মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ঋতম্ মুখোপাধ্যায়-এর ধারাবাহিক গদ্য : "কবিতার বাতায়ন"


আকাশমুখী আঙুলগুলি অনুপনীত


‘The voice of the poet will reveal to us by the inspired rhythmic word the God who is the self of all things and beings, the life of the universe, the divinity of man’.  (The Future Poetry, Sri Aurobindo)

 

সার্ধশতজন্মবর্ষে দাঁড়িয়ে বিশ্ববাসীর চোখে তিনি ঋষি অরবিন্দ (১৮৭২-১৯৫০) কিন্তু যোগী দার্শনিক এই পরিচয়ের বহু আগে থেকেই তাঁর কবি রাজনীতিক সত্তা ভারতের ইতিহাস ভুলে যেতে পারে না। তিনি নিজেই জানিয়েছেন : ‘যোগ করা পণ্ডিচেরীতে আসার আগে দর্শনের বিষয় থোড়াই জানতামছিলাম শুধু কবি রাজনীতিক, দার্শনিক নয় (‘নিজের কথা’, পশুপতি ভট্টাচার্যকৃত অনুবাদ) ইংরেজি ভাষায় অসামান্য দক্ষতার পাশাপাশি বাংলা, ফরাসি, ল্যাটিন, তামিল ইত্যাদি বহুভাষায় অধিকার ছিল শ্রী অরবিন্দ ঘোষের। জন্মসূত্রে বাঙালি হয়েও ইংরেজিয়ানার শিক্ষা পেয়েছিলেন পিতার আগ্রহেই। উচ্চশিক্ষার্থে চোদ্দ বছর বিদেশে থাকা এবং ফিরে আসা সিভিল সারভেন্ট হয়ে। তারপর পরাধীন ভারতে বিপ্লবী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া, কারাবাস এবং ক্রমশ বিপ্লবী থেকে যোগী হয়ে ওঠাএই যাত্রাপথে কবিতা কখনওই তাঁর সঙ্গ ছাড়েনি। মাত্র সাতবছর বয়সে দার্জিলিং কনভেন্টে পড়ার সময় তাঁর মধ্যে যে কবিপ্রতিভার স্ফুরণ ঘটে, তাকেই লালন করেছেন তিনি। ছোট দীর্ঘ কবিতা, অসংখ্য দেশীয় সাহিত্যকর্মের ইংরেজি অনুবাদ এবং মননশীল প্রবন্ধ, পত্রাবলী, ধর্মদর্শন তাঁর বিস্তীর্ণ রচনাবলীতে ছড়িয়ে রয়েছে। মূলত ইংরেজিতে লেখালেখি করলেও মাতৃভাষা বাংলাতেও তাঁর একগুচ্ছ রচনার সংকলন ইদানীং দুই মলাটে সহজলভ্য। অরবিন্দের কবিতায় যেমন পুরাণের নবনির্মাণ ঘটেছে, তেমনই ছোট কবিতার গীতলতা আমাদের মনোহরণ করে। যাঁরা তাঁর দীর্ঘ কবিতা এবং আখ্যান কবিতাগুলির দার্শনিক তত্ত্বকে দুরূহ ভাবেন, তাঁরা এই ছোট লিরিকগুলি পাঠে অরবিন্দের কাব্যদর্শনের মর্মবাণীটুকু সহজেই অনুভব করতে পারেন। কারণ কবি নিজেও বিশ্বাস করতেন : ‘Only brief work intense, lyrical in spirit’ তদুপরি বিশ্বকবিতা পাঠের অভিঘাতে তাঁর কবিতায় স্বদেশ বিদেশের কাব্যদর্শনের যে সমীকরণ তৈরি হয়েছিল, তাতে ভারতীয় ইংরেজি কবিতালোক সমৃদ্ধ হয়েছে। যদিও তাঁর অধিকাংশ কবিতা পরিণামে এক দিব্যানুভবে পৌঁছতে চেয়েছে, তবু প্রেম বা কামকে কোথাও অবজ্ঞা করেননি তিনি। তাই তাঁর চিত্রাঙ্গদা, পুররবা, উলূপী কিংবা রুরু প্রেমাস্পদকে নিবিড়ভাবে পেতে চায় আত্মত্যাগের মূল্যে। আর কবির বিজয়-বৈজয়ন্তীসাবিত্রীহয়ে ওঠে কালো পেরিয়ে আলোর সাধনা, যা আসলে অমৃতের আস্বাদ দেয়Love is the divine power by which all can change’

 

(দুই)

 

শ্রীঅরবিন্দেরকালেক্টেড পোয়েমস্‌’ খুলে বসলে আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর একাধিক ছোট কবিতার স্বাদ নিতে পারি। ধারাবাহিক ভাবে না পড়লেও ক্ষতি নেই কোনো। তাঁর প্রেম-প্রকৃতির অভিমুখ আধ্যাত্মিক বলয়ের দিকে যাত্রা করলেও কবিত্বের অভাব সেখানে বিন্দুমাত্র নেই। কোথাও বা বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসূদনের মতো কবিদের নিয়েও কবিতা লিখেছেন তিনি। তবে অনুবাদের দর্পণে সেসব কবিতাপাঠ ভিন্ন আস্বাদ দিতে পারে আমাদের। কারণ একালের তত্ত্ববিশ্বে অনুবাদ নিছক ভাষান্তর নয়, পুনর্লিখন। তন্নিষ্ঠ পাঠকের মতো অনুবাদক মূল ভাষায় লেখা কবিতার নিহিত সংকেতের পাঠোদ্ধ্বার করে তাকে পুনর্বিন্যস্ত করেন আরেক ভাষার কবিতায়। তাই নিবিড় পাঠ পুনর্লিখনের এই প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠতে থাকে নতুন আরেকটি কবিতা, যা মূল কবিতার নেহাত ছায়ামাত্র নয় আরেকটিঅনন্য পাঠকৃতি, অক্টাভিও পাজের ভাষায় each translation is a creation and thus constitutes a unique text.’ অরবিন্দর কবিতা নানা সময়ে অনূদিত হয়েছে বারংবার। নলিনীকান্ত গুপ্তসাবিত্রীযেমন একটি স্মরণীয় অনুবাদ, তবে ভাষায় রাবীন্দ্রিক বাক্‌রীতির ছায়া সেখানে। তাই একবিংশ শতকে মনস্বী কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত যখন একসঙ্গে দশটি কবিতা অনুবাদ করে আমাদের সামনে এনে হাজির করেন, তাঁর পুনর্লিখনের নিজস্ব মুদ্রায় আমরা  নন্দিত হই। আধুনিক মনের উপযোগী এই অনুবাদের ভাব ভাষাশৈলী মূলকে ছুঁয়েও মুক্তির স্পর্শমুখর। অনুবাদের শুরুতেই দশটি কবিতা অনুবাদের কৈফিয়ৎ হিসেবে কবি-অনুবাদক যা জানান, তা উদ্ধৃতিযোগ্য :

শ্রীঅরবিন্দের দশটি কবিতা ইংরেজি থেকে বাংলাভাষায় আনতে চেষ্টা করেছি। অনুবাদ বিষয়ে তাঁর সুসংগত দ্বিধাদ্বন্দ্ব সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। আমার জবাবদিহি শুধু এই, কবিতাগুলির মর্জিমুহূর্তের দিকেই আমি দৃষ্টি রেখেছি, অক্ষের পরিকাঠামোর প্রতি নয়। এই কবিতাগুলি পড়লে হয়তো উপলব্ধি করা সম্ভব হবে, লিখতে-লিখতেই তিনি জীবমুক্তির স্বাদ পেয়েছিলেন। কবিতার মাধ্যমেই তিনি যোগী হয়ে উঠেছেন, এবং সেই যোগ জীবন্ত। এই লিরিকগুচ্ছে তাঁর পরবর্তী অনেক দার্শনিক আধ্যাত্মিক বীক্ষার পূর্বাঙ্কুর উদ্যত হয়ে আছে। কিন্তু আমার কাছ তাঁর মহিমা প্রধানত কবিতার, এটুকুই আমার বলার কথা।                            

                                                                                       (শ্রীঅরবিন্দের কবিতা, সন্ধিৎসা, ফেব্রুয়ারি ২০১৬)

মূলের নামোল্লেখসহ মোট দশটি কবিতা অনুবাদ করেছেন অলোকরঞ্জন, কবিতাগুলি ১৮৯৫-১৯০৮ কালপর্বে রচিত; তখন এদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তুঙ্গে। কবিতাগুলি হলো : Invitation (আমন্ত্রণ), Reminiscence (স্মৃতিচর্যা), Immortal Love (প্রণয় অনশ্বর), The sea at night (সাগর, রাত্রি এলে), Evening (সন্ধ্যা), Revelation (উন্মোচন), A Tree (একটি গাছ), Seasons (ঋতুচক্র), Life and Death (জীবন এবং মৃত্যু), God (ঈশ্বর)

 

(তিন)

 

অনুবাদবীক্ষণ বা ট্রান্সলেশন ক্রিটিসিজম কেবল মূলানগত্য নিয়েই ভাবিত হয় না এখন। বরং ভাবতে চায় অনুবাদকর্মটি কতখানি মূলকে ছুঁয়েও স্বতন্ত্র সৃষ্টির মর্যাদা পেয়েছে। অনুবাদ তাই স্রষ্টা অনুবাদকের যুগল সম্মিলনে পাঠকের দরবারে পৌঁছে যায়। যদিও পাঠকমুখী নাকি লেখকমুখী হবে সেই অনুবাদ, তা নিয়ে মতভেদ চলে নিরন্তর। অনুবাদকের ভাষার উপযোগী দেশিকরণ নাকি স্রষ্টার ভাষাকে অক্ষুণ্ণ রেখে বিদেশিকরণ ঘটবে, তা একান্তই অনুবাদকের মর্জিনির্ভর। তবে অনুবাদক অলোকরঞ্জন তাঁর অনুবাদে অনুবাদকের শৈলীকে ছুঁয়েও নিজস্ব শৈলীকেই বড় করে তুলেছেন, শব্দচয়নেও নিজের মৌলিক কবিতার মতোই তিনি সৃজনশীল কবি। তাঁর সুবিধে এখানে এই যে, অরবিন্দও ভারতীয় ইংরেজির কবি, তাই ভাষার ভিন্নতা থাকলেও সংস্কৃতির ভিন্নতা নেই। এই অনুবাদগুচ্ছ থেকে কয়েকটি কবিতা এবং কিছু শব্দবন্ধ বেছে নিলেই কবির এই অভিপ্রায় স্পষ্টভাবে দেখানো সম্ভব। ধরা যাক, ‘আমন্ত্রণকবিতাটির কথাই। প্রথম স্তবকেই কবি যেসব বিকল্প শব্দচয়ন করেন, তা যেমন অনুবাদকের নিজস্ব মুদ্রাকে চেনায়, তেমনি অরবিন্দের কবিতার ভাবকেও অস্পষ্ট রাখে না :

With the wind and the weather beating round me

              Up to the hill and the moorland I go.

Who will come with me? Who will climb with me?

        Wade through the brook and tramp through the snow?

 

যেহেতু ঝড়বাতাসে আমাকে তাড়িয়ে ঘোরে ফেরে

আমি যাই পাহাড়ের উপরের ব্রহ্মডাঙাটায়।

কে যাবে আমার সঙ্গে? কে হবে আমার সহারোহী?

স্রোত ভেঙে, ছন্নছাড়া যেমন তুষার ঠেলে যায়?

 

অনুবাদ হিসেবে অবশ্যই মূলানুগত, কিন্তু মুরল্যাণ্ডের বিকল্পব্রহ্মডাঙাকিংবাসহারোহীশব্দের চমৎকার প্রয়োগ আমাদের নন্দিত করে। বিশেষত অনুর্বর উঁচু জমির প্রতিশব্দ ব্রহ্মডাঙা আমরা খেয়ালই রাখি না, আর সহযাত্রীর মতোই অনায়াসে তাঁর কলমে এসে যায় সহারোহী। বাকি তিন স্তবক জুড়েও এমন সব অপ্রত্যাশিত বিকল্প শব্দচয়ন লক্ষ করি, যথা : welkin = নভোদেশে, misadventure =দুর্দৈব, wind-swept uplands ascend = বাত্যাবিধূনিত ঊর্ধ্বদেশে, lord of tempest and mountain = প্রভঞ্জন আর পর্বতের রাজরাজেশ্বর, walks at my side = সতীর্থ চরণিক। মূল কবিতাটি যে আধ্যাত্মিক বলয়কে ছুঁতে চায়, এই অনুবাদের ভিতরে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 

 

স্মৃতিচর্যাকবিতায় আমরা বিকল্প শব্দের চমকের পাশাপাশি অনুবাদকের ব্যাখ্যামূলক সংযোজন লক্ষ করি। winged compeer যেমন হয়েছেডানাময় বন্ধু’, তেমনি Ocean deep এর বিকল্পদুরবগাহ সাগর তবেIt beheld the stars / Born from a thought and knew how being prepares.’-এর অনুবাদেসেই চিন্ময়ীকেই দেখলাম যে-প্রসূতি ভূমিষ্ঠ করে গ্রহতারা, অস্তিত্বের প্রস্তুতিপড়লে আমরা চিন্ময়ীযে চিন্তাময়ী সত্তার প্রতিরূপ তা বুঝি, ‘থটথেকে এই ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ অলোকসামান্য বলা চলে।

 

প্রণয় অনশ্বরকবিতাটিতেও wealth of Nature’s brilliance = নৈসর্গিক অভিরতি’, woman fair = শ্রীমতী, virtuous youth = তারুণ্যের বৈভব’, tender yearning speech =কম্প্রকাঙ্ক্ষিত সংলাপ’, swift compassion and deliberate truth =তূর্ণ মমতা ঋত মনস্বিতাএসব শব্দবন্ধ অলোকরঞ্জনীয় বলে চিনে নিতে অসুবিধে হয় না। প্রেমের যে অমর্ত্য রূপে -কবিতায় ধরা পড়ে, তাসাবিত্রী কবিকে চিনিয়ে দেয়।

 

সাগর, রাত্রি এলেশিরোনামের এমন অনুবাদ কাব্যিক আবহ আনে। half-visible = অনতিমূর্ত, half-hushed = অর্ধোস্ফুট, creeps = জানু দিয়ে চলে, sibilation of the waves = কল্লোলদের রণন স্বননflecked with quivering spots of foam = সঞ্চারে দেখি স্পন্দফেনার ডোরাকাটা দাগ ইত্যাদি যে সামুদ্রিক আবহ নির্মাণ করেছে, তা যুগপৎ চিত্রল ধ্বনিময়। সমুদ্রের ছবি এঁকে কবি পরিবর্তমান জগতের কথা বলতে চান।

 

সন্ধ্যাকবিতায় সন্ধে নামার ছবিটি রবীন্দ্রনাথেরছিন্নপত্র’- লাল চেলি পড়া বধূরূপী সন্ধ্যার থেকে আলাদা। তাই স্বর্ণিল সন্ধ্যা, ভাবুক সূর্য কিংবা (green companion) হরিৎ সঙ্গিনী এক ঈশ্বরীয় আবহ নির্মাণ করে। প্রকৃতি এখানে ঈশ্বরের স্তবগানের পটভূমি। Like rich old age = প্রত্ন, ঋদ্ধ সময়ের মতো  – এই শেষ ছত্রটির উপমা সমগ্র কবিতাটিকে অতীত ভারতীয় ঐতিহ্যের উঁচু তারে বেঁধে দিতে চায়।

 

উন্মোচনআসলে আত্ম-উন্মোচন। কবিতাটি মূলের মতোই ছন্দের স্পন্দনমুখর। বাংলায় দলবৃত্ত ছন্দ- মূলত ব্যবহৃত এখানে। তাই ‘Just a cheek of frightened rose / That with a sudden beauty glows.’ = ভয় পাওয়া এক গোলাপের গাল যেমনতর / আচম্বিতে রূপের আভায় থরোথরোকিংবাas a thought / Escapes the mind ere it is caught.’ = কিংবা যেন এক বিবাগী / চিন্তা উধাও মনকে ধরা দেবার আগেইচমৎকার লাগে পড়তে।  ‘বিবাগী চিন্তাএক উদাসীন মনের ছবি এঁকে দেয়। আর কবিতার শেষে heavenly rout / veil ran out = ভিনদেশি তো / নিঃশেষিতএই আকস্মিক মিলটিও ভালো লাগে।

 

ঋতুচক্রকবিতায় determined only by her eyes =নয়নের নিয়ন্ত্রণyearlong winter =সারাবছরের পুঞ্জিত শীতঅনুবাদকের নিজস্ব নির্বাচন সংযোজন। শেষ দুই ছত্রেআমি তো দেখেছি সারা বছরের পুঞ্জিত শীত / বসন্ত এল তারই আনমনা হাসির ফলেশেলির বিখ্যাত পঙ্‌ক্তিটিকে (if winter comes, can spring be far behind) মনে করায়। একইভাবেঈশ্বরকবিতায় servant of love হয়ে যায় প্রেমের গোলাম এবং clod থেকে আসে মৃৎপিণ্ডপরিসর, যা আসলে ঈশ্বরের সঙ্গে অন্ত্যমিলের সুবিধে করে দেয়।

 

(চার)

 

তুলনামূলক অনুবাদবীক্ষণে অগ্রসর হলে মূল কবিতার একাধিক ভাষান্তর আমাদের আলোচনার সহায়ক হয়ে ওঠে।A Tree’ এবংLife and Death’ কবিতা দুটির ক্ষেত্রে কবি-অধ্যাপক তরুণ মুখোপাধ্যায়ের অনূদিত পাঠ তুলনাসূত্রে বিচার্য হতে পারে, যা পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রকাশিতব্যকবি অরবিন্দবইয়ের অংশ। [এর বাইরেও তরুণ অনুবাদ করেছেন Bride of the fire (আগুনের বধূ), Krishna (কৃষ্ণ), Saraswati with the Lotus (পদ্মাসীনা সরস্বতী) এবং সনেট Divine Sense (দিব্যানুভব) এই কবিতাগুলি, যা মূলনাগুত হয়েও সৃজনশীল তরজমা। ]

 

A Tree

Sri Aurobindo

A tree beside the sandy river-beach

   Holds up its topmost boughs

Like fingers towards the skies they cannot reach,

   Earth-bound, heaven-amorous.

 

This is the soul of man. Body and brain

Hungry for earth our heavenly flight detain.

অলোকরঞ্জনের অনুবাদ

(একটি গাছ)

নদীর বালুতটের কাছে বৃক্ষটি তো

তুলে ধরেছে উপর ডালপালাকে

আকাশমুখী আঙুলগুলি অনুপনীত,

মর্ত্যে বাঁধা, স্বর্গসংরাগে।

এই তাহলে মানবাত্মা : মাটির খিদেয়

শরীর, মগজ স্বর্গ-উড়াল ঠেকিয়ে দেয়। 

তরুণের অনুবাদ

(একটি গাছ)

বালুকাময় নদীতীরে একলা সেই গাছ

সুদূর সীমা ছুঁতে মেলেছে তার শাখা

আঙুলগুলি যেন আকাশ ধরতে চায়

মাটিতে গাঁথা সে যে, স্বর্গপ্রণয় মাখা।

 

যেন মানবাত্মা প্রতিরূপ; দেহ এবং মেধা

লোলুপ মর্ত্য প্রতি; অমর্ত্য পথে বাধা। 

 

অনূদিত দুটি কবিতাতেই অরবিন্দেরএকটি গাছকবিতার মধ্যে যে প্রতীকী ছবিটি রয়েছে তথা মর্ত্যের আকাঙ্ক্ষা অমর্ত্যলোকের জন্য, তা শেষাবধি মাটি-পৃথিবীর মানবজন্মকেই সার্থক মনে করেছে। তবু ওরই মধ্যে heaven-amorous = স্বর্গসংরাগে, heavenly flight= স্বর্গ-উড়াল এবংআকাশমুখী আঙুলগুলি অনুপনীতঅলোকরঞ্জনের নিজস্ব শৈলীকে তুলে ধরে। তরুণ সেখানে মর্ত্য অমর্ত্য শব্দদুটি এনেছেন, তবে অনুবাদ প্রাঞ্জল। দুই অনুবাদেই মূলের মতো ছন্দের দোলা অন্ত্যমিল বজায় থেকেছে।  

 

দ্বিতীয় কবিতাটির দিকে এবার তাকানো যাক :

 

Life and Death

Sri Aurobindo

Life, death – death, life; the words are led for ages

Our thought and consciousness and firmly seemed

Two opposites; but now long-hidden pages

Are opened, liberating truths undreamed.

Life only is, or death is life disguised, -

Life a short death until by life we are surprised.

অলোকরঞ্জন

(জীবন এবং মৃত্যু)

জীবন, মরণমৃত্যু আর আয়ু; দীর্ঘ যুগধারা

বাহিত দুটি শব্দ আমাদের চিন্তা ছেয়ে দিত

বৈপরীত্যে, আর এখন খুলে গেল লুকোনো পাতারা

স্বপ্নেও অকল্পনীয়, সত্যকে যা যা করে উন্মোচিত।

জীবন বস্তুত, কিংবা মৃত্যুই জীবন ছদ্মমতি, -

জীবন ক্ষণিক মৃত্যু, জীবনটা আমাদের সচকিত না করা অবধি

তরুণ

(জীবন মৃত্যু)

জীবন মৃত্যুমৃত্যু জীবন; শব্দদুটি বহমান যুগে যুগে

আমাদের চিন্তাস্রোতে, চেতনায় সুদৃঢ় প্রোথিত;

দুই বিপরীত, কিন্তু এখন দীর্ঘপাতায় লুকায়িত;

এবার মুক্ত, স্বাধীন, সত্য যে স্বপ্নেও অকল্পিত

কেবল জীবন কিংবা মৃত্যু, যেন ছদ্মবেশী প্রাণ,

জীবন সে ক্ষণিক মরণ, যদি না বিস্ময়ে হই চমকিত।

 

এই অনুবাদ যুগলের তুলনায়ন আমাদের দেখিয়ে দেয়, দুজনেই মূলকে আশ্রয় করে কবিতার পুনর্জন্ম দিয়েছেন। তবে অলোকরঞ্জন মূলানুসারী অন্ত্যমিল বজায় রেখেছেন আগাগোড়াই, যা তরুণ সর্বত্র  রাখেননি। শব্দের ক্ষেত্রে অলোকরঞ্জনেরদীর্ঘ যুগধারা’ ‘জীবন ছন্নমতিযেমন অনুসৃজন, তেমনই তরুণেরলুকায়িত’, ‘ছদ্মবেশী প্রাণ শ্রুতিসুভগ ভাষান্তর। -কবিতায় অরবিন্দ জীবন-মৃত্যুর সম্পর্ক দেখাতে চান, জীবনের দেওয়া চমক তাঁর কাম্য, নইলে বাঁচাটাও বিস্বাদ। যে কবি নিছক জ্ঞান, পদমর্যাদা, খ্যাতি, কীর্তি অপেক্ষা মানুষের অন্তর্লোকের পরিণতি চান, দিব্যজীবন আর অতিমানসের কথা বলেন, তিনি যে জীবন-মৃত্যুকে এভাবেই দেখবেন তাতে সন্দেহ কী?

 

 

অনুকথন

 

শ্রীঅরবিন্দের কবিতা নানা সময়ে বাংলায় অনূদিত হয়েছে। তাঁরভবিষ্যতের কবিতাঅনুবাদ . রামেশ্বর কে অনুবাদকের সম্মান এনে দিয়েছিল। কবিজন্মের দেড়শো বছরের এই উদযাপনময় প্রহরে তাঁর কাব্য-কবিতা-নন্দনভাবনা নিয়ে বাংলা ভাষায় আরো চর্চা প্রয়োজন। তাঁর কবিতার অনুবাদবীক্ষণের পাশাপাশি তাঁর অনূদিত সাহিত্যসম্ভারের তুলনামূলক পাঠ আমাদের নতুনতর অর্থের সন্ধান দিতে পারে। অনূদিত কবিতার মতোই অনুবাদতাত্ত্বিক সাহিত্য সমালোচনার নিরিখে কবি শ্রীঅরবিন্দের পাঠ বিশ্লেষণ তাই একান্ত জরুরি।।   




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন