সোমবার, ১ মার্চ, ২০২১
মলয় রায়চৌধুরী-র কবিতা
বাসন মাজা
রবীন্দ্রনাথ, আপনি কখনও বাসন মাজেননি সেটা জানি
কেননা আপনি তো গুরুদেব যাঁরা বল্মীকের ভেতরে থাকেন
বুদ্ধদেব বসু মহাশয়, রান্নাপটু, উনিও মেজেছেন কিনা সন্দেহ
জীবনানন্দ বউকে একই সঙ্গে ভালো ও খারাপ বাসতেন
ডায়েরিতে আইনস্টাইনি ফরমুলায় বলেননি বাসন মাজার কথা
এবং বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন দত্তেরা জানি না জানতেন কিনা
কাজের মেমরা এসে কোথায় বাসন মাজেন ! অলোকরঞ্জন থাকেন
অর্ধেক বিদেশে আর বাকি হাফ দেশে ; আলোক সরকারও
হয়তো জানতেন না বাজারে এসে গেছে বাসন মাজাকে কবিতার চেয়ে
সহজ করার জন্য ঝুরোসাবান তারের নানান জালিকা ।
মহিলা ও পুরুষ কবিদের এটাই তফাত — অনেকে জানে না ।
আমি আর দাদা শৈশব থেকে শিখেছি বাসন মাজার কারিকুরি
এখন তা কাজে দিচ্ছে ; বুড়ি তো ঝুঁকতে পারে না, আমি পারি
এই বয়সেও রোজই বাসন মাজি ফুলঝাড়ু দিই বুঝলেন আলবেয়ার ক্যামু
গারসিয়া মার্কেজ — প্লেগ নয়, করোনা ভাইরাসের দিনে বুড়ো-বুড়ি প্রেম !
মাহমুদ কামাল-এর কবিতা
শর্তহীন আহ্বান
ভালো লাগে শর্তহীন আহ্বান
তবে স্বত্বহীন নয়
যা কিছু পরোক্ষ তা সত্তাহীন বলেই
অপরোক্ষ নদীর স্রোত
অনুদিত জীবন প্রবাহে।
ভালো লাগে প্রকৃত প্রকৃতি আর
কৃতি ও কৃতীর সমন্বয়
প্রকৃতি শর্তহীন হলে সেই স্বত্বে
প্রণোদিত পাঠ্যসূচি অতি দ্রুত
দ্রবীভূত দ্বিতীয় সত্তায়।
ওবায়েদ আকাশ-এর কবিতা
অক্ষরেরা উড়ে উড়ে পাখি
কবিতায় পদ্য মেশাতে গিয়ে যে লোকটি ধরা পড়ে গেলো
দীর্ঘকাল ধরে তাকে আর দেখাই গেলো না
অথচ তার স্ত্রী বলছে, লোকটি ভালো মানুষের মতো ছিলো!
কন্যা বলছে, বাবার হাত যেন চন্দ্র-সূর্যের স্রষ্টা!
আর প্রতিবেশি একদল পুরুষ:
যাদের কারো উঁচু বুক, লম্বা চুল, শার্ট ও কামিজের মাঝামাঝি পরিধেয় পরে
প্রতিদিনের মীমাংসা ঘটান
শুধু তারাই লোকটির প্রতিপক্ষ আজ!
সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে যারা
মধ্যরাতে লোকটির কাছে খাবার পৌঁছে দেয়
তাদেরও আছে লোকলজ্জা, পুলিশের ভয় –––
একদিন আমি নিশি রাইতে তাদের সঙ্গী হতে চাইলে
এদিক ওদিক তাকিয়ে কানে কানে আমাকে বলে:
‘ঘুমের সঙ্গে রাত্রি কিংবা দিনের সঙ্গে নিদ মেশানোর দায়ে
ধরা পড়ে যাবেন! মেনে নিতে হবে নির্বাসন!’
এসব কথার আগামাথা না বুঝেই আমি দুপাশে তাকিয়ে দেখি:
একদিকে জীবনানন্দ দাশ আর অন্যদিকে শক্তিদা’র মুখ
কেমন নির্ভার চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে!
আমারও দুঃসাহস বাড়ে
তাদের পিছে পিছে মধ্যরাতে ধরাপড়া লোকটির কাছে যাই
আমাকে দেখেই লোকটি হোহ হোহ করে প্রাণ খুলে হাসে, হাসে
এবং কাশে –––
আর আমি তাকে বলি:
‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী’!
হাইকেল হাশমী-র কবিতা
প্রতিশ্রুতি
তুমি তো বলে ছিলে
দিগন্তের ওই প্রান্ত থেকে
উষার অরুণ রং কুড়িয়ে শীঘ্রই ফিরে আসবে।
তুমি তো বলেছিলে
মনের অনুর্বর মাটিতে
উজ্জ্বল আলোর ফসল ফলাবে।
তুমি তো বলেছিলে
মনের তিমির অন্ধকার পরিবেশে
চাঁদের নরম আলোর কিরণ ছড়াবে।
তুমি তো বলেছিলে
কল্পনার অসীম সীমানাকে
সোনালি তারা দিয়ে সাজাবে।
এখন তুমি নিজেই অন্ধকারে হারিয়ে গেলে
আর আমি আজো তোমার স্মৃতির জ্যোতি নিয়ে
বসে আছি তোমার অপেক্ষায়
জানি না তুমি কবে আসবে!
যশোধরা রায়চৌধুরী-র কবিতা
কর্মশালা
বেবাক, বিস্বাদ, বিষণ্ণ এক কর্মশালায় বসে আছ। দুদিকে দেওয়াল। মাথার ওপরে স্কাইলাইট। চুঁইয়ে আসা অল্প আলো। তারই ভেতরে লোহার গন্ধ। তামার গন্ধ। কল ওঠা বাসনের গন্ধ। কত অন্ধকার, অন্ধত্ব। কত না তুমুল হৃষ্ট পেতলের ঘটিবাটির ঢং।
আনন্দিত থাকার চেষ্টা করি। প্রতিমুহূর্ত ছিটকে যাচ্ছে মন, যেন আলোর ফুলকি হয়ে যাচ্ছে ঝালাইয়ের যন্তরের আগুন।
দৃষ্টি ঘোলাটে হলে, পাথরের অন্ধকার ভার সহ্য হয়ে যাবে , ভেবে, ঘোলাটে হতেই দিলাম। তবু আলো,
পথভ্রষ্ট আলো, চুঁইয়ে আসা আলো, আজো টানে।
এই সব উচাটন ঢং, খং, ধাতব আওয়াজে কান বুজে এল বুঝিবা।
পাথরের চ্যাটালো হাতের তালু থেকে গড়ানো জল চেটে খাচ্ছ। গলা শুকিয়ে আসছে। তবু থামতে পারছ না।
হাতুড়ির মধ্যে ভার, যেন মেয়েদের অসম্ভব ভারি হয়ে যাওয়া কোমর। উঠছে না পড়ছে না , থম মেরে আছে।
একদা নিখুঁত হাতে মালার ফাঁশ , ছোট্ট গিঁট, এমনকি সূক্ষ্ম মোচড়, সম্ভব ছিল। যেভাবে পায়ের বুড়ো
আঙুল দিয়েও একদা চমৎকার মাটিতে বালিতে এঁকে ফেলতে চতুষ্কোণ, বৃত্ত।
হাত ও পায়ের পুনর্জাগরণের জন্য আলো ত দরকার। স্কাইলাইটের ফুটোয় গড়িয়ে আসছে ধুলো ওড়া
আলো। তাই জমিয়ে জমিয়ে রাখছ কাচের বিকারে।
আশা রাখছ। আশা হারাচ্ছ না। সব উপাদান জড়ো করছ। তা দিয়ে
একদিন পরিপূর্ণ নিটোল মন্ত্রোপম ঘড়া, কিম্বা টিকটিক চলা সূক্ষ্ম ঘড়ি গড়তে শিখে যাব, তবু?