শুক্রবার, ১ অক্টোবর, ২০২১

অর্ক চট্টোপাধ্যায়-এর ঝুরোগল্প


 দরজাটা

চিলেকোঠার ঘরে আঁক কষতে কষতে হঠাৎ চোখ পড়ল নাফিসার। জানলার বাইরে পাশের বাড়ির ছাদের ওপর আরেকটা উপর-ছাদ।তারও ওপরে পড়ে রয়েছে একটা দরজা। এত ওপরে দরজা কোথা থেকে এলো? কে রেখে গেল বা ফেলে গেল? ওপরের দিকের কাঠ ভেঙে গেছে। যেন কেউ আছড়ে ফেলেছে। 

 

এতো ওপরে এতো বড় কাঠের দরজাকে তোলা কিন্তু মুখের কথা না। নাফিসা আসমানের দিকে তাকায়। তবে কি জন্নত থেকে এসে পড়লো দরজাখান? যেভাবে একদিন শহরের ওপর নেমে আসে বোমারু বিমান? কিম্বা যেভাবে আম্মিজানের চোখে সুরমার মত নেমে এসেছিল মৃত্যু

 

নাফিসার মন উদাস হয়ে গেল এসব ভাবতে ভাবতে। অঙ্কে মন বসাতে চেষ্টা করলো কিন্তু পাটিগণিতও করোনায় সদ্যমৃতা আম্মিজানের কথাই মনে করিয়ে দিল তাকে

 

পিতা পুত্রের বয়সের সমষ্টি কত

 

নাফিসা পিতার জায়গায় মাতা আর পুত্রের জায়গায় কন্যা বসিয়ে দিল। বয়সের সমষ্টি আর কোনোদিন দুদিক থেকে বাড়বে না! আম্মির কি আর বয়েস বাড়বে? ইন্তেকাল হয়ে গেলে আর বয়সে বাড়ে নাকি? নাফিসার বাড়বে। তাতে মাতা-কন্যার বয়েসের সমষ্টিও বদলাবে। কিন্তু এজন্মে আর আম্মিজানের সঙ্গে মোলাকাত হবে না। 

 

ঠিকমত জানাজাও করা গেল না কোভিডের জন্য। বডি পেল না আব্বু। পিপিই পরা নাফিসকে একবার পা ছুঁয়েই আম্বুলেন্স থেকে বেরিয়ে আসতে হল। গোর দেবার পর ফুল দিয়ে আসা ছাড়া আর দেখা হল কই? কতই বা বয়স আম্মির? এক সপ্তাহ কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট। তারপর সব শেষ। অথচ আব্বু আর নাফিসা নেগেটিভ! যেন আম্মিকে নিয়ে যাবার জন্যই এসেছিল করোনা। 

 

আবার জানলার বাইরে পাশের বাড়ির উপরছাদের উপর পড়ে থাকা দরজার দিকে তাকালো নাফিসা। অমন এক দরজা দিয়েই চলে গেছে আম্মিজান। এমন এক দরজা যার ওখানে থাকার কথাই ছিল না! অস্থানের অযাচিত দরজা আম্মিকে আসমানে নিয়ে গেছে আর দরজাটা এসে  পড়েছে উপরছাদে, ধড়াম করে। 

 

এখন দরজার দিকে তাকিয়ে আম্মির ছবি মনে ভাসিয়ে তোলার চেষ্টা করে নাফিসা। ভাঙা দরজার ওপরদিক যেন দুটো চোখ। সুরমা লাগানো। সেখানে আজানের সুর শুনতে শুনতে কখনো কখনো আম্মির মুখ দেখতে পায় নাফিসা। প্রথম প্রথম দরজাটাকে ঘেন্না করতো। দরজাই তো  আম্মিকে নিয়ে গেছে। ওটার তো ওখানে থাকার কথা নয়। দরজা না থাকলে আম্মিজানও যেত না। কিন্তু আজকাল নাফিসার মন বদলেছে। দরজাটা আছে বলেই তো এখনও আম্মিজানকে মাঝে মাঝে দেখতে পাচ্ছে। তাই এখন নাফিসা চায় দরজাটা অমন করেই পড়ে থাকুক। থেকে যাক। 

 

চিলেকোঠার ঘরে আঁক কষতে কষতে মাঝে মাঝেই আড়চোখে দেখে নেয় নাফিসা। আছে তো দরজাটা? উবে যায়নি তো

 

মাসপিছু দরজার বয়স এক বছর বাড়ায় নাফিসা। মাতা কন্যার বয়েসের সমষ্টি  দুদিক থেকেই বাড়ছে। তার এক বছর মানে আম্মিজানের বারো বছর। যতদিন না হাওয়া-জল খেয়ে নিচ্ছে জলপাইকাঠ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন