উপন্যাস ‘মাধবী’: আখ্যানশৈলীর সন্ধানে
নান্দীকারের নাটক 'মাধবী' (২০০৯)
মাধবী এবং যযাতি
(অভিনয়ে : সোহিনী ও রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত)
মাধবী এবং গালব
(অভিনয়ে : সোহিনী সেনগুপ্ত, দেবশঙ্কর হালদার)
উপন্যাসের নাম : |
মাধবী |
লেখক : |
বসন্ত লস্কর |
প্রকাশ : |
১৪২৩ (২০১৬) |
পত্রিকা : |
উৎসবের আরম্ভ |
শ্রেণি : |
পৌরাণিক / পুরাণের পুনর্নির্মাণ। |
শৈলী : |
প্রাচ্য কথন শৈলী |
ভাষা : |
আঞ্চলিক ও মান্যচলিত বাংলা ভাষা |
বক্তব্য : |
নারীর অবস্থান : সেকাল-একাল |
আকারণোত্তর পাঠকৃতির দুনিয়ায় গল্প উপন্যাস ইত্যাদি বিবরণধর্মী সাহিত্যকর্মকে বর্ণনাত্মক সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই মানদণ্ডেই ‘ন্যারেটিভ’ বা ‘আখ্যান’ শব্দটি সুপ্রযোজ্য হতে পারে। অতএব উপন্যাসকে আমরা ‘ন্যারেটিভ ডিসকোর্স’ হিসেবেই গ্রহণ করতে পারি। উপন্যাস, যাকে লুকাচ ‘ঈশ্বর পরিত্যক্ত পৃথিবীর মহাকাব্য’ বলেছিলেন, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথ পেরিয়ে তা আজও বাস্তবেরই পুনর্নির্মাণ। কাহিনি থাকা বা কাহিনি বর্জন করা কোনটি এ-কালীন লক্ষণ বলে বিবেচিত হবে তা নিয়ে যতই বিতর্ক থাক, উপন্যাসের রচনারীতি বা আখ্যানশৈলীর অপরিহার্যতা নিয়ে কোন বিতর্কের অবকাশ নেই। যদিও ঔপন্যাসিক ভেদে কিংবা থিমগত বৈচিত্রের কারণে এই আখ্যানশৈলীর ভিন্নতা থেকেই যায়। আমার বেছে নেওয়া বসন্ত লস্করের ‘মাধবী’ উপন্যাসটি ‘উৎসবের আরম্ভ (১৪২৩)’ এ প্রকাশিত। পৌরাণিক উপাখ্যানের পুনর্কথন ও সমকালীন প্রেক্ষাপট তার উপস্থাপনা উপন্যাসটিকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।
প্লট ও থিম
এক গ্রামের এক ঢুলুনি বুড়ি থাকে, যাকে সকলে মনসা বুড়ি বলে। সে গ্রামের অল্পবয়স্ক মেয়েদের পুরাণের মাধবীর গল্প শোনায়। মাধবীর এই গল্পের সঙ্গে ছিল বুড়ির নিজের জীবনের গল্পের মিল।
মনসা বুড়ি গল্পটি আঞ্চলিক ভাষায় শোনালেও শ্রোতাদের মনে সেটি মান্যচলিত ভাষায় পুনর্কথিত হয়। গল্পের শেষে বুড়ি মরে যায়। তবে তার শ্রোতাদের মধ্যে একজন নারীর একালের অবস্থানের নিরিখে গল্পটি নতুনভাবে পাঠকের কাছে তুলে ধরে।
নদী নয়, বড় নালা, বছরভর কাঁকড় বিছানো বুকে তিরতির করে বয়ে চলে জল। আবার বর্ষায় ডোঙা চলে তার ওপর দিয়ে। তাই তার নাম নদী-নাচন নদী। তবে গ্রামের মেয়েদের আদুরে নাম নাচু। এই নদীর পাড়ে এক পুরানো বিশাল বট গাছের নিচে মনসাদেবীর মন্দির। গ্রামে যার পোশাকী নাম জগৎগৌরী মা। এই দেবীর থানে থাকে এক বুড়ি। আগে এই বুড়ির বৃদ্ধ স্বামী মায়ের পুজো করলেও বুড়ো মরে যাওয়ার পর মায়ের নিত্যসেবা করে সে, কারণ তারা ছিল নিঃসন্তান। গ্রামের বৌঝিরা কাজকর্ম সেরে মাঝ দুপুরে পুজো নিয়ে এলে বুড়ি ‘অং বং’ করে পুজো করত জগৎগৌরী মায়ের। তাই গ্রামের সকলের কাছে তার পরিচিতি ‘মনসাবুড়ি’ বলে।
এই মনসাবুড়ি গ্রামের মেয়েদের নানারকম গল্প বলত। এই গল্প বলায় উৎসাহ বক্তার যেমন ছিল, শ্রোতাদের আগ্রহ ছিল তার দ্বিগুণ। সুযোগ পেলেই বুড়ি বলতে শুরু করত তার নিজের জীবনের কথা। গ্রামের মেয়ে বৌ-রা তার জীবনের কথা অনেকবার শুনেছে। তা সত্ত্বেও বুড়ি যতবারই বলে ততবারই তাদের শুনতে ভালো লাগে। কারণ প্রতিবারই তার কথন শৈলী বদলে বদলে যায়। বর্ণনার মধ্যে দু-কলি পদাবলী, দু-চারটে গ্রাম্য শ্লোক বা টপ্পার ফোড়ন মিশিয়ে এমনভাবে সে তার তেবাসি জীবনকথা বলত যে শ্রোতাদের চোখ বুড়ির মুখের ওপর স্থির হয়ে থাকত।
এই মনসাবুড়ির একটা নয়, দুটো নয়, চারচারটে বিয়ে। প্রথম বিয়ে হয় বাপের বয়সী এক পয়সাওয়ালা লোকের সঙ্গে আচমকায়। বুড়ির ভাষায় ‘‘ওট ছুড়ি তোর বে/ধুনুচি মাথায় দে।’’ বাবা মা তার সঙ্গে বিয়ে দেয় টাকা পয়সার লোভে। তবে বিয়ের বছর দুই পেরোতে না পেরোতেই তার সেই প্রথম বর মারা যায়। বরের মৃত্যুর পরে তার কোল আলো করে আসে এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান। তবে বুড়ির বাপ মা এই দুধের শিশুকে নিজেদের কাছে রেখে আবার বুড়ির বিয়ে দেয় এক বিপত্নীক লোকের সঙ্গে। এক্ষেত্রেও কারণ কিন্তু সেই একই- ‘‘লোকটার ম্যালা টাকা’’। যা দিয়ে বুড়ির বাবা কিনেছিল দু বিগে কাঁদি। তবে সুখ মনসাবুড়ির কপালে নেই, ‘‘দ্বিতীয় বর মরল সান্নিপাতিকে’’। তখন তার কোলে এক বছরের খোকা। তৃতীয়বার বুড়ির বিয়ে দেবে বলে তার বাবা স্থির করলে বুড়িরই মেজো ঠাকুরপো তাকে বিয়ে করে নেয়। ফল- বুড়ির বাপের এক হেলে গোরু, একটা গাবিন গাই, আর খালপেড়ের মাঠের দুবিঘে জমি প্রাপ্তি। কিন্তু তৃতীয় ছেলের বয়স যখন আড়াই, মাছ ধরতে গিয়ে কেউটের আঘাতে মৃত্যু তার তিন নম্বর স্বামীর। তিন ছেলের মা হলেও বুড়ির বাপের মতে তার যৌবন ছিল নাকি অটুট। সুতরাং নিস্তার নেই তার, বিয়ের পিঁড়িতে বসল আবার, পাত্র-‘ হেঁপো রুগি। মনসামায়ের থানের পুজুরি।’ সে বুড়ির পেটে ছেলে দিয়ে যেতে পারেনি ঠিকই তবে তার জন্যই বুড়ির বাবা গুনে গুনে পণ দিয়ে তার ছোট ভাইয়ের বিয়ে দিয়েছে আর তার দৌলতেই বুড়ি আজ খেতে পরতে পায়। মনসাবুড়ি সেকালের ইউপি পাশ। তাই তার প্রথম স্বামীর যাত্রার দলে সে পেয়েছিল সীতার পাট। সে-ই তাকে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ সব পড়িয়েছিল। তাই একদিন গ্রামের মেয়েরা মনসাবুড়িকে নতুন কোনো গল্প শোনাতে বললে সে বলল রাজা যযাতির মেয়ে মাধবীর ও বুড়ির মতো চারবার হাত বদলের কাহিনী।
গল্পটা হল এই রকম। রাজা নহুষের ছেলে যযাতি আর সেই যযাতির বুড়ো বয়সে ছোট ছেলে পুরুর কাছ থেকে ফিরে পাওয়া যৌবনের ফসল হল মাধবী। এদিকে গালব নামে এক গরিব ব্রাহ্মণ সন্তান বিশ্বামিত্র মুনির কাছে আসে বিদ্যা শিক্ষার জন্য। শিক্ষান্তে আশ্রম ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে গালব গুরুদক্ষিণা দিতে চাইলে বিশ্বামিত্র জানায়- ‘‘ তোমাকে পাঠদানে আমি যা তৃপ্তি পেয়েছি সেই আমার যথেষ্ট গুরুদক্ষিণা।’’ কিন্তু গালব একথা শুনে ভাবে গুরু হয়তো তাকে কৃপা করে দক্ষিণা নিচ্ছেন না, ফলে তার বিদ্যাও সম্পূর্ণ হবে না। এরকম ভেবে সে গুরু ও গুরু মাকে বারংবার গুরুদক্ষিণা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করলে শেষে তার গুরু বিশ্বামিত্র ধৈর্যচ্যুত হয়ে তাকে আটশত শ্বেত অশ্ব দক্ষিণা চায় যার একটি কর্ণ হবে শ্যামবর্ণ। শুনে গালবের তো মাথায় হাত। কোথায় সে পাবে এমন অশ্ব। ইতিমধ্যে তার বাল্যবন্ধু বিষ্ণুর বাহন গরুড়-এর কথা মনে পড়ল। ধ্যানযোগে গালব ডাকল বন্ধুকে, হাজির হল বন্ধুও। সব শোনার পর গরুড় তাকে পরামর্শ দেয়- পৃথিবীর ধনশালী রাজাদের কাছে গিয়ে গালবকে সেই রকম অশ্ব ভিক্ষা চাইতে। গরুড় গালবকে পিঠে বসিয়ে প্রথমে নিয়ে গেল রাজা যযাতির কাছে। কিন্তু যযাতির রাজ্য তখন অনাবৃষ্টির দরুণ প্রজাদের মধ্যে হাহাকার, মহামারী। নিরুপায় যযাতি ব্রাহ্মণকে কিভাবে সাহায্য করবে ভেবে না পেয়ে দান করে তার একমাত্র কন্যা মাধবীকে। কিন্তু অপরূপা এই মাধবীকে নিয়ে গালব কি করবে যখন ভাবে তখন গরুড় তাকে পরামর্শ দেয় যযাতির শত্রু সে সব রাজা এবং একই সঙ্গে যে সমস্ত রাজার কাছে শ্যামকর্ণ বিশিষ্ট অশ্ব আছে তাদের কাছে মাধবীকে দান করবে, মাধবীর গর্ভে তার সন্তান উৎপাদন করবে এবং পরিবর্তে তারা প্রত্যেকে গালবকে দেবে দু’শো অশ্ব। বন্ধুর কথা শিরোধার্য করে গালব গরুড় পিঠে চড়ে প্রথমে যায় বৃদ্ধ রাজা হর্যশ্বের কাছে। সেখানে মাধবীকে রাজার বউ হিসেবে গ্রহণ, তার গর্ভে সন্তান উৎপাদন ইত্যাদি কাজ শেষ করে এক বছর পর মন্ত্র বলে তাকে ‘অক্ষত যোনি’ করে পুনরায় নিয়ে যাওয়া হয় রাজা দিবোদাসের কাছে। সেখানে একই ঘটনা ঘটে। তারপর একই ভাবে মাধবীকে তৃতীয়বার ভোগের বিনিময়ে অশ্ব পাওয়ার জন্য আনা হয় রাজা উলীনরের কাছে। তিনজন রাজার সঙ্গে মাধবীর তিন বছর সময় ও শরীর ব্যায়, প্রাপ্তি গালবের গুরুদক্ষিণার আটশো শ্যামকর্ণ বিশিষ্ট অশ্বের মধ্যে ছ’শ অশ্ব প্রাপ্তি৷ এখন দুশো অশ্বের অভাব যা আর দেশে নেই। চিন্তিত গালব কি করবে বুঝতে না পারলে গরুড় তাকে পরামর্শ দেয় ঋষি বিশ্বামিত্রকে মাধবীকে দান করতে। কথা মতো কাজ হলে গুরু খুশি হয়ে তাকে গুরুদক্ষিণা থেকে মুক্ত করে। তবে বিশ্বামিত্রের ঔরসে মাধবীর গর্ভে তার চতুর্থ সন্তান জন্মানোর পরই গালব তাকে দিয়ে আসে পিতা যযাতির কাছে৷ মেয়েকে পেয়ে মা-বাবা যৎপরনায় খুশি হয়ে চুলে পাক ধরা মাধবীর বিয়ে দিতে স্বয়ম্বরের আয়োজন করে। কিন্তু আজন্ম প্রকৃতি প্রাণ মাধবী এসব আর সহ্য করতে না পেরে সব কিছু থেকে পালিয়ে শেষে আশ্রয় নেয় অরণ্য মধ্যে এক শাল্মলী গাছের ছায়ায়। গল্পটা বলার পর বুড়ি নিজের মনে আক্ষেপ করে এই বলে – ‘সবটাই মেয়ে জন্মের দোষ।’
নানা চরিত্র
এক. মনসাবুড়ি:
উপন্যাসে উল্লিখিত চরিত্রগুলোর মধ্যে প্রধান হল মনসাবুড়ি। বুড়ির মায়ের কথা অনুযায়ী ভূমিকম্পের বছর তার জন্ম, সেই সময় সে ইউপি পাশ। ভালো গানের গলা ছিল তার। তারপর চারবার বিয়ে। তিন ছেলের মা সেই মনসাবুড়ি এখন বৃদ্ধ। গ্রামের বৌ-মেয়েদের নিজের জীবনের আর নানারকম পুরাণের গল্প শোনায়। গল্প বলতে বলতে কখনো সে ঘুমে ঢুলে পড়ে আবার কখনো বা কালো মিশি মাখা লালা ফোকলা মাড়ি বেয়ে টপকায়। বুড়ির চিন্তা ছিল সে মরে গেলে পেটের ছেলের হাতের আগুন পাবে কিনা। কিন্তু বুড়ির সেই চিন্তার অবসান ঘটিয়ে তার মৃত্যুকালে তার তিন ছেলেই আসে ও শ্রাদ্ধ শান্তি করে।
দুই. মনসাবুড়ির ও মাধবীর জীবন গল্পের পুনর্কথক:
মনসাবুড়ির বলা গল্পের শ্রোতাদের মধ্যে সে একজন। অন্য সবার থেকে সে পড়াশোনায় ভালো, দুতিনটে পাশ দিয়েছে। বুড়িও তাকে খুব ভালোবাসত। সবাই চলে গেলে বুড়ি তাকে মনসার সন্দেশ প্রসাদ দিত খেতে৷ কথক পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করে মনসাবুড়ি আবদার করে তার কাছে জলখাবার খেতে চায়। তবে কলেজের ফর্ম তুলে কলকাতা থেকে গ্রামে ফিরে কথক শোনে মনসাবুড়ি আর নেই, সে মারা গেছে।
তিন. গঙ্গাজল:
বুড়ির গল্পের শ্রোতাদের একজন হল গঙ্গাজল। গ্রাম্য এক মেয়ে, বুড়ির জীবনের ঘটনা তার মুখস্ত। সে কেবল জানতে চায় ‘মাদুবি’-র কথা।
চার. ঋষি বিশ্বামিত্র:
মনসাবুড়ির কথামতো এই ঋষি আগে ছিল ক্ষত্রিয়, ‘হেঁটমুণ্ডু উর্দ্ধপদ হয়ে এক হাজার বছর নাকি তপস্যা করে বিশ্বামিত্র ব্রাহ্মণ হয়েছিল।’ তবে জন্মসূত্রে ক্ষত্রিয় হওয়ায় তার রাগটাও ছিল চণ্ডাল।
পাঁচ. গালব:
এক গরিব ব্রাহ্মণের ছেলে। বিদ্যাশিক্ষার জন্য আসে ঋষি বিশ্বামিত্রের আশ্রমে। তার জ্ঞানতৃষ্ণা, অধ্যাবসায় ও ধীশক্তি গুরুকে মুগ্ধ করে।
ছয়. গরুড়:
বুড়ির ভাষায় বলা যায় ‘আস্তীকস্য মুনির মাতা/ ভগিনি বাসুকি ততা/ জড়তাকার মুনির পত্নী।’ ভগবান বিষ্ণুর বাহন, বিষ্ণুর রথের ধ্বজায় তার স্থান।
সাত. যযাতি:
রাজা নহুষের পুত্র যযাতি। বুড়ো বয়সে তার যৌবন ফিরে পেতে ইচ্ছা হওয়ায় সে তার ছোট ছেলে পুরুর থেকে যৌবন ধার নেয়। আর সেই বৃদ্ধ বয়সে ফিরে পাওয়া যৌবনের ফসলই হল মাধবী, তার আদরের রাজকন্যা।
আট. রাজা হর্য্যশ্ব:
বয়সে প্রাচীন, তবে রাজবেশ পড়লে তাকে কমবয়সী দেখতে লাগে। দুশত শ্যামকর্ণ বিশিষ্ট অশ্বের অধিকারী এবং রাজার বিবাহিত নারীর সংখ্যাও একাধিক। তবে আবারও শেষ বয়সে এসে বিয়ে করে মাধবীকে ও এক ছেলেও হয় তাদের, নাম যার বসুমনা।
নয়. রাজা দিবোদাস:
‘রাজার রাজা দিবুদাস রাজা। ....বাগে গোরুতে এক ঘাটে জল খাচ্চে এমন পেতাপ দিবুদাস রাজার। .... রাজা দিবুদাসের পেরজা বসুনলে যমরাজের প্যায়াদারা কাউকে ধরতে এলে এক পা এগোয় তো দু পা পেচোয়।’ এই রাজারও ছিল দুশোটি অশ্ব যার একটি করে কান শ্যামবর্ণ। তার অন্দরমহলে অসংখ্য পরির মতো সুন্দরী রাজকন্যার গিজ গিজ করলেও তিনি আবারও বিয়ে করেন মাধবীকে ও তাদের এক পুত্র জন্মায়।
দশ. উশীনর:
রাজা উশীনর ২০০ শ্যামকর্ণ অশ্বের অধিকারী। এক সহস্র মহিষীর স্বামী হওয়া সত্ত্বেও তিনি সন্তান সুখ পাননি কোন দিন। কথিত আছে মৃগয়াকালে মৃগরূপী কোন মুনিকন্যার অভিশাপে উশীনরের পৌরুষ তাকে ত্যাগ করেছে। তবে বৃদ্ধ বয়সে গালব ব্রহ্মবরে সেই ক্লীব রাজাকে পুনরায় তার পৌরুষ এক বছরের জন্য ফিরিয়ে দিয়ে মাধবীকে দান করে ও তার ঔরসে মাধবীর গর্ভে তার একমাত্র পুত্র সন্তান জন্ম নেয়।
পটভূমি
পটভূমি বলতে আমরা সাধারণত বুঝি স্থান এবং কাল। এই উপন্যাসটিতে আমরা দুটি পটভূমি দেখতে পাই।
এক. মনসাবুড়ির সমসাময়িক স্থানকাল:
মনসাবুড়ি থাকে নাচু নামে এক নদীর ধারে অবস্থিত এক গ্রামের থেকে মাইল খানেক দূরে মা জগৎগৌরীর থানে। সেখানে সে পূজা করে, আর ঐ থানে পূজা দিতে আসা মেয়েদের নানান গল্প শোনায়। আর কালের পরিপ্রেক্ষিতে সে বৃদ্ধা ঠাকুমা বয়সে প্রাচীন হলেও তাকে আমাদের সমকালের প্রতিনিধি বলা যেতে পারে।
দুই. মাধবীর সমসাময়িক স্থান ও কাল:
রাজা যযাতির কন্যা মাধবী ও তার পারিপার্শ্বিক চরিত্ররা সকলেই পুরাণের, মহাভারতের। বুড়ির ভাষায় বলতে পারি ‘ইসব সও যুগ তেতা যুগের কতা।’ আর স্থান প্রসঙ্গে বলা যায় রাজা হর্য্যশ্ব, দিবোদাস ইত্যাদিদের রাজ্য ও রাজত্ব, ঋষি বিশ্বামিত্রের আশ্রম সেকালের প্রচলিত নানা গল্পের মতো এখানেও গালবের গরুড়ের পিঠে চড়ে পৃথিবীর নানা স্থান পরিভ্রমণের কথা।
শৈলীগত স্বাতন্ত্র্য :
ক) গঠনশৈলী: উপন্যাসের গঠনশৈলীগত কাঠামোটি নিম্নরূপ-
কথক/ লেখক ↓ কথন/ লিখন ↓ কথা/ লেখা ↓ শ্রোতা/ পাঠক |
উপরিউক্ত এই কথনতত্ত্বের কাঠামোটি আলোচ্য উপন্যাসে খুব স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে ও উপন্যাসটির সূচনা হয়েছে উত্তম পুরুষের জবানিতে। উপন্যাসটির মধ্যে প্রাচ্য কথনরীতি লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ গল্পের মধ্যে আর একটি গল্পের উপস্থিতি। প্রথম স্তর বা বলতে পারি উপরিস্তরে-
কথক ও কথন – বসন্ত লস্কর যিনি এক অল্প বয়স্কা মেয়ের জবানিতে সমগ্র গল্প বলেছেন অর্থাৎ এখানে লিখছেন।
↓
কথা- মেয়েটি বলেছে তার নিজের সম্পর্কে কয়েকটি কথা আর ব্যাপকভাবে বলছে মনসাবুড়ির জীবন ও তার বলা গল্পের কথা।
↓
পাঠক- এখানে পাঠক আমি বা আমরা সকলেই।
আর দ্বিতীয় বা গহনস্তরে
কথক- মনসাবুড়ি
↓
কথন- যযাতির কন্যা মাধবীর জীবনের কথকতা।
↓
কথা- পিতা যযাতির রাজধর্ম পালনের জন্য কন্যা মাধবীর আত্মবলিদানের গল্পকথা
↓
শ্রোতা- নাচু নদীর তীরে অবস্থিত গ্রামের বৌ-মেয়েরা
সুতরাং দেখা গেল উপন্যাসটি গঠন কাঠামোগত দিক থেকে একেবারে নিখুঁত। আর সেই হিসেবে উপন্যাসটিকে বলা যেতে পারে খোলামুঠির উপন্যাস অর্থাৎ এর বয়ানটি উন্মুক্ত।
খ. ভাষা শৈলী:
এক. উপন্যাসে ব্যবহৃত আঞ্চলিক ও মান্য বাংলা ভাষা
মনসাবুড়ি ও তার গ্রামের মেয়ে গঙ্গাজল কথা বলেছে একেবারেই আঞ্চলিক গ্রাম্য ভাষায়। আর এই উপন্যাসের আরেক প্রধান চরিত্র, সমস্ত ঘটনার পুনর্কথক যে মেয়েটি সে কথা বলেছে আমাদের আধুনিক কালের প্রচলিত মান্যভাষায়। উদাহরণের সাহায্যে ব্যাপারটি স্পষ্ট করা যাক। যেমন-
বুড়ি গল্প বলতে গিয়ে এক জায়গায় বলে- ‘‘সেই লোহুস রাজার বেটা ছেলো যযেতি।’’ আর এই কথাটাই মান্যভাষায় উত্তম পুরুষের জবানিতে হয়ে যায়- ‘‘নহুষ রাজার ছেলে গো যযাতি।’’
আবার গল্পের পুনর্কথক যখন মনসাবুড়িকে জিজ্ঞেস করে ‘‘ঠাকমা মাধবীকে দেখে গালব বামুনের মনে হয়নি, দূর থাক বা গুরুদক্ষিণা, এমন রূপুসি মেয়েকে বিক্রি না করে নিজের কাছেই রাখি।’’ এর উত্তর বুড়ি যা দেয় তা সম্পূর্ণ আঞ্চলিক গ্রাম্য ভাষায়- ‘‘দুদ্দুর বিটকেল বামনার ত্যাখুনো মনে সঙ্গ একটা মেয়ে বিক্কি করে কত ট্যাকাই বা পাবে। তাই পাকির পিটে চেপে মাদুবির সঙ্গে তার পেথম কতাই, তোমার আর বুন নাই?’’
উপন্যাসের এই আঞ্চলিক গ্রাম্য ভাষা ও আধুনিক মান্যভাষার অনায়াস যাতায়াত ভাষার ক্ষেত্রে উপন্যাসিকের বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেয়।
দুই. উপন্যাসে ব্যবহৃত নির্বাচিত শব্দের আঞ্চলিক উচ্চারণ ও মান্য উচ্চারণ:
আঞ্চলিক শব্দ মান্য শব্দ
১. দ্যাকা ১. দেখা
২. হওেল ২. ঘাম তেল
৩. ভটচাস ৩. ভট্টাচার্য্য
৪. তেতা ৪. ক্রেতা
৫. পেতাপ ৫. প্রতাপ
৬. পিথিমি ৬. পৃথিবী
৭. আউপাতালি ৭. উথাল-পাথাল
৮. ডাঁড়াতিই ৮. দাঁড়াতেই
৯. দ্যায়লা ৯. দেয়ালা
১০. আস্তান ১০. অস্থান
তিন. উপন্যাসে উল্লিখিত কয়েকটি তৎসম শব্দের অর্থ:
শব্দ অর্থ
১. ধ্বজা ১. পতাকা
২. বুভুক্ষু ২. প্রবল ক্ষুধার্ত
৩. পাদ্য অর্ঘ্য ৩. পুজো / শ্রদ্ধার্ঘ্য
৪. শূন্য মার্গ ৪. আকাশপথ
৫. অশ্ব ৫. ঘোড়া
৬.ষোড়শী ৬. ষোল বছর বয়সী নারী
৭. বিপ্রর্ষি ৭. ব্রাহ্মণ যিনি ঋষিও / ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ
৮. শাল্মলী বৃক্ষ ৮. শিমুল গাছ
গ. বর্ণনারীতি
বর্ণনারীতির কথা আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই আমরা দৃষ্টিপাত করতে পারি উপন্যাসটির সূচনায়। এর সূচনাটি হয়েছে খুব সাধাসিদে, আটপৌরে ভাবে। একটি গ্রাম, তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা একটা সরু নদী, গ্রামের মানুষজন, গ্রামের একপ্রান্তে থাকা মা মনসার থানের সুন্দর বর্ণনা করেছেন ঔপন্যাসিক। উপন্যাসটির উপস্থাপনের মধ্যে যেন একটা গ্রাম্য সরল কথকতার বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। কিন্তু লেখক আশ্চর্য দক্ষতায় সেই গ্রাম্য সরল কাহিনিকে একালের পটভূমিতে বর্তমা যুগের পাঠকের উপযোগী করে উপস্থাপন করেছেন। এর পর কাহিনি অগ্রসর হয়েছে উত্তম পুরুষের জবানিতে। এক অল্পবয়স্কা মেয়ের কণ্ঠে। ফ্ল্যাশব্যাক-এর ব্যবহারও লক্ষ করা যায় মাঝে মাঝে। তাছাড়া আখ্যানটি আগাগোড়াই তো স্মৃতিচারণ। ঔপন্যাসিক বসন্ত লস্কর বরং ওই মেয়েটির মুখে প্রচলিত আধুনিক মান্য শব্দ ব্যবহার করে উপন্যাসটিকে আধুনিক পাঠকের উপযোগী করে তুলেছেন। অনেকক্ষেত্রে তিনি বেশকিছু অপ্রচলিত তৎসম শব্দ মেয়েটির জবানিতে এমন ভাবে প্রয়োগ করেছেন যে, তা আমাদের শ্রুতিকটু তো লাগেই না উপরন্তু উপন্যাসটিকে একটা আলাদা মাত্রা দান করে। আর উপন্যাসটির একেবারে শেষে দেখা যায় মনসাবুড়ি মারা গেছে, তাই কথক মেয়েটি নিজের মতো করে একালের সমাজের প্রেক্ষিতে উপন্যাসটিকে শেষ করছে। সে বলছে মহাভারতে সেই মাধবীকে সে যেন দেখতে পেয়েছে নন্দনের ফিলম্ উৎসব সিনেমা দেখতে গিয়ে। মাধবী যেন হয়ে উঠেছে চিরকালের নারীর প্রতিনিধি যারা সারাজীবন পুরুষ শাসিত সমাজব্যবস্থার সম্ভোগ বা ধর্ষণের শিকার। তাই এই নতুন গল্পের মাধবীও অরণ্যকেই স্বামীত্বে বরণ করে। তথাকথিত সামাজিক নিরাপত্তা নয় বরং নারী ও প্রকৃতির এই সহাবস্থান এককালীন ইকোফেমিনিজিম বা মানবী নিসর্গবাদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে, যা নারী আর প্রকৃতির সম্পর্ক দৃশ্যায়িত করে তোলে। পুরাণপ্রচ্ছদে প্রকৃতি ও নারীর উপর পুরুষ আধিপত্যের কারণ এভাবেই আমাদের চোখে তত্ত্বজীবিত হয়ে ওঠে। তাই উপন্যাসটির শেষে কথক বলেছেন- ‘‘গঙ্গাজলের মুখে শোনা এখানেই বুড়ি তার মাধবীর গল্প শেষ করেছিল। ঢুলুনিবুড়ি গল্প শোনাত, তত্ত্ব বলত না, কিন্তু ত্রিকালদর্শী মহাভারতের কবি?’’
অলংকরণ
অলংকরণের বিষয়টি এই উপন্যাসে পাঠকের বেশ নজর কাড়ে। এখানে বেশ কিছু চিত্রকরের আঁকা ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। উপন্যাসের শুরুর পাতাতেই দেখতে পাই ডানদিকে লেখা আর বামদিকের পাতায় ‘জে সুলতান আলি’-র আঁকা এক ছবি। যে ছবিতে নানা আল্পনার রেখাচিত্র পাই, যা গ্রাম্য সংস্কৃতির পরিচায়ক। আবার দ্বিতীয় যে ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে সেটি ‘কে. এম. আদি মুল্লাম’-এর। রাজা নহুষের শচীকে হরণ করে মুনি ঋষিদের দিয়ে রথ টানানোর ঘটনাটি এটাই স্পষ্ট। তৃতীয় ব্যবহৃত ছবিটি রামকিঙ্কর বেইজের। যেটিতে গ্রাম প্রান্তর, গাছপালা এসব দেখা যায়। উপন্যাসে সেই পুরনো দিনের রাজপ্রাসাদ, তার অন্দরমহল এসব বোঝাতে এস. এইচ. রাজা-র আঁকা ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। আর গোপাল ঘোষের আঁকা শেষ ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে দুটো পাখি। একটা বাচ্ছা পাখি আর একটা মা পাখি। কথক মেয়েটির রেজাল্ট বেড়িয়েছে। সে এবার গ্রাম ছেড়ে, মায়ের আঁচল ছেড়ে যাবে শহর কলকাতায় পড়তে- এইদিক থেকে শেষ ছবিটি বিশেষ তাৎপর্যবহ। তবে এতো গেল কেবল ছবির কথা। এছাড়া ঔপন্যাসিক উপন্যাসের নানা জায়গায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বড় বড় অক্ষরে তুলে ধরে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। যেমন- বিশ্বামিত্রের আশ্রমের কথা, যযাতির রাজ্যের দুর্দশার কথা ইত্যাদি। নমুনা হিসাবে তার কয়েকটি প্রতিলিপি দেওয়া হল।
শেষ কথা
পুরাণ শব্দটির মধ্যে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের যে দূরত্ব তাকে মনে মনে পূরণ করে নেওয়ার ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যায়। মাধবী ও গালবের বিখ্যাত পৌরাণিক কাহিনিটি নান্দীকারের ‘মাধবী’নামক নাট্য প্রযোজনায় (২০০৯) সবিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। নারীর অবস্থান সেকাল থেকে একালেও যে খুব একটা বদলায়নি তাকেই তুলে ধরতে চেয়েছিল এই নাটক। পাঞ্জাবী সাহিত্যিক ভীষ্ম সাহানির ‘মাধবী’ নাটকের পাশে আমাদের ‘মাধবী’ উপন্যাসটিকে রাখলে লেখকের স্বাতন্ত্র্য সহজেই চোখে পড়ে। নাটক যেখানে সংলাপ, গান এবং অভিনয় নিয়ে আমাদের স্পর্শ করে এই উপন্যাসে সেখানে গল্পের ভিতর গল্প বুনে আমাদের কাছে পুরাণকে পুনর্ণব করে তোলে। বুড়ির জীবন কথার সঙ্গে মাধবীর কাহিনির সাদৃশ্য এর প্রকাশ্য অংশ। যার অন্তরালে প্রচ্ছন্ন থাকে পুরুষ-খাদকের কাছে নারীর খাদ্য হয়ে যাওয়ার, ভালোবাসার জন্য নিঃস্বার্থ আত্মবলিদানের অকরুণ কাহিনি। পুরাণের এহেন পুনঃনির্মাণ কোনও নতুন ঘটনা নয়, সমরেশ বসু, গজেন্দ্র কুমার মিত্র, মনোজ মিত্র প্রমুখের পৌরাণিক রচনাগুলি আমরা পড়েছি। তারই পাশে বসন্ত লস্কর নিপুণ দক্ষতায় দুটি পৃথক ভাষারীতিতে যেভাবে এই পৌরাণিক আখ্যানকে বেঁধেছেন এবং শেষে মহাভারতের আখ্যানটিকে একালীন পরিবেশ-ভাবনার সঙ্গে একাত্ম করে দেখিয়েছেন, তাতে ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর কৃতিত্বে আমাদের সংশয় থাকে না।
গ্রন্থঋণ :
১) অভিজিৎ মজুমদার। শৈলীবিজ্ঞান এবং আধুনিক সাহিত্যতত্ত্ব। ২০০৭, দে’জ;
২) আশিস কুমার দে। উপন্যাসের শৈলী। ১৯৮৩, প্যাপিরাস;
৩) উৎসবের ‘আরম্ভ’ ১৪২৩;
৪) রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। ন্যারেটলজি : ছোটগল্প : ছোটোদের গল্প। ২০১৪, কোরক;
৫) ক্ষেত্র গুপ্ত। বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস :২। ২০০১, গ্রন্থনিলয়;
৬) বিপ্লব মাজী। ইকোফেমিনিজম্, নারীবাদ এবং তৃতীয় দুনিয়ার প্রান্তিক নারী। ২০১২, অঞ্জলি পাবলিশার্স।
৭) সুধীরচন্দ্র সরকার। পৌরাণিক অভিধান, ১৩৭০,এম সি সরকার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন