গৌতম ঘোষদস্তিদার : চিনতেন কবিতার রক্ত ও মাংস
কিছু দিন আগে ( ০৪/০৪/২০২৪) চলে গেলেন গৌতম ঘোষদস্তিদার। একাধারে কবি, সম্পাদক এবং সাংবাদিক। তবু আমার মনে হয় সম্পাদক গৌতম-ই ছিলেন তাঁর প্রথম পছন্দ। যে গভীর যত্ন ও মেধায় তিনি পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন শুরু সম্ভবত ১৯৮৯) তা ব্যতিক্রম না হলেও বিরল। নতুনদের কবিতা ছাপতেন, কিন্তু মানে আপোশ করতেন না। তাই সব বাঙালি তরুণের মতোই যখন কবিতা লিখতে শুরু করছি, পত্রিকার ঠিকানায় লেখা পাঠালাম। তিনি ছাপেননি। সামান্য খারাপ লাগলেও, নিজেকে বোঝাতে পেরেছিলাম, আরও প্রস্তুত হতে হবে। পরোক্ষ শিক্ষা।
২০০৪ সালে প্রকাশিত ‘ভেদাভেদের কথাসাহিত্য’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখছেন, “আলবেরুনি বলেছিলেন, হিন্দুরা কখনও ধর্মের জন্য প্রাণ দেয় না। কিন্তু, আমরা দেখেছি, পরবর্তী সময়ে বারবার হিন্দু-সুসলমানের রক্তে ভিজে গিয়েছে এদেশের মাটি। সে-জন্য ইংরেজ-সাম্রাজ্যবাদকে খুব অনায়াসে দায়ী করা গেলেও, সে-বীজ আসলে সুপ্ত ছিল মানুষেরই মনে। গোষ্ঠীপতি, রাজ্য, রাষ্ট্র কায়েমি স্বার্থসিদ্ধির জন্য সেই বীজকে বিষবৃক্ষের বিস্তার দিয়েছে। সাধারণভাবে সারা পৃথিবীর ইতিহাস এ-ক্ষেত্রে একই সুতোয় বাঁধা। বিপরীতে, আমরা দেখেছি, সাহিত্য কখনও এই সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেয় না। সহিতত্ব থেকে যেহেতু সাহিত্যের প্রকল্পনা, সেহেতু মানুষে-মানুষে সম্পর্ক, সমাজ ও ব্যক্তির সম্পর্কগত দ্বন্দাদ্বন্দই সাহিত্যের বিভাব-অনুভাব। বাংলা সাহিত্য এই মূলসুত্র থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বস্তুত, বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ ধর্মীয় শাখা-প্রশাখার প্রযত্নে হলেও তা প্রবল নৈর্ব্যক্তিকতায়, অসীম অসান্প্রদায়িকতায়, মানবতার চূড়ান্ত রূপায়ণে আজও সমুজ্বল।” তাঁর এই বক্ত্যবের দু’দশক পরে আজকের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলোর গুরুত্ব নতুন করে আমরা উপলব্ধি করতে পারি। এবং বিস্মিত হই, তাঁর সত্যদর্শনে। কবিরা সংকেত রেখে যান।
ঠিক ভুল যাই হোক, কবিদের পরিচয়ে দশকওয়াড়ি হিসেবটা বাংলায় চালু হয়েই আছে। একটু সংশয় আছে তিনি সত্তর না আশি। ফেসবুকেও দেখলাম কেউ লিখছেন আশি, কেউ সত্তর। ‘আশির পূর্ণাঙ্গ পরিচয়’ যখন লিখছি, এই দ্বন্দ নিরসনে ওঁকেই ফোন করি। উনি নিজেই জানালেন, সত্তর। আশির তালিকায় ওঁকে রাখিনি। লিখিত নেই, কিন্তু এই তথ্য এখানে নথিভূক্ত থাকুক। অন্য কোনও প্রামাণ্য নথি পেলে, সামান্য তর্কটা না হয় শুরু করা যাবে। ওঁকে আশিতে ঠেলে দেওয়ার পিছনে আমাদের কাব্যরাজনীতির কোনও ভূমিকা নেই তো?
সিউড়িতে লিটল ম্যাগাজিন মেলা শুরু হবে। আয়োজক কাঞ্চন সরকার, তিনিও আর আমাদের মধ্যে নেই, আমার পত্রিকাকে আমন্ত্রণ জানান। খুব কম আয়োজকের কাছ থেকেই এমন আমন্ত্রণ পাই। গেলাম। নিতান্ত ব্যক্তিগত কারণে আমি আয়োজকদের ব্যবস্থা করা হোটেলে না থেকে, অন্যত্র নিজের থাকার ব্যবস্থা করেছিলাম। একটু দূরে। বন্ধুরা আপত্তি করলেও, রাত্রে যখন চলে যাচ্ছি নিজের হোটেলে, গৌতম বললেন ( উনি সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন ‘রক্তমাংস’ নিয়ে), চলে আসুন, আড্ডা চলুক। ওঁর আদেশ ফেলতে পারিনি। রাত গভীর পর্যন্ত সেই তুমুল সময় আমার স্মৃতি। ঘর নিয়ে পারমুটেশন-কমবিনেশনের সেই মজা আশাকরি সবার মনে আছে! উনি সস্ত্রীক থাকা সত্ত্বেও, নিজের ঘর ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। ঔদার্য।
সেই রাত্রে, সুদীর্ঘ দিন ধরে মনের একটা প্রশ্ন, সুযোগ পেয়ে, জিজ্ঞাসা করেই ফেলি। না, ওঁকে নয়, ওঁর স্ত্রী শ্রীযুক্তা ঊর্মিলা দেবীকে। লিটল ম্যাগাজিন মেলা বা বইমেলায় সর্বদাই ওঁকে দেখেছি, সাদার ওপর ছোটো কাজ করা শাড়ি পরতে। ব্যতিক্রমহীন। উনি হেসে ফেলে, জানালেন, ভালো লাগে। ওঁর রুচিবোধকে আমার শ্রদ্ধা। শুনলাম, উনিও অসুস্থ। সামলে উঠুন, সেরে উঠুন, প্রার্থনা।
ফোনে আমার নাম বলাতে, উনি বলেছিলেন, ‘জানি, আপনার কাজ আমি খেয়াল রাখি।’ কবিতা না ছাপানোর খারাপ লাগা ধুয়ে গিয়েছিল আলোর বন্যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন