শনিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

সুরজিৎ কুন্ডু-র প্রবন্ধ

সত্যজিতের মহাভারত

'জয়দ্রথ কে ছিল ?

দুর্যোধনের বোন দুঃশলার স্বামী।

আর জরাসন্ধ?

মগধের রাজা।

ধৃষ্টদ্যুম্ন ?

দ্রৌপদীর দাদা।

অর্জুন যুধিষ্ঠিরের শঙ্খের নাম কি?

অর্জুনের দেবদত্ত যুধিষ্ঠিরের অনন্ত বিজয়।

কোন অস্ত্র ছাড়লে শত্রুরা মাথা গুলিয়ে সেমসাইড করে বসে?

ত্বাষ্ট্র।'

সত্যজিৎ কে ছিল?

কমান্ডার ইন চিফ ছিলেন রাজার পাঞ্চাল সেনাবাহিনীর।

শেষ প্রশ্নটি করলে প্রথমে যে নামটি আমাদের মাথায় আসে সেটা কোনোভাবেই ওই উত্তরের সাথে মিল খায় না আমাদের কাছে সত্যজিৎ বলতে সত্যজিৎ রায়কেই বুঝি ফেলুদা কাহিনীর 'গোলকধাম রহস্য' গপ্পে প্রশ্নগুলো ফেলু মিত্তির করেছিল তার ভাইটিকে। সত্যজিৎ রায়ের যে মহাভারত নিয়ে এত ইন্টারেস্ট তা হয়তো এখানেই বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে , আর তিনি যে মহাভারত নিয়ে বা বলা ভালো মহাভারতের একটি নির্দিষ্ট অংশ নিয়ে ছবি বানাবার কথা ভেবেছিলেন তা মানিক রায় কৌতুহলী মাত্রই জানেন আর ছেলেবেলায় ওর ঠাকুরদার লেখা 'ছেলেদের মহাভারত' আমরা অনেকেই পড়েছি আর তাই আজ আমার দুই পছন্দের বিষয় নিয়ে কিছু বলতে বসা চলচ্চিত্রের ছাত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ রায় আর মহাভারত দ্য আনপুট ডাউনেবেল বুক  একান্ত প্রিয়।

সালটা ১৯৫৯ তারিখটা ১৩ ফেব্রুয়ারি যেমনটি পাওয়া যাচ্ছে সত্যজিতের বিখ্যাত সেই লাল কাপড়ে মোড়া খেড়োর খাতায় , কিন্তু যা লিখেছেন ওই খাতায় তিনি তা কোনভাবেই চিত্রনাট্য না। বলা যেতে পারে চিত্রনাট্য রচনার ভিত্তি আর যদি সে ছবি হতো তা অবশ্যই হতো অন্তর্জাতিকতার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁরই উল্লেখিত অভিনেতা অভিনেত্রে নির্বাচনের তালিকা থেকে ধৃতরাষ্ট্রের ভূমিকায় বাছা হয়েছিল বিখ্যাত রুশ অভিনেতা নিকোলাই চেরকাসভকে, দুর্যোধনের চরিত্রে জাপানি অভিনেতা তোশির মিফুনে আর পাঁচটা ছবির ক্ষেত্রে তিনি যা করতেন প্রাথমিকভাবে, ক্ষেত্রেও তিনি তাই করেছেন। মহাভারতের পটভূমি, চরিত্রদের আর্থসামাজিক অবস্থাসেই সময়কার অনেক খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে যা কিনা পর্দায় চলচ্চিত্রকে বাস্তবায়িত করে তুলত সেসব লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রধান প্রধান যে সমস্ত ঘটনাগুলিকে তিনি তার ছবিতে উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন তারও একটা তালিকা তিনি তৈরি করেছিলেন। স্বয়ংবর সভা , রাজসূয় যজ্ঞ, দূত্য সভা, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ আরও তিনি একটা অসাধারণ কাজ করেছিলেন মহাভারত নিয়ে তা হল কুরু বংশের এক বংশ তালিকা নিজের মতো করে নিজের কাজে সুবিধার্থে তৈরি করেছিলেন। আর ঠিক এর পরেই রয়েছে প্রায় ৩০ পাতা জুড়ে মহাভারতের সমসাময়িক নানা বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ নোটস, প্রায় গোটা সমাজের সবকিছুর ব্যাপারে এক অসাধারণ সারাংশ। বিবাহ , বিবাহ পদ্ধতি থেকে শুরু করে শিক্ষা, কৃষি ,পশুপালন ,অলংকারাদি , শিল্প, গৃহ নির্মাণ প্রণালী , যুদ্ধের নিয়ম , রাজপথ নির্মাণ, খাওয়া-দাওয়া, বেশভূষা, আচার বিচার সমস্তটাই। যদিও গোটা মহাভারত নিয়ে ছবি করতে তিনি মোটেই আগ্রহী ছিলেন না ,প্রধানত ছবিকে তিনি দুটো পর্বে ভেঙে ছিলেন।

PART I --ক্রীড়া প্রদর্শন, জতুগৃহ দাহ , দ্রৌপদীর স্বয়ংবর , রাজসূয় যজ্ঞ , দূত্য ক্রীড়া , বনগমন।

PART II --যুধিষ্ঠিরের প্রত্যাবর্তন , উদ্যোগ পর্ব, কুরুক্ষেত্র, যুধিষ্ঠিরের সিংহাসন আরোহন।

প্রথম পর্বের ছবিটি যেটি নির্মিত হবে তা হবে দূত্য ক্রীড়া পাশা খেলাকে কেন্দ্র করে।

আর দ্বিতীয় পর্বে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকে নিয়ে ১৮ দিনের ডিটেলস নোটস এর সাথে সাথে , তিনি ছবিটি শেষ করতে চেয়েছিলেন বিধবা কুরুপত্নীদের সাথে গান্ধারীর কুরুক্ষেত্রে প্রবেশের মধ্যে দিয়ে। যেখানে সে তার মৃত স্বজনদের খুঁজে বেড়াচ্ছে যদিও আক্ষেপের বিষয় এই যে, এই মহান নির্মান ওই ভিত্তি নির্মাণ পর্যায়ে থমকে গিয়েছে। যদিও ওই লেখা আমার মত মহাভারত চলচ্চিত্র অনুরাগীদের কাছেই এক অমূল্য উপাদান, যা আমাদের হাতে এসেছে শ্রী সন্দীপ রায় মহাশয় বিচিত্রপত্র পত্রিকার সৌজন্যে। সেখানে উল্লেখিত নোটগুলির একটু টিপ্পনী করার চেষ্টা করছি, ভুল ত্রুটি হলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে না এই ভরসায়।

মহাভারতে যে বিবাহের বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে অগ্নিতে বর আহুতি প্রদান করে। অগ্নিকে সাক্ষী রেখে কন্যাকে ধর্ম পত্নী রূপে বরণ করলেন বর   দ্রৌপদীর বিবাহে আহুতি পুরোহিত ধৌম্য দিচ্ছেন সপ্তপদী গমন না হওয়া পর্যন্ত বিবাহ সম্পন্ন হয় নাবর বধুকে অগরু চন্দনজল নানা ধরনের সুগন্ধি দিয়ে অভিষেক করে পুষ্পের মালা দিয়ে ভূষিত করা হতো। মঙ্গল শঙ্খ তূর্য নিনাদ ঘোষিত হতো, 'দীয়তাং ভজ্যতাং' আত্মীয় অনাত্মীয় সকলের আগমন হতো,

স্বয়ংবর সভায় সকলে উপস্থিত হতো জাতি নির্বিশেষে। কন্যা প্রার্থীরা কানে দুল -- কুন্ডল, গলায় রত্নহার ,দামি পোশাক পরিহিত। যথাসময়ে শুভ মুহূর্তে সুন্দর বস্ত্র পরিধান করে নানা স্বর্ণ রত্ন অলংকার করে , হাতে এক গাছি ফুলের মালা বা কাঞ্চন মাল্যে সভাগৃহে আসতেন কণ্যা সঙ্গে সঙ্গে তূর্যধ্বনি মঙ্গল শঙ্খ বেজে উঠত, পুরোহিত সভা মণ্ডপে কুশন্ডিকা (যজ্ঞে অগ্নিকে করা সংস্কার কর্ম) করে, বেদ মন্ত্র উচ্চারণ পূর্বক  ঘৃতাহুতি দিতেন। তিন বেদের (সেসময় ঋগ্ ,সাম, যজুর্বেদকে ধরা হতো ) পুরোহিত, ঋত্বিক, হোতা ইত্যাদি স্বস্তিবাচন করতেন। তূর্যধ্বনির পর সভা নিঃশব্দ কন্যার ভ্রাতা সভায় উপস্থিত সমস্ত রাজাদের নাম গোত্র উল্লেখ করলেন ; দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে ধৃষ্টদ্যুম্ন সেই কাজটি করেছিলেন। সেকালে বরকে মাল্যের সাথে শ্বেত শুল্ক বস্ত্র দেবার রীতি ছিল তখন যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে দশম সংস্কার বিধি পালন হতো যথা, গর্ভাধান , পুংসবন (অর্থাৎ অর্থাৎ গর্ভধারনের তৃতীয় মাসেই পুত্র সন্তান কামনায় কৃত সংস্কার কর্ম),  সীমন্তোয়ন (অর্থাৎ গর্ভবতীর চতুর্থ বা ষষ্ঠ মাসের সংস্কার),জাতকর্ম, নামকরণ, নিষ্ক্রমণ, অন্নপ্রাশন, চূড়াকর্ম ,উপনয়ন বিবাহ বিবাহিত মহিলাদের অন্তঃপুরে বাসই কর্তব্য গণ্য হতো, কিন্তু নানা উৎসবে স্ত্রীগণ বের হতেন পুরুষদের সঙ্গে। যাতায়াতের ব্যাপারে সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলারা শিবিকাতেই চলাচল করতেন , মানুষ বাহিত শিবিকা সভাতে নারীদের বসবার পৃথক স্থান নির্মিত হতো , স্বামীদের সঙ্গে স্ত্রীরাও সোম রস (সম্ভবত সেকালের মদ )পান করতো। বিবাহ ইত্যাদিতে যৌতুকরূপে নারীপ্রদানও রীতি ছিল, (উদাহরণস্বরূপ বলা চলে অসুর রাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা গিয়েছিল অসুরগুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীর সাথে স্বামী যযাতির গৃহে) রাজারা যে সমস্ত আমত্য নিয়োগ করতেন তাদের মধ্যে তিনজন শূদ্রকেও নিয়োগ করা হতো।

বিভিন্ন ভাষাবিদও সভায় উপস্থিত থাকতেন, যেমন ছিল যুধিষ্ঠিরের সভায়ও। বেদ শ্রুতি হলেও লিপিবিদ্যার সাথে তাদের পরিচয় ছিল, উল্লেখ্য গনেশ মহাভারত লিপিবদ্ধ করেছিলেন দ্রৌপদী ধৃষ্টদূম্নের সাথে বার্হস্পত্য রাজনীতি (দেবগুরু বৃহস্পতি যে নীতি জ্ঞান বা বলা ভালো রাজনীতি জ্ঞান দিয়েছিলেন ইন্দ্রকে যা কিনা বিদুরেরও করায়ত্ত ছিল ) শিক্ষা লাভ করেছিলেন দ্রৌপদী সম্বন্ধে মহাভারত থেকে  নোটসে যে উল্লেখ করেছিলেন রায়েরবাবু  তাহলো ---- প্রায় হাজার লোকের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তদারকি দ্রৌপদীকেই করতে হতো , শত সহস্র দাসদাসীদের কাজকর্ম সুপার ভাইস করা , বেতন দেওয়া, অভিযোগ লক্ষ্য করা এবং অন্তঃপুরের সর্বপ্রকার তত্ত্বাবধন করা , এসবই পাঞ্চালীর দায়িত্ব আর ছিল সর্বোপরি রাজকোষের হিসাব সামলানো হিসাবপত্র পরিদর্শন করা অর্থাৎ অডিটিং  

কৃষি পশুপালন ছিল সেকালের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, কৃষকদের সন্তুষ্টি বিধান করা তাদের দুঃখ দূর্গতিনাশ করা রাজার প্রধান কর্তব্য কারণ সেকালে শুধু নয় আজও কৃষক বণিকরাই রাষ্ট্রকে সম্পদশালী করে, কর হিসেবে আয়ের ছয় ভাগের এক ভাগ দিতে হতো, কৃষকরা শতকরা মাসিক এক টাকা সুদে রাজকোষ থেকে ঋণ পেতেন প্রত্যেকেই প্রায় গরু পালন করতেন, এছাড়াও হাতি ,ঘোড়া, গাধা, কুকুর, বিড়ালেরও পালন করার উল্লেখ পাওয়া যায় এখানে ; উল্লেখ করা যেতে পারে সহদেব গোবিদ্যয় বিশারদ হওয়ার জন্য অজ্ঞাতবাসে বিরাট রাজ্যে সে ধরনের কাজেই নিযুক্ত ছিলেন বিভিন্ন প্রদেশ থেকে নানা ধরনের উপহার আসত রাজার কাছে ,যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে চীনদেশ, সিংহলদেশ (শ্রীলংকা) কাম্বোজ (কাম্বোডিয়া) থেকেও উপঢৌকন এসেছিল , আর উপহারের পরিমাণ এতই ছিল যে এপার ওপার দেখা যাচ্ছে না দুর্যোধনের কথা অনুসারে--- "অপর্য্যন্ত্যং ধনৌঘং তং দৃষ্ট্বা শত্রোরহং নৃপ! শর্ম্মনৈবাধিগচ্ছামি চিন্তয়ন্ননিশং বিভোর!।।"     সমুদ্র অভিযানেরও খবর পাওয়া যায় মহাভারতে, রত্ন জগতে সোনার দাম সর্বোপরি , সভাগৃহ থেকে শুরু করে যজ্ঞীয় উপকরণ ,মণ্ডপের তোড়ণ , ঘট, থালা সবই সোনার ,মুদ্রা ছিল সোনার তৈরি ---মোহর তামার বাসন ,ভোজন পাত্র ছিল কাঁসার, লোহার ব্যবহারও ব্যাপক ছিল অস্ত্রশস্ত্র কোদাল বর্শি সবই লোহা নির্মিত পাশাখেলা , যে খেলা মহাভারতের প্রধান দিক নির্ণয়ের কান্ডারী তার ঘুঁটি তৎকালীন দিনে বৈদূর্যমণি নির্মিত হতো সেকালের আরেকটি উল্লেখযোগ্য শিল্প হল 'দন্তশিল্প' ---খরগের বাট থেকে শুরু করে যোদ্ধাদের শরীরের অবরোক, বিচিত্র কবজ, পাশা খেলার ঘুঁটি, খাট, আসন খেলার পুতুল সবই তৈরি হতো। বণিকগণ দন্ত দ্বারা  ছাতার ছলাক প্রস্তুত করতেন এমনই খবর পাওয়া যাচ্ছে যেমন গান্ডীব--- গন্ডারের চামড়া হতে তৈরি অর্জুনের ধনুক , বাঘের চামড়ার কম্বল---' দিয়াগজ কম্বল',  চামড়ার জুতোর বহুল প্রচলন ছিল। এছাড়াও হরিণ মেষের চামড়ার আসনের চলছিল এখানকার দিনে যেমন রংবেরঙের ছাতা আমরা দেখতে পাই মহাভারত কালে আদৌ সেরম উল্লেখ পাওয়া যায় না কি দিয়ে ছাতা নির্মিত হতো তা স্পষ্ট রূপে বোঝা না গেলেও , সর্বত্রই যে 'শ্বেতছত্র'--- সাদা ছাতা প্রচলিত ছিল সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই,

এছাড়াও তালপাতার পাখার উল্লেখ নানাস্থলে পাওয়া যায়। রাজার পাশে যে চামড় ব্যঞ্জন করা হতো তারও নানা রঙের ব্যবহারে উল্লেখ পাওয়া যায় ব্যাসকৃত মহাভারতে, এমনই লেখা পাওয়া যায় সত্যজিৎ রায় কৃত মহাভারতের নোটসে। চামড়ের রঙ সাদা ---শ্বেতশুভ্র , রক্তিম লাল এবং কৃষ্ণ কালো হত।  এছাড়া পতাকার রঙে ব্যবহারেরও বৈচিত্র্য ছিল নানান চিত্র অঙ্কিত থাকতো তাতে মুনি-ঋষিরা কৃষ্ণসার মৃগের চামড়া আচ্ছাদিত কুশাসন ব্যবহার করতেন , এখনকার দিনে এয়ারকন্ডিশনার তুল্য কিছু ছিল কিনা জানা নেই, তবে 'উশিরচ্ছদ' বলে একটা বস্তু ছিল। যা মূলত সুগন্ধি তৃণমূল দ্বারা তৈরি করা চাদর।  যানবাহনের ক্ষেত্রে সর্বাধিক চারটে পর্যন্ত ঘোড়ায় টানা রথের (অর্জুনের রথ তাই ছিল) উল্লেখ পাওয়া যায়। এতদ্ ব্যতীত উট, খচ্চর গাধা চালিত রথ উল্লেখিত।  দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভার যে চিত্র আমরা সুপ্রচলিত মহাভারতে দেখতে পাই অর্থাৎ যে সিনারিও ফুটে ওঠে তাতে দেখা যাচ্ছে নগরের ঈশানকোণে সমভূমির উপর চতুর্দিকে প্রাসাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত সভাগৃহ শুধু তাই নয় , এমন কী সভাগৃহটি প্রাকার ---প্রাচীর  আর পরিখা দ্বারা বেষ্টিত দ্বার তোড়ণ ইত্যাদি দ্বারা মন্ডিত আর সেই প্রাকার বা দেওয়াল কেমন না অনেকটা এখনকার মোজাইকের মত অর্থাৎ মোজাইকে যেমন নানা রঙের পাথর বসানো থাকে ঠিক তেমনটাই, কিন্তু ওই রংবেরঙের পাথরের জায়গায় মনি মানিক্য ভূষিত---' মনিকুট্টিমভূষিতং সুবর্ণজালসংবীত'--- সোনার জালে মোরা আর 'স্রগদামর্ণমবচ্ছন্ন'--- সুগন্ধিত সুবাসিত ফুলের মালার বেষ্টিত। চারদিকে মনমুগ্ধকর উদ্যান , উদ্যানের লতা গুল্ম বাসন্তিক হাওয়ায় দোদুল্যমান, চিত্রপুষ্প দ্বারা শোভিত, উদ্যানে কোকিল তার সুমধুর গানে মুখরিত করে তুলেছে। ময়ূর অদেখা জলধরের উদ্দেশ্যে পুচ্ছ দ্বারা মনের আনন্দকে ব্যক্ত করছে 'পদ্মৎপলসুগন্ধি'--- নির্মল বাড়ি পরিপূর্ণ জলাশয়ে রাজহংস ক্রীড়া রত ,কারন্ডব অর্থাৎ বালিহাঁস চক্রবাক ইত্যাদি লীলা করছে

সভাপর্বে অর্থাৎ যুধিষ্ঠিরের ময়দানবকৃত প্রাসাদে নানা অদ্ভুত জিনিসের মধ্যে artificial পদ্ম, পাখি, কুমির মৎস্যও ছিল এখানে দুর্যোধনের যে বেকুব অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তা বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখলেও পরিসরে তা সম্ভবপর না , হেতু অপরিমিতি করুকূলে ঐশ্বর্য মন্ডিত প্রাসাদ শ্রেণী বহুকক্ষায় বিভক্ত ---পান্ডু জ্যেষ্ঠ, ধৃতরাষ্ট্র চতুর্থ কক্ষায় বসবাস করতেন প্রশস্ত রাজপথ সজ্জিত পান্ডুর মাল্য পতাকা দ্বারা, সুগন্ধি ধূপে সুরভিত নগরের রাজদ্বারে তৃণাদি দ্বারা শুক্লীকৃত পুষ্পাদিবিভূষিত পূর্ণকুম্ভ স্থাপিত হতোচতুর্দিকে রং বেরঙের ধ্বজ, প্রশস্ত রাজপথ রথের চলাচলের জন্য সুগম করবার উদ্দেশ্যে জলসেচন--- জল দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া হতো। আর চতুর্পার্শ্বে ঘন্টাযুক্ত পতাকাগুলি নরনারী দ্বারা কম্পিত হয়ে এক মধুময় গীতের শুরু করছিল। এছাড়াও পটগৃহ--- তাঁবু উডুপ , ভেলার প্রচলন বহু প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। 'পেটিকা' অর্থাৎ কিনা সেকালের শব্দ বন্ধে 'মঞ্জুষার' উল্লেখ পাওয়া যায় এক্ষেত্রে একটা কথা বলার লোভ সংবরণ করতে পারছি না, এই পেটিকা মঞ্জুষা মোম দ্বারা লিপ্ত অর্থাৎ মাখিয়ে সদ্যোজাত এক শিশুকে ভাসিয়ে দিচ্ছে তারই জন্মদাত্রী মা। শিশু পূত্রটির নাম বষুসেন মাতা পৃথা

যদিচ বহুল প্রচলিত তাদের নামখানা বললে পাঠকগন অচিরেই বুঝতে পারবেন কাদের কথা বলছি, প্রথম কৌন্তেয় কর্ণ তারই মাতা কুন্তী কুমারী। এছাড়াও নৌকো শতধারা (জলসত্র হস্তিনাপুরের বাগানের বর্ণনা যেখানে দেওয়া হচ্ছে) উল্লেখ পাওয়া যায় বস্ত্র বস্ত্র শিল্পের ব্যাপারেও নানা তথ্য পাওয়া যায় মহাভারত একটু খুটিয়ে পড়লেই , মেষের লোম অর্থাৎ ঔর্ণ , মুষিকদের (বিড়াল) ইঁদুরের লোমে প্রস্তুত তেল এবং বিড়ালের লোম দ্বারা প্রস্তুত দ্রব্যাদি যুধিষ্ঠিরেরর রাজসূয় যজ্ঞকালীন উপঢৌকন হিসাবে কাম্বোজরাজ আনয়ন করেন। মা ঠাকুমাদের আমলে যেমন সত্যিকারের সোনার রূপার জরির বেনারসির কথা শুনতে পাওয়া যায় ঠিক তেমনটি পাওয়া যাচ্ছে মহাভারতেও , বস্ত্র তন্তুর মাঝে সুবর্ণতন্তু দেওয়া হতো আর সোনার গুটিকাও দেয়া হতো চীন দেশ পশমের রেশমের কাজে বিশেষজ্ঞ ছিল, রাজসূয় যজ্ঞ কালীন উপহারে হাজার হাজার পাটের কীটজ রেশমের পদ্মবর্ণ রঞ্জিত বস্ত্র পেয়েছিল ধর্মরাজ। এছাড়াও কার্পাস তুলো থেকে প্রস্তুত বস্ত্র নিত্য ব্যবহারযোগ্য ছিল। রাজসভায় শিল্পীগনের সমাদর থাকলেও ধনী শিল্পীগন থেকে কর আদায় হতো।

ধান যবই ছিল প্রধান খাদ্যদ্রব্য, সর্বত্রই ভোজনে অন্ন সম্ভবত (সম্ভবত কারণ 'অন্ন' কথার আক্ষরিক অর্থ-- যা খাওয়া হয় )ভাতের আয়োজন হতো। পিঠা, গুড় ,দই, ঘৃত-- ঘি ,তিল, মৎস ,মাংস শাক তরকারি প্রচলিত ছিল। এছাড়াও আচার, নানা জাতীয় টক, শরবৎ খাওয়ারও চলছিল। বরাহ অর্থাৎ পর্কহরিণের মাংসও খাওয়া হত বেদ বিহিত যজ্ঞাদিতে পশুবধ প্রশস্ত সুতরাং কথা বলাই যায় যে পশুর আহারও প্রচলিত ছিল ; এখানে বলে রাখা ভালো বেদের যজ্ঞে যে শুধু বলির পশুর ঝলসানো মাংস খাওয়া হত তাই না পশুর দেহের কোন অংশ কোনযজ্ঞ পুরোহিত মানে ঋত্বিক (ঋগ্ বেদের পুরোহিত) , হোতা (যজ্ঞের সুপারভাইজার) পাবেন, কোন অংশ রাজাকে পাঠানো হবে তাও নির্ধারিত ছিল। যদিও মাংসের থেকে মাছের ব্যবহার অনেকেই কম ছিল।  "মৈরেয়" ---- বৃক্ষরস , গুড় মধু থেকে প্রস্তুত মদ, তাও ব্যবহার হতো  , তবে কথা বলা অতুক্তি হবে না যে সকল প্রকার খাদ্যের মধ্যে মাংস সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিল আর ছিল সূরাসক্তি আর সেটা বেশ বাড়াবাড়ি পর্যায়েরই ছিল এমনকি অভিজাত কূলের বধুগন সূরা পানে অভ্যস্ত ছিল তা সে পঞ্চস্বামি গর্বিতা দ্রৌপদী হোক কিম্বা কৃষ্ণা ভগিনী সুভদ্রা কিম্বা উত্তরা  

আজকেও যেমন নিত্য হেঁসেলের দায়িত্ব থাকেন মূলত বড় গিন্নিটি--- বাড়ির গৃহিনীটি, একইভাবে সেকালেও পাকের ভার মূলত ন্যস্ত থাকত স্ত্রীলোকের উপরই , তবে পুরুষেরাও জানতো রান্না। এখানে উল্লেখ্য অজ্ঞাতবাসে বিরাট রাজ্যে ভীম কিন্তু পাচক হিসাবেই অজ্ঞাত ছিলেন। আবার বনবাসে দেখা যায় তামার হাঁড়ির ব্যবহার, কাটা, হাতা ইত্যাদি রন্ধন সামগ্রী। যদিও পরিবেশনের ব্যাপারে ,না ছোটখাটো নিত্যদিনের নয়, বড়োসড়ো ব্যাপারের বাড়িতে পরিবেশনের কাজটি করতেন পুরুষেরাই। অনুশাসন পর্বে দেখা যাচ্ছে কিছু নিষেধ কর্তব্যকার্যের কথা।  একবস্ত্রে যাওয়া নিষেধ, উত্তরীয় চাদর অত্যাবশক ইত্যাদি, পোশাক পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে দ্রোন কৃষ্ণ সাধারণত সাদা ধুতির ব্যবহার করতেন , কর্নের অবশ্য ব্যবহার্য রঙ ছিল পীত বর্ণ  আর অশ্বত্থামা -- দুর্যোধন , নীল রঙের কাপড় পরিধানের কথা লেখা আছে কৃষ্ণাগ্রজ বলদেবও নীল রঙ ধারণ করতেন  আবার ব্রাহ্মণগন ধারণ করতেন শ্বেতশুভ্র মৃগচর্ম , সাদা যোজ্ঞপবীত  , উত্তরীয় চাদর হিসাবে রত্ন শোভিত প্রাবার ব্যবহার করতেন রাজারা বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন বস্ত্র পরিধানেরও রীতি ছিল, ঠিক যেমন এখনকার ফরমাল ক্যাজুয়াল আবার যুদ্ধে বীর যোদ্ধাগণ রক্তবর্ণ ধারণ করত, পুরুষরা বা বলা ভালো রাজপুরুষরা 'অঙ্গদ' , 'কুন্ডল'--- কানের দুল পড়তেন আর সব অলংকারই সুবর্ণ নির্মিত। রাজাদের মাথায় মনি, গলায় 'নিষকের' হার থাকতো ,যোদ্ধারা 'শিরস্ত্রাণ'--- হেলমেট পড়তেন। দুর্যোধন থেকে অর্জুন মোটামুটি সব পুরুষরাই লম্বা চুল রাখতো , অর্জুন অবিশ্যি চুলে বেনী করতেন আবার শৃঙ্গের মতো চুরা করেও চুল বেঁধে রাখার রেওয়াজ ছিল 'কাকপক্ষ' অর্থাৎ 'পঞ্চশিখা' দেখা যায় অভিমুন্য অর্জুনের ক্ষেত্রে ব্যাসদেব দ্রোণাচার্য দাঁড়ি রাখতেনব্রহ্মচারীরা হাতে দন্ড ধারণ করতেন। অরণ্যে অবস্থানকালে যুধিষ্ঠিররা বর্ম বলক্ল (গাছের ছালপরিধান করত রাজসূয় অথবা বৈষ্ণব ইত্যাদি যজ্ঞ কালে যজমানরাও ব্রহ্মচারীদের মতো পরিচ্ছদ গ্রহণ করতেন অর্থাৎ ক্ষৌমবস্ত্র, রেশমী বস্ত্র , কৃষ্ণজিন কৃষ্ণসার হরিণের চর্ম (এই জন্যই কি কৃষ্ণসার হরিণ আজ এত দুর্লভ ?) পড়তেন। বিবাহ কালে দ্রৌপদীও রেশম নির্মিত ক্ষৌমবস্ত্র পরিধান করেছিলেন, সোনার হার ,কানের দুল--- কুন্ডল মুনিরত্ন , 'নিষ্ক', 'কম্বু' অর্থাৎ শঙ্খ , 'কেয়ূর' অর্থাৎ বাহুভূষণ এবং হাতি সম্ভবত শাঁখা পড়েছিলেন। 'পিপ্লূ' ধারণ অর্থাৎ ভ্রু মধ্যে কৃত্রিম চিহ্ন পড়তো (টিপ ) চন্দন চর্চা ছিল প্রসাধনের প্রধান সামগ্রী, শরসজ্জাকালে কুমারী কন্যারা ভীষ্মকে চন্দনলেপ দ্বারা ভূষিত করেছিল , দিনের শুরুতে বা পূর্বাহ্নে কেশ প্রসাধন অঞ্জন লেপন (সম্ভবত কাজল করবার) নিয়ম ছিল বিধবারা সাদা বস্ত্র উত্তরীয় পরিধান করতেন, যদিও রক্তমাল্য ধারণ করা নিষেধ ছিল।

দিনের শুরু হত মহাগুরু প্রনতীর মাধ্যমে, ভাইরা সকলে একত্রে বসবাস করাই রীতি ছিল বিশেষ কোনো কাজে কোনো সম্ভ্রান্ত পুরুষের সাথে অন্তঃপুরে  দেখা করতে গেলে কৃতাঞ্জলি হয়ে, পায়ের আঙ্গুলের দিকে দৃষ্টি দিয়ে প্রবেশ করাই বিধান। গুরুজনদের পা স্পর্শ করে প্রণাম করার চলছিল যদিও এখনো এই রীতি প্রচলিত আছে। এবার আসা যাক রাজ্যাভিষেকের কথায় রাজ্যাভিষেকে যে রীতি লক্ষ্য করা যায়, যা পালন করা হয়েছিল কর্ণের অঙ্গরাজ্যের রাজা হওয়ার সময় তা অনেকটা এইরকম --- একটি সোনা নির্মিত জলপূর্ণ ঘটে খই পুষ্প প্রক্ষেপ করে রাজাকে সুবর্ণপীঠে উপবেশন করিয়ে ওই ঘটের জল দ্বারা মন্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ করেছিল অভিষেক অভিষেক কার্যের সময় মাথায় ছত্র ধরা , বালব্যজন দ্বারা তাকে বীজন করা হয় , চারদিক থেকে মান্য গণ্য সর্বজন জয়ের ধ্বনি দেয় , ঠিক তেমনি যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেকের ক্ষেত্রে কাঞ্চন পিঠে উপবেশন পূর্বক  শ্বেতপুষ্পস্বস্তিকভূমিসুবর্ণ , রজত এবং মনি স্পর্শ করানো হয়েছিল সুবর্ণ, রৌপ্য, তাম্র মৃত্তিকার কলস জলে পূর্ণ করা হয় আর পুষ্প , খই , কুশ, দুধ, মধু, ঘৃত ,শমী , পিপল, অশত্থ, পলাশ , সমীধ, স্রুত ,ঔদুম্বর (ডুমুর) শঙ্খ অর্থাৎ কিনা সমস্ত শুভ মঙ্গল দ্রব্যাদি উপস্থিত করা হলো। ধৌমো, ঈশান কোণে কিঞ্চিত ঢালুভাবে থাকে এমন জমি প্রস্তুত করলেন , সর্বোতভদ্র শুক্লো আসনের উপর বাঘের চর্ম আসন স্থাপন করে তার উপর যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বসানো হলো, ধৌমো মন্ত্র চারণ পূর্বক আহুতি দিলেন আর বাসুদেব কৃষ্ণ তখন পূজিত শঙ্খের জল দ্বারা যুধিষ্ঠিরের অভিষেক করলেন। অতঃপর ধৃতরাষ্ট্র ভ্রাতাগণ উপস্থিত প্রজাবৃন্দ ধর্মরাজের অভিষেক করলেন।তখনি পণব ( ঢোল জাতীয় বাদ্যযন্ত্র ) আনক (ঢাক জাতীয় বাদ্য) দুন্দুভি বাদ্য বারংবার জয়সূচক শব্দে বাজতে লাগলো , সর্বশেষে উপস্থিত সকল গুরুজনদের প্রণাম করে রাজ্যভার গ্রহণ করলেন যুধিষ্ঠির। এছাড়াও অন্যান্য সামাজিক রীতিনীতি প্রচলিত ছিল যেমন অমঙ্গলসূচক শব্দশ্রবণে স্বস্তিবাচন বিধি , যেমন উদাহরণস্বরূপ দ্রৌপদীর অপমানের সময় বিদুর , গান্ধারী ,ভীষ্ম, দ্রোন , কৃপ স্বস্তিবাচন করছিলেন আনন্দ প্রকাশে করমর্দনের প্রথা প্রচলিত ছিল, ইদানিংকালের মতোই। 'যোগ' শব্দটি সম্ভবত আনন্দ ব্যক্ত করার জন্য ব্যবহৃত হতো। পূজা পার্বণের মেলা যেমন বসত, ঠিক তেমনিই শরৎকালে ধান পাকলে ব্রহ্মোৎসব পালিত হতো। কুস্তি আয়োজন করা ,এছাড়াও ডাংগুলি বিটা খেলা , লক্ষাভিবরন , সাঁতার খেলা হত। বিবাহ, যুদ্ধে জয়লাভ কিংবা মহৎ ব্যক্তির যাত্রাকালে, যাগযজ্ঞে রাজসভায় উৎসবাদিতে সংগীত পরিবেশিত হতো। বৈতালিকের ,রাত্রিকালে প্রত্যুষে রাজা নৃপতিদের নিদ্রাকালে নিদ্রাভঙ্গে নির্দিষ্ট স্তব গীতি বীনা বাদ্য করারও রীতি প্রচলন ছিল। সাম গান গাওয়া হতো যজ্ঞকালে , "ছালিক্য" গান অর্থাৎ বহু যন্ত্র সংযোগে গান গাওয়ার রীতি ছিল বাদ্যযন্ত্র হিসাবে বীনা, ঝল্লিষক( হরিবংশে উল্লিখিত বাদ্যযন্ত্র বিশেষ), বাঁশি , মৃদঙ্গ , কুইন্টেট ব্যবহার হত। দুর্লক্ষণ হিসাবে শ্যেন, কাক, গৃধ্ন , কঙ্ক ,বক, কোকিল , শতপত্র ---কাঠঠোকরা পাখি, 'চাষ'(বহুবর্ণ পালক বিশিষ্ট উচ্চস্বরে ডাক দিতে পারে এমন প্রকৃতির পাখি) , ভাষ , সারস , ময়ূরের চিৎকার এগুলিও উল্লেখিত। সকাল সকাল দন্ত মার্জনা দাঁত মাজা দন্ত কাষ্ঠের প্রয়োগ হতো, নদীতে স্নান করে তর্পণ সন্ধ্যা আহ্নিক নিত্য রীতি। সেকালে প্রচলিত রীতিনীতি ইত্যাদি বিষয় নানা বক্তব্য রাখা গেল, সেকালে প্রচলিত নানা ব্যবস্থা বিধি নিয়ম-কানুন ইত্যাদি, পাকি পক্ষী উদ্যান ফুল বা লতাপাতা , বস্ত্র পরিধেয় ,জলাশয়ে জলচর, রাজ্যভিষেক আরো অনেক কিছু। শিল্প-শিল্পী, খাদ্য অখাদ্য , মঙ্গল অমঙ্গল সূচক, বাদ্য বাজনা ,গীত সংগীত সমগ্র রাজ্যের কথা কিন্তু খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও তার নিয়ম-কানুন -- গুলি , পদ্ধতিগুলি নিয়ে এখনো বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি।

তাও হবে দ্বিতীয়পর্বে আর ওই দ্বিতীয়পর্ব , প্রায় পুরোটাই উল্লেখিত  হয়েছে ----তার উদ্দেশ্য ,সেই ক্ষেত্রে যা নির্দিষ্ট করতো , নির্ধারণ করত সমাজের, মানুষের জ্ঞানই সমস্তটাই যাইহোক সেই মহামূল্য পর্বে ঢোকার আগে আরো কিছু সামাজিক প্রথা রীতির কথা বলা যাক

জতুগৃহ থেকে রাতের গহীন আঁধারে কুন্তিসহ পঞ্চপান্ডব যখন বের হল অগ্নিস্নাত জতুগৃহ কে পিছনে ফেলে, দূরে আরো দূরে যেখানে আর ওই লেলিহান শিখা পথ দেখাতে অক্ষম তখন পথপ্রদর্শক আলো কে প্রদান করেছিল ? বউ তার স্বামীকে কি বলে ডাকতো সেকালে ?  "অক্ষক্রীড়া" কি রাজারাই করত নাকি সর্বসাধারণে প্রচলিত ছিল ? আরো কত প্রশ্ন। অন্ধকারে পথ চলতে জ্বলন্ত কাষ্ঠ কিংবা মশালের ব্যবহার ছিল , হ্যাঁ অক্ষক্রীড়া সর্বসাধারণের সর্বত্র প্রচলিত ছিল, ব্রাহ্মণেরা নিজেরাই গোদাহন করতেন গভীর চিন্তনে যে বডিল্যাঙ্গুয়েজ ---- শারীরিক অভিব্যক্তি প্রকাশ ঘটতো , তা হলো নখ দিয়ে মাটি খোঁড়া। যা অনেক সময়ই দ্রৌপদীকে করতে দেখা গেছে , গভীর দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা কন্যা তার প্রিয়তম স্বামীকে 'আর্য' বলে সম্ভাষণ করত, তখনকার দিনেও গৃহপ্রবেশ রীতি ছিল , নিমন্ত্রণের দূত প্রেরণ করা হতো। প্রিয় সংবাদ পেলেন যেমন উপঢৌকন তথা ধন দান করা হতো ঠিক তেমনি বিরাগে নমস্কার করা ভূমিতে পদাঘাত করার ব্যাপারেও পরিলক্ষিত হতো।  অতি শোকে আকুল স্ত্রীগণ বুকে আঘাত করে রোদন করতেন রাজ দরবার নিত্য বসে পরামর্শ করত নানা বিষয়ে, আবার  আমোদ আল্হাদ করাও হত যদিও জ্ঞান-বৃদ্ধ উপস্থিত থাকলে নিশ্চুপ হয়ে বক্তব্য শোনাই সৌজন্য সন্ধ্যাকালীন কর্মবিরতি হওয়া আবশ্যকরাজগৃহে ঋষিমুনিদের সাদর অভ্যর্থনা করাজীবনধারণ কালে যেমন সামাজিক রীতিনীতি বিধি-নিষেধ নিয়ম কানুন ইত্যাদি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনি ছিল অতিথি অভ্যাগতদের সৎকার ক্রিয়াও সৎকার্যে লিপ্ত থাকা ঠিক তেমনি জীবনান্তে সৎকার করা যার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে ভীষ্মের প্রয়াণে। দাহ পদ্ধতিতে, বিশেষত বিশিষ্ট জনের ক্ষেত্রে চন্দন কাষ্ঠ, পুষ্প, গন্ধ, মাল্য, বস্ত্র (অবশ্যই শ্বেতবস্ত্রাদি) শিবিকা বহনে শ্মশানে যাওয়া , পবিত্র নিনাদে বাজনা সহযোগী। মস্তকে শ্বেতশুভ্র ছত্র , পার্শ্বে চামড় ব্যঞ্জন এবং অসংখ্য পুরুষেরা শবের অনুগমন করত ।অন্তে শবকে স্নান করানো শুক্লো চন্দন চর্চাতে ঘৃত সহযোগী অগ্নিসংযোগ করা।

তাহলে মোটামুটি সমাজের সর্বব্যাপী এক চিত্র খানিকটা চিত্রিত করা গেল। এবার আসছে সেই ব্যাপারখানা যা অতীব গুরুত্বপূর্ণ, সমাজ জীবন দেশকালের গতি নির্ধারণ ক্ষত্রিয় কুলের প্রধান কর্ম অর্থাৎ যুদ্ধ। যুদ্ধের নিয়ম-নীতি যুদ্ধের শিবির নির্মাণ প্রক্রিয়া করন।

'ক্ষত্রিয়' অর্থাৎ ক্ষত থেকে ত্রাণ দেওয়া। যুদ্ধের ব্যাপারটা বড্ড জটিল অনেক নিয়ম অনেক কৌশল। আরআরো বেশি জটিল হল যুদ্ধ শুরুর আগের নানান কূটনৈতিক কার্য কারণ হেতু। মহাভারতে অঘ্রান মাসে মে ১৮ দিনব্যাপী  মহাযুদ্ধ হয়েছিল , যাতে কুরুবংশ প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল, তা থেকেই শুরু করা যাক। কৃষ্ণ অস্ত্র ধারণ না করলেও তারই অধিনায়কত্বে পাণ্ডব কুল সেনাপতি নির্ধারণ থেকে শুরু করে সমগ্র যুদ্ধ করা , সবটাই সমগ্রটাই করেছিলেন। শিবির নির্মাণ পরীখা দ্বারা ঘেরা প্রভৃতি নির্মিত হয়েছিল। প্রচুরকাষ্ঠ দ্বারা ঘিরে শিবিরকে দূরাধর্ষ করা হয়েছিল , সম্ভ্রান্ত  অতিথিদের জন্য পথের মাঝে মাঝে সভাগৃহ তৈরি করাও হয়েছিল।  যুদ্ধের নিয়মাদির যে পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে ,মা ভীষ্ম পর্ব শান্তি পর্বে উল্লেখিত ; আবশ্যক বোধে রাত্রিতেও যুদ্ধ করা যেতেই পারে কিন্তু আবশ্যক না হলে দিনেই যুদ্ধ করা বিধেয় রাজা , রথী মহারথীরা যখন যুদ্ধযাত্রা করতেন তখন ব্রাহ্মণগন প্রশস্তি সূচক মন্ত্র পাঠ করতেন , পুরোহিতগণ করতেন স্বস্ত্যয়ন।  শুভশঙ্খ নিনাদে ঘোষিত হতো যুদ্ধযাত্রার উদ্দেশ্যে পদচালনা, রণবাদ্য আর  অশ্বক্ষুরের গভীর শব্দে রসাতল পর্যন্ত প্রকম্পিত। রনবাদ্যের যে উল্লেখ পাওয়া যায় তাতে 'ভেরি' , 'পণব' , 'আনক', 'মৃদঙ্গ' , 'দন্দুভি' ( দামামা জাতীয় বাদ্যযন্ত্র) 'মহানক' (বৃহৎ ঢাক), 'ঝর্ঝর' (করতাল-গোত্রীয়), 'পেশি' (কাঠ দিয়ে আঘাত করে বাজাতে হয় এমন বাদ্য), 'গোবিষান' (গোমুখ গরুর মুখের মত দেখতে বাঁশি জাতীয় বাদ্য), 'পুষ্কর'--- ঢাক অথবা ঢোল, 'মুরজ'  (বড় ঢাক) 'ডিন্ডিম' (ছোট ঢাক) উল্লেখযোগ্য।  নিশান , বাতাসে সমস্ত ক্ষেত্রে উড্ডীয়য়মান। সৈনিক সেনাপতি যুদ্ধ গ্রহণকারী সমস্ত প্রজাগণের মনস্তাত্ত্বিক বল আনতে রণবাদ্য অতিশয় প্রয়োজনীয়যেন এক অ্যাম্বিয়ান্স তৈরি করত ওই শব্দ মন্ডলী একত্রে পরিধানে ধুতি , চন্দন চর্চিত মাল্যগাধার চামড়া নির্মিত 'অঙ্গুলীত্রান' অর্থাৎ কিনা গ্লাভস জাতীয় বস্তু , দেহ বাঁচাতে বর্ম --- তনুত্রান (তনু অর্থাৎ দেহ ) কবচ, লৌহবর্ম (লোহা নির্মিত বর্ম) ,  কংসবর্ম , অস্ত্রশস্ত্র বহনের জন্য গরুর গাড়িও প্রয়োজনীয় আদি, বন, বিরাট, উদ্যোগ , ভীষ্ম দ্রোণপর্বে অস্ত্রশস্ত্র সম্বন্ধে বলা হয়েছে। দ্রোন অসি অর্থাৎ তরবারি চালনায় পারদর্শিন, তরবারি রাখতে অসিকোষ থাকতো। যা উচ্চ থেকে নিম্ন পর্যায়ের সেনা , সেনাপতিদের বিভিন্ন ধরনের হত   যেমন গোচর্ম নির্মিত, ব্যর্ঘচর্ম নির্মিত , স্বর্ণ নির্মিত বিভিন্ন যুদ্ধে বিভিন্ন মন্ডল নির্মিত হতো, বিশেষত গদাযুদ্ধে ; শল্যদিব্যাস্তের প্রয়োগে মন্ত্র উচ্চারণ হতো , প্রয়োজনে শত্রুনাশে 'বুহ্য' রচনা করা হতো অর্থাৎ ট্র্যাপ। যেমন 'চক্রব্যূহ' নির্মিত হয়েছিল অভিমুন্য কে হত্যা করতে। উদ্যোগপর্বে যুদ্ধ প্রকরণের আরো বিস্তারিত বর্ণনা আছে যা এখানে আলোচনা করা অসম্ভব।

মহাভারতের মহাসাগরে মন্থন করে সমাজ সংস্কার বিধিনিষেধের , শিল্প, ব্যবহারিক নানা সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বিষয় শ্রী সত্যজিৎ রায় মন্থন করে নিয়ে এসেছেন। কি পড়তো, কি খেত, কি রংয়ের ছাতা ব্যবহার করতো, কি ধরনের শিল্প-সামগ্রী ব্যবহার হতো বা প্রস্তুত হতো সেই সব বিষয়। গান্ধারী কুরুক্ষেত্র ভারত যুদ্ধ শেষে শব পরিবৃত হয়ে  দাঁড়িয়ে আছেন, হয়তো সেখানে কর্ণ পত্নীরাও  হাজির, আরো অনেক মৃত রাজা করুবংশ ধরেরা।  যে কুরু রক্তের ধারায় আজ স্নাত করুবংশীয় ক্ষত্রিয়দের যুদ্ধ-বধ্যভূমি, সেই ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে গান্ধার কন্যা। ওই ক্ষেত্রেই এক ছবির কথা মনে পড়ছে সম্ভবত নন্দলাল বাবু বা অবন ঠাকুরের অঙ্কিত , যেখানে শুধু দেখা যাচ্ছে গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রের পা আর  পায়ের আঙুল কম্পিত হচ্ছে কুরু রক্ত ধারায়। মহাভারত--- পঞ্চমবেদ যা কিনা গল্পের পর গল্প, শাখা প্রশাখা বিস্তার করে সমস্ত মানবজগতের সব কিছুকে ধারণ করেছে নিজের মধ্যে, নিজেকে করেছে প্রতিষ্ঠা সমস্তের উদাহরণ স্বরূপে যদি মহাভারত চলচ্চিত্র সত্যি তৈরি হতো , শ্রী রায় সেক্ষেত্রে প্রধান যে সমস্যার কথা বলেছেন তা হল চরিত্রের সাথে চরিত্রের সম্পর্কের কথা। কেননা ইংরেজি ভাষায় যদি ছবিটি হতো , বিশ্বের দর্শকের কাছে  তা স্পষ্ট করা সত্যিই এক দুরহ কাজ। ভীষ্মের সাথে বিদুরের সম্পর্ক কি ? শকুনি বা কি হতো সঞ্জয়ের, কিম্বা একলব্য পাঞ্চাল রাজের  সাথে ঠিক কি সম্পর্ক ব্যাসের! তা সত্যি আমাদের কাছেও জটিল যারা কিনা ছোট থেকেই মহাভারতের নানা গল্প শুনে বড় হয়ে উঠেছি। তাহলে বহির ভারতীয় দর্শক কুলের কি অবস্থা হতো একবারটি ভেবে দেখুন ! তা সে যাই হোক ছবি তৈরি হলে আমাদের কাছে সত্যিই এক মহান সৃষ্টি হয়ে থাকতো সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শেষ পাতে আমার বলার  যে যদি কোনদিন চলচ্চিত্র নির্মিত হয় শ্রীরায় লিখিত চিন্তায় ভর করে , তবে ওই নোটস গুলি এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠবে ডিটেলিং এর ক্ষেত্রে তবে একথাও ঠিক আরও বিশদে আরও গভীরভাবে আলোচনা প্রয়োজন এই নোটগুলিরটিকা টিপ্পনি সহকারে। কোথায় কোন প্রেক্ষিতে কি লিখিত , কেনইবা এমন হলো! সর্বোপরি মূল যে বিষয়গুলির, যেপর্ব গুলির কথা সত্যজিৎ রায় লিখেছেন তারও বিশদে আলোচনা analysis দরকার এবং সেই সঙ্গে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট শ্লোকগুলির উদ্ধার , যদিও তা এক বিরাট কাজের জায়গা হবে বলেই মনে হয়। যেহেতু সত্যজিৎ রায় মহাভারত দুইই আমার খুবই আগ্রহের পছন্দের বিষয় তাই সেই কাজে আমার অন্তত কোন অনীহা নেই , যদি সময় সুযোগ পাই আর তা লিখিত হবে এক চলচ্চিত্র ছাত্র নির্মাতার দৃষ্টিভঙ্গিতে এইটুকুই যা বলবার। সবশেষে শুধু একটা কথাই বলব সত্যিই যদি সত্যজিতের পরিচালনায় মহাভারত তৈরি হতো--- "তবে তবে কেমন হতো তুমি বলতো…!"


ঋণস্বীকার : 

বিচিত্রপত্র পত্রিকা, সন্দীপ রায়, হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ, নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী, ধীরেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন