আধুনিক মননের বীজায়ন
আধুনিকতায় আমরা জীবনের সমস্ত দেহ মনের প্রবৃত্তি, উপকরণকে আত্মার প্রসাধনে দেখি । সেই কথাই আমাদের বিশ্বকবিতার অন্বেষণে আজ আলোচনা করব।
বস্তুতঃ কবিতার নিগড় ছাড়া মানুষের সংস্কৃতি হয়নি। ইতিহাসকে এই
একটা কৌণিক ধারা থেকে দেখলে আমরা মানব সংস্কৃতির একটা অন্য উন্মেষের ছবিপ্রকৃতি দেখতে পাই। প্রথমত, আমাদের জৈবিক স্তর থেকে যখন আমরা সমাজবদ্ধ চেতনায় জেগে উঠছি তখন আমরা মূলত কবিতার মধ্যে দিয়ে (মূলত মহাকাব্য বা ধর্মগ্রন্থর মধ্য দিয়ে) সমাজ, সংসার, আইন, শীলতা সখ্য আর শিল্পের জীবনে উন্নতি লাভ করছি। আমাদের ধর্ম আসলে কবিতা নির্ভর। ধর্মের উৎসেও কবিতা। কাব্যিকতা আমাদের উৎস। কবিতার উৎসে রয়েছে উৎসের কবিতা। তাই সব উন্মেষ। উন্মেষের প্রথম চরনে কবিতার স্থান - তার আগে কি আছে আমরা যুগের প্রেক্ষিতদৃষ্টি থেকে বলতে পারি না। সময়ের কতটুকুই বা সিঞ্চন করা যায়। রক্ষা করা যায় ? তবে যেটুকু স্মার্ত তাও কাব্যিক। এটা আমরা ধর্মের প্রাকলগ্নেও দেখেছি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বৈকি – আজন্মমৃত্যু, পূর্বাপর, জীবনের সব পরিশীলিত আচার অনুষ্ঠান উৎসবের ধর্ম সংহিতা বলে যা আমরা মেনে নিই তাতো আসলে কাব্য গ্রন্থ। যেমন ভগবৎ গীতা । বা দাভিদের প্রার্থনা সংগীত । সেই সব কাব্যগ্রন্থে কিছু অনিবার্য ব্যবহারিক সত্যের কথা বলা হয়েছে। সেই থেকেই সমাজের বিধি বিধানকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ব্যাপক সংস্কারের মধ্যে তার স্থান দেয়া হয়েছে, মান্যতা দেওয়া হয়েছে। একটি কাব্যগ্রন্থ ‘মহাভারত’ থেকেই তো ভারত নামক রাজনৈতিক সমাজের উদ্ভব হয়েছে।
কবিতার বিশ্বায়ন শুরু হয় খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকের থেকে। এই সময়টা উপনিবেশের গোড়ার কথা। একটি বিশেষ ধারা লক্ষ্য করি আমরা - আরব ও মোঘল সাম্রাজ্যের সময়কালে এশিয়া ভূখণ্ডের থেকে আরবি বা পারসি ভাষার যে প্রবর্তন ব্যবহার শুরু হয় - তার পরবর্তীতে, কিংবা তার কিঞ্চিৎ পরে - ইউরোপের রাজন্যবর্গের অনুগ্রহে যখন প্রান্তিক উত্তর-ইউরোপের বণিকশ্রেণী ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে তাদের ব্যবসা বা সমবায় প্রতিষ্ঠা করা শুরু করে - তখন থেকেই। কবিতা যখন সমগ্র বিশ্বের মানুষের কাছে একই সাথে পৌঁছতে শুরু করলো তখন থেকেই আন্তর্জাতীয় পাঠকের জন্যে তা গৃহীত হোল । সব জাতি, বর্ণের মানুষের জন্যে একটা সাধারণ, ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক জনজীবনের জন্য প্রকাশ ঘটেছিল সেই কবিতার। সম্ভবত জার্মান মহাকবি যখন তাঁর ‘ফাউস্ত’ কাব্যনাট্য লেখেন তখন তাঁর সূচনায়, নাট্যের নান্দীমুখে কালিদাশের কথা উল্লেখ করেন । ইউরোপীয়রা ভারতের কবিতায় বিশ্বায়ন খুঁজেছে । সেই দুশ্মন্ত-ফাউস্তের উত্তরসূরি আধুনিক যুগের জয় পরাজয়ের নিয়ামক হয়ে আছে ।
প্রথম বিশ্বকবিতা হিসেবে যদি কোনো একটি কাব্যগ্রন্থকে বেছে নিতে বলা হয় - তাহলে আমাদের মেনে নিতে হবে যে হয় চণ্ডীদাস না হয় শেক্সপিয়রের কবিতাই এই বিশ্ব কবিতার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। চণ্ডীদাসের কবিতায় শুধুমাত্র যে বৈষ্ণব চেতনা তা নয় – তাঁর ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ -এক আধুনিক বিশ্লেষ । মানুষ এখানে অন্তর্মুখী ধর্মনিরপেক্ষ ধর্মান্তরিত বৌদ্ধ বা এমনকি সুফি মতাদর্শের মানুষ – এবং সেই অর্থেই সত্য যে অর্থে মানুষ তার নিবিড়তম অন্তর্যামীকে খুঁজে পায় – বিশ্লিষ্ট ভাবরসের মধ্যে দিয়ে দেখে । অন্য অর্থে শেক্সপিয়রের কবিতাকে আধুনিকায়নের উৎস বলে কেন ধরে নিতে হবে সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া দরকার। ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক প্রতাপ এবং বিস্তৃতিও বিশ্বমুখীনতার প্রাথমিক কারণ - কিন্তু শুধুমাত্র ব্যবসায়িক ঔপনিবেশিকতাই এই বিশ্বমুখি কবিতা ধারার প্রতিষ্ঠা বা প্রসার বা অগ্রগামিতার জন্য দায়ী সে কথা বলা যায় - তা বললে কিছুটা সরলীকরণ হয়ে যাবে। ইতিহাসে অবশ্যই দেখা যায় যে কোনো বিদেশী রাজনৈতিক শক্তির প্রতিষ্ঠা বা বিকাশের মাধ্যমে নতুন ভাষার বা ভাষিক বোধের সম্প্রসার হয়। ভাষার চর্চা বা অনুশীলনের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে এই ক্ষমতায়ন - সে বিষয় সংশয় নেই। ভারতবর্ষে ফারসি ভাষার ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছিল । ইংরেজি ভাষার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। কিন্তু শেক্সপিয়রের কাব্যের কিছু বিশেষ গুণাবলী সে কবিতাকে ধর্মান্ধতা নিরপেক্ষ, আধুনিক কবিতা হিসেবে চিহ্নিত করে - শেক্সপিয়রের উৎকর্ষ, তার চেতনা তার কাব্যগুণ, তার শৈলী - তার প্রভাব তাকে বিশ্বের আধুনিক কবিতার পূর্বসূরি করে প্রতিষ্ঠা করেছে। আজকে যে আধুনিক মহাকাব্যের নিদর্শন আমরা দেশে দেশে সংস্কৃতি সংস্কৃতিতে পরিস্ফুট হতে দেখছি - শুধুমাত্র ইংরেজি কিংবা স্প্যানিশের মতো ঔপনিবেশিক ভাষা সাহিত্যে নয় - বরং সর্ব ভাষাভাষির কবিতা শৈলীর মধ্যে – তার প্রকাশ - সেই আধুনিক মানুষের কবিতার বা অন্তর্নিহিত উপকথন শেক্সপিয়রে রয়েছে। শেক্সপিয়রের কবিসত্ত্বা সেই আধুনিক মানুষের যে মানুষ শুধুমাত্র একটা মননশীল প্রেমিকের ভূমিকায় অবতরণ করেছে । তার মূর্ছনায় শুধুমাত্র সেই প্লেটোনীয় চিরন্তন প্রেমের খোঁজ – যেমন চণ্ডীদাসের । প্লেটোনীয় অথচ নিছক ধর্মীয় নয় তা । বরং তা মানুষের । তা সমকামী কিন্তু শারীরক নয়। তার বিশেষ দৃষ্টান্ত রয়েছে সেই লাইনটিতেঃ
এই মর্ত্য ঝড়ের সাথে সে সুন্দর কি পারে ?
যার ক্ষণিক অস্তিত্ত্ব ফুলভঙ্গুর বৈ নয় - (৬৫)
আমি প্রথমেই এই কবিতার প্রাণস্পর্শ করতেই চাই। তাহলে বিশ্বকবিতা কাকে বলে। আধুনিক শিক্ষায় বিকশিত, বৈজ্ঞানিক মানুষের স্বাধীন, স্বরাজনৈতিক ও মুক্ত সচেতনতার যে বন্ধনমুক্ত ভাবধারাকে আমরা আধুনিকার একটা বিশেষ চেতনা বলে মেনে নিতে পারি, যে দলিত, নিপীড়ত মানুষের শৃংখলামোচনের সচেতনাকে আমরা বিশ্ব নাগরিকত্যের পূর্বশর্ত বলে মেনে নিতে পারি, সেই সব মানবিক মূল্যবোধের কাব্যিক প্রকাশ নিহিত রয়েছে বিশ্বকবিতায়, চণ্ডীদাসে, শেক্সপিয়রে। এবং সর্বপরি রয়েছে সত্যের এক শারীরক অনুসন্ধান - সেখানে সত্যি প্রমিত নয়, মানুষ সেখানে সত্যের আধার। মানুষ সত্য। এই বিশ্ববোধ যেমন শেক্সপিয়রের তেমন তা বড়ু চন্ডীদাসের। বিশ্বের মানুষের জন্যে , আজকের মাটিতে দাঁড়িয়ে যদি কোনো সমগ্র মানুষের কবিতা হয় - সত্যিকারের কবিতা - তবে মানতে হবে যে বিশ্ববোধ আমাদের মানুষের চেতনায় , স্বাধিকারের বিশ্বাসে, আর সে বোধির কবিতাই আজ প্রাসঙ্গিক। চন্ডীদাসের মধ্যে সেই মানুষের কথাই বলা হয়েছে - আর সেই শ্রীকৃষ্ণ উচাটন - ঠিক যেমন শেক্সপিয়রের সনেট-এ। বা ‘লিয়র’ -এর মতো একটি নাট্যকাব্যের মানুষের দারিদ্রচেতনায়, দারিদ্রমোচনের কাব্যে - বা সেই প্রেম উচাটনে যা মানুষকে সর্বোচ্চ প্রেম বা সৌন্দর্যের দিকে প্রেরিত করে, পৌঁছে দেয়। এই সংবেদন বিশ্বকবিতার মূলমন্ত্র। তাতে ধর্ম বা জাতীয়তার অনুসঙ্গের দরকার পরে না। পুরান বা মিথ বা দেশমাতৃর ব্যঞ্জনার উল্লেখ তাতে থাকতে পারে - কিন্ত মূলত তা মানবমুখি। সেই মানুষের উত্তর-চেতনায় ঈশ্বর থাকতে পারে - চন্ডীদাসের কাব্যে যেমন তা আছে। শেক্সপিয়রেও তা আছে - প্লেটোনীয় আধ্যাত্মিকতায়। কিন্তু সে কবিতার শরীর সহজ, সহজিয়া, সরল সুন্দর মানুষিকতায়।
ক্রমশ...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন