মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

রজতকান্তি সিংহচৌধুরী-র দীর্ঘ কবিতা

ঝরঝর


কনকনে ঠান্ডা নিয়ে খ্যানখ্যানানি শেষ হতে না হতেই গনগনে গরমের ওজর তুলে ঘ্যানঘ্যান শুরু হয়ে গেল। গোটা গায়ে চমচমের মতো চটচটে ঘামে জ্যাবজ্যাব করে ভিজতে ভিজতে ছমছমে ঠান্ডাটাই বেশ ছিল যখন ভাবছি, গুমগুমিয়ে মেঘ গর্জাল। দরজাজানলা ঠকঠকিয়ে বৃষ্টি নামল ঝরঝর করে। টকটকে লাল গোধূলিমেঘের আড়ালে দগদগে সূর্যটা লুকোতে না লুকোতেই শীতের ঠকঠকানি বুঝি ফিরে এল। তকতকে বারান্দায় থকথকে কাদা। এমনকি জোনাকির ঝিকমিক দেখলেও বুক ঢিপঢিপ করে। বৃষ্টি কখনো টিপটিপ, কখনো রিমঝিম, কখনো বিনবিন, কখনো ঝরঝর, কখনো ঝমঝম করে ঝরেই যাচ্ছে, ঝরেই যাচ্ছে। গর্ত থেকে সুড়সুড়  করে বেরিয়ে-আসা অজানা জন্তুর ড্যাবডেবে চোখ দুটো অন্ধকারে ধকধক করে জ্বলছে। কুচকুচে কালো আকাশে যে ফুটফুটে তারা উঠবে, তার কোনো চিহ্ন নেই। ভুলভাল আষাঢ়ে বকবক করে যাওয়াটাই সার। 


ব্যাঙের মকমকের সঙ্গে একটা ঢবঢব আওয়াজ শুনেই বুঝলাম রোদে-দেওয়া বাঁয়াটা বারান্দায় রয়ে গেছে, তুলে আনতে ভুলে গেছি। কুকুরছানার ভুকভুক আওয়াজ এড়িয়ে বেরোতে গিয়েই দেখি  চারদিক - করছে কাঁঠালি চাঁপার গন্ধে। ঘুটঘুটে অন্ধকারেও ফুরফুরে হাওয়ার দোলায় ফুসফুস ভরে যায়। থমথম করছে দশ দিক। থেকে থেকে দিগবিদিক দপদপিয়ে বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গের হিসহিস শুধু নীরন্ধ্র অন্ধকারকে জমজমাট ঘনঘোর করে তুলেছে।    

'চল নামিআষাঢ় আসিয়াছেচল নামি। 

আমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃষ্টি বিন্দু, একা এক জনে যূথিকাকলির শুষ্ক মুখও ধুইতে পারি নামল্লিকার ক্ষুদ্র হৃদয় ভরিতে পারি না। কিন্তু আমরা সহস্র সহস্র, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি, – মনে করিলে পৃথিবী ভাসাই। ক্ষুদ্র কে?

দেখ, যে একা, সেই ক্ষুদ্র, সেই সামান্য। যাহার ঐক্য নাই, সেই তুচ্ছ। দেখ, ভাই সকল, কেহ একা নামিও নাঅর্ধপথে প্রচণ্ড রবির কিরণে শুকাইয়া যাইবেচল, সহস্রে, সহস্রে, লক্ষে, লক্ষে, অর্বুদে, অর্বুদে, এই বিশোষিতা পৃথিবী ভাসাইব। 

পৃথিবী ভাসাইব। পর্বতের মাথায় চড়িয়া তাহার গলা ধরিয়া, বুকে পা দিয়া, পৃথিবীতে নামিব; নির্ঝরপথে স্ফাটিক হইয়া বাহির হইব। নদী-কুলের শূন্যহৃদয় ভরাইয়া, তাহাদিগকে রূপের বসন পরাইয়া, মহাকল্লোলে ভীমবাদ্য বাজাইয়া, তরঙ্গের উপর তরঙ্গ মারিয়া, মহারঙ্গে ক্রীড়া করিব। এসো, সবে নামি।'


জলস্রোতে ভেসে আসছে সেইসব দিন, যখন ডাকপিওন বৃষ্টির মধ্যে এসে চলে যেত, দূরে মিলিয়ে যেত তার পদশব্দ ; যখন ঢেঁকি পড়ন্ত, গাই বিয়ন্ত, উনুন জ্বলন্ত। ফুলকি গাই বিইয়েছে আমবাগানের মধ্যিখানে মেঘলা আলোর ভেতর। সদ্যোজাত বকনা বাছুরছানাটা তার মায়ের গোলাপি দুধেল বাঁট থেকে চোঁ চোঁ করে দুধ খাচ্ছে অদ্ভুত শরীরী কাঁপন তুলে। 


ডালিম গাছটায় ফল ধরেছে। পেকে একেবারে ফেটে পড়ছে একটা পুরুষ্টু ডালিম। ফলটাকে চিরে দু'ফাঁক করতেই দেখা গেল কী টুকটুকে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল সহাস্যতা। জীবনের আনন্দের সঙ্ঘবদ্ধ সুস্থ সমারোহ ওর ভেতরে দানায় দানায় শক্তপোক্ত ঠাসা। মুখে নিলে মিষ্টি স্বাদ - প্রবাল রঙের আলো। এই টানটান সুপক্ব লাল থইথইয়ের ভেতরে দাঁতগুলো কী অথই আরামই না পায়! আর ডালিমগুলো হাওয়ায় দোলে স্ফটিকের ওপর মেঘলা দিনের সূর্যের শেষ প্রতিফলিত আভা বুকে ধরে। তার ভেতর বয়ে যায় সূর্যাস্তের গোলাপি  রং-মাখা নদী, আর আমাদের বহতা ভাবনাগুলো রাতের বুকে মুখ গুঁজতে চলে।


ফণিমনসার ঝোপ থেকে ঝুঁঝকো আলোয় হঠাৎ উঁচিয়ে ওঠে অকালমৃত সেই মেয়ের কালো হয়ে-যাওয়া হাতে ধরা লন্ঠন। মেয়েটির মাথায় বাজ পড়েছিল। ঝলমলে গোলাপটাকে দেখে মনে হয়, ওই তো ঘুমিয়ে আছে বাচ্চা মেয়েটা - রজনীগন্ধার সাদা পালকও ঢেকে দিতে পারেনি ওর বড়ো বড়ো কালো দুটো চোখ। এসবের ওপর কদমের রোমাঞ্চ ছড়িয়ে পূর্ণ যুবতির মতো এসে পড়েছে বর্ষা।


'
প্লাতেরো আমার আর আমিও প্লাতেরো ছাড়া নই।' সেই প্লাতেরো, যার শরীরটা ইস্পাতের, যার সঙ্গে মিশে আছে চাঁদের আলোর রুপো। তাই বলে, হায় শক্তি, অঙ্ক ক্লাসে ফাঁকি দিয়ে খেতে হবে কড়াইশুঁটির প্রস্রবণ! আমাদের দেবতা কি পা ঝুলিয়ে বসেন পশ্চিমে? আমাদের দিনগুলি রাত্রি নয়, রাত্রি নয় দিন। আহা, সাহাবাবুদের কালো ছেলেটি আমারো চেয়ে কালো? শাক্ত পদাবলির ঠাটঠমকে বয়স দাঁড়িয়ে থাকে কোনো মাঠে স্কেলকাঠি হয়ে -- '-" হয়ে যায় মনোরমা কাপ নির্বাচন। কিন্তু বয়স,খেলবার নয়, হেলাফেলা সারাবেলার নয়।


পায়ের নীচে মচমচ করে চুরমার হচ্ছে ব্যাঙের ছাতা। লন্ঠন-জ্বালানো গোরুর গাড়ি, আলোক সরকারের ছন্দে, হারিয়ে যাচ্ছে চোখের ওপারে। ঝটপট করে উঠছে বাদুড়, ককিয়ে ককিয়ে উঠছে প্যাঁচা, লাফিয়ে উঠল ইঁদুর, সড়সড় করে উঠল খড়। বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে। 


'হৃদয় চায়

মেধার সঙ্গ, অসঙ্গ মেধাবী 

তখন নিজের মগজ কুরে খায়।'...


লাফিয়ে ঘরে ঢুকেছে কোলা ব্যাঙ। থপথপ কাদা মাখা পায়ে থামল গিয়ে টেবিলটার পাশে। কালো বর্ষার রঙের কোলা ব্যাঙ। কেমন একটা বর্ষার মেঘ থমথম করছে। পুবদিকের আকাশ ইস্পাতের মতো, কালো মেঘ জমেছে বিস্তর। অন্ধকার টেবিলের পাশে আরো একটা অন্ধকার ওই নড়ে উঠল।


শরৎমেঘের সিংহদুয়ার তীর্ণ হয়ে চলে গেলেন আলোক সরকার...


এদিকে বৃষ্টিধারা নেমে আসছে বিভিন্ন বেগের আবেগে। কেন্দ্রে এক কালো পর্দা -- নিরবচ্ছিন্ন নয় এমন এক নেটওয়ার্ক। ঝরছে অপ্রতিরোধ্য, অথচ নরম-নরম ফোঁটায়, গরম-গরম বোঁটায় -- জুঁই, কামিনী, হাস্নুহানার। ফোঁটাগুলো বেশ হালকা-পলকা, প্রকৃতির বিশুদ্ধতম পরিশ্রুত ভগ্নাংশ। খানিক দূরে ফোঁটা বেশ ভারী-ভারী, একেকটা গমের দানার মতো, কোনোটা মটরদানা, কোনোটা শিরীষ পাতার আদলে, কোনোটা আবার বাচ্চাদের খেলনা মার্বেলের মাপের। উল্লম্ব ভাবে তো বটেই, হাওয়ার ঝোঁকে কখনো তির্যক, এমনকি প্রায় আনুভূমিক রেখায় ঝরে যাচ্ছে। বেচারা পথচারীর গায়ে-মাথায় কখনো তারা ছুঁচের মতো নেমে আসছে। কখনো জাল বিছোচ্ছে সরু বিনবিনে সুতোর ইলশেগুঁড়িতে।


জল পড়ার শব্দেরও হরেক রকম - টিপটিপ, টপটপ, টুপটাপরিমঝিম, রুমঝুম, হুসহুস। কখনো গলগল বয়ে যাচ্ছে নর্দমা দিয়ে, ছলছলাচ্ছে রাস্তা জুড়ে, কখনো পাখোয়াজ, ড্রাম, এমনকি ধামসা-মাদলের আওয়াজকে হার মানিয়ে। 

অবশেষে রোদ্দুর উঠলে সব হাপিস। ভেজা যা কিছু গায়ে রোদ মেখে জ্বলজ্বল করে। শুকোতে থাকে, নাকি অপেক্ষা করে আরেক বর্ষণের? খটখটে রোদ্দুর আসে ঝকমক করে, তবু বেশ বোঝা যায়, বৃষ্টি হয়ে গেছে, এই তো খানিক আগেই। 


বাইরে কেবল জলের শব্দ ঝু--প্‌্‌, ঝু--প্‌্‌, ঝুপ্‌--

 

[এ লেখায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ফ্রান্সিস পঞ্জ, আলোক সরকার, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার পঙ্‌ক্তি ব্যবহৃত।]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন