রবিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২৫

রঙিন ক্যানভাস ।। বর্ষ ৬ ।। সংখ্যা ৫১-৬২ (জানুয়ারি-ডিসেম্বর সংখ্যা) ।। জানুয়ারি-ডিসেম্বর সংখ্যার প্রচ্ছদ {জন্মদিন সংখ্যা}


 

সম্পূর্ণ সূচি ১ (বর্ষ ৬ ।। সংখ্যা ৫১-৬২) [জানুয়ারি-ডিসেম্বর সংখ্যা] {জন্মদিন সংখ্যা}


 

সম্পূর্ণ সূচি ২ (বর্ষ ৬ ।। সংখ্যা ৫১-৬২) [জানুয়ারি-ডিসেম্বর সংখ্যা] {জন্মদিন সংখ্যা}


 

সম্পূর্ণ সূচি ৩ (বর্ষ ৬ ।। সংখ্যা ৫১-৬২) [জানুয়ারি-ডিসেম্বর সংখ্যা] {জন্মদিন সংখ্যা}


 

সম্পাদকের নিবেদন

 

সম্পাদকের নিবেদন

মনোবিশ্লেষণের প্রবর্তক প্রফেসর সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯) গ্যালিলিও যেমন জ্যোতির্বিদ্যায়, ফ্রয়েডও তেমনি মনস্তত্ত্বের ক্ষেত্রে। তিনি বলেছেন যে মানুষ বয়স্ক হতে হতে জীবনকে আরও বেশিমাত্রায় অসহনীয় করে তোলে। মৃত্যু মনে হয় শেষ পর্যন্ত অনেক কমমাত্রায় অসহনীয়, তিনি মনে করতেন। তাঁর অনুভবী হাত দুটিতে ফুটন্ত ফুলের কোমল স্পর্শে, তিনি এই বলে গুরুত্ব দিতেন যে মৃত্যুর পরে যা-কিছুই ঘটুক না কেন, তার চাইতে তিনি, এই প্রস্ফুটনে অনেক বেশি আগ্রহী। তিনি অবশ্যই নিরাশবাদী নন। জীবনের ছোট ছোট উপভোগগুলিকে তিনি গুরুত্ব দিতেন।

নিজেদের মনোবিশ্লেষণের উপর তিনি জোর দিতেন। তবেই, অন্যদের আরও ভালোভাবে মনোবিশ্লেষণ করা সম্ভব। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সবকিছুকে বোঝার অর্থ কিন্তু সবকিছুকে ক্ষমা দেখানো নয়। মনোবিশ্লেষণ আমাদের শেখায়, যাকিছু আমরা সহ্য করতে পারি, শুধু তাই- নয়, এমনকি এও শেখায় যে, আমাদের কী কী এড়িয়ে চলা উচিৎ। এবং এর থেকে এও শিখি যে কাকে অবশ্যই নির্মূল করতে হবে।

ফ্রয়েড মানুষের সমাজ থেকে পশুদের সমাজকে অসীম মাত্রায় পছন্দের কথাও বলতেন। ফ্রয়েড ভাবতেন যে জটিল সভ্যতার সঙ্গে অসম্পূর্ণ সমঝোতায় বিপদগ্রস্ত হয়ে মানুষের অসম্মতিজনক অভ্যাসগুলি, এবং শ্রদ্ধার অভাববোধ জন্ম নেয়। বরং একটি কুকুরের সুতীব্র আবেগ, কতোই না সরল খোলামেলা।

ফ্রয়েড যৌনতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। আবার মৃত্যুকেও প্রায় সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই আত্মাহুতির একটি পদক্ষেপ হিসেবে কোনও কোনও মানুষ যন্ত্রণাকে ভালোবাসেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে যৌনতার যদি অভাব থাকে, তাহলে সমস্ত কিছুরই অভাব ঘটে। সমস্ত মানবিক ব্যাপারের আদি চালিকাশক্তি প্রেম ভালোবাসা-কে তিনি বিশেষ প্রাধান্য দিতেন। যিনি অবলীলায় মন্তব্য করতে পারেন যে ফুলগুলির সৌভাগ্যবশত না আছে চরিত্র, না কোনও জটিলতা।  তাই তিনি ফুলদের বেশি ভালোবাসেন।

সিগমুন্ড ফ্রয়েড মনস্তত্ত্ববিদ হিসাবে বিশাল পরিসরে বিরাজ করেন। মহান অস্ট্রিয়, সত্তার গহীন জগতের আবিষ্কর্তা তিনিই প্রফেসর সিগমুন্ড ফ্রয়েড। 


রঙিন ক্যানভাস’-এর সমস্ত লেখক পাঠককে আন্তরিক শ্রদ্ধা শুভেচ্ছা অভিনন্দন জানাচ্ছি।

সকলে ভালো থাকুন। 


রোশনি ইসলাম

সোনালি বেগম

ঋতম্ মুখোপাধ্যায়-এর ধারাবাহিক গদ্য : "কবিতার বাতায়ন"

 

রূপকথার যাবতীয় আবহ


রূপকথার কুশীলবগণ খুব দূরে নেই, যেন-বা খুব

কাছেই, ওই যে পাতলা আবরণ ছিঁড়ে উঠে আসছে 

রূপকথার যাবতীয় আবহ, রূপকথা কবেকার

তা কি এককথায় বলে দেওয়া সম্ভব, না, সম্ভব নয়

পুরাণ-পূর্ব সময়েও রূপকথা ছিল, পুরাণের সময়েও

ছিল, মধ্যযুগে ছিল, আধুনিক যুগে, অধুনান্তিকে

অথবা আধুনিক থেকে উত্তর-আধুনিকে যাওয়ার

ট্রানজিশনাল পিরিয়ডে, রূপকথার মধ্যে একটি

অরূপকথাও আছে, মানুষের মানুষের প্রতি প্রেম-অপ্রেম

সমস্ত অন্যায়ের প্রতিরোধে অসীম সাহস আর অভিযাত্রা   ( নাসের হোসেন : সাহস, লাফ : ২০১২) 


রূপকথা আসলে অপূর্বকথা বা অপরূপকথা; অবান্তর,অপ্রধান ছোট আখ্যায়িকাবলেছিলেন ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেন। জনৈক ইংরেজ সমালোচক রূপকথায় দেখেন ‘aspiration to a higher life, freer and purer life’ আর অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁররূপকথাশীর্ষক ছোট অথচ ভাবনাজাগর প্রবন্ধে জানিয়েছেন :

 প্রকৃতপক্ষে দেখিতে গেলে রূপকথা অবাস্তব নহে, উহা একটা বাস্তবতার দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।...রূপকথা কতগুলি অসম্ভব বাহ্যঘটনার ছদ্মবেশ পরিয়া আমাদের মনের সহিত ইহার প্রকৃত ঐক্যের কথা গোপন রাখিতে চেষ্টা করে। কিন্তু ছদ্মবেশ খুলিলেই ইহার সহিত আমাদের যোগসূত্র সুস্পষ্ট হইবে।’ ( রূপকথা / বাঙ্গালা সাহিত্যের কথা )   

এই সমাজের,সময়ের ক্ষতমুখ রূপকথায় উৎকীর্ণ রয়েছে বলেই এগুলিছদ্মবেশী সত্যকথা দেশে-বিদেশে সর্বত্রই এই রূপকথা বা ফেয়ারি টেল- নারীসমাজের যন্ত্রণার ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। স্নো হোয়াইট, সিণ্ডারেলা,হ্যানসেল-গ্রেটেল, দ্য ফ্রগ প্রিন্স, বুদ্ধু-ভুতুম, নীলকমল-লালকমল, সুখু-দুখু, সাতভাই চম্পা ইত্যাদি সমস্ত গল্পেই দেখা যায় সুয়োরাণী সুখী, দুয়োরাণী বঞ্চিতা। কিংবা স্বামীর আগের পক্ষের ছেলেমেয়ের প্রতি সৎ মায়ের নিষ্ঠুরতার ছবি দেখানো হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে  সেই সন্তানেরা রাজকন্যাকে জয় করে মায়ের দুঃখ ঘোচায়। আসলে অপ্রাপণীয় যে জীবন অচরিতার্থ যে স্বপ্ন তাকেই কাহিনিরূপ দেওয়া হয়েছে এসব গল্পে, অলৌকিকতার আগমনও সেই কারণেই। তাই লোকসাহিত্যের গণ্ডিতে রূপকথাকে বেঁধে রাখা হলেও আধুনিক সাহিত্যের আঙ্গিনায় সে ব্রাত্য নয়। উত্তরকালের বাংলা সাহিত্যেও পড়ছে রূপকথার ছায়া। বিশিষ্ট অবয়ববাদী আখ্যানতাত্ত্বিক ভ্লাদিমির প্রপ রাশিয়ার একশোটির বেশি লোককথা ঘেঁটে তাদের কথনবিন্যাসে পুনরাবৃত্তির একটা সাধারণ ছক খুঁজে পান। প্রায় একত্রিশটিনির্বাহণ’(Functions) তথা কার্য প্রতিক্রিয়ার সূত্রে প্রপ দেখান কিভাবে নায়ক কঠিন কাজের প্রস্তাব পান খলনায়ককে পরাজিত করে রাজকন্যাকে জয় করেন। এই প্রেক্ষিতে তরুণ মুখোপাধ্যায়ের প্রশ্নকতটুকু রূপকথা?’ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। উৎকলিত কবিতায় আমরা যে মিথ-পুরাণের কথা পেলাম, সেখানেও তো এমনই রূপক। হাতের কাছেই রয়েছেরামায়ণ রবীন্দ্রনাথ যে-রামায়ণে কৃষিজীবী আর যন্ত্রসভ্যতার দ্বন্দ্ব খুঁজে পেয়েছেন। সাম্প্রতিক কালের বাংলা কবিতা কিংবা উপন্যাসে রূপকথার নানাবিধ পুনর্নির্মাণ ঘটে দেখি।  বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে থেকে একালের শিবাশিস মুখোপাধ্যায়ের কবিতাতেও এসেছে রূপকথার চরিত্র : কঙ্কাবতী, নীলকমল-লালকমল, রাক্ষস-রাক্ষসী, রাজা-রাণী-রাজকুমার-রাজকন্যা ইত্যাদি প্রসঙ্গ। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের আধুনিক গল্প-উপন্যাসেও এসেছে রূপকথাধর্মিতা। তাছাড়া জাদু-বাস্তবতা, অধিবাস্তবতার ভিতরেও কি নেই রূপকথার ক্ষীণ ছায়া?  আশির কবি নাসের হোসেনের কবিতাকে দেখি উত্তরাধুনিকতার স্পর্শ মেখে ঐতিহ্যলালিত শিশুতোষ রূপকথাকে অবলম্বন করেছে। রূপকথার ছদ্মবেশ ভেদ করে তাকে সমকালে অনুবাদ করে নেন আর দেখতে পান সেই অরূপকথাকে, যেখানে : ‘মানুষের মানুষের প্রতি প্রেম-অপ্রেম / সমস্ত অন্যায়ের প্রতিরোধে অসীম সাহস আর অভিযাত্রা অমল শৈশবকে ছুঁয়েও তাঁর এই কবিতা ব্যঞ্জনাময় হয়ে ওঠে ক্রমশ। পুরাণ থেকে উত্তর আধুনিকে তিনি রূপকথাকে যাত্রা করাতে চান। 


২.


রুশ লোককথার ভিতরে যেসব মায়াবী রূপকথাগুলো আজও আমাদের স্বপ্নলোকের সঙ্গী হতে পারে, তেমনি একটি গল্পসিভ্‌কা-বুর্কা ছোটবেলায়মণির পাহাড়নামে একটি সংকলনে অনেকেই আমরা -গল্প পড়েছি বহুবার। বুড়ো বাবার মৃত্যুর পর তাঁর শেষ ইচ্ছে বজায় রেখে পর পর তিনদিন কবরে গিয়ে খাবার দিয়ে আসার পুরস্কার পায় বোকা ইভান। বাবা তাকে সিভ্‌কা-বুর্কা নামের এক জাদু ঘোড়ার খবর দেন। যার গতি তেজ অসামান্য। সেই ঘোড়ার ডান কান দিয়ে ঢুকে বাঁ কান দিয়ে বেরিয়ে ইভানের রূপ খুলে যায়। আপাতভাবে বোকা অলস ইভান এই ঘোড়ার সাহায্যেই তার চালাক দাদাদের ছাপিয়ে রাজকন্যাকে জয় করে ফেলে। সে হয়ে যায় রাজার জামাই। নাসের তাঁরদ্রুতকবিতায় এই রুশী রূপকথাটিকে পুনর্লিখন করেছেন, এও একরকম উল্লিখন (allusion) এবং আন্তর্বয়ানযোগ্য (Intertextual) পাঠ বলা চলে। সেখানে গল্পটির পরিচয় দিয়ে তিনি জানান, এই যাদুঘোড়া মানুষকে সাহসী বিজয়ী করে, বাড়ির ছোট ছেলে ইভানের সঙ্গে নিজেকে একই আসনে বসান কবি। শেষাংশে লেখেন :

               আমি একটা ছোট ছেলে এবং বাড়ির 

ছোটো ছেলে। আমার দায়িত্ববোধ অন্য কারো থেকে

কম নয়। আমার নাম ইভান। কিন্তু তফাৎ যেটা 

সেটা হল আমি বাড়ির বাইরেটা নিয়ে একটু বেশি

ভাবি। সবসময় মনে হয় পৃথিবীটা এত বড়ো

এবং সময় এত কম। সুতরাং যে-কাজ সারতে

হবে তা করতে হবে খুব দ্রুত। সিভ্‌কাবুর্কা-

হ্রেষা খুরধ্বনিতে সওয়ার হয়ে ঝড়ের মতো

নিমেষে পৌঁছে যাচ্ছি অসহায় মানুষদের মাঝে, শুনছি।  (দ্রুত, লাফ : ২০১২) 

রূপকথার স্বপ্নপূরণের কাহিনিকে কবি এখানে ব্যক্তিগত থেকে নৈর্ব্যক্তিক করে তুলেছেন। একালের ইভান  রাজকন্যাকে জয় করাকেই উদ্দেশ্য ভাবে না, তার লক্ষ্য অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। রূপকথার ভিতরে সাহস আর বিজয়ের সুরটিকে নাসের বারংবার বড় করে তুলেছেন দেখা যায়। 

আবার এরই পাশে প্রাচ্যদেশীয় রূপকথা আলাদিন তার আশ্চর্য প্রদীপের রেফারেন্স এসে যায়গাছকবিতায়। -কবিতা প্রত্যাশা প্রাপ্তির বিরোধে ভরা যে মানব জীবন, তারই রূপক :

যদি জীবন রয়েছে জীবনের মতো করে তবু

কখনো কখনো মনে হয় ঠিক যেমনটি চেয়েছি

তেমন তো নয়, শিরা-ওঠা বৃদ্ধ বটের গায়ে

নবীনা বল্লরী যেভাবে বেড়ে উঠতে চায় কিংবা

উড়ন্ত জাজিমের ওপর আলাদিন তার আশ্চর্য 

প্রদীপ, যেন বা চিরনূতনের দেশ, ...   (গাছ, লাফ : ২০১২) 

জীবন তো পাল্টায়, চাওয়া-পাওয়ার হিসেবও বদলে যায়। মুখের পাশে দুঃখকে রেখেই কবি সকলের শুভার্থী হয়ে ওঠেন। এই গাছের অনুষঙ্গ তাঁর আরো একটি কাব্যে আমরা আগেই পেয়েছিলাম, সেখানে উত্তরাধুনিক যাদুবাস্তবতার ছোঁয়া লেগেছে : 

মগজ ফাটিয়ে উঠে এসেছে গাছ

দোল খাচ্ছে

প্রতিটি পাতায় বয়ে চলেছে মানুষের পা

প্রতিটি ফলে ছলকে উঠছে মানুষের হৃদয়

প্রতিটি ফুলে কেঁপে যাচ্ছে মানুষের হাত   (গাছ, গ্যাব্রিয়েল বলো : ১৯৯৭) 

-কাব্যে দেবদূত গ্যাব্রিয়েল যেমন পুরাণপুরুষ, তেমনি যাদুবাস্তবতার স্মরণীয় কথাকার মার্কেজও। শিল্পের পাখিকে কবিরহস্য-সমুদ্রের মহাকল্লোলেউড়তে দেখেন। সে-পাখি শিস দেয় তাঁর গাছে বসেই। এখানেও জাদুবাস্তবের যে আবহ, তা রূপকথারই উত্তরজাতক। গাছের সঙ্গে মানুষের তুলনা এজরা পাউণ্ডের বিখ্যাতমেয়েটা’ (A Girl) কবিতায় আমরা আগেই পেয়েছি,  

গাছটা এই তো ঢুকল আমার হাতে,

প্রাণরস ওঠে আমার দ্বিভুজে, আর

গাছটা আমার বুকে উঠে বেড়ে চলে

নিচে

গজায় ডালপালা, যেন অবিকল ভুজশাখা।


তুমিও একটা গাছ

শ্যাওলা সেটাও তুমি,

তুমি অসংখ্য ভায়োলেট হাওয়া যাদের ওপরে কাঁপে

শিশুঅতো বড় তুমি :

পৃথিবীর চোখে এটা বড়ো দুষ্টুমি।  (অনুবাদ : অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত) 

আর কবিকিশোর সুকান্তচারাগাছ’, ‘আগামীইত্যাদি কবিতায় বীজ থেকে গাছ হয়ে ওঠা-কে মানবজীবনের বিকাশের রূপকার্থে ব্যবহার করেছেন চমৎকার ভাবে। বাংলাদেশের সমরেশ দেবনাথও লিখেছিলেন : প্রতিটি বৃক্ষের রক্ত প্রবাহে / একজন করে মানুষ ঢুকে আছে... (বৃক্ষের সংসারে একা) যদিও এঁরা সকলেই উপনিষদ, কালিদাস রবীন্দ্রনাথের উত্তরজাতক। তবে নাসেরের কবিতায় এই গাছ স্বাভাবিক ছন্দে স্পন্দিত হয়নি, ভাঙাচোরা সময়ে গাছকে তিনি আমাদের প্রতিনিধি করে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেনকথা বলো বিজ্ঞান   ঝাড়ফুঁক / কথা বলো যাদুবাস্তবতা যদি রহস্যসাগর পেরিয়ে উত্তর অজানাই রয়ে গেছে। 


৩.


‘The child is the father of man’ এই ওয়ার্ডসোয়র্থীয় উচ্চারণের পুনর্লিখন করেছেন গোলাম মোস্তফাঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে নাসের দেখেন : ‘শিশু সেই আয়না / মানুষ / নিজের মুখ দেখে’ (শিশু) তিনি চান আলোর স্মৃতির কাছে ফিরে যেতে বারবার, অন্ধকারের স্মৃতিকে স্বীকার করেন না তিনি। ছেলেবেলার দেখা কোনো বাঁদর-নাচ তাঁকে নস্ট্যালজিক করে। কখনো বা ডিসকভারি চ্যানেলে সমুদ্রের তলায় মাছেদের খেলা দেখে সেই জলজ আবহকে মনে হয় জলের স্কুল। শিশুদের প্রজাপতির মতো গুঞ্জন তাঁকে আনন্দ দেয়। যখন কোনো বালককে দেখেন অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছেদের পুকুরে ছেড়ে দিয়ে আসতে, বলেনসে জানে না আপেক্ষকিতা, / জীবন অজীবনের দ্বন্দ্ব, সে শুধু মুক্তি জানে’(রঙিন মাছ, গ্যাব্রিয়েল বলো)  আকাশের নীলাভ পেট চিরে নেমে আসা শিশুদের পা তাঁর কাছেজয় ভালোবাসার জয়এই আনন্দধ্বনি শোনায়।  টলোমলো পায়ে হেঁটে যাওয়া অন্ধকারের শিশুর অস্তিত্ব তাঁকে আশাবাদী করে। সব বিপর্যয়ের পরেও আশা রাখেন  অজস্র দুর্গতির মাঝেও, কোথাও, জেগে উঠবেই, একদিন প্রাণ’ (যে শিশু, অন্ধকারের, ছায়াপুরাণ : ২০০০) সেই প্রাণের প্রতীক শিশুদের স্বপ্নিল রূপকথায় যে অভিযাত্রার ছবি আছে তা শেষাবধি নাসের তাঁর কবিতায় লালন করেছেন বলেই লোকপুরাণের অবয়বে সেই পুরাতন রূপকথাপ্রতিম আখ্যান তাঁর কবিতায়  ফিরে ফিরে এসেছে।পশ্চিমকর্তব্যকবিতায়  মনসামঙ্গলের বেহুলা-লখিন্দরের চেনা কাহিনি পাই আমরা :

) পুরাণযুগ থেকে বয়ে আসা এক নদী, সে-নদীতে

অনেক অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে, বেহুলা লখিন্দরের

ভেলা ভেসে গিয়েছিল স্বর্গের দিকে, স্বর্গীয় সভায়  (পশ্চিম, লাফ)

) -নগর হয়তো-বা স্বর্গেরই বিকল্প কিছু

এখানেও রয়েছেন দেবতা, দেবীরাও, সেইসব দেব

দেবীদের নাম আমাদের চেনা, সেখানকার অদ্ভুত

গাছগাছালিরাও যেন-বা অচেনা নয় কিছু, এখন

প্রধান কাজ কর্তব্য লখিন্দরকে বয়ে নিয়ে যাওয়া   (কর্তব্য, লাফ)

পোস্টমডার্নিজম ফিরে যেতে চায় অতীতের কাছে, আনে একাধিক টেক্সটের অনুষঙ্গ বা ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি, সংরূপের বেড়ি ভাঙে। পুরাণের নবনির্মাণ, সমকালের নিরিখে তাকে ব্যাখ্যা, প্রশ্নায়ন,এমনকি পরিহাসবিদ্ধ করাও তার কাজ। এখানে লখিন্দরের লাস প্রাণময় হয়ে আছে বলেই তা নতুন জীবন পায়, কবি ভাবেন। এভাবে লখিন্দরকে বহন করে যেন তিনি ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর আস্থা ব্যক্ত করেন তাকে পুনর্জীবিত করতে চান।  অতএব নাসের তাঁর কবিতায় যে-রূপকথার আবহ রচনা করেন, তা কেবল লোককথাতেই সীমায়িত হয় না, সেখানে রামায়ণের রাম-সীতা-হনুমান-পুষ্পক রথ কিংবা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের চক্রব্যূহ এবং মঙ্গলকাব্যের কাহিনিও মেশে। পুরাণ-পূর্ব কাহিনি থেকে অধুনান্তিকে যিনি রূপকথার সন্ধানী, তাঁর অভিযাত্রী মন হাজার বছরের পথ হাঁটতে ভালোবেসে। কবিতায় লেখেন অন্তহীন প্রেম। সেলাম জানান মাটি, দর্শক শিশুদের : ‘যাদের মধ্য থেকে আবারো কোনোদিন / লাফ দিয়ে উঠে আসবে এক লক্ষ জ্যাকজ্যাক অ্যান্ড দ্য বিনস্ট্যক্‌’ (জ্যাক সিম)-এর সেই জাদু বিনস্‌ও আকাশচুম্বী গাছে উঠে দৈত্যপুরীতে অভিযান কিংবাজ্যাক দ্য জায়াণ্ট কিলার’ (দৈত্যবিনাশী জ্যাক)-এর একের পর এক দৈত্যহননের কৌশলী অভিযানের পর সুখে ভরা জীবনযাপনের সাহসী রূপকথাগুলি আমাদের মনে পড়ে নাকি?         



গ্রন্থঋণ :

) নির্বাচিত কবিতা, নাসের হোসেন, কবিতা পাক্ষিক, ২০০৪

) লাফ, , ২০১২

) মণির পাহাড় (সোভিয়েত দেশের নানা জাতির রূপকথা), অরুণ সোম সম্পাদিত, অনুবাদ : ননী ভৌমিক সুপ্রিয়া ঘোষ, রাদুগা প্রকাশন, মস্কো  

) সিন্দারেলা অন্যান্য রূপকথা, ভাষান্তর : কমল রায়, কসমস : কসমো স্ক্রিপ্ট, ১৯৮৬

) বিঊট অ্যান্ড দ্য বীস্টো অন্যান্য রূপকথা, ভাষান্তর : কমল রায়, কসমস : কসমো স্ক্রিপ্ট, ১৯৯১ 

) রূপকথার ছদ্মবেশ এবং বিশ্বসাহিত্য, ঋতম মুখোপাধ্যায়, এভেনেল প্রেস, ২০১৫

) বিগিনিং থিওরি, পিটার ব্যারি, ভিভা বুক্‌স্‌, তৃতীয় সং, ২০১০