শনিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

নীলাদ্রি দেব-এর প্রবন্ধ


হিমালয়ের কোলে গিদ্দাপাহাড়, সুভাষচন্দ্র বসুর স্মৃতি জড়িয়ে

কার্সিয়ংয়ের গিদ্দাপাহাড়কে আলাদা করে যে খুব জেনেছিলাম আগে, তেমন নয়। এবারে এক অন্য স্বাদ খুঁজে পেলাম। পাহাড় মানেই পলকে অজস্র মুহূর্ত, দৃশ্যের জন্ম। মেঘমুলুক। এই বৃষ্টি, এই রোদ। এরই মধ্যে ইতিহাস ছুঁয়ে দেখলাম। নেতাজি ইনস্টিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিস। তার সংগ্রহশালায় প্রবেশ করতেই অন্য অনুভব। সংগ্রহশালার ফলক থেকে প্রাপ্ত তথ্য ইতিহাসের অন্য এক অধ্যায়ের ভেতর পৌঁছে দিল।


মিউজিয়ামটি একটি ঐতিহাসিক বাড়ি। যা ভারতের কৃতি সন্তান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে জড়িত। বসু পরিবারের অন্যতম শরৎচন্দ্র বসু। ১৯২২ তিনি জনৈক মিঃ রাউলি ল্যাসসেলস ওয়ার্ডের কাছ থেকে বাড়িটি কিনেছিলেন। এর পর থেকে বাড়িতে এসেছেন, থেকেছেন বহু কৃতি জন। ১৯২৫ এর ১৬ জুন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যু। তার অল্প কিছুদিন আগে তিনি তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী বাড়িতে রাত্রি যাপন করেন। এই বাড়িতেই বিভিন্ন সময়ে বসুরা আত্মগোপন করেন। ১৯৩৩ থেকে ৩৫, শরৎ বোস এখানে প্রায় ঘর বন্দি ছিলেন। ১৯৩৬ সাত মাসের মতো ছিলেন সুভাষ। গিদ্দাপাহাড়ে থাকার সময় তাঁর সঙ্গে এমিলি শেঙ্কলের যোগাযোগ ছিল চিঠিতে নিয়মিত। এখানে অবস্থান অবস্থাতেই মোট যে ছাব্বিশটি চিঠি তিনি লিখেছিলেন, তার এগারোটিই এমিলি শেঙ্কলকে। এর উত্তরে এমিলিও সুভাষকে পাঠান দশটি চিঠি। সুভাষচন্দ্র বসু এমিলি শেঙ্কলের মধ্যেকার সম্পর্কের সুতোয় এভাবেই জড়িয়ে আছে পাহাড় কোলের এই বাড়িটি। ঐতিহাসিক ভাবেও চিঠিপত্রগুলি সাক্ষ্য দেয় সুভাষ, এমিলির ব্যক্তিগত পরিসরের। শুধু এমিলি নন, বাড়িতে বাসকালীন সময় চিঠি আদান প্রদান হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গেও। সে সময় বিতর্ক চলছিল 'বন্দে মাতরম' গান বিষয়ে। চিঠিপত্রে সে বিষয়ের উল্লেখ ছিল। গিদ্দাপাহাড়ের এই বাড়িটি শান্ত, স্নিগ্ধ। এমন উচ্চতায়, এমন পরিবেশের ভেতর এমন অবস্থান, যেন স্বর্গ ছুঁয়ে আছে। বাড়িতে সুভাষচন্দ্র বসুর যে ছবিগুলো পাওয়া যায়, তাতে কখনও তিনি আরাম কেদারায় বসে হিমালয়ের ধী স্পর্শ করে আধ্যাত্মচেতনায় লীন। কখনও লনে অস্থির চলাফেরায়। কখনও ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতিতে। বাড়িতে অবস্থানরত অবস্থায় তিনি তৎকালীন ইতিহাস, বর্তমান, ভবিষ্যতের ঠিক মাঝে অবস্থান করছিলেন। যেন প্রস্তুতি পর্ব। রাজনৈতিক অনেক চিন্তা বা প্রয়োগের বীজ সুপ্ত ছিল এই পাইন, ফারের দুনিয়ায়। ১৯৪৫, শরৎচন্দ্র বসু জেল জীবনের পর দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন এই বাড়িতে। শরৎ বোস, তাঁর স্ত্রী বিভাবতী দেবী এবং পরিবার পঞ্চাশের দশকের মাঝ বরাবর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়, এমনকি খানিক অবসরও কাটিয়েছেন গিদ্দাপাহাড়ে। মূলত তাঁদের শেষ অবস্থান ১৯৫৪। 


এরপর তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাড়িটি অব্যবহৃত ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই অবহেলিত। এবং অযত্নের শিকার। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বসু পরিবারের তরফে এর সামান্য রক্ষণাবেক্ষণ করা হলেও পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চশিক্ষা দপ্তর বাড়িটি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করে। তারা কিছু সময়ের ভেতর বাড়িটি পুনরুদ্ধার সংস্কার করে। নেতাজি ইনস্টিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজ, কলকাতার কাছে হস্তান্তর করে। নেতাজি ইনস্টিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজের তত্ত্বাবধানে ঐতিহাসিক এই বাড়িটিকে সংগ্রহশালায় রূপান্তরিত করা হয়। বর্তমানের মতো রূপ পায় ২০০০ সালে। সে বছর ২৩ এপ্রিল এর উদ্বোধন করেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৎকালীন উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী সত্যসাধন চক্রবর্তী। ২০০১ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এই সংগ্রহশালা পরিদর্শনকালে গেস্ট হাউসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। শ্রী ভট্টাচার্য সুভাষচন্দ্র বসুর শ্রী চক্রবর্তী শরৎচন্দ্র বসুর আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করেন। বর্তমানের এই যে নেতাজি মিউজিয়াম, তার ছবির গ্যালারি প্রকাশিত হয় ২০ মে ২০০৫, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর উপস্থিতিতে। এর পরিকল্পনা প্রয়োগে ছিলেন কলকাতার ভারতীয় জাদুঘর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন