চলনবিল
এত হাসি এত গান এত রোদ্দুর
তবু মেঘ কাটে না...
তবু কেন স্থল কমে
নোনা হ্রদ বাসা বাঁধে শিরায় শিরায়…
তুই তো অনড় নদী
বাস্প করে উড়িয়ে দিস
সঞ্চিত জল...
কথা ছিল ফিরে এসে কথা হবে। কথা ছিল ঘটস্থাপন হবে সান্ধ্যআহিকের মন্দ্রিত স্তোত্রোচ্চারণে। হাওয়ায় ঢিল ফেললেই চক্রাকারে গজল ছড়ায়। এখন মৌসম ফের স্তব্ধবাক, এখন বৃষ্টি ফের অঝোর ধারায়।
সারারাত্রি সারাদিন সারা সারা ছিন্ন প্রহর, দুচোখের ভ্রু হাততালু সানশেডে তীব্র আকুল। এই শুরু এই শেষ, এই ফের বরফ জমে কষ্ট গাছের পাতা ক্লিষ্ট হলুদ। এত হাসি, এত গান, ছায়া ছায়া অভিমান, এত সূত্র সূক্ষ্মচিত্রের। লহমায় উড়ে চলে ঘূর্ণির অমোঘ মায়ায় শান্ত প্রতিবিম্ব দুপায়ে ঠেলে। ওই এককোণে মুখঢাকা মেঘলা দুপুর চির আগন্তুক বেশে রহস্য বিছায়। কথা সব কথা থাকে, ইচ্ছেরা দেশ ছাড়ে ঢাকের বাদ্যি বোলে, অভিমান ঝিকমিক পায়ের ধুলোয়।
সঙ্গত ছাড়া গান ন্যাড়া। অন্ততঃ একটা সুর অদৃশ্য গুনগুন, অন্ততঃ একটা ছায়া ছায়া আবছায়া মুখ! সব গাড়িই নিজের রুটে ছুটছে। তার মধ্যেই কেউ ব্রেক কষে দেখে নেয় ভাদ্রের শেষ বর্ষায় জমা জলে ফেয়ারওয়েলের অপেক্ষায় থাকা মেঘের ছায়া। ছায়া... ছায়া আবছায়া...
কেবল আঁকিবুকি কেটে গেছি। রোদ্দুরে বৃষ্টিতে সেসব মুছেও গেছে। বিবেকানন্দর বলে যাওয়া দাগ কাটতে পারিনি কোথাও। পারিনি, কারন চেষ্টাই করিনি। কেবল আঁকিবুকি কেটে গেছি। আর্য এসে আদিবাসী কে বলেছিল অস্পৃশ্য, শূদ্র। আসলে আর্য ছিল নাগরিক, সম্ভ্রান্ত। উজ্জ্বল আলোর রেখায় ছিল তার বাসভূম। বাকিরা প্রান্তিক, অবহেলিত। আমি সেই প্রান্তিক। খুব সামান্য, সাধারণ একজন আদিম নিবাসী মানুষ। আমি দাগ কাটিনা, কাটিনি কখনো। শুধুই আঁকিবুকি কাটি নিজের খুশির আল্পনায়। নাগরিক আর্য কখনো প্রান্তিকের বন্ধু হয় না। আমারও কোনো বন্ধু নেই, আত্মীয় নেই, স্বজন নেই। যারা আমার স্বজন ছিল, তারা ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছে। যারা আমার স্বজন ছিল, তারা পিঠে গুলির ক্ষত নিয়ে উপুড় হয়ে দেখেছে ধানজমির ভুলুকের ভুলভুলাইয়ার আশ্চর্য যতিচিহ্ন। যারা আমার স্বজন ছিল, তারা আপনমনে দৈনন্দিন খাবারের সন্ধানে গিয়ে বিষাক্ত খরিশের ছোবলে মারাংবুরুর অশ্বত্থ গাছের এক কোণে তিন পা ঘোড়া হয়ে গেছে। তারা কেউই দাগ কাটেনি। তারা নাগরিক নয়। তারা উজ্জ্বল এলইডি আলোকবর্তিকা নয়। তারা এলেবেলে। তারাই আমি, আমিই তারা। এক সামান্য, খুব সাধারণ প্রান্তিক মানুষ মাত্র। যে মানুষ দাগ কাটেনা, আঁকিবুকি কাটে মাত্র সারাটা নিস্ফলা জীবন সময়ে।
ব্যস এটুকুই যথেষ্ট একজনের মানসিক অবস্থান বোঝানোর জন্য। হাত উল্টালে নেতি, মুখ উজ্জ্বল হলে পরমাত্মীয়ের নক্সাকাটা আসন। কিন্তু পারম্পর্য বুঝতে হয়, আর এখানেই বাধে গোল। নিউরন উন্নত না হলে মানুষ আটকে যায় কোনো নির্দিষ্ট জন এ। আর সেই ভালোলাগার ছাঁচে ফেলে মিলিয়ে নিতে চায় নতুনতরের নতুন একটা দেওয়াল, একটা উঠান, একটা নতুন বাড়ি। মিললেই বাহবা, না মিললেই থু থু। কিন্তু সময় বলে সবকিছুর মতো স্বপ্নও এগোয়, আর সেই এগোনোকে দেখতে হয় মন খোলা রেখে। আর চোখ খোলা রেখে গিলতে হয় চারপাশের দৈনন্দিন রঙের সুতো দিয়ে বোনা এক আশ্চর্য রূপকথার ঝালর। খুঁজেপেতে নতুনতর রাস্তায় হাঁটতে হয়। তাতে কে ভালো বললো, আর কে খারাপ, তাতে মন হারানো মানুষটার তাৎক্ষণিক ভাবে বয়েই গেল।
সব হারানো নিঃস্ব ফকিরকেও অবধারিতভাবে রাখতে হয় মৌলিকত্বের ছাপ। আঁকতে হয় নিজস্ব এলাকার চালচিত্র। অ্যান্টার্কটিকার পেঙ্গুইন কোনোদিন সাহারায় বালির টিলার উজান বেয়ে টুকটুক করে কোনো নিঃসঙ্গ ফারাওয়ের একাকী গোপন সমাধির দরজায় এসে বলতে পারে, "দরজা খোলো গো মহাজন! খানিক গল্প করে যাই।"
শুধুমাত্র আমিই যা দেখতে পাই সেসব আমার গভীর রাতের স্বপ্নের লালন। আমাদের হাসি গান ভয় বিদ্রুপের ঠান্ডা কিম্বা উষ্ণ সময় জুড়ে যে নকশি কাঁথারা ছড়িয়ে আছে তাদের পালন করি নিউরনের নাতিশীতোষ্ণ কুঠরিতে। তাদেরই সন্তান সন্ততি অথবা পৌত্র প্রপৌত্রের কেউ কেউ বয়স জনিত বালখিল্যপনায় সেই বন্ধ ঘরের জানলা টপকে, শাড়ি বা স্রেফ দরজার পর্দা পাকিয়ে ব্যালকনিগুলো থেকে লাফ দেয় নীচে, পালায়... পালায়। পালানোর রাস্তায় পেয়ে যায় এক ছোট্ট নামগোত্রহীন ম্যাজিক ঝোরা। মাঝরাতের প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের ঘন্টা বাজে গুনে গুনে বারোবার। আর ওমনি ঝুপ্পুস নামে একলা ইয়েতি, একলা ইউনিকর্ণ, একলা দেড় আঙলা দেড়েল মানুষ। বিগত ছায়ার যত ফেলে আসা না কথা, অবজ্ঞা, অকারণ কুৎসা, একগাল হাসি আর নাভিমূলে আদরের ক্ষতচিহ্নের দল পেছনে মিলিয়ে যেতে যেতে বিন্দু হয়। সামনে অচলায়তনের মস্ত বার দুয়ারী কপাট হাট করে খুলে কুর্ণিশ ঠোকে আজন্ম ক্রীতদাস দুই শাস্ত্রী। ঘোড়ার কেশরে ছলকায় অনন্য চাঁপার সুগন্ধি। স্বপ্ন জড়িয়ে, স্বপ্নের গায়ে পা তুলে চুমু খাই। ফের ঘুমোই কালকের রোদ্দুর ছোঁব বলে।
ক্রমশ...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন