মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ওবায়েদ আকাশ-এর ধারাবাহিক গদ্য : "শালুক ও অধুনাবাদ"

 

শালুক ও অধুনাবাদ

প্রকৃতিমুগ্ধ, প্রথাহীনতার নির্ভার অসীমতা

বিবিধ প্রজাতিতে নিরন্তর অনুসন্ধান পর্যবেক্ষণ ভাংচুর সংস্কার অনুশীলন অধ্যবসায় এক অনিবার্য প্রক্রিয়া। যে কোনো সৃষ্টির মূলে এর প্রতিটি পর্যায় মৌলিক অত্যাবশ্যকীয় উপাদেয় হয়ে কাজ করে। সৃষ্টি ফিরে পায় পরিপূর্ণতা। স্রষ্টা খুঁজে পায় সার্থকতা। এই সফল হবার প্রাক্কালে দেখি, বাবুই পাখিটি তার বাসাটি নির্মাণের কালে সামান্য ব্যত্যয় ঘটলেই তাকে পুনর্নির্মাণে প্রয়াসী হয়। চড়ুই পাখিটা তার আশ্রয় নির্মাণে খুঁজে নেয় ঘরের কার্নিশের নিভৃত কোণ। এক একটি এলাকা নির্ধারণ করে বাঘ, সিংহ কিংবা প্রকাণ্ড হিংস্র প্রাণিরা নিজেদের কর্তৃত্ব আবিষ্কার করে। দুর্বলকে ঘায়েল করে খায়। প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করে। মানুষ নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাববার পরদিন থেকেই শুরু করেছে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। বাধ্য হয়েছে অন্যান্য প্রাণির হাত থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখতে। শিখেছে খাদ্য গ্রহণের কৌশল, খাদ্যান্বেষণের কারিকুরি। মানুষ পাতার পোশাক থেকে আজ সমকালীন ফ্যাশন কিংবা সর্বসাম্প্রতিক স্টাইল সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছে। গুহা কিংবা বৃক্ষতল থেকে বাস করতে শিখেছে সুন্দরতম অট্টালিকায়। এখানেও বসে সেই মানুষ। সম্পৃক্ত হয়েছে অগণ্য সৃষ্টিশীল কাজে। অভাবিত তার সৃষ্টি সাম্রাজ্য। সময়ানুগ চেতনা তাকে প্রতিনিয়ত প্ররোচিত করছে। তাতে উথলে উঠছে মানুষের সৃষ্টিসত্তা। সৃষ্টি মানেই নির্মাণ। নির্মাণ মানেই অস্তিত্ববাদী অবস্থানের প্রবল উপস্থিতি। সৃষ্টি দিয়ে নির্মাণ করছে বিশেষ বিশেষ অস্তিত্ব। ঘোষণা করছে স্বনির্মিত অস্তিত্বের বহুমাত্রিক অবস্থান।

এই সব সৃষ্টিশীলতা মানুষকে নিরন্তর নতুন নতুন সৃজনে প্রলুব্ধ করছে। এক সৃজনে সন্তুষ্ট নয় মানুষ। সন্তুষ্ট নয় সদ্য সমাপ্ত উদ্ভাবনে। তাই নিরন্তর উদ্ভবনপ্রয়াসী স্রষ্টা।  স্রষ্টা  কে থেমে থাকতে নেই। তবে স্তব্ধ হয়ে যাবে চিন্তার প্রবাহধারা। এই অব্যাহত খনন প্রক্রিয়ায় সে সাজানো পৃথিবীকে রেখেছে গতিশীল। এক  স্রষ্টা   চালিত করছে অপর  স্রষ্টাকে। যেন নির্দিষ্ট দূরত্বে সারিবদ্ধ ইট সাজিয়ে প্রান্তিক ইটে একটি ধাক্কা দিলে সব ইটে পরপর ধাক্কা লাগার মতো অবস্থা।
 
এই সৃষ্টিশীলতার ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয় সভ্যতা। সভ্যতার প্রয়োজনে দরকার পড়ে চেতনার নিরন্তর জেগে থাকবার অনিবার্যতা। কিন্তু চিন্তার অসাড়তা বলেও কালে কালে একটি ক্রিয়াশীল স্থবিরতাকে সকল ছাপিয়ে বড় হতে দেখি। কখনো তা মহীরূহ হয়ে পড়ে। মানুষের চিন্তায় ভর করে, ভাবনার দৈন্য, মৌলবাদ, কুসংস্কার, স্বেচ্ছাচার, ব্যক্তিপূজার মতো নিকৃষ্টতা। দীর্ঘদিনের এই বিকল চিন্তার ফসল একদিন আমরা ঘরে তুলে নাক ডেকে ঘুমাই। আর গভীর রাতে সিঁধ কেটে চুরি হয়ে যায় আমাদের যা কিছু মহার্ঘ অর্জন।

লিটল ম্যাগাজিনশালুকমানুষের ভাবনার স্বাধীনতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে যা অর্জিত হয়েছে, তা আজ দৃশ্যমান বাস্তবতা। অসংখ্য লেখক তাদের চিন্তার বিকাশমান ধারার চর্চায় শালুককে পাশে পেয়েছে। টিলা থেকে চূড়ায় উঠেছে তাদের সৃজনশীলতার সংক্রমণ। সকল প্রকার সুসংকলনের অধিত ব্যাখ্যায় কথা বলাই যায়, “শালুকসর্বদা নতুনত্বসন্ধানী এক সৃষ্টিবান্ধব লিটল ম্যাগাজিন। নিরন্তর নিরীক্ষাপ্রয়াসী তার লেখকগোষ্ঠী। অব্যাহত সৃজনশীলতা ভাংচুর দিয়ে চিন্তার ব্যাপকত্বে ছড়িয়ে দিয়েছে উল্লম্ফ ডানা।


শালুকের স্বসংজ্ঞায়িত কিংবা শালুকের সম্পূর্ণ নিজস্ব চিন্তার ফসলঅধুনাবাদপ্রধানত এই সৃজনশীলতা নিরীক্ষাপ্রবণতার প্রবাহমানতাকে বিরামহীন ক্রিয়াশীল রেখে নতুন অন্বয়ের খোঁজে সদা তৎপর।
সংশ্লিষ্ট মেধাবী তারুণ্যকে প্রধান টার্গেটে রেখেঅধুনাবাদতার মৌলিকত্বে আস্থা রাখতে চায়। সে চায় ওই মেধাবী তারুণ্যের আহৃত জ্ঞানের চেয়ে যতটুকু তিনি জন্মগতভাবেই ধারণ করে এনেছেন তার বিস্ফারিত দ্যুতি। জন্মগত জিজ্ঞাসায় প্রাপ্ত মেধার যে স্ফুরণ তার বিকাশধারাকে পর্যবেক্ষণ করে অধুনাবাদ। এবং তার সঙ্গে সমন্বিত আহৃত জ্ঞানের পরিণতিতে প্রাপ্ত সমত্তীর্ণ সৃজনশীলতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তাদের মেধাবী ডানায় পাল তুলে দেবে অধুনাবাদ। কালিক চেতনায় পর্যবেক্ষণ নিঃসন্দেহে ভাবনার নবতর স্তরে আহ্বান করে।  

কেবলই সৃজনশীলতা যেখানে সদাতৎপর, কেবলই নিরীক্ষা যেখানে মুখ্য, কেবলই প্রবহমানতা যেখানে অনিবার্য, কেবলই নবঅন্বয়ের ধারণা যেখানে সংবদ্ধ-- সেখানেই অধুনাবাদের দুর্বিনীত যাত্রা।

এই সৌরমণ্ডলীর সৃষ্টি রহস্যেই লুকিয়ে আছে যে কোনো নতুন নতুন সৃষ্টির প্রসব বেদনা। তারপর ধীরে ধীরে তার ব্যাপ্তিতে ছড়িয়ে দেয়া সমগ্র সৃষ্টি। সৃষ্টি বলতেই যে উদ্ভাবন। তার প্রথম উদ্ভাবন ছিল প্রাণিজগতের খাদ্যের অন্বেষায়, তারপর আশ্রয়, এবং তারপর সভ্যতায়। গুহাবাসী মানুষ কেন প্রথম শিল্প করেছিল? কে তাকে পৌঁছে দিয়েছিল শিল্প সৃষ্টির ধারণা? কোথা থেকে পেল তারা লজ্জা নিবারণের আগে নন্দন ভাবনা? তাই অধিক করে ভাবতে চেয়েছে শালুক। তাই হয়ে উঠেছেঅধুনাবাদী চিন্তা মৌলিক জিজ্ঞাসা। সহজাতভাবে এই চিন্তা ছিল গুহাবাসীর বিস্ময় আবিষ্কার। সৃষ্টির ধারণা লাভের চেয়ে বরং দীর্ঘ দীর্ঘ কাল এই ধারণা বিতরণ করেছে মানবকুলে। তারপর সভ্য মানুষের বিবেক কিংবা নির্বিবেক জাগ্রত হয়েছে, তারা তুলি দিয়ে এঁকেছে যেমন নন্দন, তারা আর হাতে অস্ত্র তৈরি করে হরণ করেছে মানুষের প্রাণ। এই যদি হবে, শিল্পের সাম্প্রতিকায়নের পাশাপাশি হত্যার নন্দন কেন প্রয়োজন পড়েছিল? বৃহৎ জঙ্গলে পশুদের বাস। তাদের কেন সীমান্তের প্রয়োজন পড়ে না? চীনের প্রাচীর কিংবা কাঁটাতারের বেড়া তো নেই অরণ্য গহনে। তবু কেন তারা নির্ভার মানুষের চেয়ে? মানুষে মানুষে যত রক্তপাত, পশুতে পশুতে কেন ততটা নয়? এই জিজ্ঞাসা অধুনাবাদের।

একুশ শতকে দাঁড়িয়ে কেন একটি চিন্তা কাঠামোর এই বিষয়টাকে অন্যতম প্রধান স্তম্ভ করে ভাবতে হচ্ছে? সেভাবনা থেকে নিস্তার কি আছে? যে হাতের প্রধান অস্ত্র মসি, সেই হাতকেই কী করে কম্পিত করছে পারমাণবিক বোমা? যে হাত শিল্প করছে, যে হাত নন্দন লিখছে, সেই হাতকেই কী করে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রতারণায়, অপকৌশলে, দুর্নীতিতে? শালুক সে প্রশ্নের মুখোমুখি অধুনাবাদের চর্যায়।

ভাবি মনে মনে, নদীর স্তব্ধতার চেয়ে ভয়াবহ কিছু নেই।

অধুনাবাদ শুধু হাজামজায় ভরে যাওয়া নদী খনন করেই তৃপ্ত নয়; সে ফিরে পেতে চায় হারানো প্রবাহধারা। অধুনাবাদ নিরন্তর গতিতে বিশ্বাসী, স্তব্ধতায় নয়। তাই তার কাছে প্রাধান্য পেয়েছে সৃজনশীলতার গতি। এই সৃজনশীলতার বিরাট প্রধানতম অধ্যায় জুড়ে রয়েছে কবিতা, সঙ্গীত, চিত্রকলা, কথাসাহিত্য, নাট্যকলা, চলচ্চিত্র, বুদ্ধিবৃত্তি, সমাজ রাজনীতি।
এর প্রতিটি অধ্যায়ে স্বতঃস্ফূর্ততা আনয়নে, এবং স্ব স্ব ক্ষেত্রের মৌলিকত্ব নতুনত্বকে পর্যবেক্ষণে নিরীক্ষায়অধুনাবাদতার যাত্রা শুরু করেছে। অধুনাবাদের এই যাত্রা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, প্রাচীর ভাঙা, বর্ণহীন, প্রথাহীন এক চিরউন্মুক্ত অভিজ্ঞায়। তাই এই ধারণার জন্ম হলো কোনো অবুঝ শিশুর মস্তিষ্ক থেকে। যে শিশুটি এতকাল ধরে ভাবতে ভাবতে আজ মধ্যবয়স্ক শিল্পঅন্তপ্রাণ।
 
কিন্তু তার ভাবনাজুড়ে শৈশব। তার ভাবনা এখন মধ্যগগনে আদি অন্তহীন। সে ভেবেছিল ভাবনার শুরুতে হয়তো প্রগাঢ় বিষয় ছিল ভাববার। তবু ডট ডট ডট (লিডার) দিয়ে হাতের মুঠোয় ফিরে পাওয়া শৈশবই তাকে অধিক নিশ্চিন্তি দিয়েছে ভাববার। বুঝতে শেখার আগে সে দেখেছে, তার শৈশব ছিল গন্ধহীন, বাতাস ছিল বর্ণহীন, বন্যা এলে ভাসিয়ে নিত সকল ধর্ম প্রজাতি, আগুন লাগলে পুড়ে যেত ধনী-নির্ধন সকলের সম্পদ। সূর্যের আলো সমানভাবে বর্ষিত হতো সকল ধর্ম বর্ণ প্রজাতিকে আলোকিত করতে। তার শৈশব দেখেছে, প্রভু আর ভৃত্যের ফসলের রং অভিন্ন, দেখেছে-- সময়ান্তরে একইভাবে ক্ষুধায় জর্জর হয় প্রতিটি মানুষ। দেখেছে-- সুন্দরের প্রতি ভালবাসা ধনী দরিদ্র সকলের। প্রকৃতিতে কোনো ভেদাভেদ কেন থাকে না, বিভাজন করে না ধর্ম বর্ণ ধনী নির্ধন?

কেন ফুল এক রকম গন্ধ বিলায় মালী প্রভুর তন্ত্রে? প্রকৃতিতে এত এত সমানানুপাত কেন? আর মানুষে মানুষে এত এত ধর্ম কেন? কেনইবা এত এত বর্ণ, এত এত বিভাজন, কেন এত এত ছোটবড় বন্ধুরতা?

যে সেই শিশুমন, কোথাও নিজেকে প্রশ্রয় দিতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ফিরে এসেছে প্রকৃতির কাছে। ফিরে এসেছে বিভাজনহীনতার কাছে, ফিরে এসেছে সীমাহীনতার কাছে। শুরু হয়েছে তার কর্মচাঞ্চল্য প্রকৃতিকে ঘিরে। বর্ণগন্ধহীনতাকে উপজীব্য করে। তার আর ভাবতে বাকি থাকে না যে, প্রকৃতির চেয়ে শক্তিধর আর কিছু নেই। সে ভেবেছে, প্রকৃতির চেয়ে বড় শিক্ষক আর কিছু নেই। একটি মাত্র সূর্য কিংবা চন্দ্র যখন সমগ্র পৃথিবী আলোকিত করতে পারে, সেখানে ধর্ম বর্ণ সম্প্রদায়ের সীমাবদ্ধতা দিয়ে আর কতটাইবা অগ্রবর্তী হবে মানুষ? যে শিশুটি এমন করে ভাবতে শিখে গেল, সেই একদিন কণ্ঠে তুলে নিলঅধুনাবাদ অধুনাবাদকে সে এই প্রাকৃতিক অসীমতা, মহত্ত্ব বর্ণগন্ধসম্প্রদায়হীনতা দিয়ে অনন্য করে তুলতে চায়। তাই যে যত দূরেই বিস্তৃত হোক ফিরে আসবে স্বভূমির কাছে, প্রকৃতির কাছে, অসীমতার কাছে, শেকড়ের কাছে, বহু বহু পূর্বে থেকে চলে আসা এর ধারাবাহিকতার কাছে।

শিশুটি এত বড় হলো, শিশুটি সকল বাধা ডিঙাল, শিশুটি প্রাচীরও পেরুল, হয়তো কখনো শুরু হবে তার পড়ন্ত বয়স, কিন্তু তার ভাবনা ব্যাপ্তি বড় হতে থাকবে সেই প্রকৃতিকে ঘিরে, সেই শৈশবের দেখা উন্মুক্ত জানালা দিয়ে, প্রকৃতি থেকে পাওয়া মহত্ত্ব দিয়ে, প্রকৃতিনিসৃত সমানাধিকারের নিক্তিতে। সে দেখবে যে, তার হাতে যত ক্ষমতা রয়েছে, তার হাতে যত নতুনত্ব রয়েছে, তার হাতে যত বিস্ময় রয়েছে, তার কোনোটাই কৃত্রিম ভাবনারা দিতে পারেনি। তাই অধুনাবাদ বারবার তার ভাবনার জন্য ঋণী প্রকৃতির কাছে। নিজের ভাবনাকে সমন্বিত করে প্রকৃতি প্রদত্ত চেতনায়।

অধুনাবাদ তাই প্রকৃতির বৈচিত্র্যায়নে পাল তুলে দিয়ে নিরন্তর নতুন নতুন আবিষ্কারে এবং ভাবনায় নিজেকে নিমজ্জিত রেখেছে। মূল কা- শাখাপ্রশাখা ছাপিয়ে সে সর্বদা উড়ে বেড়ায় পাতায় পাতায়। তার ভাবনারা পাতায় পা রেখে হাত পাতে অসীমে। আকাশে। নক্ষত্রে। নীলে। হাত ভরে তুলে আনে নতুনত্ব-- কবিতার জন্য, পাতাল থেকে তুলে আনে মহার্ঘ নিশ্বাস-- বেদনাকে শাণিত করতে, আনন্দকে অভিনন্দিত করতে। শিল্পীর কণ্ঠে, চিত্রকরের চিত্রে, রাজনীতিকের চেতনায় আরো আরো প্রথাভাঙার গান সুললিত করে ছড়িয়ে দিতে।

প্রকৃতি থেকে শেখা মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে আশ্রয় করে প্রকৃতিতেই সমন্বিত হতে চায়অধুনাবাদ তাই তার প্রধান কাজ হয়ে পড়ে, যে প্রকৃতিতে সে বড় হয়েছে, তার সমগ্র সৃষ্টিশীলতায় প্রবাহিত হোক তার সৃষ্টির ধারা। এভাবেই গড়ে উঠুক তার বিশ্ব। বরং বিশ্বই একদিন ঝুঁকে পড়ুক শিল্পীর প্রকৃতিমুগ্ধতায়।

অধুনাবাদেসৃষ্টিশীলতা কেন্দ্রমুখিনতায় স্থিত হতে হতে পৃথিবীর তাবৎ কেন্দ্রকে স্বকেন্দ্রিক করতে চায়। কেননা যে কোনো কেন্দ্রমাত্রই স্বতন্ত্র শক্তিমান। সুতরাং অধুনাবাদের কেন্দ্র সেরকম অবস্থানে থেকে সে স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করবে, এবং বিশ্বের অপর কেন্দ্রগুলো তাদেরও স্বাতন্ত্র্যশক্তি প্রকাশ করতে করতে একদিন অপর কেন্দ্রীয় স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে একপ্রকারের সাযুজ্য খুঁজে পাবে।

সুতরাং এতকাল ধরে সৃষ্ট ধারণা কিংবা চিন্তাপদ্ধতির পরনির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত হতে অপর ধারণাকেন্দ্রিক বিশিষ্টজনদের কোটেবল ব্যাখ্যা কিংবা উদ্ধৃতিজাত প্রামাণ্য প্রক্রিয়া অধুনাবাদে কখনো আশ্রয় পাবে না।অধুনাবাদস্বতন্ত্র হতে হতে, নিজেদের ঐতিহ্য, স্বভূখণ্ডের প্রত্ন তাত্ত্বিক গবেষণা, ইতিহাস, প্রাগৈতিহাসিক ধারাবাহিকতা, ভাষার ক্রমবিবর্তন, চারিত্র্যের সুসমন্বয়-- সর্বোপরি নৃতাত্ত্বিক ধারবাহিকতায় দ্ব্যর্থহীনভাবে আপোসহীন। অধুনাবাদ মনে করে ব্যক্তি থেকেই বহু, আর বহু থেকেই বিশ্ব। ব্যক্তি আবির্ভাব থেকে অতীতের আবির্ভূতের ধারাবাহিকতা। ব্যক্তিগত সৃষ্টি থেকেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব সামগ্রিক নির্মাণ কিংবা নির্মাণ কুশলতা। ব্যক্তিতেই সমগ্র অস্তিত্ব এবং অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখে তার চারপাশ।

সব কিছুর ভেতর মন্দ লুকিয়ে থাকে, যেমন মন্দের ভেতর থাকে ভালো। সুতরাং দূর থেকে দেখা মহত্ত্ব, কাছে যেতে যেতে বিবর্ণ হয়ে যেতে দেখা যায়। অর্থনৈতিক বিবেচনা দিয়ে যে ভালোমন্দের বিচার করা হয়, তাই সর্বাধিক নিকৃষ্ট বিচার। একই দৃষ্টিভঙ্গিতে দারিদ্র্যের পঙ্কিলতা সবার চোখে ছানি হয়ে পড়ে। তাই ক্ষমতা প্রভাবপ্রতিপত্তির পক্ষে এই ভালমন্দ বিচারের ভার কখনো বর্তালে তা যাবতীয় সৃষ্টিশীলতাকে উপহাস করবে। সৃষ্টিশীলতা সর্বক্ষণ ধরে রাখবে তার অহঙ্কার। তার আভিজাত্য। সে অর্থের প্রতি অন্ধ নয়, সে প্রতাপের প্রতি অনুগত নয়, নয় ক্ষমতার প্রতি নতজানু। সে শুধু ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। অধুনাবাদ এমন করে ভাবতে চায়। নিজের ভূখণ্ড, নিজের অর্থনীতি, নিজস্ব পরিচয়, ব্যক্তিগত লোকাচার, শেকড়ের প্রতি বিশ্বাস, তা সে গঞ্জ কিংবা নগর যাই হোক না কেন, নিভের্জাল জাতীয়তাবাদ, নৃতাত্ত্বিক অভ্রান্ত ক্রমসম্পৃক্তি অধুনাবাদে আত্মপরিচয়ের প্রধান সূত্র। তাই যে শিশুটি অধুনাবাদের বুদ্বুদ কণ্ঠে ধরে অবির্ভূত হয়েছিল, সে এখন মৌলযৌবন, শাশ্বত্বে আসীন। কিংবা একদিন সময় ফুরিয়ে যাবে, পুনরাবির্ভাব হবে ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন লোকাচারে, ভিন্ন ঐহিত্য, অন্য জাতীয়তাবাদে-- অধুনাবাদ তখন তাকেই যাপন করে যাবে। আজ যে বাংলার প্রত্যন্ত ভূখ- তার আবির্ভাব হলো, সেই গাঁওগেরামের ভূখ- হয়ে উঠল তার আত্মপরিচয়। সেই ভূখণ্ড থেকেই আহৃত হলো তার মৌলিক অভিজ্ঞান, খুঁজে নিল হারানো ঐতিহ্য, আবিষ্কার করে নিল নৃতাত্ত্বিক উৎপত্তি আর তার ক্রমবিকাশের ধারা, সৃষ্টিশীলতা।

অধনুবাদ তাই সকল প্রকার মৌলিক প্রথাকে গুরুত্ব দেয়নি। সকল প্রকার উচ্চাশাকে আমলে নেয়নি। বরং সে স্থানিক মৌলিকত্বকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছে যে, তার শক্তিমত্তাই একদিন তাকে বৈশ্বিক করে তুলবে।  


ক্রমশ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন