শনিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

ওবায়েদ আকাশ-এর ধারাবাহিক গদ্য : "শালুক ও অধুনাবাদ"

শালুক ও অধুনাবাদ

অধুনাবাদ : কী বলে ভেতরের আমি

ভাষাগত বৈচিত্র্য ছাপিয়ে মানুষের একটিই ভাষা-- সেটি হচ্ছে: ভাবের বা বক্তব্যের বা জিজ্ঞাসার বিনিময়। এই পারস্পরিক আদানপ্রদান মানব-মন ছাপিয়ে সর্বজীবকুলে প্রতিষ্ঠিত সত্য। আবার চিন্তার বিভিন্নতা ছাপিয়ে মানব-মনের একটি অধ্যায়; আর সেটা বিকাশ, উৎকর্ষ কিংবা লক্ষ্যকে কেন্দ্রে রেখে প্রতিষ্ঠিত। এটা মনুষ্য আধারে চূড়ান্তভাবে সত্য হলেও অন্য প্রাণিরাজ্যে এখনো কিন্তু শেকড় প্রোথিত করেনি। অনুসন্ধানব্যাপে মানুষের জাতীয় অভীপ্সা আবির্ভাবকাল থেকে এখনো অবধি বিদ্যমান প্রখরতরভাবে প্রবহমান। গাছে উঠে আকাশ স্পর্শ করার চেয়ে ডানা মেলে কিংবা নভোযানে উড়ে যে আরও গভীর সত্যে পৌঁছানো যায়, এই ভাবনাকে ছাপিয়েও এখন নতুন কিছু ভাবছে মানুষ। আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স মানুষের এসব ভাবনার প্রগাঢ় উচ্চতাকে অনুবাদ করে দিচ্ছে মুহূর্তে। রোবটের কমান্ড বোঝার বা মানার অতি আশ্চর্য ক্ষমতাও এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে কিছুটা পুরনো হয়ে গেলযখন পৃথিবীর কোথাও কোথাও মানুষের চেয়ে বরং রোবটকে গার্লফ্রেন্ড বা প্রেমিকা হিসেবে বেছে নেবার আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে।


এমন চিন্তাশিখরে মানুষ যে হঠাৎ করে বা ঘুম ভেঙেই উঠে গেছে জাতীয় ভাবনার কারণ যেমন নেই; তেমনি ভাবেও না কেউ। তবু বিস্ময় বলে কথা! হয়তো এসব স্রষ্টাকে সবাই অতিমানব বা অলৌকিক আবির্ভাব হিসেবে ভাবছে। আর এই রাজ্যে এসে আমরা আমাদের নিজেদের সঙ্গে যুদ্ধ করছি নিজে। কালের সঙ্গে, স্রোতের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করছি নিজে। অবিশ্বাস্য সাপোর্ট কিংবা সীমাহীন সুযোগ-সুবিধার গভীরে বসেও ঝঞ্ঝামুক্ত নিজেকে নির্মল বাতাস বিছিয়ে এক দণ্ড ঘুম পাড়ানো যে কতটা দুরূহ, তা ভুক্তভোগীদের জানা। যে কারণে মানুষ তার দূর শৈশবে হারানো গ্রামের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে মোহিত নস্টালজিক হয়। এক অকৃত্রিম নির্মল সুখে আন্দোলিত হয়। আমিষের অভাবে যে নানা প্রকার ভর্তাভোজন প্রচলিত ছিল অভাবের সংসারে; সেই ভর্তাভোজন এখন বহুতারকা-বিশিষ্ট হোটেলের বিলাসী খাবার। আবার মধ্যবিত্তিক অভাব-অনটন হেতু একদা যে মানুষ শনেছাওয়া কিংবা হোগলাপাতা বা মাটির ঘরে বসবাস করতো; আজকাল তার পরিবর্তে মানুষ ইটপাথরের আবাসনে বসবাস করে বিলাসী জীবনযাপন করছে। কিন্তু কর্মাবসরে যখন তারা দূরদূরান্তে ভ্রমণে বের হয়, তখন তারা খরকুটোয় নির্মিত, নিসর্গলগ্ন রিসোর্টটা বেছে নেয় অতিচড়া মূল্যে ভ্রমণানন্দ উপভোগের জন্য। তাদের কাছে তখন নাগরিক আবাসনগুলো যথার্থ আনন্দ দেয় না। তা নিত্যদিনের ক্লিশে অভ্যাসকে ইঙ্গিত করে। এবং বাঁশ-বেত, শন-হোগলা, খরকুটোর আবাসন তখন আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। 


সুযোগ থাকলে সবার আগে মানুষ ফেরত চাইত তার শৈশব বা কৈশরকে। মুক্ত হতে চাইতো যান্ত্রিকতা কিংবা তুখোড় নগরায়ন থেকে। আরবানাইজেশনকরনে মানুষের মানসিক সম্মতিকে যতটা প্রয়োজনের জন্য বিবেচনা করা যায়; নির্মল প্রকৃতির মানুষের ঠিক ততটাই অসম্মতি নগরায়নের বিরুদ্ধে।


অধুনাবাদ মানুষের এই মনের গভীরতর ইচ্ছা কিংবা অভিলাষকে প্রাধান্যে রেখে তার মনুষ্য কাননে ঢুকে পড়েছে গহন অজান্তে। এটি তাই হারানো শৈশব, মাটিলগ্ন জীবনের নির্মলতা, আবাল্যের হারানো পল্লীগীতি, বাউল, জারি, সারি, ভাওয়াইয়া, পুঁথি, পালা, গাজীর গান, গ্রামীণ নাচগান, খেলাধুলা প্রভৃতির মতো পুরনো আচারকে আস্কারা দেয়। পুরনো লোকাচারের সহজ-সরল জীবনাচারের ভিতর দিয়ে, বাঙালির নানান উৎসব-পার্বণের আনন্দাভিযানের সাম্পানে চড়ে পাল তুলে দেয় গন্তব্যে। 


এই যে আমাদের বিশাল বিপুল জগত, এই যে আমাদের মহার্ঘ কাঙ্ক্ষিত অতীত, এই যে আমাদের পুরনোর কাছে, হারানোর কাছে ফিরে যাবার অভিলাষ; তাকে কি আমাদের সাম্প্রতিক আরবানাইজেশন কেড়ে নিতে পেরেছে? অধুনাবাদী জিজ্ঞাসায় অতীত বরং এক টুকরো স্বস্তির জন্য মানুষের মধ্যে গভীরভাবে শেকড় প্রোথিত করে চলেছে দিন দিন। নগর সভ্যতার যতই বিকাশ ঘটছে নিয়ত, ততই মানুষ একটুকরো সবুজকে, এক খণ্ড জলাশয়কে পরিপাটি করে দীর্ঘস্থায়িত্ব দিতে পরিকল্পনা আঁটছে। যদিও তৃতীয় বিশে^ অনুন্নত উন্নয়নশীল দেশগুলোর শাসনব্যবস্থা এসব গণমানুষের আকাক্সক্ষাকে প্রাধান্য দেয় না। তারা সব সময় প্রকৃতি নিধন, সবুজ হটিয়ে, জলাশয় ভরাট করে বাণিজ্যিক ইমারত নির্মাণের ভিতর দিয়ে নিজেদের অভিপ্রায় পূরণে ব্যস্ত থাকে। যেখানে শুদ্ধ চিন্তা, নির্মল আকাক্সক্ষার মানুষের ইচ্ছার কোনো প্রতিফলন থাকে না কিংবা এসব মানুষও কোনো শাসকের কাছে তা প্রত্যাশা করে না। কেননা দলগত শাসক, প্রত্যেকেই জানে, তাদের সিংহাসন নামের ভাঙা টুলটি সারাক্ষণই নড়বড়ে থাকে; কাঁপতে থাকে; যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। তাই গণমতকে উপেক্ষা করে, প্রকৃতিলগ্ন অনাবিল সুন্দরকে উপেক্ষা করে তারা বরং নিজেদের নিয়েই মগ্ন থাকে। সভ্যতার শুরু থেকে হয়তো এটাই ভেবে এসেছে যে, ক্রমাগত নগরায়নের জন্যই বুঝি পৃথিবী নামের ভূখণ্ডটি তারা খুঁজে নিয়েছে বিপুল জগৎভাণ্ডার থেকে। তারা হয়তো জানেই না, বিজ্ঞান প্রকৃতিলগ্নতা একই সঙ্গে সমান্তরালে হাঁটে।


প্রকৃতি যেমন বিজ্ঞান প্রাকৃত জিজ্ঞাসাকে সঙ্গে করে নিজেকে বিকশিত করতে চায়, তেমনি প্রকৃতিও বিজ্ঞানের সংস্পর্শে এসে আরও বেশি পল্লবিত আরো বেশি নৈসর্গিক আরও বেশি নান্দনিক সৌকর্যে মাটিলগ্ন থেকেই মানুষের পাশে আশ্রয় খুঁজে পেতে চায়। বিজ্ঞান কখনো প্রকৃতিকে ধ্বংসের পক্ষে নয়। বিজ্ঞানমনস্কতার সৌন্দর্য হলো প্রকৃতিকে নির্ভর করা। প্রকৃতির কাছ থেকে শেখা। যেমন পাখি ওড়ার দৃশ্য দেখে বিজ্ঞানীরা উড়োজাহাজ আবিষ্কার শিখেছে। অবার বাতাসে গাছের পাতা হেলেদুলে ওঠার দৃশ্য দেখে মানুষ বৈদ্যুতিক পাখা আবিষ্কার শিখেছে; যা আমাদের বদ্ধ ঘরেও শীতলতা দেয়। আবার প্রকৃতির ব্যাপারটা যেহেতু প্রাকৃত, তাই প্রকৃতি মানুষকে দান করেই তৃপ্ত। এই দেয়া এবং গ্রহণের প্রক্রিয়ায় যারা বিভাজনে বিশ্বাসী, কিংবা যারা এর বিরুদ্ধে অবস্থান করে বিজ্ঞান প্রকৃতি উভয়ের ধ্বংসসাধনে প্রবৃত্ত, তারা অধুনাবাদের প্রতিপক্ষ। এই প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের আজন্মের লালিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবোধকে ধারণ করে সহজাত স্বকীয়তা লতানো সারল্যে মিশে আছে অধুনাবাদ।


এবার প্রশ্ন হলোপ্রতিদিন প্রবলভাবে যে আরবানাইজেশন ঘটছে, যে যান্ত্রিকীকরনের কালো ধোঁয়ায় ডুবে মানুষ পুষ্পের হাসি হাসতে শিখেছে, যেখানে তার অন্তত এক জেনারেশনের শেকড়বাকড় প্রোথিত হয়েছে, সেই সাজানো নগর ছেড়ে মানুষ তার অন্তরালের সাধ পূরণে আবার গ্রামে ফিরে যাবার কথা কখনো কল্পনা করে কিনা? কিংবা এমন কল্পনা করলেও তা কতটা বাস্তবতাপ্রসূত ভেবে দেখা যাক। প্রথমত ধারণা করতেই হবে যে, এটা বাস্তবিক পক্ষেই যে বাস্তবতাবর্জিত, এটাই সব চেয়ে বড় সত্য। একটি প্রজন্মের নগরায়নের জার্নি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়জীবন জীবিকার তাগিদে নির্দিষ্ট চাকরি করছে, প্রতি পরিবারে এক বা একাধিক জন; আবার ব্যবসার ক্ষেত্রে ব্যবসাকে ঘিরে চারপাশের বা ভৌগোলিক বাস্তবতা; আবার সন্তানের লেখাপড়া সূত্রে স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানিকতা ছাড়াও হাত বাড়ালেই সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা হাতের নাগালে পেয়ে যাবার মতো বন্ধন থেকে মানুষ কী করে নগর ত্যাগ করে তার ফেলে আসা শৈশবের আবেগকে কাঁকড়ে ধরবে? যদিও একটি বাউল গান, একটি বিচ্ছেদী, মুর্শিদী কানের পাশ দিয়ে উচ্চারিত হয়ে গেলে এই নাগরিক মানুষেরই ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে; এই ধাতব মনই গলতে গলতে পানি হয়ে যায়; ক্ষণিক স্তব্ধ করে দেয় যাত্রাপথকে। আবার কোনো প্রকারের ধর্মীয় কিংবা বড় উৎসব আয়োজনে শহর ত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়: বস্তুত নগরে আঁটসাঁট তালা মেরে মানুষ গ্রাম কিংবা শেকড়ের খোঁজে শত বাঁধা অতিক্রম করে ছুটে যায়; আর দুর্ভাগ্যক্রমে যারা গ্রামের বসতী হারিয়েছেন, যাদের ঘরবাড়ি নদী বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বংস হয়ে গেছে; কিংবা যাদের কোনো পূর্বসূরিই আর গ্রামে থাকে না; সেইসব নাগরিক মানুষ, হয় সমুদ্রের কাছে, না হয় পাহাড়ের কাছে ফিরে যায়। সেটাও সম্ভব না হলে এমন এক প্রাকৃতিক ভূস্বর্গকে নির্বাচন করে, যেখানে তারা শৈশবের উৎসব উদ্যাপনের মতো একটি সহজাত পরিবেশ খুঁজে পাবে। তাহলে এমন সত্যে কেউ কি স্থির হতে পারেন যে-- মানুষ মূলত শেকড় অন্বেষী, মানুষ প্রকৃতার্থেই শৈশব সন্ধানী, সে প্রবল গ্রাম-নস্টালজিক; তারা সুযোগ পেলেই, কিংবা অবসর মিললেই নির্মল প্রকৃতির কাছে, নিসর্গের স্পর্শে ছুটে যায়? গ্রাম এবং নগরের তুলনামূলক আয়াস-সুবিধার এই দোদুল্যমানতাকে ঘিরে অধুনাবাদের রয়েছে স্পষ্ট উচ্চারণ। স্পষ্ট মীমাংসা কিংবা স্পষ্ট অবস্থান। যেহেতু মানুষ নগরকে এড়াতে পারে না; যেহেতু মানুষের নগরের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে ওঠে এবং সমগ্র মননজুড়ে বসবাস করে নির্মল গ্রাম্য প্রকৃতি, ফুল ফোটা, পাখি ডাকা ভোর, পাখপাখালির কলকাকলিময় সন্ধ্যা, বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওর, নদীনালায় মাছ ধরা, কিংবা নৌকা ভ্রমণের অভিলাষের মতো আরও বিপুল সহজাত অনুষঙ্গ; তাই অধুনাবাদী চিন্তায়: প্রগাঢ় প্রকৃতিময় নগর সভ্যতার বিনির্মাণেই কেবল মানুষ তার প্রকৃত ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে পারে। যেখানে নগর শুধু নগর নয়; কিংবা যেখানে গ্রাম শুধু গ্রাম নয়। নগর এবং গ্রাম উভয় জায়গাতেই থাকতে পারে, জলাশয়, সবুজ প্রকৃতির ঘনঘটা আবার কোমল ছোটখাটো নাগরিক দালানকোঠা, বিপণিবিতানসহ আরও সব প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ-- যা মানুষের আবাসন এবং বাণিজ্যিক সুবিধাকে সমান্তরালে নিয়ে আসবে। তবে কালো ধোঁয়া উৎপাদনকারী কলকারখানা কিংবা ট্রাক বাসসহ ভারি যানবাহনের জন্য অবশ্যই আলাদা আলাদা নির্দিষ্ট স্থান সড়ক সেতু তার স্বঅবস্থানে থাকবে। সেখানে যে মানুষের কর্মসংস্থান থাকবে না, এমনটাও নয়; যোগাযোগের ক্ষেত্রে এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে; যেন মানুষ তার কর্মঘণ্টাটুকু অতিক্রম করে আবার প্রকৃতিময় আবাসনে ফিরে যেতে পারে। নিঃশব্দ ঘুমে রাত কাবাড় করে দিতে পারে। যেন তার ঘুম ভাঙে মোরগের ডাক শুনে, পাখপাখালির কলকাকলিময়তায়। আবার ভোরবেলার কর্মস্থলে যেন পৌঁছে দেয় যোগাযোগ ব্যবস্থার সর্বোচ্চ সুযোগ। অধুনাবাদ তার চেতনায় বিশ্বকে এমন একটি গ্রামের আদলে মেপে দেখতে চায় যে, সমগ্র বিশ্বই হবে একটি গ্রাম। তার থাকবে ছোটখাটো থেকে বিশাল বিপুল নগর সভ্যতা। কিন্তু তাতে যোগাযোগ পদ্ধতির এতটাই সহজগম্যতা প্রয়োজন; যার মাধ্যমে মানুষ বিশাল দূরত্বকেও সহজে অতিক্রম করে দিন শেষে কর্মাঞ্চল ছেড়ে গ্রামে ফিরে এসে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে।


আর একটি জরুরি বিষয় আমাদেরকে অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে যে-- আমাদের বাঙালিয়ানা, আমাদের ইতিহাস, আমাদের আত্মপরিচয়, আমাদের উৎসব-পার্বণ, আমাদের লোকাচার, আমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির মতো অনুষঙ্গগুলো আজ নানা প্রতিকূলতায় ধ্বংসের মুখোমুখি, এগুলো এখন অপ্রয়োজনীয়, অনাদরণীয় হয়ে উঠছে এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মানুষের কাছে। অধুনাবাদের মীমাংসায়: এর জন্য মূলত মানুষই দায়ী; কারণ তারা তাদের আত্মপরিচয় ভুলে, বিশুদ্ধতা ভুলে রমরমা সস্তা রঙের উৎসবে মেতে উঠছে। নিজস্ব সংস্কৃতিকে পায়ে দলে পশ্চিমা-সংস্কৃতির সেবক হয়ে উঠছে। অকারণে ইংরেজি বলতে শিখছে। অপ্রয়োজনে প্রভু সাজতে শিখছে সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতায়। উত্তর উপনিবেশের ঘোড়ায় চড়ে তারা, না পারলেও হাওয়ায় বৈঠা চালাতে শিখছে। যে কারণে আমাদের নিজস্ব আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যাচ্ছে। এখন এই মুহূর্তে অধুনাবাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলোবাঙালিকে তার বাঙালিয়ানায় ফিরিয়ে আনা। তার সংস্কৃতিকে শীর্ষে তুলে ধরা। ঐহিত্যকে হৃদয়ে লালন করা। হারানো অহংকারকে পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে নিজেদের আভিজাত্যে অভিজাত হয়ে ওঠা। আর আমরা নিজেদের সম্পূর্ণ নিজস্বতাকে সামনে তুলে ধরতে পারলেই যে তাতে বিশ্বপরিসরে  তুলে ধরা সম্ভব অধুনাবাদের চর্চায় আমরা প্রতিনিয়ত এমন আকাঙ্ক্ষার বিন্দুতে মিলিত হই।


পরের সংস্কৃতি বা পশ্চিমা মডার্নিজম কিংবা পশ্চিমা পোস্ট মডার্নিজমের অভিঘাতে নড়েচড়ে বসার দিন আমাদের শেষ হয়ে এসেছে। অধুনাবাদ সবসময় নিজস্ব আলোয় আলোকিত হতে যেমন প্রতিশ্রুত, তেমনি সে আলো ছড়িয়ে দিতে চায় বিশ্বব্যাপী। কেননা আমাদের রয়েছে এক সমৃদ্ধ অতীত। সমৃদ্ধ ইতিহাস। সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। অতি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। এসব কিছুর প্রতিপালক এই বাঙালি জাতি। এই জাতীয়তাবাদের আলো দিয়ে আমরা বিশ্বজাতীয়তাবাদকে যেমন আলোকিত করতে চাই, তেমনি ঘুরে আসতে চাই অন্য আলোর ভুবন; তাতে তা গ্রহণ বর্জনের প্রশ্নটি তখনই মাত্রা পাবে যখন তা হবে সমানে সমান। কারো কাছে মাথা নত করে হাত পেতে কিছু নেবার দিন শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করি। অধুনাবাদের শিক্ষা এইআজ আমরা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি, কারো কাছে মাথা নত করে নয়, কেবল নির্মোহ সমান্তরালেই বুকে বুক মেলাতে পারি, হাতে হাত মেলাতে পারি। পরস্পরের এই বোঝাপড়াটুকুর জন্য আমাদেরকে অতীত ভ্রমণে যেতে হবে। যেখানে আমাদের ছিল নতজানু প্রবৃত্তি। আমরা পশ্চিমা ইজম, সাহিত্যিক প্রবণতা, চিন্তা পদ্ধতিতে নিজেদের রাঙিয়েছি, এবং এখনো সেই পথে হাঁটছি। কিন্তু অধুনাবাদী শিক্ষায়, সেই অতীত শিক্ষা থেকে আমরা আমাদের নিজস্বতাকে ফিরিয়ে আনবো নিজেদের মতো করেই। আর কোনো -নত গ্রহণ নয়।


অধুনবাদ কোনো ইজম নয়; এটি কেবলমাত্র একটি চিন্তা কাঠামো; আবার অধুনাবাদ আমাদের চিন্তাপদ্ধতিও। জয়তু অধুনাবাদ।



ক্রমশ...




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন