ভবতারণের জোত
১৯।
অনিমেষ জানে দেওচড়াই হাটের গানের আসর থেকে হেঁটে হেঁটেই বাড়ি ফিরছিল সখীচরণ।হাতে
ধরা ছিল সেই চিরপুরাতন বাঁশিটি।তরলা বাশের বাঁশি।ছয় ছিদ্রের।এই বাঁশির আওয়াজ শুনলে
পাষানের বুকেও আবেগের উচ্ছাস জাগে।খুনীর চোখেও জল আসে।এমনই এই বাঁশির মহিমা।প্রায়
তিন কুড়ির দু’চার বছরের কম সময় ধরে এই বাঁশি সখীচরণের সম্পদ।দেশ দুনিয়ায়,গা-গঞ্জের
সকলেই সখীচরণের বাঁশির মহিমা জানে।হাটবারগুলিতে হাটের ভেতর এই কারণেই সখীচরণের
অতিরিক্ত খাতিরদারী জোটে।শিঙ্গারা,জিলিপি,চা,সিগার সব মিলে যায়।খালি একটু বাঁশিতে ফুঁকে
দেওয়া,আর কি।সখীচরণের বাবা ছিল এলাকার মস্ত গিদাল।তার ছিল গানের দল।পালাগানের
দল।সবাই বলতো কালুচরণের দল।জোতদার জমিদার মাতব্বরের ঘর থেকে নিয়মিত বায়না
আসতো।কালুচরণ ঘুরে বেড়াতেন গঞ্জের পর গঞ্জের পরিধী জুড়ে।মাঝে মাঝে সঙ্গে নিতেন ছোট্ট
সখীচরণকে।তখন শুরু হয়েছে সখীর বাঁশি বাজানোর তালিমপর্ব।সেই সময় একবার সাহেবপোঁতার
সুখেশ্বর দেউনিয়ার বাসায় গানের দল নিয়ে পালা গাইতে গিয়েছিলেন কালুচরণ তার দল নিয়ে।
ছিল সখীও।বাচ্চা সখীচরণের বাঁশি শুনে দেউনিয়া সখীচরণকে উপহার দিয়েছিল এই বাঁশিটি।
তারপর কত কত দিন পার হয়ে গেল।কালুচরণ মারা গেল।জোতদারী আইন পাশ হলে
জোতদারীও চলে গেল।ভরভরন্ত নদীর বুকে জেওগে উঠলো বিরাট বিরাট সব চর।গানের দল
ভেঙ্গে গেলেও সখীচরণ নুতন করে আবার দল বানালেন।এদিক সেদিক বায়নাও জুটতে লাগলো।
এখন আবার ভোটের আগে ভোটের লোকেরা তাকে দিয়ে গাওয়াতে শুরু করলো ‘ভোটের গান’।
সখীচরণের বয়স বাড়লো।দিনদুনিয়ায় কত কত বদল এলো।কিন্তু সখীচরণের বাঁশিটি কিন্তু
থেকেই গেল।বাঁশিটি ক্রমে মিথের মত,দুঃখসুখের গানের মত চিরকালীনতাই বুঝি বহন করতে
থাকলো।তবে কি সখীচরণের এই বাঁশিটি ডাকাতিয়া বাঁশি!কিংবা ডাকাতি করতে এসে বাঁশি
শুনেই পালিয়ে যেতে থাকা মোকাম্মেল ডাকাতের সেই কিসসাটি সখীচরণের বাঁশিবৃত্তান্তের
চিরস্থায়ী অংশ হয়েই স্থির হয়ে বসে থাকে!এই প্রায় মধ্যরাতের চাঁদের আলোয় ভেসে যেতে
থাকা গ্রামীন পথে বাড়ি ফিরবার এই সময়ে সব কিছুই তার প্রবীন চোখের সামনে স্পষ্ট
দেখতে থাকেন সখীচরণ।তার ভ্রম ও বিভ্রমের ভেতর দিয়ে সবকিছুকে অথবা বাঁশিটিকে মান্যতা
দিতে গিয়েই হয়তো সখীচরণ নিজের অজান্তেই বাঁশিটিতে ফুঁ দেন।আর সমস্ত চরাচরে ছড়িয়ে
পড়ে গান_
‘তরলা বাঁশের বাঁশি
ছিদ্র গোটা ছয়
ও বাঁশি কতই কথা কয়’
অলৌকিক চরাচরের ভিতর এভাবেই নুতন এক অলৌকিকতার জন্ম হয়।
২০।
এক হেমন্ত দুপুরে অনিমেষ তার প্রয়াত কবি বন্ধুকে নিয়ে লিখছিল_
‘মৃত্যুর কি কোন পূর্ব প্রস্তুতি থাকে!মৃত্যু তো আসলে এক ঘনঘোর ম্যাজিক।
আচ্ছা,নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কি করেন বা কি ভাবেন একজন মানুষ!
জানি না।বুঝি না।কেননা আমরা তো এটুকু জানি আর তা জেনেই বাঁচি,বেঁচেবর্তে থাকি;কি এক প্রবল
উদাসীনতায়!
কবি সুবীর মন্ডল।আমার বন্ধু।সেই নয়ের দশকে আমরা লিখতে এসেছিলাম বাংলা কবিতা।
বেশ কয়েক টি কবিতার বই এবং একটি উপন্যাস লিখে সুবীর মন্ডল অনেক বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন।
ক্যান্সার জড়িয়ে ধরেছিল সুবীর কে। সে বুঝে গিয়েছিল মরণ আসন্ন।কিছুই করবার নেই।সেই থেকে
নিজের মধ্যে হয়তো মৃত্যুর প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিল সে।
মৃত্যুর কিছু আগে,অসুখ জড়িয়ে বাঁচতে বাঁচতে নইলে সুবীর কেন লিখবেন_
"কাল যদি মৃত্যু আমাকে বিছানায় ফেলে চলে যায়,আমি এই উপলব্ধির কথা,এই ক_লাইন ডেটল গন্ধ,জনে
জনে বলে যেতে চাই"।
কিংবা_
"যেন আমার ভিজিটরকে ন য়,আমাকেই বলা হল:ইয়োর টাইম ইজ ওভার..."
অথবা_
"একবার শ্মশানে গিয়ে উঠলে,আর তো কখনো বাড়ি ফেরা হবে না, বলো! "
এভাবেই মৃত্যুকে ফেস করেছিলেন কবি সুবীর মন্ডল।আর মৃত্যুর আগে মজা ও ম্যাজিক দিয়ে লিখতে
চেয়েছিলেন_"ও জীবন রে।"
কান্নার কাছ থেকে এরপর অনিমেষকে প্রায় পালিয়ে বাঁচতে হয়েছিল একটা গোল আগুনের কাছে গিয়েই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন