন্নাথের চোখ হয়ে ওঠে বিপন্ন জীবনের আশ্রয়, নিজেকে ত্রস্ত পাখির চিত্রকল্পে ধরতে চান তিনি :
যেখানেই যাই
আমাকে লক্ষ করে দুটি কালো চোখ
কী আয়ত, ভয়াল, মধুর
বিস্ফারিত চরাচর জুড়ে –
যা কিছু আমার স্খলন, ত্রুটি, ভুল
ওই দুটি চোখের পাহারায় ত্রস্ত পাখি
যেন নীল সমুদ্রের বুকে বড় একা আমি
----- তোমার করুণা চাই, হে নয়নপথগামী। (নয়নপথগামী, তরুণ মুখোপাধ্যায়, পাণ্ডুলিপি)
একইভাবে ‘জগন্নাথের চোখ’ কবিতায় শিলচরের কবি বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য দেখেন : ‘এই চোখ যে এঁকেছে সেই জানে গভীরতা / ঠুঁটো হলেও তার আকর্ষণ দুরন্ত প্রেমের’। যদিও এরই পাশে নারীচেতনাবাদী কবিতা সিংহের ‘নিমকাঠ’ ভিন্ন মাত্রা সূচিত করে বাঙালি কবিদের জগন্নাথ-চর্চায়। তিনি এখানে নিমকাঠের তেতো দেহের প্রতি তাঁর অনুরাগ ব্যক্ত করেন, যে তেতো কাঠ ‘মোহিনী মহিমা’-কে দেহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। চন্দন-মেহগনি-আবলুশের বদলে এই নিমকাঠ বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে কবি তাঁর নারীসত্তাকেও ঐ নিম জগন্নাথের সঙ্গে একসূত্রে গাঁথতে চান। সব প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়িয়ে তাঁর উচ্চারণ :
এই দেখো! দেহ নেয় যে আমার বিমূর্ত প্রণয়
যে আমার নিমকাঠে প্রতিকোষে আয়নায় আয়নায়
যে আমার সমগ্র আমিকে করে তক্ষণে সৃজন
নিমের শরীর খুঁড়ে গড়ে দেয় কৃষ্ণ চেতনাকে
হস্তবিহীন তার খুলে যাওয়া বাড়ানো দুহাত
এই দেহ অধিবাসী আদিবাসী নিম জগন্নাথ।
অশ্রুকষায় নিম মধুই এই নারীজীবনে তাঁর প্রাপ্তি, তাই নিম জগন্নাথকে তিনি শরীরে-মনে আত্মস্থ করে নিতে চান। আবার অন্যদিকে জগন্নাথ নিয়ে নিরন্তর গবেষণারত অধ্যাপক শেখ মকবুল ইসলামও তাঁর বৌদ্ধিক-চর্চা ও ক্ষেত্রসমীক্ষার পাশাপাশি লিখে ফেলেন ‘শ্রীজগন্নাথ অনুভব’ এবং ‘মা সারদার জগন্নাথ দর্শন’(২০১৯)-এর মতো কবিতা। যদিও মকবুল ইসলাম আধুনিক মানসের টানাপোড়েনে কাতর নন। তিনি ইসলামধর্মাবলম্বী হয়েও জগন্নাথে মন-প্রাণ সমর্পণ করেছেন। মা সারদার জগন্নাথ-দর্শনের ছবিটি পয়ারে বেঁধে পাঁচালির ভঙ্গিতে লিখেছেন মকবুল :
শুদ্ধ-মন, সাধু-চিত্ত, বাসনা বর্জন।
তাঁরই চিত্তে জগন্নাথ মুক্তির কারণ।।
জ্ঞান হতে বিজ্ঞান অনুভূত সত্য।
রামকৃষ্ণ-জগন্নাথ-অভেদ - একই তত্ত্ব।।
আবার তাঁর সংহত চিত্তে জগন্নাথের অনুভব নিয়ে লেখা হয় বারো পর্বের জগন্নাথের জন্ম ও মাহাত্ম্যের কাহিনি। ভক্তি অবনত মন নিয়ে মকবুল যুক্তি ও তর্ককে তুচ্ছ করতে চান। তাঁর কাছে জগন্নাথের প্রসাদ ভিন্ন সকল শাস্ত্রই নিষ্ফল মনে হয়। বলেন :
ভক্তিহীন শাস্ত্র-বর্ণ, শব্দের কঙ্কাল।
নির্মম সমাধি লাভে, গ্রাসে মহাকাল।। ৫৬
জন্ম হতে মৃত্যু, এই জীবন এক পথ।
গতাগতি করে তথা জগন্নাথের রথ।। ৫৭
হৃদপথে ‘নন্দীঘোষ’ উজলিবে আশে।
ব্যাকুলিত বসে আছি ‘বড় দাণ্ড’ পাশে।। ৫৮
মায়া-পাশ কাটিবারে দাও জ্ঞান অসি।
ছিন্ন করি ভব-রজ্জু, ধরি রথের রশি।। ৫৯
শ্রী বিষ্ণু-চৈতন্যলোকে করিয়া প্রণাম।
রচে জগন্নাথ কথা মকবুল ইসলাম।। ৬০ (শ্রী জগন্নাথ অনুভব, ২০২০)
এই ভক্তিরসসিক্ত মন নিয়েই জগন্নাথকে দেখেছিলেন রবীন্দ্রসমকালীন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। তাঁর ‘পুরী উপকণ্ঠে’ কবিতাটিতে চারটি ছোট পর্যায়ে তিনি রাজাধিরাজ জগন্নাথের প্রসাদে তাঁর ‘ভিখারির ঝুলি’ পূর্ণ হয়েছে, এমনই অনুভব তাঁর। কুমুদরঞ্জনও জগন্নাথের বিশাল দুই চোখের সামনে ভয়ার্ত হয়েছেন :
দুর্বল হিয়া কাঁপে দুরুদুরু
দাঁড়াইতে তব আগে,
ও বিশাল আঁখি হেরি পাপ তাপ
সভয়ে বিদায় মাগে।
বেদি পরশিতে শিহরে যে বুক
পূত শঙ্কায় শুকায় এ মুখ
পাষাণ হৃদয় হয় বিগলিত
গলে যায় অনুরাগে। (পুরী উপকণ্ঠে ৩, বীথি)
হাসে অন্তর্যামী
ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী রবীন্দ্রনাথ মূর্তিপূজার বিরোধী ছিলেন। তবে তাঁর কবিতায়, নাটকে, গল্পে রথযাত্রার প্রসঙ্গ ফিরে আসতে দেখি। ‘রথের রশি’ নাটিকায় যেমন তিনি ব্রাত্যজনের হাতে রথের রশি তুলে দেন, বোঝাতে চান ‘একঝোঁকা হলে তাল কাটে’; তেমনি তাঁর ‘লিপিকা’য় দুখীর দুয়ারে রথের চিহ্ন হয়ে ফুটে থাকে সূর্যমুখী ফুল। ঈশ্বরকে তিনি লোকারণ্যে, আড়ম্বরে খুঁজতে চাননি। ‘কণিকা’-র সেই বিখ্যাত কবিতাটি আমাদের সকলেরই জানা :
রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব – হাসে অন্তর্যামী। (ভক্তিভাজন)
আসলে জগন্নাথ তথা ঈশ্বরকে আয়োজনের আড়ালে, ধর্মতন্ত্রের বেড়াজালে আচ্ছন্ন করে রাখার হেতু নেই কোনো। এসব একান্তই স্বার্থান্ধ মানুষের অসাধু ব্যবসা মাত্র। তাই ভূপেন হাজারিকার মতো মানবতাবাদী শিল্পীও অসমীয়া ভাষায় লিখে ফেলেন ‘জগন্নাথ মন্দির’ নামে এক শ্লেষাত্মক কবিতা :
কুষ্ঠরোগী
লোভী পাণ্ডার ভুয়ো মন্ত্র।
থিয়োলজিক্যাল সমাজতন্ত্র।
ব্রাহ্মণের অত্যাচার ভেদি
ঊর্ধ্বমুখ করে দণ্ডায়মান
জগন্নাথের পুরী।
বলভদ্র শুভ্র
সুভদ্রা
জগন্নাথ নারী নীলাকাশ আদিগন্ত
প্রকাশ। (অনুবাদ : শেখ মকবুল ইসলাম)
পাণ্ডাদের ভণ্ডামি ও ধর্মব্যবসাকে ছাপিয়ে জগন্নাথের মহিমাকেই শেষ অবদি কবি বড় করে দেখেছেন। শ্রী অরবিন্দও ভেবেছিলেন ‘আদর্শ সমাজ মনুষ্য-সমষ্টির অন্তরাত্মা ভগবানের বাহন জগন্নাথের যাত্রার রথ। ঐক্য স্বাধীনতা জ্ঞান শক্তি সেই রথের চারি চক্র’ (জগন্নাথের রথ)। অরবিন্দ তাঁর রথযাত্রায় চেয়েছেন পরস্পরের এগিয়ে যাওয়ার অসম প্রতিযোগিতাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে। শোকে-দুঃখে, প্রেমে-বিরহে জগন্নাথ তাই হয়ে ওঠেন বাঙালি কবিদের হৃদয়ের নাথ। ‘জগন্নাথের রথ’-এর দেবতা হয়ে ওঠেন ভালোবাসার কাণ্ডারী। অবিশ্বাসের কাঁটাকে তুচ্ছ করে তাই প্রবীণ কবি তুলে নেন ‘ভালোবাসার ব্রহ্মকমল / স্পর্শ মধুর’। বাঙালি কবির জগন্নাথ-পরিক্রমায় শেষাবধি জেগে থাকে মিলন-বিরহের সুর :
দূরাদয়শ্চক্রনিভ লবণাম্বুরাশিধারা
যত দেখি, হই আনন্দে আত্মহারা;
ভাবি কোথা আমি, কোথা তুমি নাথ
নিষ্পলক দুটি কালো চোখ – জগন্নাথ! (জগন্নাথ, তরুণ মুখোপাধ্যায়, পাণ্ডুলিপি)
তাঁর দিকে তাকিয়ে তাই বলতেই হয় : ‘প্রেমময় মনে পড়ে তোমাকেই। তোমাকেই দেখি। / জগন্নাথ!’ (সুধেন্দু মল্লিক)
ঋণস্বীকার :
১) চৈতন্যজীবনীকাব্য (চৈতন্যচরিতামৃত, চৈতন্যভাগবত-এর রিফ্লেক্ট সংস্করণ : ১৯৮৩)
২) চৈতন্যসুন্দর, শীতল চৌধুরী, প্রজ্ঞাবিকাশ, ২০১৮
৩) কাঁহা গেলে তোমা পাই, জয়দেব মুখোপাধ্যায়, প্রাচী পাবলিকেশন, ২০১০
৪) ক) শ্রেষ্ঠ কবিতা, সুধেন্দু মল্লিক, পারুল, ২০১৭ খ) মেঘে আশ্বিন হাওয়ায় জন্মদিন, ঐ, এবং মুশায়েরা, ২০১০
গ) এই সবই আমার কবিতা, ঐ, দিশারী, ২০১১ ঘ) সঙ্গে আমার বালক কৃষ্ণ, ঐ, বিশ্বজ্ঞান, ১৯৭৯
৫) কুমুদ কাব্যমঞ্জুষা, পবিত্র সরকার ও সুধেন্দু মল্লিক সম্পাদিত, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০১১
৬) শ্রীজগন্নাথ অনুভব, শেখ মকবুল ইসলাম, খসড়া খাতা, ২০২০
৭) শ্রী জগন্নাথ ভাব-শাস্ত্র-তত্ত্ব, ঐ, ঐ, ২০২০
৮) এবং মুশায়েরা : বীতশোক ভট্টাচার্য সংখ্যা, সুবল সামন্ত সম্পাদিত, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১২
৯) বাংলা-অসম বিদ্যায়তনিক-সাংস্কৃতিক বিনিময়, শেখ মকবুক ইসলাম, সোম পাবলিশিং, ২০২১
১০) নীল দিনলিপি, ঋতম্ মুখোপাধ্যায়, কথাকৃতি, ২০১৮
১১) পত্র-পত্রিকা : ক) উদ্বোধন (২০১৮) খ) শর্বানন্দবোধি (২০১৯) গ) সংবাদ প্রতিদিনের ‘রোববার’ : জয় জগন্নাথ, ১১ জুলাই ২০২১
১২) কালের যাত্রা : নানা মাত্রা, তরুণ মুখোপাধ্যায়, ইউনাইটেড বুক এজেন্সি, ২০০৯
১৩) শ্রেষ্ঠ কবিতা, কবিতা সিংহ, দে’জ পাবলিশিং, ১৯৯৮
১৪) tagoreweb.in
১৫) গণেশ পাইনের ছবিটি সিমা আর্ট গ্যালারির ফেসবুক পেজ থেকে পাওয়া। ডিজিট্যাল এডিটিং : শ্রী রাজর্ষি ধাড়া।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন