বুধবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১

তরুণ মুখোপাধ্যায়-এর প্রবন্ধ


 কবি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় : ধারাবাহিক তোমার জল

১.

হয়তো জলেরও কিছু কিছু দাবী আছে

পরাজিত হয়ে তুমি মানুষের কাছে

জলের নিকটে গিয়ে চেয়ে নিয়েছিলে...  (জলমগ্নের প্রতি, পড়ে আছে চন্দনের চিতা)

 

তাঁরশ্রেষ্ঠ কবিতাপ্রকাশকের নিবেদন’- বলা হয়েছিল

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নামটি বাঙালি সমাজের কাছে আজ আর নতুন করে পরিচিত হবার অপেক্ষা রাখে না। অভিনেতা,  নাট্যকার, নির্দেশক, আবৃত্তিকার, সর্বোপরি সংস্কৃতিমনস্ক এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব হিসাবে দীর্ঘদিন তিনি আমাদের হৃদয় জুড়ে র‍য়েছেন। এসব বাদেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আরেকটি পরিচয় আছে। তিনি কবি। কবিতা লেখেন ছাত্রাবস্থা থেকেই...’         

তবে শ্রেষ্ঠ কবিতা’  (১৯৯৩) কবিতা সমগ্র’( ২০১৪) শুধু নয়, তারপরেও একাধিক কাব্যগ্রন্থ আমরা পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে সেই তালিকায় আছে : ‘ক্যালাইডোস্কোপ’ (২০১৫), ‘স্বেচ্ছাবন্দি আশার কুহকে’ (২০১৮),‘অন্তমিল’(২০১৯), ‘ভাঙা পথের রাঙা ধুলায় (২০২০) ইত্যাদি কাব্য। অনুবাদ করেছেন খলিল জিব্রান-এরদ্য প্রফেট’ ‘দ্রষ্টানাম দিয়ে ১৯৯৮ সালে। সত্তরের কবি সুবোধ সরকার যথার্থই বলেন : কবিতা তাঁর কাছে টাইমপাস নয় অস্তিত্বের পাসওয়ার্ড ... তাঁর কবিতা আসলে মানবিকতার ইস্তাহার (দ্র. আনন্দবাজার পত্রিকা / ১৫.১১.২০২০)  কবি সৌমিত্রকে তাঁর কবিতায় বিচিত্র ভাবনায় আমরা পাই, সেখানে প্রেম-প্রকৃতি কিংবা মৃত্যুচেতনা, মানবতা আর স্মৃতির ছবি এসবই রয়েছে। তবে নদী জল তাঁর কবিতায় ভিন্নমাত্রা পেয়েছে, এও সত্য। প্রয়াণের পর তাঁর কবিতাকে সেই জলজ দর্পণে ফিরে পড়া যেতে পারে।   


.

শুধু ভারতে নয়, সারা বিশ্বে তিনি সুঅভিনেতা রুপে বিখ্যাত, বন্দিত এবং বহু দেশি-বিদেশি পুরস্কার সম্মানে সম্মানিত অনুবাদ করেছেন বহু বিদেশি নাটক, লিখেওছেন বেশ কিছু। তাঁর পিতা মোহিতকুমার মা আশালতাদেবী তাঁর স্ত্রীর নাম দীপা দুই সন্তান তাঁদেরসৌগত পৌলোমী অভিনেতার আড়ালে কবি সৌমিত্র কিছুটা প্রচ্ছন্ন যদিও কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নছোড় অনুরোধ চাপে তিনি কবিতার জগতে প্রবেশ করেছিলেন শক্তির উদ্যোগেই  ১৯৭৫- প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ : জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াব বলে প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন সত্যজিৎ রায় ছড়াকার অমিতাভ চৌধুরী নেপথ্যচারী কবি সৌমিত্রকে নিয়ে লেখেন :

                    নুন-সাহেবের ছেলে তিনি

                                          সত্যজিতের নায়ক,

                    অভিনয় ছাড়েন তিনি

                                           ফাস্টোকেলাস শায়ক

                     কখন তিনি অপুবাবু

                                            কখন তিনি ফেলুদা,

                      মঝে মঝে পদ্য লেখেন

                                          যেন পাবলো নেরুদা

 

গড়পরতা বাঙালি ছেলের মতোই সৌমিত্রও প্রেমে পড়ে কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন নানা কাজে, অভিনয়ের নানা চরিত্রে ঢাকা পড়া মানুষটি স্বীকার করেন,কবিতা আমাকে মুক্ত করে দেয় ভাবেন, ‘মানুষ কখনো ঋণ নিয়ে মরতে চায় না। কবিতাই  সময়ের কাছে, মানুষের কাছে, আমার সেই ঋণস্বীকার তাই তাঁরকবিতাসমগ্র ভূমিকায় জানান :

আমি কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম কৈশোরের নতুন জন্মানো প্রেমাকাঙ্ক্ষার আন্দোলনে...পরবর্তীকালে অবশ্য একটু, একটু করে প্রকৃতি, সমাজ, বেঁচে থাকার অপরিহার্য অভিজ্ঞতাও কবিতার মধ্যে ফুটে উঠতে থাকে লাগল

তাঁর কবিতার প্রথম শ্রোতা স্ত্রী দীপা, একসময় যাঁকে চিঠির বদলে কবিতা লিখে মনোবাসনা প্রকাশ করতেন প্রথম দিকে তাঁর লেখায় রাবীন্দ্রিক ছোঁয়া ছিল যা বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পরামর্শে সংশোধন করেন কবির কথায়,আসলে তখন আমাদের প্রভাবিত করেছে জীবনান্দ দাশ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়েরা কীভাবে তিনি কবিতা লেখেন? সৌমিত্রর স্বীকারোক্তি :  কবিতা আমি লেখার কে? না, কবিতা আমার দ্বারা লিখিত হয়। ...কখনও শ্যুটিংয়ে দুটো শটের মাঝেখানেও কবিতা লিখে ফেলি বাড়িতে এসে রাত্রে মেজে ঘষে ঠিক করি। ...কখনও বা একটা কবিতাই দুচারদিন ধরে কাটাকুটি সংশোধন করে তৈরি হয়


.

 প্রেম  প্রকৃতি সৌমিত্রের কবিতা মুখ্য বিষয়। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলির নামকরণ লক্ষ করলে -ধারণা স্পষ্ট হয় : ‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াব বলে’, ‘স্বেচ্ছাবন্দি আশার কুহকে, ‘ব্যক্তিগত নক্ষত্রমালা, ‘হায় চিরজল’, ‘হলুদ রোদ্দুর’, ‘পড়ে আছে চন্দনের চিতা’, ‘মধ্যরাতের সংকেত’, ‘ভাঙা পথের রাঙা ধুলায় ইত্যাদি আকাশ ,ঋতুনক্ষত্ররোদ আর নদীজল ঘুরেফিরে আসে তাঁর কবিতায়  বিশেষ ভাবে নদী আর জল যেন তাঁর কবিতায় ধ্রুবপদ এক এক দিন’ কবিতায় পড়ি,    

                          এক এক দিন

                          একটা নদী জেগে ওঠে এই দেহটার মধ্যে

                          কূল ভেঙে দেয়                      

                          নিরাপদ যা কিছু ছিল খরস্রোতে ভাসে

কখনও বা ঘুমের মধ্যে তিনি শোনেন ‘অনেক জলের শঙ্খধ্বনি ‘হায় চিরজল কাব্যে বলেন, ‘এক যাযাবর নদীর নূপুর ডাকছে তাকে (ভিতের নিচে বিদ্রোহী সুর ) নদী  প্রেমের সাধর্ম্য তিনি খুঁজে পান তার ভাঙা-গড়ার মধ্যে কোথায় খুঁজবে তাকে কবিতায় পড়ি :   

                                 বাঁক তো ভেঙেছে আজ নদী

                          তার মন কোনদিন  ফিরবে কি মানুষ অবধি?

আর হায় চিরজল কবিতায় লেখেন,

                             না হয় তুমিও এক নদীরই মতন

                             থেকে যেতে চিরদিন 

পড়ে আছে চন্দনের চিতা দেখেন ‘নদী চলে গেলে চলে যায় প্রেম না নদীনা নারী – কেউই ধরা দেয় নাবন্দিও থাকে না তবুও কবির কাজ শব্দ সাধনা শেষ কাব্য ভাঙা পথের রাঙা ধুলায়’- কবি সৌমিত্র প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছেন, ‘মহাশূন্যের কাছে তবু সিন্ধু তার জলশব্দে অঙ্গীকার করেই চলেছে তোমার অন্ধকারকে আমি মুখর করবো পৃথিবীর মহাসমুদ্রধ্বনির পাশে কবি ‘ধর্ষিতা ধরিত্রী যন্ত্রণাকেও রাখেন। তাই অন্ধকারকে আলোকিত করার এই তীব্র অঙ্গীকার তাঁর।


.

নদী জল নিয়ে এই আবেগে রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার সৌমিত্র বহন করেছেন। রবীন্দ্রনাথেরনির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’- ঝর্ণা   নদীর রূপকল্প আজো আমাদের স্মৃতিধার্য। আবারনদী’(১৮৯৬) নামেই রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন আমরা জানি, পুস্তিকা আকারে তা অলংকরণ সহ প্রকাশিত হয়। বাংলা দীর্ঘকবিতা লেখার সূত্রপাত সম্ভবত এইখানেই। সে-কবিতায় সাগরগামী নদীর চোখে পাড়ের ছবি উজ্জ্বল হয়ে আছে। তবে পদ্মা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের তীব্র আকুলতা; ‘পুনশ্চকাব্যেও তাইকোপাইকবিতায় লেখেনপদ্মা কোথায় চলেছে দূর আকাশের তলায়, / মনে মনে দেখি তাকে।কুমুদরঞ্জনের অজয় কিংবা জীবনানন্দের ধানসিড়ি নদীর কথাও আমাদের প্রসঙ্গত মনে পড়ে। সেখানে সৌমিত্র তাঁর কবিতায় নির্দিষ্ট কোনো নদীর কথা  বলেন না বা শুধু তাকেই চিত্রিত করেন না। বহমান জলস্রোত বা জলপ্রপাত তাঁকে আকর্ষণ করে। সমুদ্র তাঁর চোখেএকা যুদ্ধার্থী নারী জলতলে খুঁজে পানপ্রত্ন শৈশবের রথ সম্পর্কের দূরত্বের ছবি তাঁর কাছে এইভাবে আসে :

আমরাও আজ বুঝি দুটি নৌকারই মত

দুদিকে গিয়েছি সরে

প্রতিমা ভাসান দিয়ে... (মাঝে জলস্রোত, হে সায়ংকাল)

বিচ্ছেদের মাঝখানে খেলা করে নদীর জলস্রোত আর পরিণত বয়সে তাঁর উপলব্ধিতে নৌকা পারাপারের ছবি ফিরে আসে  অন্য আরেক অনুভবে :    

এক নারীদেহ নৌকার মতো

আমাকে সেই অন্ধকার পার করে এনেছিল

তাকেই তো মা বলে ডেকেছি।  (ক্যালাইডোস্কোপ)

মাতৃগর্ভের জলে ভাসমান শিশুর অবচেতনে জলের এই স্মৃতিই সম্ভবত কবি সৌমিত্রকে জলের কাছে টেনে নিয়ে গেছে বারবার।ধারবাহিক তোমার জলেকাব্যের নাম কবিতায় কবি তাই প্রশ্ন করেন : ‘ধারাবাহিক, তোমার জলে ভয়ঙ্কর টান  / ধারাবাহিক, বলো তো শেষ কবে আখ্যান?’ তাঁর কবিতায় এই জলের গল্প শেষ হয় না কখনও।।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন