শনিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

ঋতম্ মুখোপাধ্যায়-এর ধারাবাহিক গদ্য : "কবিতার বাতায়ন"

 

মণীন্দ্র রায়ের দীর্ঘকবিতা : পুরাণের পুনর্জন্ম


Myth is a type of speech chosen by history: it cannot possibly evolve from the ‘nature’ of things.                      

 - (Roland Barthes) 


দীর্ঘ কবিতা কেন লেখেন? তার উত্তর দিতে গিয়ে মণীন্দ্র রায় (১৯১৯-২০০০) নিজেই জানিয়েছিলেন : ‘বহু বিচিত্র এবং এক-এক-সময় পরস্পর বিরোধী কারণে সমাজের মধ্যে ভয়ানক রকম একটা টানাটানি, ভাঙচুর এবং টেনশন’-কে ছোটো মাপের কবিতায় স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তাঁর দীর্ঘ কবিতা রচনা সার্থক নাকি ব্যর্থ এই নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়েও তিনি সে-পথ পরিত্যাগ করেননি। অনেকরকম আত্মদ্বন্দ্ব পতনের চিহ্ন নিয়ে সেই দীর্ঘ কবিতার ভিতর দিয়ে কবি আমাদের মহৎ কবিতার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। বিশ্বাস করতে চেয়েছেন কডওয়েলের এই অনুপম বাচনএইজন্য মহৎ কবিতা সবসময়েই হয়ে থাকে দীর্ঘ কবিতা সেসব কবিতায় অনেক হতাশা যন্ত্রণার রক্তাক্ত কাহিনি, নতুন সমাজের স্বপ্ন বুনে দিয়েছেন কবি। আর মাঝে মাঝে তাঁর দীর্ঘ কবিতায় পুরাণের ব্যবহার সেসব কবিতাকে পৃথক মাত্রা দিয়েছে। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের দূরত্বকে মনে মনে পূরণ করে নেওয়া সেইসব মিথ-পুরাণের ভাঙা-গড়ার পিছনে রয়েছে তাঁর সচেতন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। আর তাই মণীন্দ্র রায়ের কলমে কর্ণ, যযাতি কিংবা বেহুলা সমকালের দর্পণে নিজেদের দেখতে পায়। মৃত্যু জীবনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কর্ণ নিজের মৃত্যু দিয়ে রেখে যেতে চান বিদ্রুপতিক্ত প্রতিবাদ, খসে পড়ে যযাতির যৌবনের আরোপিত মুখোশ আর বেহুলার দিকে তাকিয়ে সাপে-কাটা শরীরের কঙ্কাল থেকে  লখিন্দর পৌঁছতে চায়অন্য জীবনের আঙিনায় আমাকে বাঁচতে দাও, আমাকে জাগতে দাওএই আর্তি যাঁর, সেই কবি আসলে জীবনের বিষ মন্থন করে পেতে চান প্রেমের অমৃত আর নতুন মানবজন্মের আস্বাদ।  


.


ভারতীয় সাহিত্যে মহাভারতের কর্ণ চরিত্র নিজগুণেই অমরত্ব পেয়েছে। একদিকে কর্ণ উদ্ধত-দাম্ভিক, অন্যদিকে তিনিই মহাবীর আর দানশীল এক মানুষ। জন্মক্ষণে যার মা তাকে পরিত্যাগ করেছেন, ক্ষত্রিয় হয়েও আজীবন সূতপুত্র এই পরিচয় বহন করতে হয়েছে কর্ণকে। হয়তো না-পাওয়ার যন্ত্রণা তাকে মাঝে মাঝে কঠিন করেছে। দুর্যোধনের কাছে অঙ্গরাজ্য উপহার পেয়ে সেই সম্মানের ঋণ আমৃত্যু শোধ করে গেছেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে কুন্তীই তাঁর আসল মা জেনেও নিজের পুরনো পরিচয় ছেড়ে আসেননি কর্ণ। প্রধান শত্রু অর্জুনের পিতা ইন্দ্রদেব ছদ্মবেশে হরণ করেছেন তাঁর দিব্য কবচ-কুণ্ডল। অন্যায় যুদ্ধে পরাজিত অথচ মহাবীর সেই কর্ণ ভাসের নাটককর্ণভারম্‌’, রবীন্দ্রনাথের নাট্যকবিতাকর্ণকুন্তীসংবাদ  আর বুদ্ধদেব বসুর কাব্যনাটকপ্রথম পার্থ’-তে নানা ভাবে চিত্রিত হয়েছেন। মণীন্দ্র রায়েরপৃথিবী আমার, পৃথাদীর্ঘ কবিতাটি এসবেরই উত্তরজাতক। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ বা পঞ্চম শতকের নাট্যকার ভাস তাঁরকর্ণভারম্‌’- কাহিনিকে সামান্য আগে-পিছে করেছেন। কাহিনির মূল উপজীব্য কর্ণকে কৌশলে তার দিব্য কবচ-কুণ্ডল দান করানো। এখানে ইন্দ্রদেব ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে এসেছেন, শল্যরাজ যদিও কর্ণকে সাবধান করেছিলেন -ব্যাপারে। তবু দানবীর কর্ণ নিজের জীবনকে সংকটে ফেলেও দানের মাহাত্ম্যকে অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। কর্ণ এখানে বিস্ময় শ্রদ্ধার পাত্র। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেব বসুর রচনায় কর্ণ তাঁর মাতৃপরিচয় পেয়েও স্বধর্মচ্যুত হতে চাননি। রবীন্দ্রনাথের কর্ণকে দেখা যায় মায়ের পরিচয় পেয়ে উতলা হতেযাব মাতঃ চলে যাব, কিছু শুধাব না - / না করি সংশয় কিছু না করি ভাবনা কিন্তু পরক্ষণেই ক্ষোভে, বেদনায় সে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে মা-কে : ‘কেন চিরদিন / ভাসাইয়া দিলে মোরে অবজ্ঞার স্রোতে - / কেন দিলে নির্বাসন ভ্রাতৃকুল হতে তাই রাজত্বের অধিকার কিংবা বীরভ্রাতাদের আনুগত্য কোনো কিছুই তাঁর কাছে লোভনীয় নয়। একদিকে বন্ধু দুর্যোধনের প্রতি কর্তব্য আর অন্যদিকে আত্মপরিচয় জানার পর এক শূন্যতাবোধে আক্রান্ত হন কর্ণ। যুদ্ধ তার কাছে কেবল কর্তব্য এখন। জয়হীন চেষ্টা আর আশাহীন কর্মের উদ্যম নিয়ে কর্ণ বোঝে এই পৃথিবী তার কাছে আর বাঁচার যোগ্য নয়। পরাজয়ের ঘ্রাণ আঁচ করেও সে দুঃখ আর পরাভবকেই রাজমুকুট করেছে। এক গোপন যন্ত্রণাকে অন্তরে লালন করে পঞ্চপুত্রের প্রাণভিক্ষা সে দিয়েছে মা-কে, ব্যথার্ত স্বরে বলেছে : ‘জয়ী হোক, রাজা হোক পাণ্ডবসন্তান  -/ আমি রব নিষ্ফলের, হতাশের দলে।বীরের সদগতিই কেবল তার কাম্য, আর কিছু নয়। এই নিঃসঙ্গ নায়ক কর্ণ আমাদের আধুনিক সময়ের অস্তিত্বের সংকটে দীর্ণ এক চরিত্র। 


একই কাহিনিসূত্রকে আরও বিস্তারিত করেছেন বুদ্ধদেব তাঁরপ্রথম পার্থকাব্যনাট্যে। কাব্যনাট্যের নির্ভার কাহিনিতে যেভাবে মানুষের অগম, গহন মনকে স্পর্শ করতে চাওয়া হয়, নাটকে বুদ্ধদেব তা সার্থক ভাবে করেছেন। এখানে চরিত্র মোট টি : কর্ণ, কুন্তী, দ্রৌপদী, কৃষ্ণ এবং দুই বৃদ্ধ। এখানে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরুর আগে কর্ণের অবস্থান নিয়ে ভাবিত সকলে। কারণ সে একমাত্র বীর, যে কুরুকুলের কেউ নয়। বাকি বীররা সকলেই কৌরবদের পক্ষে থাকলেও পাণ্ডবদের প্রতি স্নেহশীল। তাই মহান কর্ণকে যুদ্ধবিমুখ করতে একে একে কুন্তী, দ্রৌপদী, কৃষ্ণ এবং বৃদ্ধেরা সকলেই উদ্যোগী হয়েছেন এখানে। কিন্তু কর্ণকে টলানো যায়নি শেষাবধি। যদিও কর্ণ মায়ের আহ্বানে, দ্রৌপদীর মধুর আকুতিতে চঞ্চল হয়েছে, কিন্তু শেষপর্যন্ত সে যুদ্ধকেই আশ্রয় মেনেছে। কারণ, আত্মপরিচয়হীন কর্ণ এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে চান। যে দুই নারীকে তিনি ভালোবাসতে পারতেন আজ তারা তাঁর থেকে দূরে। কালস্রোতে ভাসমান কর্ণ কুন্তীকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য আজ, মা তাঁর কাছে শুধুই স্বপ্ন। দ্রৌপদীকে পেতে চেয়েছিলেন একান্তে নিজের করে, সূতপুত্র পরিচয় তাঁর সেই চাওয়াকে ব্যাহত করেছে। আজ তাই রাজত্ব বা দ্রৌপদীর স্বামিত্ব জন্মসূত্রে পেতে চাননি কর্ণ : ‘আমার গ্রাহ্য নয় অনর্জিত উত্তরাধিকার এখানে কর্ণ আর দ্রৌপদীর কথোপকথনে উন্মোচিত পারস্পরিক অনুরাগ আর বর্তমানের অনিবার্য বাধা। দ্যূতসভায় দ্রৌপদীর প্রতি কর্ণের দুর্বাক্যও গভীর বেদনাসঞ্জাত, একথা জানায় কর্ণ। কুরু-পাণ্ডবের কেউ না হয়েও কর্ণ যুদ্ধ চান, তার উত্তরে কর্ণ জানান : ‘কেউ মিত্র নয় আমার, কাউকে আমি শত্রু বলে ভাবি না - / আমি স্বাধীন, আমি নিঃসঙ্গ।কিন্তু এই যুদ্ধ তাঁর কাছে এক নিষ্করুণ পরীক্ষা, যার মধ্য দিয়ে তিনি আত্মপরিচয়ের সন্ধান পাবেন : ‘হতে পারবো নিজের কাছে প্রকাশিত প্রমাণিত।এরপর কৃষ্ণকেই একই কথা বলেন কর্ণ, লুপ্ত সময়ে ফেরা অসম্ভব তাঁর পক্ষে। মাঝে মাঝে যুদ্ধ-বীরখ্যাতি তাঁর আছে অসহনীয় লাগে, তবু বীর কর্ণ চান না উদ্ভিদের মতো কেবল বেঁচে থাকতেআমার সার্থকতা চেষ্টায়সংগ্রামে’ – এই তাঁর চাওয়া। তাই পরাজয়ের স্বাদ নিয়েই অতৃপ্ত কর্ণ অর্থ খুঁজতে চান নিজের অস্তিত্বের। কর্ণের জীবনে শত্রুতা আর প্রেম একই মুদ্রার দুই পিঠ আসলে। যদিও কৃষ্ণ দুই সমান ক্ষমতাধারী বীরকে মুখোমুখি করে দিয়েও কর্ণকে হত্যার অবকাশ রচনা করবেন, এই ইঙ্গিত দেন। আসলে এই মৃত্যুর মূল্যেই অমর হবেন কর্ণ, যাকে ন্যায় যুদ্ধে হারানো অসম্ভব অর্জুমের পক্ষেও। কর্ণ প্রথমে ক্রুদ্ধ হলেও কৃষ্ণের দেওয়া এই বীরোচিত সম্মানের মূল্য বোঝেন। পরাজয়ের মালা গলায় পরে তিনি চান না পুনর্জন্ম। মহান ভাস্বর পরাজিত বীর রূপে কর্ণ সর্বকালের মানুষের চোখের জলে চিরজাগরূক হয়ে থাকবেন। বৃদ্ধদের আক্ষেপে কাব্যনাট্য শেষ হয়, কিন্তু কর্ণের যন্ত্রণা আর আনন্দের যুগলবেণী আমাদের মনে এক অভূতপূর্ব অনুভব জাগায়এই কর্ণ আধুনিক মানুষ হয়েও বিষাদাচ্ছন্ন নন, বরং পরাজয়ের তীব্র স্বাদেই সে বিজয়ী। -নাটকের প্রেক্ষাপট খুঁজতে গেলে দেখা যায় ১৯৬৯/৭০ সালে রচিতপ্রথম পার্থনকশালবাড়ি আন্দোলনের ছায়ায় লালিত। বাঙালি জীবন তখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত। কর্ণ তখন সেই স্বাধীনচেতা নিঃসঙ্গ এক মানুষের নাম, যেখানে চেষ্টার ফল ব্যর্থতা, যোগ্যতা মূল্যহীন। সমকালকে আলতো করে ছুঁয়ে রেখেছে এই পৌরাণিক কাব্যনাটক। কারণ বুদ্ধদেব বিশ্বাস করতেন, ‘মহাভারত কোনো সুদূরবর্তী ধূসর স্থবির উপাখ্যান নয়, আবহমান মানবজীবনের মধ্যে প্রবহমান তাঁর কলমে পুনর্নির্মিত পৌরাণিক চরিত্রেরা আমাদের সমকালের সঙ্গী হয়ে যায়।


.


বাংলা সাহিত্যে কর্ণ চরিত্রের -হেন নবনির্মাণের প্রেক্ষিতে আমাদের কাছে মণীন্দ্র রায়ের কবিতাটি বিচার্য হতে পারে। এখানে কর্ণ সরাসরি কুন্তীর সঙ্গে কথা বলেছে অনেকটা নাটকীয় একোক্তির ঢঙে। কবিতাটি পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত। সমগ্র কবিতা জুড়ে বেজে ওঠে কর্ণের হাহাকার আর দৃপ্ত কণ্ঠস্বর :

আকাশ থেকে মাটির দিকে,

মানবী, তুমি ধারণ করেছিলে তার বেগ,

সাতঘোড়ার রথ, আর পূর্বতোরণ,

লালন করতে পারো নি তবু তাকে বুকের তাপে,

আর ভেসে গিয়েছি আমি তাই নদীর জলে,

মৃত্যু আর জীবন আমার দুদিকের প্রহরী।

একটা ছিন্নবৃন্ত জবার মতো তামার থালায়।

যেন বলিপ্রদত্ত তার জীবন। ছিন্ন জবার অনুষঙ্গ পশুবলির কথা মনে আনে। তবু কর্ণ ক্রোধী, সূতপুত্র হয়ে বেড়ে ওঠার ফলে অবজ্ঞাকে সে কাছ থেকে দেখেছে। বাজপড়া গাছের মতো সে দগ্ধ হয়েও  হার মানেনি কখনো। অবাঞ্ছিত তার জন্ম, পতনের ভয় তবুও তাকে  ভীত করেনি। নিয়তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেই কর্ণ স্পর্ধা দেখিয়েছে, হয়েছে কর্কশ। যদিও এটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। সেও হৃদয়বান। তাই বসন্তের আহ্বানে, জ্যোৎস্নালোকে সেও কামনামদির হয়, কিন্তু তার একান্ত কামনার ধন দ্রৌপদী বংশপরিচয়ের কারণেই মুখ ফিরিয়ে নেয় ঘৃণায়। মাকে প্রশ্ন করে কবির কর্ণ : 

কেন ভালোবাসার জানালায় আমি

কোনদিন পাব না আমার নির্বাচিতা হৃদয়ের

                                 প্রতীক্ষা?

কেন সারাজীবন থাকবে আমার শুধু

জীবনধারণ আর বাঁচা?

তুচ্ছ সংসার আর ভ্রাতৃবিরোধ, দুর্বিনীত দুর্যোধনের তোষামোদকোনোটাই চায় না কর্ণ। কিন্তু সেসবই তাকে করতে হয় শুধু তার অবিবেচক মায়ের জন্য : ‘দ্যাখো, মানবী, তুমি চিরকালের জন্যেচিরকাল / বঞ্চিত করেছ আমাকে আমার স্বপ্নে আর তাই এক প্রবল ঘৃণার জগতে আজ তার বাস। তার তৃষ্ণার অঞ্জলিতে ঝরে পড়ে জ্বলন্ত অঙ্গার : ‘ঘৃণার চিতা দিয়েই আরতি করব আমি / বঞ্চনার অমাবস্যার মুখ কিন্তু এই শ্মশানের মতো জীবন তো কাঙ্ক্ষিত ছিলো না তার। তার অঙ্গে ছিল সহজাত কবচকুণ্ডল। কিন্তু সব বিলিয়ে দিয়ে কর্ণ পেয়েছিলেন ইন্দ্রের উপহার একাঘ্নী, সেও তাকে ছেড়ে দিতে হয়। -কবিতায় দানবীর কর্ণকে আমরা মর্মযাতনার গোপন কীটের দংশনে হাহাকার করতে দেখি। কিন্তু যন্ত্রণাকে সে মুক্তি দিতে চায় প্রতিবাদের মধ্যে :

এই নিষ্ফল কামনা, এই পদাহত পৌরুষ,

আর দিনের পর দিন শুধু অভিশাপ,

আমার বুকের গহ্বর থেকে খুঁচিয়ে বার করেছে

মাতাল একটা রোখা শুয়োর,

আমার দাঁতের লাঙলে উলটে ফেলব আমি পাতাল,

আর আমার নিয়তির বুকের ওপর

চাপিয়ে দেব আমি আমার বাঁ পা;

এই বিশ্রী কর্কশ স্পর্ধা আমার আমরণ! 

বারংবার কর্ণের উচ্চারণেখর্ব বামন সংসার’-এর প্রতি ক্ষোভ উঠে আসে। কবি যেন কর্ণের মুখ দিয়ে সমকালের পৃথিবীকে ঠাট্টা করেন। সাতের দশকে লেখা এই কবিতায় মুদ্রিত হয় স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। নকশালবাড়ি আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রেক্ষিত -প্রসঙ্গে স্মরণে রাখা যেতে পারে। আর তাই ভালোবাসা নয়, শিখা থেকে অঙ্গার আর অঙ্গার থেকে ছাই হয়ে যাওয়া সত্তা নিয়ে কর্ণ ঘৃণার কথা বলে। রাজকীয় স্বর্গের প্রলোভন তাকে পথভ্রষ্ট করে না, নীতিবিহীন নীতি কতখানি ক্ষতিকর তা সে জানে। তাইরক্তাল্পতার অসুখে আক্রান্তজগতে অন্ধত্ব আর শঠতার চেহারা দেখে সে আর ধর্মের প্রতি আস্থা রাখতে পারেনি। উপনিষদেরপূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে’- ইতিবাচক মন্ত্রকে ব্যঙ্গ করে তার আর্তি আমাদের স্পর্শ করে : ‘শূন্যের ঘণ্টার মতো শূন্যে বেজে উঠে / শূন্যে গেছে মিশে সমকালের নির্মম প্রহারে আহত কবিসত্তা কর্ণের কণ্ঠে তাই যুদ্ধের নির্মম রূপ উদ্‌ঘাটিত করে। এই কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধে হারা বা জেতায় কার লাভ? সত্যিই কি ধর্ম বলে আছে কিছু? তার কাছে একদিকে একশ জন অন্ধ গোঁয়ার আর জুয়াড়ী ধর্মপুত্র দুজনেই সমান অপরাধী। তাই এক অদ্ভুত বিদ্রুপে কর্ণ উচ্চারণ করে :

কার যুদ্ধ, কেইবা জেতে?

হাসতে পারলে আমি নিজেই লিখে যেতাম 

প্রচণ্ড একটা প্রহসন!

নিজের মৃত্যু দিয়েই আমি রেখে যাব বরং

                              আমার বিদ্রুপ,

আমার প্রতিবাদ! 

আসলে কর্ণ যেন সেইদারুণ এক প্রতিশ্রুতিযে পারে এই সমাজ-সংসারকে বদলে দিতে, কিন্তু তার যথাযথ ব্যবহার করা হয় না বলেই তাকে অন্যায় যুদ্ধে বিদায় নিতে হয়। তার কাছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে আসলে ঘটেছেছেলেখেলার জয়-পরাজয় কিন্তু না, প্রথম পার্থ কর্ণ হেরে জেতে রাজি নন কখনোই। তাই তিনি ফিরে আসতে চান তাঁর অতৃপ্ত কামনা স্বপ্নকে পূর্ণ করতে। আমরা বুদ্ধদেব বসুর কর্ণকে পুনর্জন্মে অনাগ্রহী দেখেছি, সে আর এই বঞ্চনার জীবন চায় না। কিন্তু মার্ক্সীয় চেতনায় দীক্ষিত মণীন্দ্র রায়ের কর্ণ বলে : 

শতকে শতকে আর দেশে দেশে আমি আসব

যতোবার আমার রথের চাকা রাক্ষসী মাটি গিল্‌বে,

যতোবার আমাকে টেনে তুলবে ফাঁসির মঞ্চে,

আর জ্বলন্ত সীসের গোলকে ঝাঁঝরা করে দেবে শরীর,

বারবার আমি আসব

আমরা এর সঙ্গে প্রতিতুলনায় টেনে আনতেই পারি নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা রাম বসুর কাব্যনাটকপার্থ ফিরে এলো’(১৯৭৪)-কে। সেখানে পার্থ সমস্ত পুরাতন ঐতিহ্য মূল্যবোধকে ধ্বংস করতে চায়, বাবাকেও সে প্রয়োজনে হত্যা করতে পিছু পা নয়। ছাল-চামড়া তোলা জীবনের রূপ দেখেছে একালের পার্থরা, তাই এই নাটকের নায়ক রতনবাবু ভাবেন, পার্থ কুরুক্ষেত্র শেষ করে ফিরবে নাকি বুকে কুরুক্ষেত্র নিয়ে? পার্থ কুরুক্ষেত্র বুকে নিয়েই ফেরে এবং প্রাণহরণের অনুতাপে সে ড্রাগ নিয়ে ঘুমাতে চায়। -নাটক মৃত্যুখচিত, বিদ্রোহের স্বপ্ন বুকে নিয়েও পার্থ সফল হয় নি। একদা ভুল পথে হেঁটে আজ সে ঘুমের মধ্য দিয়ে বিশুদ্ধ হতে চেয়েছে। অন্যদিকে আমাদের কবিতার কর্ণ পূর্ণ উদ্যম নিয়ে ফিরে আসতে চায়, দীপ্ত হতে চায় সূর্যের মতো মধ্যগগনে, বলে :

আর মাথায় তোমার সেদিন পরিয়ে দেবো না,

                          আমি সোনার মুকুট,

শুধু হাতে তুলে দেবো ধানের গুচ্ছ,

আর পৃথিবী আমার, পৃথা,

মানবী নয়, ডাকব আমি তোমাকে সেদিন

মা লে!  

এই শস্যশ্যামলা পৃথিবীর সঙ্গে কর্ণ একাত্ম হতে চেয়েছে। রাজকীয় মহিমা নয়, মাটির বুকে জেগে ওঠা সোনালি প্রাণের জাদুই তার অন্বিষ্ট। কবিতার অন্তিমে এসে কবি কর্ণকে স্বপ্নলোক গড়তে চাওয়া কর্মী মানুষের প্রতিভূ করে তুলেছেন। পরবর্তীকালে কর্ণকে নিয়ে আরো অনেকেই কবিতা লিখেছেন, সেখানেও কর্ণ ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের প্রতিনিধি হয়েছে বারংবার। সেই তালিকায় সব্যসাচী দেব তরুণ মুখোপাধ্যায়কর্ণনামাঙ্কিত দুটি কবিতার কথা বলা চলে। সব্যসাচীর কর্ণ আজীবন মিথ্যার আড়ালে অর্জিত নিজের সাফল্যে কষ্ট পায়, মৃত্যুকে বরণ করে নিয়ে সে বলে : ‘অর্জুন, মেদিনী নয়,  রথচক্র গ্রাস করছে আমারই সে দ্বিধা অন্যদিকে তরুণের কর্ণ পরাজয়ের বেদনায় হাহাকার করে চলেছে আজীবন, তবু তার অন্তিম উচ্চারণ : ‘আমি কর্ণ - কুলহীন, গোত্রহীন / সুচিহ্নিত তথাপি সমরে  


.


মহাভারতে দৈত্যগুরু শুক্রচার্যের অভিশাপে অভিশাপে  রাজা যযাতির জরাগ্রস্ত হওয়া পুত্র পুরুর বদান্যতায় যৌবন ফিরে পাওয়ার পৌরাণিক কাহিনি আমাদের জানা। যদিও শেষাবধি যযাতি যৌবনবিলাসের অসারতা বুঝে পুরুকে যৌবন ফিরিয়ে দিয়ে বনবাসী হয়েছিলেন। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় এইযযাতিস্মরণীয় হয়েছেন একালে। সেখানে যযাতি জেনেছেন জীবনের সারসত্য। মহাভারতীয় রাজার মতো তিনি আর ভুল করতে চান না। ভবিষ্যৎ আশাহীন, নিষ্ফলা জেনেই তিনি বেঁচে আছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একনায়কদের আস্ফালন কবি দেখেছেন, দেখেছেন মানুষ বিচ্ছিন্নতা বোধে আক্রান্ত, ‘মরু নগরে নগরে এই অস্থির সময়ে সোনার তরীতে চড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রার সৌন্দর্যাভিসার কবির কাঙ্ক্ষিত নয়। যুগে যুগে অভিযাত্রীর দিল নানা ভয়, বাধা, শত্রুতা সব তুচ্ছ করেই জয়ী হয়েছিলেন। তাদের অভিযাত্রা মধুর না হলেও সম্মাননীয়, কবির যযাতি সেই পথের পথিক। কবি টেনে এনেছেন র‍্যাঁবোর মাতাল তরণীর প্রসঙ্গও।  কিন্তু তাঁর যযাতি নব্য রোম্যান্টিক নন, তাই বিংশ শতাব্দীর সমান বয়সী তিনিমজ্জমান বঙ্গোপসাগরে প্রখর বাস্তবে দাঁড়িয়ে অতীত বিলাস বা প্রবল প্রগতি কোনোটিই তাঁর জীবনে ঘটে না। এক ত্রিশঙ্কুর মতো দশা এই যযাতির। একালের মানুষ অভিমন্যুর মতো ব্যূহবন্দি, নিষ্ক্রমণের পথ জানে না। কবি লেখেন : ‘স্বপ্নে জাগরণে যেন মনে রাখি নয় কল্পতরু / ঊর্ধ্বমূল, অধঃশাখ, দুর্নিরীক্ষ্য সেই মহীরূহ -কবিতায় স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নির্বেদ ফুটে ওঠে কারণ, -যুগের যযাতি অকাল জরায় অবরুদ্ধ নন কিংবা পুরুর সঙ্গে যৌবন বিনিময় করেননি তিনি। এই যুগে জরা যৌবন উভয়ই শাপগ্রস্ত বলেই মরুময় এই সমকাল মানবজীবন। অন্যদিকে বিষ্ণু দেরযযাতিকবিতায় সমালোচক জীবন মৃত্যুর দ্বন্দ্বে কাতর যযাতিকে জীবনতৃষ্ণার প্রতীক হিসেবেই দেখেন। জটিলতাময় জীবনে জ্ঞান পাপের বোঝা থেকে ক্ষণমুক্তি পেতে যযাতি বেছে নেন প্রেম সম্ভোগ। যদিও শেষরক্ষা হয়নি। একালের মানুষেরাও কি যযাতির মতো নয়? – ‘তাই তো হৃদয় নির্দয় লোভে তোমাকে মাগে / নাটকীয় সুরে প্রলাপ-কম্প্র প্রবল গানে 


বাঙালি কবিদের এই যযাতি-চর্চারই উত্তরাধিকার মণীন্দ্র রায়ের কবিতাযযাতি১১৯৭৩  চারটি পর্যায়ে বিন্যস্ত এই চারপাতার দীর্ঘ কবিতা। এখানেও যযাতির কাছে পুত্রের কাছে ছিনিয়ে আনা যৌবন একআরোপিত মুখোশ তিনি স্বগতোক্তির মতো বলে ওঠেন :

আর মজ্জার মধ্যে

সময়ের বজ্রকীটের দংশন,

যেন সংকটের দুটি শিঙের মধ্যে আমি টালমাটাল,

আমার এই মন্থিত বিষের গেলাসে আজ

কীসের ছায়া কাঁপে?

সুন্দর পৃথিবীর রূপে তিনি দেখতে পান নারীদেহের মদির আমন্ত্রণ আরটাটকা তাজা ভালোবাসার মাতাল করা উচ্চহাসি আর প্রকৃতির মোহজালে মুগ্ধ হয়েই তিনি জরাগ্রস্ত জীবন মেনে নিতে পারেননি, পুত্রের কাছ থেকে ধার নিয়ছিলেন যৌবন। কিন্তু সেইলুঠ করে আনা যৌবন’-কে ভোগ করতে গিয়ে শেষে উপলব্ধি করেন, এসবই আসলেএক মিনিটের ইন্দ্রজাল হাজার বছর ধরে সম্ভোগতৃষ্ণা মিটিয়ে যযাতি ক্লান্ত এবং আজ তার অসারতা বোঝেন। আর তারপর কবির যযাতি নিজেকে প্রশ্ন করেন, নতুন যুগের যুবকের কাছে থেকে ছিনিয়ে আনা এই যৌবন যেন জোর করে অপহরণের নামান্তর। আর সেই যৌবনের মোহে যযাতি লালসার যজ্ঞে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন, নারীমাংসের বিলাসে তৃপ্তি খুঁজেছেন। আসলে প্রাচীনকাল আর নতুন কালের দ্বন্দ্ব -কবিতা চিত্রিত। যেন প্রাচীন সময় নতুনকে তার পায়ের তলায় দমিয়ে রাখতে চেয়েছে। যৌবনের অন্যায় ব্যয়ের পাপে আজ জরা অনুতপ্ত, ব্যধিগ্রস্ত। তাঁর উপলব্ধি :

আর হাজার বছরের বিলাসরজনী তাই

হাজার ফনা বাসুকীর মতো

উগরে দিয়েছে বিষ!

কে জানত বল, ভালোবাসাহীন বলাৎকার এমন

ছুঁড়ে ফেলে দেয় পাতালে।

আমার পতন আমাকে ভাঙতে থাকে।  

-কবিতা নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রেক্ষিত স্মরণে আনে। তাইভ্রষ্ট শতকের ভূলুণ্ঠিত ছায়া উল্লেখ করেন কবি। একাকী যযাতি তৃষ্ণার বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে হাহাকার করেন। যদিও সেই তৃষ্ণা যৌনপিপাসা নয় আর, বেঁচে থেকেও নারকীয় মৃত্যুর অনুভবে বিক্ষত হন তিনি। প্রাণবন্ত যৌবনকে নষ্ট-ভ্রষ্ট করার অভিশাপ গায়ে মেখে পুরাণ-পুরুষ যযাতি পতনের শেষ সীমায় একা দাঁড়িয়ে থাকেন, শতাব্দীর রাক্ষসীবেলায় এই তাঁর শাস্তিবিধান। -কবিতায় বামপন্থী মণীন্দ্র রায় কোনো আশাবাদের স্বপ্ন দেখাননি, বরং এই যযাতির প্রচ্ছদে সমকালের অন্ধকারকেই ইঙ্গিত করেছেন।  


৫.


মনসামঙ্গলের বেহুলা-লখিন্দর-এর গল্প লোকপুরাণের অন্তর্গত। কালনাগিণীর বিষে প্রাণ হারানো লখিন্দরকে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে এনেছিলেন সহধর্মিণী বেহুলা। যদিও সেই কাজ সহজ ছিল না। একদিকে শঙ্কর-ভবানী পূজক দৃঢ়চেতা শ্বশুর চাঁদ সদাগর আর অন্যদিকে প্রতিহিংসায় উদ্যত দেবী মনসার ক্রোধএই দুয়ের মাঝাখনে দাঁড়িয়েছিল বেহুলা। স্বর্গের দেবতাদের নাচ দেখিয়ে তুষ্ট করে এবং শ্বশুরকে মনসাপুজোয় সম্মত কবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে তার স্বামীর জীবন লাভ করেছিল। বেহুলা নানা প্রলোভন কঠিন পরিস্থিতি পার করে তার পতিব্রাত্য বজায় রেখেছিল বলেই তার কাহিনি যুগে যুগে কিংবদন্তীর মর্যাদা পেয়েছে। বাংলা কবিতায় বেহুলা-লখিন্দর-চাঁদ সদাগরের প্রসঙ্গ কালিদাস রায়, জীবনানন্দ দাশ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, সব্যসাচী দেব, কৃষ্ণা বসু, কবীর সুমন প্রমুখের গীতিকবিতায় নানাভাবে উঠে এসেছে। এসব কবিতার মূল উপজীব্য বেহুলার আত্মত্যাগ, নিষ্ঠা, প্রেম এবং দেবতাদের নিষ্ঠুরতা, হৃদয়হীনতা। জীবনানন্দেরছিন্ন খঞ্জনা মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়পঙ্‌ক্তিটি আমাদের বেদনাবিদ্ধ করে। সব্যসাচী দেব যখনবেহুলা ভাসানকবিতায় বেহুলার নিরুপায় হয়ে  শরীরকে পণ্য করার জন্য হাহাকার ব্যক্ত করেন আর বেঁচে ওঠা লখিন্দরের ঔরসে জন্ম দিতে চান এমন এক সন্তানের যারবিষের দহনে জ্বলে যাবে দেবভূমিআমরাও সহমর্মী হই। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় পড়িলখিন্দরবেহুলা নাচানো স্বর্গ’-এর কথা। লেখেনসে জাগবে, সে জাগবেই, লখিন্দর সে আমার।কিংবা কি দেবতা অসুর জড়সড় / বোবা রক্তের কোলাহলে / এই বেহুলা নাচানো স্বর্গ? / সে-যে আগুনের মতো জ্বলে আর কবীর সুমনজাতিস্মরগানের লিরিকে লেখেন : ‘কালকেউটের ফনায় নাচছে লখিন্দরের স্মৃতি / বেহুলা কখনো বিধবা হয় না এটা বাংলার রীতি / ভেসে যায় ভেলা এবেলা ওবেলা একই শবদেহ নিয়ে / আগেও মরেছি আবার মরবো প্রেমের দিব্যি দিয়ে। 


মণীন্দ্র রায়েরআমাকে বাঁচতে দাও আমাকে জাগতে দাওদীর্ঘ কবিতার শুরুতে সেই বেহুলা-লখিন্দর ফিরে এসেছে :

আমার সাপে কাটা নীল শরীরটাকে নিয়ে

তুমি, বেহুলা, কাকে ফিরিয়ে আনলে?

এই ইন্দ্রের মতো যৌবন,

এই বজ্রের মতো সাহস,

আর আমার স্বপ্ন, আমার উল্লাস, 

আমি কোথায় রাখি!   

ছয়টি পর্যায়ে -কবিতা বিন্যস্ত হয়েছে। লখিন্দরের পুনর্জীবন লাভের ভিতরে যেন তৃপ্তি নেই। তার শব হয়ে থাকাকালীন সমস্ত যাত্রাপথ স্বর্গের সভা, বেহুলার নৃত্য সবই সে বর্ণনা করেছে। কিন্তু পুরনো পৃথিবীতে পুরনো দেহ নিয়ে ফিরে আসা সে মেনে নিতে পারে না, বলে : ‘কোথায় রাখি আমার এই জাগিয়ে তোলা জীবন’? কারণ নতুন করে বেঁচে উঠে লখিন্দর স্বর্গ আর মর্ত্যলোকের প্রভেদ বোঝে। কারণ আঙুলের ডগায় সে বিদ্যুৎ ছুঁয়ে এসেছে বলে পৃথিবীলোক তার কাছে সহনীয় হয় না আর। তাছাড়া আগামী জন্মের স্বপ্ন তার চোখে লেগেছিল, কিন্তু সেই সাপে-কাটা শরীরকেই নতুন জীবন দিয়ে ফিরিয়ে এনেছে বেহুলা। সেই আগামী জীবনে অন্যকালের হাওয়ায় সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিকতা ভেঙে-চুরে নতুন কিছু গড়ার ইচ্ছে ছিল তার :

জিহ্বার আঘাতে বাজিয়ে তুলেছি সেই অন্যকালের হাওয়া

আমরা সমস্ত ঘরবাড়ি আর প্রতিষ্ঠানকে

লোহার মত গালিয়ে

দাঁড় করিয়ে দিয়েছি অন্য মাপের ভিতের ওপর,

আর সমস্ত স্তম্ভের গায়ে কান পেতে শুনেছি

নৃসিংহের গর্জন 

কিন্তু সেই আশা স্বপ্ন- রয়ে গেল। ফিরে আসতে হলো নতুন করে। লখিন্দরের স্বপ্নের মধ্যে যেন সত্তরের উত্তাল যুবকদের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়। কিন্তু লখিন্দর একই জীবনে পায় দ্বিতীয় জন্মজাতিস্মরের মতো তার দশা। ক্ষুধা আর মৃত্যুর জগতে সে ভালোবাসার মন্ত্র শোনাতে চায়, কিন্তু পারে না। কারণ স্বর্গলোকের বিরাট রূপ দেখে এসে তার পক্ষে আর ফেরা সম্ভব নয় এক ইহজাগতিকজন্তুর খোঁয়াড়ে বুকের মাঝে লখিন্দর বিশ্বলোকের সাড়া পেয়েছে, বিশাল এক ডানামেলা দেবদূতের মতো সে গোটা পৃথিবীর মুখোমুখি যখন দাঁড়াতে প্রস্তুত, ঠিক তখনই এই নতুন জীবন তার বিড়ম্বনা বাড়িয়েছে। আসলে এক অবক্ষয়ের চিহ্ন বহন করেছে সাপে-কাটা শরীর, যা থেকে লখিন্দর মুক্তি খুঁজেছিলো। কিন্তু তা পেলো না সে। বরং স্বর্গলোক ছুঁয়ে এসে  যে শানিত ইস্পাতের মতো চেতনা সে পেয়েছে সেখানে তার বেহুলার অতীত জীবনের মধুর স্বপ্নবিলাস   প্রথম পরিচয়ের বিস্ময় আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। বেহুলার উদ্যোগে বেঁচে ফিরে আসা লখিন্দরের হৃদয়ে এখন অন্যরকম বেঁচে ওঠার স্বপ্ন। মার্ক্সীয় দর্শন এখানেও কবিকে সংগ্রামী মানবচেতনায় উদ্দীপিত করেছে। তাই লখিন্দর প্রশ্ন করে :

কবে আমরা ভেলা ভাসাব আমাদের সেই বেঁচে ওঠার দিকে?

শতক থেকে শতকে,

তোমার চোখে চোখ রেখে

তোমার বুকে বুক,

আমি জন্মে গেছি অন্য জীবনের আঙিনায়

আমি দাঁড়াতে চাই সেখানে মাটির ওপর পা রেখে! 

লখিন্দর তার রক্তের উল্লাস আর আগ্নেয় সত্তাকে সঞ্চারিত করে দিতে চান আগামী প্রজন্মের হৃদয়ে, তাঁর স্বপ্নে উদ্‌ভাসিত হয়আগুনের মতো মানুষ লখিন্দরের বাঁচতে চাওয়ার অর্থ আসলে প্রেমের হাত ধরে পৃথিবীতে নতুন স্বর্গ রচনার স্বপ্ন দেখা।


আবার চাঁদ সদাগরের জবানিতে লেখা হয়েছে আরেকটি দীর্ঘ কবিতাএই আমার বিষ, আমার জীবন কালিদাসের চাঁদ সদাগর বিশ্বাস করতেনমানুষই দেবতা গড়ে / তাহারই কৃপার পরে / করে দেব মহিমা নির্ভর এখানেও চাঁদ নাগিনীর পায়ে বাঁ হাতের পুজো সঁপে দিয়ে অন্ধকারে মুখ লুকান। পরিশ্রমের ঘামে গড়ে তোলা তাঁর মনুষ্যত্ব পরাজয়ের গ্লানিতে লীন। তাঁর জয়স্তম্ভ আজ লাথিতে লাথিতে ভেঙে পড়েছে। তিনি আর্তনাদ করেন :

কলার মান্দাসে ভেসে গেল আমার স্বপ্ন

আমার শিরার মধ্যে নড়ে উঠল সাপ;

আমি ভয়ংক্র ধ্বংসের শিখরে জেগে উঠেছি আজ একা,

আর মৃত্যু তার অমোঘ ত্রিশূলে আমার পাতাল থেকে

টেনে বার করছে শয়তান

তবু তিনি মানবপ্রেমিক। পাপের ছোবলে হুমড়ি খেয়েও তাঁর সুন্দর তাঁকে মানুষের দিকে টানে। প্রকৃতি মানূষের সান্নিধ্যে এসে চিৎকার করে বলেন :

হে মানুষ, আমার নষ্ট দিনের সাহস, আমার প্রেম,

রক্ত ক্লেদ আর যন্ত্রণার মধ্যে

জন্ম নিতে চাই আমি তোমারই ঘরে। 

মানবজন্মেই বিষ আর জীবনকে একবৃন্তে ফুটে উঠতে দেখেন চাঁদ সদাগর ওরফে কবি মণীন্দ্র রায়। তাঁর এই মানবতাবোধ আমাদের রুশ কথাশিল্পী মাক্‌সিম গোর্কির কথাকেই স্মৃতিজীবিত করে : ‘যদি পৃথিবীতে পবিত্র বলে কিছু থাকে তা হচ্ছে নিজের অপূর্ণতায় মানুষের অতৃপ্তি এবং তার অগ্রগতির প্রচেষ্টা। আর পবিত্র হচ্ছে, যে ক্লেদ যন্ত্রণা জীবনের সুস্থ সুন্দর গতিকে রুদ্ধ করে তার প্রতি ঘৃণা, হিংসা দ্বেষ লোভ পাপ যুদ্ধকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার আকাঙ্ক্ষা আর তারজন্য সৃজনশীল শ্রম। 

 


৬.


মণীন্দ্র রায়ের বিশ্বাসআধুনিক কবিতা জীবনেরই সহযাত্রী তিনি রোম্যান্টিক কল্পনাবিলাসে আস্থাশীল নন, কবিকে তিনি চান সমাজব্যবস্থায় রাজনৈতিক কর্মীর মতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিতে। তাঁর কাছে লড়াইয়ের দুই দিকরাইফেলের লড়াই আর কলমের তথা সংস্কৃতির লড়াই। তাঁর কবিতায় প্রেমের তীব্রতা যেমন ধরা পড়ে, তেমনই ফুটে ওঠে মেহনতী মানুষের বাঁচার দাবি। আলোচিত দীর্ঘ কবিতাগুলিতে পুরাণকে তিনি নতুন তাৎপর্যে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। তাঁর অন্যান্য একাধিক কবিতায় বিচ্ছিন্নভাবে পুরাণ-প্রসঙ্গ এসেছে যদিও। যেমন,

) কোথায় হারালে তুমি সপ্তডিঙা চাঁদ সদাগর? 

বাণিজ্যবায়ুর পালে কড়ি আর শঙ্খ আর লবঙ্গ সোনার

কোথায় খুঁজেছ তুমি রাশিচক্রে হারানো বন্দর?

কোন মশানের খড়্গে শ্রীমন্তের কমলে কামিনী

খুলে দিল মানুষেরই অজানা সংসার?  (মানুষ... মানুষ)

) সে আমার পৃথিবী, আমার স্বপ্ন, আমার অশ্রু,

তাকে বুকে নিয়েও ঠিক বুকে নেই,

যেন চোখের সামনেই ঘর্ঘর, মাটি চৌচির,

আর পাতালে গেলেন সীতা,

সময়ের ফাঁক দিয়ে তেমনি মিনিটে উধাও... (তারই জন্যে আমি)


মিথ-পুরাণ আসলে সামাজিক সত্যের শিকড়ের উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। সেই মিথ-নির্ভর সাহিত্যকর্মগুলি চায় সেকাল আর একালের দ্বিরালাপে সত্যান্বেষণ করতে। সাহিত্যতাত্ত্বিক রোলাঁ বার্ত মিথের উৎসে লুপ্ত ইতিহাস, তার রাজনৈতিক চারিত্র্য গভীরভাবে জনমানসকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের সচেতন করেছিলেন। মণীন্দ্র রায়ের কবিতায় ব্যবহৃত মিথগুলি তার চেনা অলৌকিক মহিমাকে বজায় রেখেও ঐতিহাসিক-সামাজিক-রাজনৈতিক তাৎপর্যে সার্থক পুনর্জন্ম লাভ করেছে, মনে করি।।   



সহায়ক গ্রন্থ :


) মণীন্দ্র রায়ের কাব্যসংগ্রহ (১৯৭৭), দে পাবলিশিং 

) স্বনির্বাচিত (১৯৭০), শান্তনু দাস রুদ্রেন্দু সরকার সম্পাদিত, অনির্বাণ প্রকাশনী

) বুদ্ধদেব বসু : কবিত্বের অদ্বিতীয় ব্রতে (২০০৮), তরুণ মুখোপাধ্যায়, ভাষা সাহিত্য

) কাব্যনাট্য বিভাবনা (২০০৭), তরুণ মুখোপাধ্যায়, সুপ্রিম পাবলিশার্স

) ধ্রুপদি কবি সুধীন্দ্রনাথ (২০১৮), তরুণ মুখোপাধ্যায়, পারুল প্রকাশনী

) মিথ-পুরাণের ভাঙাগড়া (২০০১), চন্দ্রমল্লী সেনগুপ্ত, পুস্তক বিপণি 

) এছাড়া একাধিক কবিরশ্রেষ্ঠ কবিতা বই 

) উইকিপিডিয়া, মিলনসাগর, বৈদ্যুতিন রবীন্দ্র-রচনাবলী ইত্যাদি ওয়েবসাইট 





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন