আধুনিক মননের বীজায়ন
আধুনিকতার অর্থ কি ? আধুনিকতার একটা বিশ্বজনীন অর্থ বা সংজ্ঞা তৈরি হয়েছে - সারা বিশ্বে সমাজ ও রাজনীতির ইদানীন্তন উন্মেষের প্রেক্ষিতে আধুনিকতা কি সেটা বোঝা দরকার । সে অর্থে আধুনিক মানে সেই ‘অধুনা’, অর্থাৎ এই সময়ের – বা সমকালের – যে চেতনা । সে চেতনা ইতিহাস বা রাজনৈতিক পরিণতি ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে । তাই সে অর্থেই আধুনিক হতে হয় – আধুনিক দৃষ্টি অভ্যাস করে পেতে হয় , অনুশীলন করতে হয় যাতে - অন্তরে আর বাইরে – দেহমনের একই সংযুক্ত গূঢৈষা থেকে আমরা আধুনিক মননকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করতে পারি । আধুনিক হয়ে ওঠার এই চেতনার কথা বলছেন ফরাসি প্রাবন্ধিক লিয়তার – অথচ তিনি আধুনিকতার সংজ্ঞা নির্ণয় করছেন উত্তর-আধুনিকতার সংজ্ঞার প্রসঙ্গে । লিয়তারের মতে ' উত্তর-আধুনিক' কোন ঐতিহাসিক সময় পর্যায় বা যুগ নয় । বরং তা একটা মানসিকতা । আধুনিকতা মানে অতীতের স্মৃতিতে কল্পে আত্মোপলব্ধি করা । আধুনিক মননে সৃষ্টি করাকে তিনি উত্তর-আধুনিক মানুষের আগাম চৈতন্য উদ্ভবের নির্ণায়ক বলে প্রমাণ করছেন । এবং এই মননশীলতার উপরে জোর দেওয়ার কারণে আধুনিকতাকে তিনি যুগ বা যুগ বৈশিষ্ট্যের থেকে আলাদা করে দেখছেন এবং দেখতে সাহায্য করছেন । উত্তর-আধুনিক মানুষের এই সংস্কৃতিবান হয়ে ওঠার ইচ্ছেকে তিনি একটি চিন্তন ধ্বজার মতো, এক নতুন উন্মুক্ত সংস্কৃতিবান, ক্ষুদ্র লেখনী , দলিত লেখনী, অন্যতা, বা অনেকান্ততার সাথে যুক্ত করছেন। লিয়তার তাঁর The Post-Modern Condition বইটিতে, এই চেতনাভিত্তিক উত্তর আধুনিকতার কথা না বললে হয়ত তার মতামতকে আমরা মেনে নিতাম না ।
বাংলাভাষি মানুষ এই যুগবর্জিত আধুনিকতা ফরাসীদের আগেই জেনেছি । এবং তা সম্ভব হয়েছে আমাদের যৌক্তিক রাজনৈতিক চেতনায়। আধুনিক ভারতবর্ষের উন্মেষলগ্নে যখন আম্বেদকর আমাদের এক নতুন স্বাধীন দেশের সংবিধান রচনা করেছিলেন তখনই উত্তর-আধুনিক যুগের মন তৈরি হয়েছিল । গান্ধীজির আদর্শে তা চিরন্তন হয়েছে। গান্ধীজি ইউরোপীয়দের দাস্যত্য ব্যবস্থার মধ্যে স্বয়ংক্রিয় শক্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। স্বামীজী যখন শিকাগোতে ধর্ম নিয়ে বলছেন তখন ভারতীয় চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক আমেরিকায় তাদের আত্মপরিচয়ের জন্যে মামলা করছিলেন। প্রথমে সম্ভব হয়নি। কিন্তু তারপর জয় হয়েছে। এসেছে পৃথকীকরণ বা অপারথাইড বিরোধিতা। একটি বিশেষ মানুষ বা সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে শুধু নয় – জাতি সত্ত্বা নয় – মুক্তধারায় বরং যেমন অন্নুলিখিত চালিকা কাজ করে ।
আমাদের বাঙ্গালি আধুনিকতার বীজ রোপিত হয়েছিল দু’ভাবে । কেবলমাত্র যুক্তিবদ্ধতা নয় – আধুনিক বাঙ্গালি নাগরিকের শিক্ষার কাজে কিছু অনন্য চিন্তাবিদের অবদানকে এইখানে স্বীকার করে আজকের তর্কের উপসংহার টানবো। তাঁদের মধ্যে অবশ্যই একজন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত – তাঁর অদ্বৈতের অত্যাচার বাঙ্গালি উত্তর-আধুনিকতার একটি নিদর্শন । শুধু যে অনেকান্তবাদের বিশ্লেষণে সুধীন্দ্রনাথ ক্ষান্ত হয়েছেন তাই নয় তিনি বরং হিন্দু বাঙ্গালির – তথা ব্রাহ্মণ্য একাগ্রতার সমস্ত ঐতিহ্যকে একই প্রচেষ্টায় অস্বীকার করেছেন তার লেখায়। এই মুক্তিকামিতার মধ্যে, বৌদ্ধ বা জৈন প্রাণিত উত্তর-আধুনিক ভাবনা এসেছিল তাঁর মননে, শিল্পে। জীবনান্দের সিংহল চেতনাতেও তাই - যদিও সুধীন্দ্রনাথ কবি হিসেবে জীবনানন্দকে স্বীকৃতি দেননি । বুদ্ধদেব বসুর প্রেম কল্পনায় দেখা যায় ভারত মনন । এই ভাবনার ফল্গুধারা কখনই নিঃশেষিত হবার নয় । তার কারণ এই মুক্তিকামি চিন্তা ধারা নিতান্তই মানবিক, প্রাচীন, আধুনিক ও উত্তর আধুনিক। ষাটের দশকে ইউরোপের - বা বিশেষ করে আমেরিকার – বিশ্বনিবেশিকতার – উত্তর-প্রেক্ষাপটে একটা কাউন্টার কালচারের রাজনৈতিক তথা কাব্যিক প্রকাশের অবসর তৈরি হয়েছিল। আমরাও উত্তর-আধুনিক হয়েছিলাম অতীত সমাজ ব্যবস্থার মহাকথনের শিক্ষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে। ফরাসী উত্তর-আধুনিকতা, বা আমেরিকান কাউন্টার-কালচারের সমান্তরাল আমরাও পুরাণ মহাকাব্যের মহাকথন বা métarécit বা grand narrative এর গুপ্তিতে নয় - বোধির আশায় আকাঙ্খায় উত্তর-আধুনিক হয়েছিলাম । বামপন্থার গ্রহণ ও পরিহার, গণতন্ত্রের বহুমুখিনতা, শান্তি, সহজ সামাজিক বন্ধনের মধ্যে দিয়ে, কলকাতার মানুষের মরমি মধ্যবিত্ততায়, হাতে গোণা কিছু সংবেদি সাহিত্য ভাবনায় এখনও আমরা উত্তর-আধুনিক ।
ক্রমশ...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন