মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ওবায়েদ আকাশ-এর দীর্ঘ কবিতা

থেঁতলানো হাসি

বিদ্যুতের মতো তোমার মায়া  দশদিক ঘুরে এসে
ঘরে ঘরে অবিশ্রান্ত চঞ্চল শিশুদের মুখ আলোকিত করে
পড়ে আছে সংসারের নিশ্বাসের ওপর। তুমি তার ছায়া থেকে
এই মাত্র উঠে জঙ্গলের পরিবেশ থেকে প্রাত্যহিক
অভ্যাসবশত গুছিয়ে নিচ্ছ প্রতিদিনের প্রিয় গৃহস্থালি

ওখানে গরুর শিং থেকে কার যেন প্রাচীন কণ্ঠস্বর এসে
তোমার সবকিছু এলোমেলো করে দেয়
তোমাকে জানাবার মতো আর অধ্যাত্ম সাধনা জানা নেই বলে
আমি তোমার দৃষ্টিজুড়ে মৃতবাড়ির নিস্তব্ধতার পায়ে
হাঁটাচলা করি। তোমার নিশ্বাসের ধোঁয়ায় দেয়ালের
সুউচ্চ কার্নিশ থেকে ঝরে পড়ছে অনর্গল অবজ্ঞার হাসি

তোমার বেডরুমের পাশে শৃঙ্খলিত দুঃখের কিছু
খতিয়ান ছাড়া আর কোন অবকাশ কেন্দ্র এ গাঁয়ে
দেখেনি কেউ। এখন কিছু ডাহুক ও প্রজাপতির ভাষায়
তোমার সন্তান সকল বড় হতে হতে বিদ্যুতের আলো
মেখে ঘুমিয়ে যায় যদি জানি এ-মতো নাক্ষত্রিক
সুখের অধিক আর কোনো আরোগ্য তুমি অন্তত
তিন মাস জ্ঞান হারিয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়েও
প্রার্থনা করো না ভুলে। আমি রাত্রিদিন কিছু
ভূতপ্রেতের মতো অবিশ্বাস্য দুঃসংবাদসহ
তোমার মুখোমুখি হই। প্রতিনিয়ত তোমার বিক্ষিপ্ত
মন বুঝে একবার রেডিওর নব আর একবার
আমার মুখের একাংশ জুড়ে ভয়ঙ্কর সাংকেতিক সেই
জন্মদাগে তোমার আঙুল টেনে এনে বসিয়ে
দিলেই শুরু হয়ে যায় তোমার সাম্প্রতিক শরীর জুড়ে
অবিশ্বাস্য সেই বিদ্যুতের খেলা যা তোমাকে
পোড়াতে পোড়াতে পোড়াতে পোড়াতে এখন
তোমার সন্তানের মুখে আলোকময় স্থির হয়ে
আজাবধি এই সংসারের আঙুলে বেঁচে আছে

আমাকে পেলেই তুমি দক্ষিণের সকল দরজা
বন্ধ করে একপ্রকার প্রতিবাদের ভাষায় প্রকৃতিকে
জব্দ করে তার দাঁত থেকে অসামান্য হাসি বিদ্যুতে
ঝলসে দিয়ে সেই এক প্রাচীন খেলায় মত্ত হয়ে যাও
আমাকে পেলেই তোমার চিরকালের পোষ্য পেটের
গভীর জুড়ে ছড়ানো প্লিহার চারপাশ জুড়ে মুখিয়ে-থাকা
কৃমিগুলো আমার সমস্ত অবয়ব আর বেশবাস জুড়ে
লেলিয়ে দিয়ে ভাল থাকবাব ভান করো বলে
কাল রাতে স্বপ্ন দেখেছ তুমি। তোমার মগজের কোলে
আমাদের ছোট্ট নদী-পরিচয়ের সেই দিনগুলির
বনেদি কঙ্কালগুলো আজও কেউ মুখাগ্নির ছুঁতোয়
চিতায় তোলেনি। এই এক প্রসঙ্গ জানি তোমার
আমার কথোপকথনের ভেতর চমৎকার
দীর্ঘয়ুকারক। নদীতে তোমার জ্বলে-যাওয়া
পুড়ে-যাওয়া পায়ের ক্ষতরক্ত সব অবিকল আছে
অথচ সন্ধেবেলায় এই নদী থেকে তোমার
পা বিহীন নিথর শরীর আমাকেই কাঁখে করে
ঘরে এনে বুঝে দিতে হয়। আর নদী থেকে পাওয়া
তোমার আমার সারা রাতের খোরাকী কিংবা
নদী থেকে পাওয়া আমাদের সদ্যজাত সন্তানগুলো
তারা কেমন বড় মানুষের মতো হেঁটে হেঁটে
পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় ঘরে। ঠিক তখন তুমি আমি
আর আমাদের আহার আর সদ্যজাত সন্তানের
অনুপস্থিতি হেতু নদীতে সে কী ভয়ঙ্কর সঙ্গীতের
দিন শুরু হয়ে যায়! চিরকাল ভুল বাক্য ভুল
ছন্দে লেখা সঙ্গীতের ছায়ায় বড় হয়েছিলে তুমি
এই বিভ্রম ও ছন্দহীনতার এক অবিশ্বাস্য গল্প
তোমার হাত দিয়ে একদিন পৃথিবীর স্মরণীয়
আর বরণীয়দের সমাধির এপিটাফজুড়ে টাঙিয়ে
রেখেছে কারা? একদিন তার সমস্ত স্মারক-নিশানা
কাকের চঞ্চুর মতো তোমার হৃৎপিণ্ডের
খুব ভেতরে হাত ঢুকিয়ে তুলে এনে মুহূর্তে
বিক্ষুব্ধ হয়ে আবার তা গিলে ফেললেও ফি বছর
দেশে দেশে হত্যার মৌসুম শুরু হতে না হতেই
পৃথিবীর বিলুপ্তপ্রায় আসমানের চিল ও রূপকথার
শকুনেরা এসে অযথাই তোমাকে মিডিয়ামুখো
অনিবার্য ব্যক্তিত্বে বসিয়ে দেয়। আর তাদের
এই অসামান্য কল্পকুশলতার কেমন অবোধ
শিকারী তুমি অনঙ্গ তবু পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে
হাত-পা ছুড়ে মারো। অথচ আমি জানি
এ জাতীয় সকল জিঘাংসা তোমার, শুধুই আমাকে
ঘিরে। তোমার জিঘাংসার কিছু অবিশ্বাস্য দাঁত
আমৃত্যু বয়ে বেড়াবো বলে তুমি তার নিঃশর্ত প্রতিশ্রুতি
আমাকে করিয়ে ছেড়েছ। তোমার জিঘাংসার
নিচে আমি শীতল পাটি বিছিয়ে নিয়ে আজও
দেশে দেশে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের কালে
কাঁখে করে বয়ে নিয়ে যাই। একবার আমাদের
শেষ বিবাহবার্ষিকী জুড়ে এ-মতো জিঘাংসার নিচে
আমাদের সমস্ত সম্পর্ক চাপা পড়ে পিষ্ট হয়ে গেলে
তা থেকে যে স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ গড়ে উঠেছিল
সেই সম্পূর্ণ নিরোগ ও স্বাস্থ্যকর দেহে আমার
নবপরিণীতা স্ত্রী এখন সমুদ্র সাঁতরে বেড়ায়

অথচ গাছে গাছে ছড়িয়ে থাকা জিঘাংসার
বিশ্বস্ত আধার একবার তোমাকে আর একবার
আমাকে যে মধ্যরাতে তুলে নিয়ে যায় আর তাই
সারারাত পরস্পর বুকে বুক রেখে ঘুমিয়ে পড়লেও
কখনো হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরতে পারো না
তুমি, আর আমি তোমাকে

এই এক রহস্যগল্পও তোমার আমার কথপোকথনে
অবিশ্বাস্য দীর্ঘায়ুকারক। আজও কারা যেন
বেড়ার ফাঁক গলে দৃষ্টির তলোয়ার ঢুকিয়ে দিয়ে
আমাদের কথপোকথনের নগ্ন ঊরু, নিতম্ব-জঙ্ঘায়
এই মতো ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আঘাতে
ফালি ফালি করে রক্তাক্ত করে এঘর থেকে ওঘর
শুধুই ভাসিয়ে দেয় তারা। আমাদের ইতোপূর্বের
কিছু কথোপকথন ইতিহাসের খেরোখাতা থেকে
পালিয়ে এসে সুন্দরবনের অনাগত সব বাঘের
পেটে লুকিয়ে রয়েছে। ফলে এখনো তাদের ফিরে
পাবার প্রত্যাশা করি আমি। তাই এখনো বাঘ ডাকলে
তুমি যতই বারণ করো আমি বাঘের মুখে বাঘের
পেটে হারানো সন্তান ফিরে পাবার মতো আনন্দ নিয়ে
ঢুকে যেতে চাই। আমাদের সাম্প্রতিক কিছু কথপোকথন
ভয়ঙ্কর রক্তাক্ত হয়ে হাসপাতালের কোমায় শুয়ে
নির্বোধ সময় কাটিয়ে চলেছে। জানি আর কোনোদিন
ফিরবে না তারা। তাই আমাদের এই কথপোকথনের
ভবিষ্যৎ গন্তব্য নিয়ে দেশে দেশে যে সেমিনার
সান্ধ্যানুষ্ঠানের নিরীহ পরিকল্পনা আছে, জানি তাকেও
অশান্ত করে সমস্তই কেড়ে নেয়া হবে একদিন

আর তাই আমাদের সমাধি পাশে গর্জমান সিন্ধুর
যা কিছু গর্জন সবই আমাদেরই মৃদু-উচ্চ উচ্চারণ বলে
তোমার এই ভবিষ্যদ্বাণী এখনো কাগজে মুড়িয়ে রেখেছি
বিপরীতে তুমি এই শতাব্দীর চিরপ্রবহমান সন্ধ্যার কিছু
পাখির কূজন এনে থরে থরে সাজিয়ে রেখেছ আমার
স্বরচিত গ্রন্থের ছায়ায় যা আমি প্রতিবছর শীত ঋতু
এলে বিবিধ কাগজের ঘুড়িতে এঁকে পৃথিবীর মানচিত্রের
পিঠে সগর্বে নিবেদন করি। একবার এক অগ্রাণের শীতল
পাঁজরে কিছু প্রস্তাবিত গোধূলির ভাষা আমাকে ফিরিয়ে
দেবে বলে কে যেন প্রতিশ্রুতি করে সেই যে উধাও
হয়ে গেল; সেই থেকে সন্ধে হলেই নাগরিক ঐশ্বর্য
থেকে আমার বুকের সমস্ত শীতলতা এনে মাঠে মাঠে
ধান ছড়ানোর মতো ছড়াতে দেই। আর স্বভাবত তা
প্রকৃতির পাখপাখালি এসে খুঁটে খেতে খেতে আমাকে
আশীর্বাদ করে কত! তুমি তো জানো এমতো অভিশপ্ত
দেহে এই নিতান্ত আশীর্বাদ আমার মোটেই প্রার্থিত নয়

আমি তড়িঘড়ি করে আবার তা গুটিয়ে নিয়ে তোমার
ছায়ার আড়ালে দৌড়াতে থাকি। আমার এ নিস্তব্ধ দৌড়
জানি তুমি দেখোনি আজও। ভাবছি এবার জানাবো
তোমাকে আমার এই রহস্যদৌড়ের সকল মুদ্রা; আর
সে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ জুড়ে তোমার আঙুলের স্পর্শ
এবার মুদ্রিত হবে আমার ভবিষ্যৎ গ্রন্থের ভাষায়। তুমি
পৃথিবীর অনন্ত শীতলতা থেকে বারবার মুখ ফিরিয়ে
এই যে সামান্য উষ্ণতা নিয়ে বেঁচে থাকবার কসরত করে
যাও মাইরি বলছি পাখিদের অজস্র ভাষায় তার
অনুবাদ করে একদিন এক যথার্থ স্মারক আমি রচনা
করব ঠিক। এই নিতান্ত বেঁচে থাকবার কসরত আমার
অনর্গল অশ্রু ঝরিয়ে যায়। আমি তো জানি আমার
শৈশবে হারানো মায়ের কোলের উষ্ণতার চেয়ে এ
মোটেও কম কিছু নয়। অথচ দেখো একমাত্র আমার
জন্যে বরাদ্দকৃত তোমার সমস্ত উষ্ণতা এখন পৃথিবীর
ক্রমবিলুপ্তপ্রায় পাখপাখালির পেটে। এইসব পাখিদের
সঙ্গে আমার এ জীবন আমি বিনিময় করতে পারিনি
বলে তুমি ছুঁতো পেলেই কোথায় কোন অরণ্যের ভেতর
হারিয়ে যেতে থাকো। আর তোমাকে খুঁজতে বেরিয়ে
আমার প্রতিটি জন্মের শেষে আমার শুভ্র সাদা চুলে
যে বিদ্যুচ্ছটা তোমাকে ঝলসে পুড়িয়ে দেয় তোমার
আমার প্রথম যৌবনে শুধু আমরাই রচনা করেছি তা

তখন কত আগুন ধরিয়েছি অরণ্যের বৃষ্টির ফোঁটায়
আর বৃষ্টি ঝরিয়েছি গাছের ফাঁক গলে আসা সূর্যের
প্রতিটি শাখায়। সে কী দুরন্ত দিন আমাদের একবার
রঙধনুর লালে একবার কৃষ্ণচূড়া ফুলে অনন্তকাল
ধরে এই স্বর্গ মর্ত্য পাতাল নক্ষত্রজুড়ে রাজত্ব করেছে

তোমারই প্রস্তাবিত ভূস্বামীর এক চিলেকোঠা ঘরে
সামুদ্রিক কিছু শামুক ঝিনুকের মতো সন্তানসন্ততি
নিয়ে তুমি আমি শুধুমাত্র সামুদ্রিক খেতাবপ্রাপ্তির ভয়ে
এক প্রকার অলৌকিক জীবনযাপন করি। আর সেই
ঘরে সাম্প্রতিক তোমার থেঁতলানো হাসি পরতে পরতে
সাজিয়ে রেখে এক নতুন মাত্রা রচনা করেছি আমি
তুমি তা জানো। জানে তোমার আমার হেমন্তের
প্রকৃতির মাতা। ফিবছর বর্ষা ঋতুতে এই হাসির
আবক্ষ কিছু রক্তাক্ত ক্ষত ধুয়েটুয়ে সাফ করে এনে
সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত অতিথি পাখির
কণ্ঠাবরণে ঝুলিয়ে দিয়ে মর্যাদা বোঝে। অথচ পাখিরা
তার যথার্থ গুরুত্ব বুঝে এই মতো দগ্ধক্ষত হাসি
তাদের ঠোঁটের কার্নিশ ধরে পরিপাটি করে হাসিতে
মিশিয়ে রাখে। আর আমি তা পরিত্যক্ত
ঝিনুক কুড়িয়ে এনে একটু একটু করে ঝিনুকে
তুলে আবার তা ঘরের আড়ায় সেঁটে দেই। একবার
এক সামুদ্রিক জাহাজের চাকায় আমার থেঁতলানো
ভ্রমণ বিলাসিতা যেভাবে তুমি আজও বয়ে বেড়াও
তোমার পরিশ্রান্ত চুল ও নিশ্বাসের আসা-যাওয়াজুড়ে

আমার প্রস্তাবিত ঘুমে কখনো স্বপ্ন দেখোনি তুমি
বরং নিরীক্ষা করে দেখেছ যে, আকাশ থেকে পড়ে
যাবার ভয় তোমাকে সমান আলোড়িত করে কিনা
কেননা একদিন আকাশ থেকে পড়ে যেতে যেতে
তোমার আমার প্রথম পরিচয় নিয়ে আজও অব্দি
প্রশ্ন তোলনি কোনো। কেননা পড়ে যেতে যেতে
তুমি ধরেছিলে আমার হাত আর আমি তোমার আবক্ষ
উষ্ণতায় ভর করে করে এই পৃথিবীতে নেমে এসেছিলাম

প্রতিটি ক্ষণে তোমার কাছে আমার বয়ে আনা
অজস্র দুঃসংবাদের বিপরীতে ভাবো এইভাবে
আমিহীনা তুমি শুধু একা একা আকাশ থেকে পড়ে
যেতে যেতে আরো অধিক নাক্ষত্রিক জীবন তুমি
উপহার পেতে কিনা। প্রতিটি দুঃসংবাদের বিপরীতে
স্বর্গমর্ত্য নক্ষত্রের তাবত সুসংবাদ শুধু তোমাতেই
বর্ষিত হতো কিনা! তাই আমি একবার বহুবার
অনন্তবার আর কখনো তোমার প্রস্তাবনার নিভৃত
ঢেউয়ে ভেসে ভেসে আর কোনো কূলে স্থির হবো না
বলে তোমাকে জানিয়ে দিয়েছি; আর তা শুনে
তোমার আমার পৃথিবীতে একমাত্র জীবিত তোমার
থেঁতলানো হাসি মুহূর্তমাত্র আরোগ্য লাভ করে
অনন্ত কাল ধরে আবার মুষড়ে যেতে থাকে 

 

1 টি মন্তব্য: