‘যো লোগ নজরসে পীতে হ্যঁয়, উনকে লিয়ে পানিহি শরাব হ্যয়’
সৃষ্টিধর্মী লেখা আসে জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। মোটামুটিভাবে তাই আমাদের মেনে নিতেই হয় যে সৃষ্টিধর্মী লেখা লিখতে গেলে জীবনের সঙ্গে সরাসরি
যোগাযোগ স্থাপন করে বাঁধা গতের বাইরে একটু আলাদা ধরণের জগতে বাস করতে হয়। বাস্তবে দেখা যায় যে অধিক চিন্তাশক্তি ও সেইসঙ্গে অনেক বেশি কল্পনাশক্তি থাকার ফলে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা অধিকাংশই সমাজের নীতি-নিয়মের বন্ধনে খুব একটা স্বস্থ বোধ করেন না, এবং তাই অনেকাংশেই মুক্ত জীবন যাপন করেন। মেয়েরাও যে তার ব্যতিক্রম তা নয়। ঊনিশ শতকের বৃটিশ সমাজের কড়া নীতিনিয়ম লঙ্ঘন করে জর্জ এলিয়ট বিয়ে না করে পছন্দমতো পুরুষের সঙ্গে জীবন কাটিয়েছেন। বিদেশে লেখক নারীদের মধ্যে এমন অনেক আছেন। গারট্রুড স্টাইন তো সমকামী সম্পর্কেই জীবন কাটিয়েছেন। তাই আমার মতো সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যে, বলতে গেলে পুরোপুরি সমাজের নিয়ম-নিগড়ে বাঁধা জীবন কাটিয়ে একটা মধ্যবিত্ত ঘরের বাঙালি মেয়ে কেমন করে কবিতা লেখে, উপন্যাস লেখে সেটা বেশ অবাক হবার মতো ব্যাপার বটেই। আমার বাঙালি কবি (মহিলা) বন্ধুরাও তো আমাকে ‘ভালো মেয়ে’ বলে ঠাট্টা করেছেন যথেষ্ট। তাই আমি নিজেই বেশ অবাক হই। তবে আশাপূর্ণা দেবীর মতো দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে অনেক আছে।
আমার নিজের লেখালেখির কথা বলতে বসে পিছনে তাকিয়ে দেখছি যে বলবার মতো কথা এমন বিশেষ খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না যাতে বিন্দুমাত্র চমক আছে। ভাবলাম লিখব না, কিন্তু তারপর মনে পড়ল কীটসের কথা। সে কি ভয়ঙ্কর, দুঃখ-দৈন্য আর হতাশায় ভরা সামান্য কদিনের যৎসামান্য বাঁচা। কিন্তু তারই মধ্যে কি অসামান্য কল্পনাফসল। কটি বই সম্বল করে প্রথম থেকে অসুস্থ মায়ের পরিচর্যা আর ভাইবোনদের দেখাশুনা করবার মধ্যেই কবি মনকে কি অপরিমেয় মুক্তির পথ দেখাতে পেরেছিলেন! বই আর প্রকৃতি, এই তো ছিল কবির কল্পনার মুক্তিপথের পাথেয়। শেষসময়ে সেই অনেক সাধের ইতালি গেলেন, তবুও তো অসুস্থতার চরম পর্যায়ে ছোট্ট একটা ঘরের মধ্যে, প্রকৃতির আঢেল সম্পদের এত কাছে থেকেও অনেক দূরত্বে কেটে গেল জীবনের শেষ কটি দিন! কীটসের তবু প্রণয়িণী ছিলেন, পুরুষ বলে বাইরের একটা জগৎ ছিল, এমিলি ডিকিনসনের তো তাও ছিল না। বাবার কড়া শাসনে কোনও প্রেমিকও তাঁর কাছে ঘেঁষতে সাহস করেননি, তাই বিয়েও হল না। ঊনিশ শতকের আমেরিকায় পিউরিট্যান সমাজের বিধিনিষেধের বেড়াজালে জীবন কাটিয়ে তিনি কত সহজেই বলে গেলেন যে তিনি হাওয়া আর শিশিরের মদে চূর (Inebriate of Air am I/ Debauchee of Dew)! এঁদের তুলনায় কজনের জীবনকেই বা আর সীমিত বা অপূর্ণ বলা যেতে পারে? আমার তো মোটে একছটাক কল্পনার জগৎ, সেটুকু জমিতে কিসে সামান্য রসসঞ্চার হল সেটুকু লিপিবদ্ধ করলে ক্ষতি কি? মানুষকে হাসির খোরাক যোগানোও তো একটা বড় কাজ।
কল্পনার খোরাক তবে কি? অনেককেই তো বলতে শুনেছি যে মদ না খেলে কবিতা লেখা যায় না। অনেকে বোঝেন না সচ্চরিত্র পুরুষ বা নারী কেমন করে লিখবেন। আগে তো পুরুষের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে নারী যেহেতু ঘরসংসারের সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকেন তাই নারীর পক্ষে সৃষ্টিধর্মী রচনা লেখা সম্ভবই নয়। আজকের দিনে কিছু আলোকপ্রাপ্ত পুরুষ হয়তো মনে করেন যে এসব পুরোনো দিনের কথা, কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা অন্যরকম। সামান্য কিছুদিন আগের কথা, বিশ শতকের নব্বুইয়ের দশকের কথা বলছি। তখন আমি হায়দ্রাবাদে ফেলোশিপ নিয়ে গোয়েন্ডোলিন ব্রুকস আর সোনিয়া স্যাঞ্চেজ, কালো আমেরিকার দুজন মহিলা কবির উপর গবেষণা করছিলাম। সেখানকার ফেলোশিপের নিয়ম অনুযায়ী একদিন আমাকে একটি সেমিনার পেপার পড়তে হয় সারা ভারত থেকে আসা অধ্যাপকদের সামনে। বক্তৃতার পর প্রশ্নোত্তরের সময় দেখলাম, মেয়েদের লেখালেখি কতদূর গ্রহণযোগ্য, সেটা আদৌ উচ্চমানের হয় কি না, এই নিয়েই পুরুষ শ্রোতাদের আজও সন্দেহ। নানারকম প্রশ্নোত্তরের পর একজন অবাঙালি অধ্যাপক উঠে আমাকে বললেন, ‘কিন্তু ম্যাডাম, ডক্টর জনসন যে বলে গেছেন যে মেয়েদের লেখার চেষ্টা কুকুরের দুপায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টার সঙ্গে তুলনীয়’? আমি বুঝিনি আজকের দিনে এত অজস্র অসামান্য নারীর রচনার সঙ্গে পরিচিত একজন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক কি করে এমন কথা বললেন। তারা যতই নোবেল প্রাইজ আর পুলিৎজার প্রাইজ পাক, শ্রেষ্ঠ কবি-সাহিত্যিক হিসাবে পাঠকসমাজে স্থান করে নিক, তাদের সম্বন্ধে মূল ধারণা বদলায় না। মেয়েরা চিরদিন শুধু ঘরের কাজের উপযুক্ত। তারা সৃষ্টিশীল হতে পারেনা। মেয়েরা যে লিখতে পারেনা এই বিশ্বাস তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আরোপিত মূল্যবোধের অবদান। তাই এ বিশ্বাস ভাঙা যায় না! মানসিকতা সহজে পালটায়না, আজও তা বিশেষ পালটায়নি। মেয়েদের স্বাধীনতা না দিয়ে সহজেই বলে দেওয়া যে তারা লিখতে পারে না, এ তো খুব সহজ কাজ। স্বাধীনতার প্রয়োজনটুকু যে আমরা বুঝিনা তা নয়, বরঞ্চ ছেলেদের চেয়ে হয়তো অনেক বেশি করেই বুঝি, কারণ যে যেটা পায়না সেটার দাম সেই বেশি করে বোঝে। কিন্তু শুধু পাইনি বলে হাত উলটে বসে না থেকে কৃপণ জগতের কাছে যা পাওয়া গেল তাই নিয়েই তো গড়ে তুলেছেন মেয়েরা তাঁদের কল্পনার জগৎ, চিরদিন।
আমার নিজের কথা যদি বলি তবে বলতে হয় যে সংসার নিশ্চয়ই আমাকে বঞ্চিত করেছে। শুধুই নিয়মের বন্ধন, সংসারের জোয়াল। মানবজীবনের প্রথম যে অনায়াসলব্ধ সম্পদ, মা-বাবার স্নেহ, তা থেকেও নেহাৎ এক অবাঞ্ছিত কন্যাসন্তান বলেই আমি আজন্ম বঞ্চিত। কিন্তু অনেক কিছুই পাই নি বলেই আমি জানি যে প্রকৃতি যেটুকু দিয়েছে তার দাম কতখানি। একজোড়া চোখ তো দিয়েছে, আর তার সঙ্গে চোখ ভরে দেখবার ক্ষমতা। মন দিয়েছে, ভালোবাসবার, চিন্তা করবার, আঘাত পাবার। সাহিত্যের কাছে যাবার, তাকে অনুভব করবার মতো কল্পনাশক্তিও তো আছে তার সঙ্গে। ব্লেক বলেছিলেন, যার কল্পনাশক্তি নেই তার কাছে এই পৃথিবীর এত সম্পদ আর সৌন্দর্যের কোনও অর্থ নেই। পথ চলতে ফাঁকা মাঠের কোণে কিছু আগাছার জঙ্গল, আর একটা স্বর্ণলতায় প্রায় ঢাকা পড়ে যাওয়া ভাঙা মন্দির দেখে বুক যে কেন কি এক গভীর সুখে গুরগুর করে ওঠে তা আমি তো বিশেষ কাউকে বোঝাতেই পারব না। আমরা যারা পৃথিবীকে চোখ ভরে দেখে তার সৌন্দর্য বুক ভরে গ্রহণ করি তারা সবসময় মনেই রাখিনা যে আমরা কত ভাগ্যবান। কল্পনার মুক্তি তো আসে সৌন্দর্যের আস্বাদন থেকে। যাঁরা চোখ দিয়ে পান করেন তাঁদের তাই জল হলেই চলে যায়, মদের প্রয়োজন হয় না।
ক্রমশ...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন