তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে: কবি জয়দেব বসু
"মারকুটে কাব্য হোক, চাঁদ আর মেয়েদের কলস্বরে ভরে গেছে এপার বঙ্গাল
ভাববাদী কবিদের চরিত্র তো সর্বলোকে জানে, আর তাদের কথায় ভুলে
বিপ্লবীরাও দেখি চাঁদ বা মেয়ের দিকে ফাঁক পেলে আরেঠারে চান।
এবার অন্যভাবে কবিতা বানানো যাক--- এসো, লেখাপড়া করো,
কবিতা লেখার দু'বছর পোস্টার সেঁটে নেওয়া ভালো,
কায়িক শ্রমের ফলে বিষয় মজুত হয়--- এবং সমান ভালো
রান্না শেখা, জল তোলা, মানুষের কাছাকাছি থাকা।
পার্টি করার থেকে বিশল্যকরণী আর কিছুই নেই কবির জীবনে, আমি
অভিজ্ঞতা থেকে এই পরামর্শ দিতে পারি,
মারকুটে কাব্য করো, বুদ্ধিমান রকবাজ কবিতা বানাও,"
( জনগণতান্ত্রিক কবিতার ইশতেহার )
হ্যাঁ, কবি জয়দেব বসু সেই মারকুটে কাব্য করে গেছেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন বুদ্ধিমান রকবাজ কবিতা বানিয়ে গেছেন । পাঞ্জাবীর বোতাম খুলে খোলা হাওয়া লাগিয়েছেন পালে। বাংলা কবিতায় এক প্রতিস্পর্ধী কন্ঠস্বর তিনি। বিশেষ রাজনৈতিক চেতনা, দলের প্রতি আনুগত্য আর শব্দের প্রতি আনুগত্যকে তিনি এক করে দিয়েছিলেন।
সময়টা ছিল ১৯৭৯ সাল। আমি তখন বাংলা অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। এর ঠিক দু' বছর আগে অর্থাৎ ১৯৭৭ এ দেশে জরুরি অবস্থার অবসান হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। সেই যুগান্তের মুহূর্তে বামপন্থী মতবাদে বিশ্বাসী শিল্পী সাহিত্যিক অর্থনীতিবিদ সমাজবিজ্ঞানী ঐতিহাসিক ও নাট্যকর্মীদের নিয়ে অশোক সেনের সম্পাদনায় ১৯৭৮ সালের জুন মাসে আত্মপ্রকাশ করল মাসিক "বারোমাস" পত্রিকা। উল্লেখযোগ্য যেটা তা হল, এই "বারোমাস" পত্রিকার তহবিল গঠনের জন্যে ১৯৭৮-এ শম্ভু মিত্র তৃপ্তি মিত্র শেষ বার ‘রাজা অয়দিপাউস’ নাটক মঞ্চস্থ করেন ‘বহুরূপী’-র ব্যানারে।
এই পত্রিকাকে ঘিরে একদল তরুণ লেখক গোষ্ঠী সৃষ্টি হল। বলতে দ্বিধা নেই কবি জয়দেব বসু তার মধ্যে উজ্জ্বলতম।
এই তরুণ লেখকরা যাতে আরো শিক্ষিত হয়ে বিষয়ানুগ বৈচিত্র্যপূর্ণ উন্নতমানের সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে তার জন্য দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কের কাছে শরৎ বসু রোডে বারোমাসের তৎকালীন কার্যালয়ে মাসের শেষ শনিবার বিকেলে বসত বিশেষ সাহিত্য অধিবেশন। সাহিত্য পাঠের পাশাপাশি ছিল বাংলা সাহিত্য, ভারতীয় সাহিত্য এমন কি বিশ্ব সাহিত্যের উপর আলোচনা। আলোচনা করতেন কবি-সমালোচক শঙ্খ ঘোষ সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। সেইরকম এক মাসিক অধিবেশনে প্রথম আমি কবি জয়দেব বসুকে দেখি। সম্ভবত তিনি তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাঁর শিক্ষক ছিলেন কবি-সমালোচক শঙ্খ ঘোষ। বারোমাসে তখন তাঁর "মেঘদূত" সিরিজের কবিতা বের হচ্ছে। আমরা মুগ্ধ হয়ে পড়ি সে কবিতা। ইতিমধ্যে আমারও গোটা চারেক কবিতা বেরিয়ে গেছে। আলাপ হতে মৃদু হেসে হাত টেনে নিলেন। বললেন, রবীন, তোমার কবিতা পড়েছি। আমার পাশেই ছাপা হয়েছে।
এখনকার মত তখন এত কবি সম্মেলন বা সাহিত্য সভা ছিল না । তবুও প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর, কফিহাউস— যেখানেই হোক কবিতাপাঠের আসরে তাঁকে ঘিরে ভিড় থাকত। আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন এই সুদর্শন তরুণ কবি। অপ্রিয় সত্যকথা বলতেন বলে শত্রুও ছিল বেশি। দিল খোলা উদাসী এক স্বপ্নের মানুষ। তাঁর "মেঘদূত" দীর্ঘ কবিতাটি "প্রতিক্ষণ" পত্রিকায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি অগ্রজ কবিদের প্রশংসা যেমন পেয়েছিলেন, তেমনই পেয়েছিলেন পাঠকপ্রিয়তা। পাঠকদের সেই ভালোবাসা অকাল মৃত্যুর পর বহু গুণ বেড়ে গেছে। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ অগ্রজ কবিদের প্রশংসা কবি জয়দেব পেয়েছিলেন।
কলকাতায় জন্ম হলেও শৈশব কেটেছে দার্জিলিং ও শান্তিনিকেতনে। প্রেসিডেন্সি কলেজের বাংলা বিভাগের ছাত্র। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। দমদম মতিঝিল কলেজে আমৃত্যু অধ্যাপনা । কাব্যগ্রন্থ: মেঘদূত, ভবিষ্যৎ, জীর্ণ পাতা ঝরার বেলা, ভ্রমণ কাহিনী, শ্রেষ্ঠ কবিতা। পুরস্কার পেয়েছেন দুটি : সুকান্ত পুরস্কার আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার ।
ব্যক্তিজীবনে একটু বেহিসেবি হলেও উদার আর বন্ধুবৎসল ছিলেন। কবি যে দল বা বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, এবং লিখেছিলেন, "পার্টি করার থেকে বিশল্যকরণী আর কিছু নেই কবির জীবনে।" দুঃখের বিষয় সামান্য কারণে সেই দল তাঁকে বহিষ্কার করে। তবুও তিনি আজীবন বামপন্থায় আস্থা রেখেছিলেন।
কবিতার বক্তব্যে যেমন দৃঢ় ছিলেন, তেমন ছন্দের হাত ছিল চমৎকার। এক অনায়াস অভ্যাসে নিখুঁত ছন্দে "রক্তকরবী" কবিতায় লেখেন----
"পেরিয়ে গেছি মেঝেনদের দেশ
পেরিয়ে গেছি কুষ্ঠে খসা গ্রাম,
জানো কি তুমি অনেকে এখানেও
ফিসফিসিয়ে বলে তোমার নাম।"
চারপাশের দমবন্ধ অন্ধকার অপ্রেম আর অসুন্দরের মাঝে তিনি হাত ধরেছেন নন্দিনীর, রবীন্দ্রনাথের। শাশ্বত প্রেমের।
"পুরাণে বলে, লোককথায় বলে
আসবে তুমি কখনো কোনোদিন
মুছিয়ে দেবে গেরস্থালি চোখ
অনামিকায় ফোটাবে আশ্বিন।"
কিন্তু এ যুগের নন্দিনীর কী পরিনতি? সমাজ বাস্তবতায় কবি জয়দেব তাও দেখিয়েছে । আর আমরা শিউরে উঠি।
"মস্ত এক পাঁচিল পার হয়ে
পরের পর দরজা ঠেলে ঠেলে
খুঁজে পেলাম তোমাকে নন্দিনী
নিখোঁজ এই পাগলিদের সেলে।"
একহাতে আগুন নিয়ে অন্য হাতে শব্দকে ছেনেছেন। তার নিভৃতেই রয়ে গেছে কবির চিরকালীন আর্তি, কবির অনন্ত বাসনা—
"খাওয়া হয়নি শালিধানের চিঁড়ে
খাওয়া হয়নি সোনামুগের ডাল,
দেখা হয়নি পুণ্যিপুকুর ব্রত
স্বপ্নে আমার বউ আসেনি কাল।" (বাসনা)
সমসাময়িক তরুণ কবিদের প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল। আবার তাদের স্বাধীনতার পক্ষেও তিনি সজাগ ছিলেন।
"তরুণ কবিরা শুনি
অনেকেই অতিবিপ্লবী
কেউ কেউ দাড়ি রাখে। কেউ যায়
খালাসিটোলায় বাকিসব করে রব
এখানে সেখানে। তবু তারা
নিয়মিত জ্যান্ত কবিতা লিখে থাকে।...
এসো ঐ কবিদের ছুঁয়ে দেখি
অনুভূতিদেশ।"
তরুণ কবিদের প্রতি তাঁর ভালোবাসাই তাদের উদ্দেশ্যে সতর্কতা দিয়েছিল।
"সারাক্ষণ এর পিছনে ওর পিছনে কাঠি না দিয়ে লেখো, ইডিয়ট, লেখো। শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে, যদি পারো এই ফাঁকে আরো কয়েকটি কবিতা সংযোজন করে যাও মানুষের স্মৃতির পাতায়। কয়েকটি কবিতামাত্র।" (ডায়েরি থেকে)
রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকলেও কবি জয়দেব বসু আবহমান বাংলা কবিতার প্রবহমান শরিক।
"রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রদ্ধাস্পদেষু" কবিতায় লেখেন,
"আমার কাঁধের উপর
থাকুক তোমার ভার
আমি হাঁটতে থাকি
আকাশ বাতাস যার
যে পার হবে কান্তার
সে তো আমার মধ্যে
বকুল ঝরে দারুণ
আমি হাঁটতে থাকি….
দল তাঁকে ভুলে গেলেও বাংলা কবিতা তাঁকে ভোলেনি।
অসময়ে চলে না গেলে তাঁর ছায়া আরো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হত। সময় ও সমাজ সচেতন এক অন্তর্লীন বিবেকী কবি হিসেবে তিনি আমাদের পাশে পাশে আজও হেঁটে যাচ্ছেন ঋজু ভঙ্গিমায়।
পড়লাম,সংক্ষিপ্ত হলেও ভালো লিখেছেন। আপনার মতো আমিও ১৯৭৯ সালে বাংলা অনার্সের তৃতীয় বর্ষের, ' বারোমাস' পড়তাম,এক্ষণ,আনৃণ্য এরকম কতকত প্রগতিশীল কাগজ।
উত্তরমুছুন