গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়াও
‘লুব্ধ মানুষ অরণ্যকে ধ্বংস করে নিজেরই ক্ষতিকে ডেকে এনেছে; বায়ুকে নির্মল করবার ভার যে গাছপালার উপর, যার পত্র ঝরে গিয়ে ভূমিকে উর্বরতা দেয়, তাকেই সে নির্মূল করেছে। বিধাতার যা-কিছু কল্যাণের দান, আপনার কল্যাণ বিস্মৃত হয়ে মানুষ তাকেই নষ্ট করেছে।’ (১)
(অরণ্যদেবতা / রবীন্দ্রনাথ)
নোয়ানো গাছ কোথায় গেলো?
পাড়ার পুকুর কে বোজালো?
যুগের হাওয়া অন্যমনে
জমি বেচার টাকা গোনে। (২)
সেই কবে, আমার কৈশোরে, সুমনের কণ্ঠে শুনেছিলাম এই গান। পুকুর পাড়ের নোয়ানো গাছ, ছটফটে মাছ, পুকু্র, জল আর হাওয়ার গল্প। অনাবিল প্রকৃতি, জড় ও জীবন্ত পরিবেশের সঙ্গে সহাবস্থানের কথা এই গানে রয়েছে বলেই হয়তো এ-গান মন ছুঁয়ে যেতো আমার। কিন্তু গানের ভিতরে বিষণ্ণতার সুর বুনে দেন সুমন এই ধ্রুবপদে ‘রইলোটা কী বর্তমানে? / মানুষ জানে, মানুষ জানে’। অর্থাৎ মানুষেরাই সজ্ঞানে ধ্বংস করে চলেছে এই পরিবেশ-কে। গাছ কেটে, পুকুর বুজিয়ে নগরায়ণের এই অসুখে আক্রান্ত আমরা। গানের লিরিকে এভাবেই সুমন তুলে এনেছেন গাছের ছায়ায় বেড়ে ওঠা সংসারের গল্প, চড়ুই পাখির সঙ্গে একটি মেয়ের খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়া, নীপবনের বিকল্প কৃত্রিম নলবনে আমাদের বর্ষাবরণের ছবি কিংবা বিভূতিভূষণের হেঁটে যাওয়া সবুজ ঘেরা সুবর্ণরেখার পাশে আজ পর্যটকের ভিড় ঢেকে দেয় ঝিঁঝিঁর আওয়াজ আর ‘হঠাৎ জেনারেটর ওগরায় শব্দদূষণ’। পরিবেশের সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্কের এই সূত্রটি আজও বারংবার আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের সমাজ ও সভ্যতা। দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর – নেটশাসিত বিশ্বলোকে এই মন্ত্রোচ্চারণের সুযোগ হয়তো আমাদের নেই, কিন্তু গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা আজও আমাদের মলিন হয় না।
হে প্রবল প্রাণ
প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক রবীন্দ্রোত্তর কবিতায় নানাভাবে ফিরে এসেছে। তবে বিশেষভাবে ফিরে এসেছে গাছের প্রতীক। উপনিষদে আদিপ্রাণ বৃক্ষের বন্দনা ধ্বনিত হয়েছে : ‘বৃক্ষ ইব স্তব্ধ দিবি তিষ্ঠ্যতেক - / স্তেনেদং পূর্ণ পুরুষং সর্বম্’ (শ্বেতাশ্বতর) (৩) আর রবীন্দ্রনাথ শুনতে পান ‘বনবাণী’; বলেন অরণ্যের ধর্মের কথা। তাঁর প্রবন্ধ,কবিতা, গানে ধ্বনিত হয়েছে অরণ্যদেবতার প্রতি উজ্জীবনী মন্ত্র :
মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে উড়াও, হে প্রবল প্রাণ
ধূলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে ধন্য করো, হে কোমল প্রাণ।
গাছের মধ্যে আছে অপরাজেয়তা, সহিষ্ণুতা আর সেবাধর্ম। প্রকৃতির সঙ্গে দেওয়া আর নেওয়ার মধ্য দিয়েই রচিত হতে পারে সংহতির মাধুর্য। অথচ মানুষ সেই প্রকৃতিকে ধ্বংস করে চলে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশের কবি আল মাহমুদও তাই শোনেন বিশ্বগোলকের কান্না : ‘শস্য ছিল শ্যামল ছিল, ছিল সুখের পার্বণ / শান্তিটাকে পুড়িয়ে মানুষ করল কালো কার্বন। / পক্ষী কাঁদে পুষ্প কাঁদে। রসায়নের রান্না / বন্ধ করো বন্ধ করো, আর পারি না আর না’। একালীন ডিপ ইকোলজি কিংবা গ্রিন কেমিস্ট্রির জন্ম এই প্রেক্ষিতেই। বৃক্ষ আমাদের শেখায় সহিষ্ণুতার মন্ত্র, ত্যাগ, ক্ষমা এবং সংকল্পের দৃঢ়তা। রবীন্দ্রোত্তর তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশের বাংলা কবিতায় এই গাছের প্রতীক ও ইমেজ বহুমাত্রিক তাৎপর্যে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘বনলতা সেন’ কাব্যে জীবনানন্দ লিখেছেন ‘নিখিলের বৃক্ষ নিজ বিকাশে নীরব’ এবং নামকবিতাতেও তিনি নায়িকা বনলতাকে ‘সবুজ ঘাসের দেশ’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। আবার বিষ্ণু দে-র ‘আমার হৃদয়ে বাঁচো’তে একটি পুড়ে যাওয়া গাছের পুনরুজ্জীবনের ছবি জেগে ওঠে :
একবছর নিঝুম মেরে সে দাঁড়িয়ে রইল –
পরের বছরই কচি-গোল পাতায় তার জয় সে জানালো।
আজ দেখি সে-গাছ – হাজারখানেক তালশাঁস –
হার-না-মানা হার পরেছে সে তার চূড়ায়!
রোজ কত পাড়ে – তবু যে অফুরন্ত।
চোখের আরাম – কচি সবুজ নিটোল কোমল শীতল সে-তালশাঁস!
- মরু বিজয়ের কেতন ওড়াও হে শূন্যে, ওড়াও, হে প্রবল প্রাণ!
রবীন্দ্রনাথের এই আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের গানটিকে পুনরুজ্জীবনের মন্ত্র করে নিয়েছেন বিষ্ণু দে। যে-গাছ মানবজীবনেরও প্রতীক। আর কবিকিশোর সুকান্ত ‘চারাগাছ’, ‘আগামী’ ইত্যাদি কবিতায় বীজ থেকে গাছ হয়ে ওঠা-কে মানবজীবনের বিকাশের রূপকার্থে ব্যবহার করেছেন চমৎকার ভাবে। তাঁর বিশ্বাস :
সেদিন ছায়ায় এস : হানো যদি কঠিন কুঠারে,
তবুও তোমায় আমি হাতছানি দেব বারে বারে;
ফল দেব, ফুল দেব দেব আমি পাখিরও কূজন
একই মাটিতে পুষ্ট তোমাদের আপনার জন।
(আগামী / সুকান্ত ভট্টাচার্য)
আর বৃক্ষ আর মানুষের তুলনায়ন এজ়রা পাউণ্ডের আরেকটি কবিতায় পাই যার নাম ‘মেয়েটা’,
গাছটা এই তো ঢুকল আমার হাতে,
প্রাণরস ওঠে আমার দ্বিভুজে, আর
গাছটা আমার বুকে উঠে বেড়ে চলে –
নিচে
গজায় ডালপালা, যেন অবিকল ভুজশাখা।
তুমিও একটা গাছ
শ্যাওলা সেটাও তুমি,
তুমি অসংখ্য ভায়োলেট হাওয়া যাদের ওপরে কাঁপে
শিশু – অতো বড় তুমি :
পৃথিবীর চোখে এটা বড়ো দুষ্টুমি। (অনুবাদ : অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত)
গাছগাছালির ছায়াকোণে
বৃক্ষের ভিতরে দেবত্ব আরোপের প্রবণতা মানুষের সেই আদিমকাল থেকেই। এর মূলে আছে গাছের নানাবিধ উপকারিতা এবং সহিষ্ণুতা। এর পাশাপাশি গাছের মধ্যে দেবতার সন্ধান প্রসঙ্গে আইরিশ কবি সিমাস হিনি জানান :
...in the context of monasticism, the god of my title would be the Christian deity, the giver of life, sustainer of nature, Creator, Father and redeemer Son. But there was another god in the tree, impalpable perhaps but still indigenous, less doctrinally defined than the god of the monasteries but more intuitively apprehended. The deities remained shrouded in the living matrices of stones and trees, immanent in the natural world. (৪) সেই কাব্যাদর্শ সামনে রেখে অলোকরঞ্জনের ‘আয়ুকর’ কবিতা অবশ্যপাঠ্য। যেখানে রবীন্দ্রোত্তর এই কবি চান, মানুষের মধ্যে পরিবেশচেতনা আর বৃক্ষপ্রীতি জাগাতে। সেই জ্যোতিগৃহ গড়ে তোলার কাজে তিনি ব্রতী হতে চান, বটের ঝুরিতে দেখতে পান মগ্নচৈতন্যের শিখা। তাই অরণ্যকে ডাক নামে ডেকে তিনি যেন আমাদের বলতে চান ‘মানুষকে মাঝখানে রেখে নয়। আকাশের পাশে কিংবা সান্দ্র গাছগাছালির ছায়াকোণে স্পর্শাতীত যেসব বটের ঝুরি মগ্নচৈতন্যের শিখা জ্বেলে আছে মানুষকে স্বযাচিত হয়ে তাদের গরজ বুঝে নিতে হবে’। কিংবা আমরা পড়তে পারি কবিতা সিংহের ‘শাপ’ কবিতা, যেখানে তিনি লেখেন ‘আর তুমি অভিশাপ কুড়াও প্রত্যহ! / কারণ, সমস্ত বন তুমি একা পিটিয়ে মেরেছ’। তবে স্পষ্ট ভাবে গাছ ও পরিবেশ বাঁচাও ভাবনা পাই নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘গাছ কেটো না’ ছড়ায় :
হারিয়ে গেছে মাথার উপর
গাছের সবুজ পাতা।
জ্বলছে বাজার রাস্তা ও ঘর
এই নাকি কলকাতা।
তাই তো বলি গাছ কেটো না,
গাছকে রাখো ধরে,
তা নইলে ভাই লক্ষ্মীসোনা
বাঁচবে কেমন করে?
ছড়ার ছন্দে এই আপাত হালকা কবিতার ভিতরেও রয়েছে সেই চূড়ান্ত বিপদ থেকে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা। কবির বিবেকী কণ্ঠ এবং পরিবেশ সচেতন মন এখানে ফুটে উঠেছে। হয়তো মনে হতে পারে, কিছুটা উদ্দেশ্যমূলক এই কবিতা। কিন্তু নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সেই উদ্দেশ্য-কে কাব্যিক মেজাজেই ফুটিয়ে তুলেছেন। শঙ্খ ঘোষ ‘সবুজ’ কবিতায় বলেন জন্ম-জন্মান্তরব্যাপী অস্তিত্বের ভিতর জেগে ওঠা অন্তহীন সবুজের গল্প আর বাংলাদেশের কবি সমরেশ দেবনাথ লেখেন :
প্রতিটি বৃক্ষের রক্ত প্রবাহে
একজন করে মানুষ ঢুকে আছে
মানুষ যখন দাঁড়ায় - তখন সে বৃক্ষ
আর বৃক্ষ যখন হাঁটে – তখন সে মানুষ
আপনার পদপ্রান্তে আমরা পিঁপড়ের দল
বিশাল মৌনতায় শুধু পরমায়ু ভাঙছি! (বৃক্ষের সংসারে একা)
এই উচ্চারণে গাছের মহত্ত্ব আর উদারতা-কে সসম্ব্রমে দেখা হয়েছে, যদিও এখানে কবির মৃত বাবার স্মরণ এখানে গাছের উচ্চারণে রূপকায়িত। কালিদাসের শকুন্তলাকে দেখা গেছে সহকার গাছ ও বনজ্যোৎস্না লতার বিবাহ দিতে এবং ফুল না ছিঁড়তে। রবীন্দ্রনাথের বলাইও তো ছিল এমনই বৃক্ষপ্রিয়। মনস্ক পাঠকের বনফুলের ‘নিমগাছ’ মনে পড়ে। এই গল্পে সংসারে সর্বংসহা অসহায় বউটির রূপক হয়ে আসে নিমগাছ। আবার আমরা যখন পড়ি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘গাছটা বলেছিলো’ কিংবা জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘গাছ’ গল্প, সেখানেও গাছেদের বিচিত্র ভূমিকা লক্ষ করা যায়। সিরাজের গাছের মর্মর ধ্বনি শুনে অনেক লোকের মৃত্যু হলে, লোকে ভাবে অভিশপ্ত গাছ আর কেউ বা সেই গাছকে পুজো করে। যদিও গল্পের শেষে গাছ কাটা আর না-কাটা নিয়ে গ্রামবাসীদের সংঘর্ষ ঘটে। আবার ‘গাছ’ গল্পে দেখি দুটি ছেলে-মেয়ের বিপরীতমুখী মন এক হয়ে যায় গাছের ছায়ায় এসে। ভালোবাসার মন্ত্র তারা গাছের কাছে শেখে যেন।
গাছের দূরত্ব বাড়তে দেখিনি
কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথের উত্তরজাতক কবিদের অনুভবে এই নাগরিক সভ্যতায় বিযুক্তির সংকট বারবার এসেছে, মার্ক্সীয় দর্শনে এই বিযুক্তি ত্রিবিধ : প্রকৃতি থেকে, সমাজ থেকে এবং আত্মবিযুক্তি। কবিতায় আমরা সেই বিযুক্তি উত্তরণের শব্দশিল্প রচনা করতে চাই। ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’ কাব্যে শক্তি অনুভব করেছিলেন : ‘একটি চিঠি হতে অন্য চিঠির দূরত্ব বেড়েছে কেবল / একটি গাছ হতে অন্য গাছের দূরত্ব বাড়তে দেখিনি আমি’, তিনিই প্রৌঢ়ত্বের সীমায় এসে বলতে পারেন : ‘গাছের সবুজটুকু শরীরে দরকার / আরোগ্যের জন্যে ঐ সবুজের ভীষণ দরকার’। গাছের ফুল ফুটে ওঠার মধ্যে যে জীবনের ইঙ্গিত বিদ্যমান, সেই চিরকালীন ইমেজও শক্তি ব্যবহার করেছেন। তিনি লেখেন : ‘আসলে কেউ বড়ো হয় না বড়োর মতো দেখায় / আসলে আর নকলে তাকে বড়োর মতো দেখায়/ গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়াও দেখবে কত ছোট / সোনার তাল তাংড়ে ধরে পেয়েছো ধূলিমুঠো’(বিরহে যদি দাঁড়িয়ে ওঠো)। বিশেষত, ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব’ কাব্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় গাছের কথা যখনই বলেছেন তখনই তাঁর হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়েছে অপরূপ মুগ্ধতা আর স্নিগ্ধ শুশ্রূষা। শক্তি প্রেমিক, রোম্যান্টিক কবি। তাঁর প্রেমের অনুষঙ্গে গাছের ইমেজ এসে মেশে :
ভালোবাসার শিকড় আমায় জড়িয়ে করে গাছটি
মাটির উপর দাঁড় করিয়ে ছায়ার কাছে আসছে
গভীর ভালোবাসছে আমায়, দারুণ ভালোবাসছে। (ভালোবাসার শিকড়)
বীজের ভিতরে আছে বৃক্ষের সম্ভাবনা। স্মৃতিকাতর একটি কবিতায় দেবদারু গাছ তার দীর্ঘ ঋজুতা নিয়ে এক শান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ‘মনস্বী পড়ুয়া দেবদারু’ এই বিশেষণে কবি সমাসোক্তি অলংকারের ব্যবহার যেমন করেছেন, তেমনই মানুষের বেড়ে ওঠাকেও চিহ্নিত করেছেন :
সাধ হয়, দেবদারু-ছায়ার ভিতরে, থ্রোনে, বসে কয় বরষাপীড়িত
সেদিন মনের কথা
মেঘের চাঁদোয়া ফুটো, বৃষ্টি পড়ে সবুজ ছাতায়
পিছনে দেবদারু ফল রাঙা মরামের কোণে উজ্জ্বল বীজের
আগুনের ফলা টেনে বের করে গাছ হবে ব’লে।
গাছ হয়! (আগুনের ফলা টেনে)
কবির কাছে গাছের মাটির গভীরে চলে যাওয়া গাছের শিকড়ের দৃঢ়তা বিস্ময় জাগায়, এ যেন অস্তিত্বের শিকড়, সম্পর্কের গাঢ়তা :
গাছের শিকড়গুলি মাটি ধরে কী তীব্র ক্ষুধায়
প্রতিষ্ঠিত হবে বলে দাঁড়িয়ে রয়েছে দীর্ঘদিন
মানুষের মতো তারও প্রতিষ্ঠা চাই মনে করে –
দাঁড়িয়ে রয়েছে একা-একা, ঐ জঙ্গলের মাঝে। (গাছের শিকড়গুলি দাঁড়িয়ে আছে)
এই নিঃসঙ্গতা যদিও বেদনাবহ নয়, বরং একাকিত্ব দেয় ধ্যানমগ্নতা। শিকড়-এর গভীরে জলের আকাঙ্ক্ষা হপকিন্স ও বিষ্ণু দে থেকে পরিশ্রুত হয়ে শক্তির কবিতাতে নতুনভাবে উচ্চারিত হয়েছে। যে-উচ্চারণে ‘শিকড় দেহ’ বলতে কবি নিজ অস্তিত্বকে ইঙ্গিত করেন। ‘ফিরে আসে’ শীর্ষক এই কবিতায় রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্য ‘চণ্ডালিকা’র বৌদ্ধ সন্ন্যাসী আনন্দ-এর ‘জল দাও’-এর রেফারেন্স ব্যবহার করে কবিতাটিকে আন্তর্বয়ানযোগ্য করে তুলেছেন কবি। জল এখানে তৃষ্ণা নিবারণের পানীয় এবং সেই তৃষ্ণা শুধু শারীরিক নয় মনেরও তৃষ্ণা :
শিকড় জুড়ে আনন্দ-র পাতা করতল
পূর্ণ করে জল চায়, জল দাও, ক্লান্ত, চণ্ডালিকা
জল দাও শিকড়ে আমার
জল দাও হৃদয় ভাসায়ে
শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভাসাও
আমার শিকড় দেহখানি
অথচ কবিবন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন ‘গাছের নিচে’ দাঁড়িয়ে থাকার বিষম নিঃস্বতার ছবি। তিনি বৃক্ষের আশ্রয়ের থেকে মাঠের মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের কবি আল মাহমুদ তাঁর কবিতায় সবুজের আশ্রয়ের কথা বলেছেন বারংবার, তাঁর কবিতাতেও ফিরে এসেছে গাছের প্রতীক : ‘নিজেকে বাঁচাতে হলে পরে নাও হরিৎ পোশাক / সবুজ শাড়িটি পরো ম্যাচ করে, প্রজাপতিরা যেমন / জন্ম-জন্মান্তর ধরে হয়ে থাকে পাতার মতন’ (ক্যামোফ্লাজ)। আবার বৈদিক ঋষির মতো উচ্চারিত হয় তরুণ সান্যালের ‘ঈশ্বরস্তোত্র’। লেখেন : ‘বন্যা ধেয়ে আসে ঘাস পায়ের পাতায়, গুল্ম জঙ্ঘায় কটিতে, / ডুবে যাই আশরীর সবুজ সমুদ্রে, যা উদ্ভিদগন্ধে অন্ধ আশ্লেষ প্রকৃতি’ (আমার নিয়তি এই / যেমন উদ্ভিদ )। মার্ক্সীয় চেতনায় দীক্ষিত এঁদেরই পূর্বসূরী বিষ্ণু দে-র শেষ কাব্যেও দেখেছিলাম ‘পুড়ে যাওয়া গাছ ক’টি’ কবিতায় মৃতপ্রায় গাছের মধ্যে প্রাণসঞ্চারের ছবি, কবিতাটি শেষ হয়েছিল ‘মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে, হে প্রবল প্রাণ’ গান দিয়ে, আমরা আগেই তা আলোচনা করেছি। সুভাষ মুখোপাধ্যায় ‘যাচ্ছি’ কবিতা সমস্ত পরিবেশ-কে বিদায় জানানো হয় ‘ও মেঘ, ও হাওয়া ও রোদ ও ছায়া যাচ্ছি...’ এবং থাকে মশা,মাছি, মিউ ইত্যাদি সজীব বস্তুকেও বিদায় জানানো কিংবা তিনি আইবুড়ো কুচ্ছিত মেয়ে এবং একটি শানবাঁধানো ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা পুষ্পিত গাছের প্রেক্ষাপটে উচ্চারণ করেন ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’। এই নিরন্তর আশাবাদেই রবীন্দ্রনাথের প্রবল প্রাণ, কোমল প্রাণ, মোহন প্রাণ এবং উদার প্রাণ মরুবিজয়ী বৃক্ষ উত্তর-রৈবিক বাংলা কবিদের কলমে সবুজ হয়ে জেগে থেকে। গাছের এই অবিরল করুণার পুণ্য বিতরণে পাঠকও সিঞ্চিত হয়।
বৃক্ষচ্ছবি ধ্যানের মতন
১৯৬২তে র্যাচেল কারসনের যে ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ বই-এর কথা আমরা পাই, সেখানেও আগামী দিনে প্রকৃতির প্রতিশোধের পূর্বাভাস নিয়ে সতর্কবার্তা রয়েছে। সভ্যতার অগ্রগতির দোহাই দিয়ে এই যে সবুজের নিশ্চিহ্নকরণ প্রক্রিয়া তারই বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠেছে ‘গ্রিন রেভোলিউশন’ তথা সবুজ বিপ্লব। যদিও সবুজ বিপ্লবের সীমানায় সার্বিক ভাবে পরিবেশ দূষণ বিরোধী ক্রিয়াকাণ্ডও যুক্ত হয়ে যায়। আর সেই পরিবেশচেতনায় সন্দীপিত হয়েই আমরা নতুন যে-সাহিত্য সমালোচনার জন্ম দিই, তার নাম ইকোক্রিটিসিজম, যেখানে মানুষ ও পরিবেশের সম্পর্ক যেমন চিত্রিত হয়, তেমনি ফুটে ওঠে পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকারের ইঙ্গিত। ভারতীয় দর্শনে নারীকে প্রকৃতি বলা হয়েছে, সেই ভাবনা পাশে রেখেই যেন ইকোফেমিনিজম তত্ত্বে আমরা ফুটে উঠে দেখি সমাজে অত্যাচারিত, পদদলিত নারীর সঙ্গে প্রকৃতির একাত্মতা। এখানেও রবীন্দ্রনাথ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন অরণ্যের ধর্ম ও মানুষের কর্তব্যের কথা :
For us the highest purpose of this world is not merely living in it, knowing it and making use of it, but realizing our own selves in it through expansion of-sympathy; not alienating ourselves from it and dominating it, but comprehending and uniting it with ourselves in perfect union. (Religion of Forest) (৫)
একদিন যেও না হারিয়ে
চেনা মুখ শহর ছাড়িয়ে
অজানা প্রান্তরে,
একটি শিমূল গাছ আর আকাশ যেখানে
মুখোমুখি চায় পরস্পরে। (হারিয়ে)
সমগ্র কবিতার ভিতরে হাট-বাট-নগরের চেনা পরিসর ছাড়িয়ে ‘দিশেহারা মাঠে’ যেতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। জীবনের কৃত্রিম সমস্যার গোলকধাঁধা থেকে মুক্তি দিতে পারে প্রকৃতির নির্জন, মুক্ত পরিসর। শিমূল গাছ এখানে নাগরিক মানুষের প্রতীক হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত আমরা কিট্সের ‘টু ওয়ান হু হ্যাজ বিন লঙ ইন সিটি পেন্ট’ (৭) সনেটটির কথা ভাবতে পারি, যেখানে নগর-খোঁয়াড়ে আবদ্ধ মানুষটি এক বেলার জন্য মুক্তি পেয়েছিল গ্রামীণ পরিবেশে, পাখির গানে, সবুজ ঘাস আর খোলা আকাশের সান্নিধ্যে। আসলে শহরের সাজানো সভ্যতার হৃদয়হীনতা তাঁর সংবেদী মন-কে পীড়িত করে। ‘আরণ্যক’ কবিতায় দেখেন বন কেটে, পশু হত্যা করে মানুষ হয়ে ওঠে হিংস্র শ্বাপদ। তবু জেগে থেকে ‘অনুচ্ছিন্ন অরণ্যের ডাক’। নাগরিক জীবনে থেকেও সবুজের সান্নিধ্য মানুষের সুচেতনা জাগাতে পারে। রবীন্দ্রনাথের ‘বনবাণী’র উত্তরজাতক ‘গাছ’ কবিতায় অমিয় চক্রবর্তী মধ্যাহ্নের রিক্তপটে যে ধ্যানমগ্ন বৃক্ষের ছবি আঁকেন, সেই একলা গাছের বুকে আছে ফুলের উচ্ছ্বাস আর সকলকে মেলানোর মন্ত্র :
সর্বহীন
আছে তবু সর্বমাঝে, চেতনায় হয়েছে সে লীন
অস্তিত্বের গূঢ় যোগে পরম সত্তায়,
তাই আজ সবারে সে পায়।।
গহনসঞ্চারী শিকড়ে, মৃত্তিকার প্রাণের রসে বেঁচে থাকা গাছের পুষ্পিত ইমেজ আমাদের নন্দিত করে। বাংলা সাহিত্যেও সেই গাছের ছায়া প্রসারিত হয়ে আমাদের বলে যায় ‘এই যে ধরণী চেয়ে বসে আছে ইহার মাধুরী বাড়াও হে’।।
উল্লেখপঞ্জি :
১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পল্লীপ্রকৃতি, বৈদ্যুতিন রবীন্দ্র-রচনাবলী। ২) সুমন চট্টোপাধ্যায়, ‘জমি বেচার টাকা’, ‘বসে আঁকো’ অ্যালবাম, সারেগামা (ইউটিউব) ৩) উপনিষদ, অখণ্ড সংস্করণ, হরফ, ১৯৮০। ৪) Heaney, The God in the Tree, Preoccupations, 1980 (দ্র. Elmer Andrews, The Poetry of Seamus Heaney, Macmillan, London, 1988) ৫) www.tagoreweb.in ৬) বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, আরণ্যক, মিত্র ঘোষ সংস্করণ, পৃ.১৩২, ১৯৭৬ (পিডিএফ) ৭) www.poetryfoundation.org
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি :
১) অরুণাভ মিশ্র, র্যাচেল কারসন ও আজকের পৃথিবী, এভানেল প্রেস, ২০১৬। ২) অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিনিকেতন, স্থাপত্য ও পরিবেশ এবং রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বভারতী, ২০০০। ৩) অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শেষ কথা কে বলবে, পত্রলেখা, ২০০৭ ৪) উজ্জ্বলকুমার মজুমদার, বিশ্বভরা প্রাণ, এবং মুশায়েরা, ২০০৯। ৫) কবিতা নন্দী চক্রবর্তী, বাংলা সাহিত্যে পরিবেশচেতনা : রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ, আশাদীপ, ২০১৭। ৬) গ্রেগ গারার্ড, ইকোক্রিটিসিজম, রুটলেজ, ২০০৭। ৭) দোলা দেবনাথ সম্পাদিত, বাংলা সাহিত্যে পরিবেশ ভাবনা, মিত্রম্, ২০১৩। ৮) পিটার ব্যারি, বিগিনিং থিয়োরি, ভিভা, ২০১০। ৯) বিদ্যুৎবরণ ঘোষ, সংস্কৃত-রচনায় প্রতিফলিত পরিবেশ সচেতনতা, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, ২০০৬। ১০) মোহিত রায়, পরিবেশ নিয়ে ভাবতে শেখালেন যাঁরা, পত্রলেখা, ২০১৬। ১১) শুভেন্দু গুপ্ত, প্রাচীন ভারতে পরিবেশচিন্তা, সাহিত্য সংসদ, ২০১২। ১২) একাধিক কবির একাধিক কাব্যগ্রন্থ ও শ্রেষ্ঠ কবিতা এবং www.tagoreweb.in ওয়েবসাইট।
চিত্র সৌজন্যঃ অধ্যাপিকা অবন্তী ভট্টাচার্য ও আশিস গোপাল
গাছের দূরত্ব বাড়তে দেখিনি- আমার খুব ভালো লেগেছে।
উত্তরমুছুন