মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

তপন বাগচী-র প্রবন্ধ

কবি সুফী মোতাহার হোসেনের ‘বাংলা ভাষা’


সুফী মোতাহার হোসেন (১৯০৭-১৯৭৫) রোমান্টিক ধারার কবি। তিরিশি আধুনিকতার
প্রবল প্রতাপের কালেও তিনি ছিলেন বাংলা কবিতার মরমি মূলধারার চিরায়ত পথের
পথিক। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩), বিহারীলাল চক্রবর্তী
(১৮৩৫-১৮৯৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), কাজী নজরুল ইসলাম
(১৮৯৯-১৯৭৬)  জসীমউদ্দীনের (১৯০৩-১৯৭৬) কাব্যভাষার ভেতরেই তাঁর সদম্ভ
পদচারণা ছিল সুস্পষ্ট। মধুসূদন-নির্দেশিত চতুর্দশপদী কাব্য-আঙ্গিকের
বাইরে তিনি অগ্রসর হননি। আরেকটু স্পষ্ট করে বলা যায় চতুর্দশপদী বা সনেটই
ছিল প্রধনা বাহন। সনেটকবি বা সনেটকার হিসেবেই পরিচিত ছিলেন আমাদের প্রিয়
কবি সুফী মোতাহার হোসেন।
সুফী মোতাহার হোসেন ফরিদপুর শহরের উপকণ্ঠে শিক্ষকতা পেশায় থেকে বাংলার
পল্লিপ্রকৃতি থেকে রসদ নিয়ে রচনা করেছেন দুই শতাধিক সনেট। কেবল সনেটের
ভেতর দিয়েই প্রকাশ করেছেন তাঁর অসাধারণ কাব্যসত্তার প্রকৃতির রূপবর্ণনার
ক্ষেত্রে তিনি যতীন্দ্রমোহন বাগচী (১৮৭৮-১৯৪৮), কুমুদরঞ্জন মল্লিক
(১৮৮৩-১৯৭০) , কালিদাস রায় (১৮৮৯-১৯৭৫), জসীমউদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬),
বন্দেআলী মিয়া (১৯০৬-১৯৭৯), কাজী কাদের নওয়াজ (১৯০৯-১৯৮৩), কে এম সমশের
আলী (১৯১০-), বেগম সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯) প্রমুখের কাতারে অবস্থান
নিয়েও নিজের স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করেছেন সনেটের আঁটোসাঁটো বাঁধনে। সনেটের
অষ্টক-ষষ্টকের ভেতরেই খুঁজেছেন বাংলা কবিতার মুক্তি।
প্রকৃতির রূপের মধ্যেই রোমান্টিক হৃদয়ের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। ছন্দ এবং
অর্ন্তমিল রক্ষা করে কবিতা লিখেও তিনি বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে
রয়েছেন।
‘বাংলা ভাষা’ নামের একটি কবিতা বিশ্লেষণ করে সুফী মোতাহার হোসেনের
কাব্যশক্তি ও ভাষাপ্রেম নিরূপণ করা যায়। এটি সনেট তথা চতুর্দশপদী তবে
প্রতি চরণে ১৪ মাত্রা নয়--১৮ মাত্রা রয়েছে। মাত্রাবিন্যাস অক্ষরবৃত্তে
৮+৮+২। ছন্দের শাসন ও শৃঙ্খল পুরোপুরি মান্য করার সঙ্গে সঙ্গে
মিলবিন্যাসেও পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। কবিতার প্রকরণকৌশল তাঁর করায়ত্তে।
তাঁর সময়ে ছন্দ জানা ছিল কবি হওয়ার প্রধান শর্ত। তিরিশি আধুনিকতার অন্যতম
পুরুষ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত --- প্রদত্ত ‘ছন্দোস্বাচ্ছন্দ্যই কবিতাপ্রতিভার
একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র’ দিয়েই কবিত্বের শক্তি পরিমাপ করা যায়। আর সেই
বিচারে সুফী মোতাহার হোসেনের কবিতা উত্তীর্ণ।
‘বাংলঅ ভাষা’ কবিতায় ভাষাকে ‘বাণীর অঙ্গনে’র ‘সোনার ফসল’, ‘অরূপের
রূপশতদল’, ‘বিকাশত বাণীর প্রকাশ’, ‘কালের অঙ্গনে’. ‘পুষ্পিত আশ্বাস’
প্রভৃতি অভিধায় চিহ্নিত করেছেন। ‘বাংলা ভাষা’-কে তিনি ‘কালের অনাদি
তীর্থে’-র ফসল বলে এর প্রাচীনতাকে বুঝিয়েছেন। এই বঙ্গের ভুবনে অনাদিকাল
থেকেই বাংলা ভাষার জন্ম। ‘কালের অঙ্গনে’ এই ভাষা প্রতিদিন ফুল ফুটিয়ে
চলছে।
বাংলা ভাষার চমৎকার পরিচয় বিধৃত রয়েছে এই কবিতায়। ভাষার কবিতায় বৈশিষ্ট্য
তুলে ধরেছেন অলঙ্কৃত চরণে ---
ক) কালের অনাদি তীর্থে জন্ম
খ) বাণীর অঙ্গনে সোনার ফসল ফলায়
গ) অপূর্ব আভা বিকাশ করে
ঘ) অরূপের পদ্ম ফোটায়
ঙ) নতুন সৌন্দর্য সৃষ্টি করে
চ) নতুন ভাষা, নতুন গান সৃষ্টি করে
ছ) রস ও আনন্দের আধার
জ) বঙ্গের ভুবনে বাণীর প্রকাশ
ঝ) গীততান স্বর্ণের বীণা
ঞ) মধুভাষ অমর্ত্য ছন্দ
চ) কলা রেখা সৌকর্য
ছ) কালের অঙ্গনে পুষ্পিত আশ্বাস
ভাষা নিয়ে এমন বিচিত্র অনুভবের প্রকাশ খুব কম কবির কলমেই হতে দেখেছি।
তিরিশি আধুনিকতা থেকেও দূরে থাকতে চাইলে কালের হাওয়াকে এড়াতে পারেননি।
সুফী মোতাহার হোসেনের কবিতায় তাই দেখি ‘বাণীর অঙ্গনে’, ‘নবীণ সৌন্দর্য’,
‘মানসের পত্রখানি’, ‘বঙ্গের ভুবন’, ‘গীতজন’, ‘রূপকলা রেখা’, ‘কুসুম সুরভি
পথে’, ‘চিত্তের তৃষা’, ‘কালের অঙ্গনে’, ‘পুষ্পিত আশ্বাস’ প্রভৃতি
শব্দবছের উপস্থিতি। এ সকল শব্দবঙ্গে কবির অলঙ্কার প্রয়োগের ঈর্ষণীয়
ক্ষমতার সাক্ষাৎ পাই।
কবি বলতে চেয়েছেন অনাদিকাল থেকে যাত্রা শুরু করে যুগ-যুগান্তর পেরিয়ে এই
বাংলা ভাষা বাণীর অঙ্গনে সোনার ফসল ফলিয়েছে। অপরূপ তার সৌন্দর্য। এই
ভাষায় নতুন গান রচিত হয়েছে। আমাদের মানসলোকে রসের সঞ্চার করেছে, এবং
বিশ্বের দরবারে আমাদের গৌরব দান করেছে। বাংলাদেশে এই বাংলা ভাষা বাণী
প্রকাশ করেছে, সোনার বীণায় সুরের ঝংকার তুলেছে, স্বর্গীয় ছন্দে মধুর তান
সৃষ্টি করেছে, সৌন্দর্যের রূপ নির্মাণ করেছে, মনের তৃষ্ণা নিবারণ করেছে,
এবং কালে কালে তা নতুন হয়ে ফুটে উঠেছে। বাংলা ভাষার চিরায়ত জীবন্ত
ইতিহাসের কাব্যিক প্রকাশ রয়েছে এই কবিতায়। কবি খন বলেন,
‘সু-চির বণিত তব গীততান স্বর্ণের বীণায় ---
সু-চির ছন্দিত তব মধুভাষ অমর্ত্য ছন্দেতে
সু-চির ললিত তব রূপ কলা রেখা সৌন্দর্যেতে’...
তখন আমরা এক ধরনের সুরলালিত্য অনুরণন উপলব্ধি করি। এই অনুরণই কবিতাটি
পড়ার পরেও আমাদের বোধে জাগ্রত থাকে। আর সে কারণেই সুফী মোতাহার হোসেনের
কবিতা কালের গর্ভে হারিয়ে যায় না।
সুফী মোতাহার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন। জীবনের শুরুতে
একবার দুধের সাথে বিষ মিশিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয় তাঁকে। সন্দেহ জাগলে
পুরো দুধ পান না করায় প্রাণে বেঁচে গেলেও দীর্ঘ অসুস্থতায় ভোগেন তিনি।
একপর্যায়ে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। প্রায় ১২ বছর শয্যাশায়ী থাকেন কবি।
ফলে উপার্জনহীনতা তাঁকে নতুন সংকটে ফেলে দেয়। সকল অসুস্থতা, দারিদ্র ও
প্রতিকূলতা কাটিয়ে তিনি কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আদমজী সাহিত্য
পুরস্কার ্ এবং বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার তাঁর বড় অর্জন। ‘সনেট
সংকলন’ (১৯৬৫), সনেট সঞ্চয়ন (১৯৬৬) ও সনেটমালা (১৯৭০)  মাত্র তিনটি
গ্রন্থে ২০৬টি সনেটের মাধ্যমেই তিনি বাংলাসাহিত্যে আসন করে নিয়েছেন।
‘বাংলা ভাষা’ নামের সনেট তাঁর সনেটমালঞ্চের সুরভিত কসুম মাত্র।
একথা ঠিক যে, একটি মাত্র কবিতা পাঠ করে একজন কবির মানসচরিত্র নির্ণয় করা
কঠিন। আমরা কেবল বাংলা ভাষার প্রেক্ষাপটে রচিত একটি কবিতা দিয়ে তাঁকে
চেনার চেষ্টা করেছি। কবিতার বিষয় যেহেতু ‘বাংলা ভাষা’ আর কবির লেখার বাহন
যেহেতু বাংলা ভাষা, সেহেতু এই কবিতার ভেতর দিয়ে আমরা সুফী মোতাহার
হোসেনের অন্তরের সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারি।
সুফি মোতাহার হোসেনের সনেটরচনায় যে স্বাতন্ত্য দেখিয়েছে, বাংলাভাষায় তা
মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩),  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(১৮৬১-১৯৪১), প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬),  আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪), ফররুখ
আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) প্রমুখ কবির সনেটের সঙ্গেই তুলনীয়। সনেট ছাড়া অন্য
আঙ্গিকের কবিতা তিনি লেখেননি। কিংবা লেখার মতো শারীরক সুস্থতা ও সময় তাঁর
হাতে ছিল না। আর সংখ্যাধিক নয়, গুণবিচারেই সুফী মোতাহার হোসেন কেবল সনেট
রচনা করেই বাংলাকবিতার ভুবনে নিজের অবস্থানকে পোক্ত করেছেন। ‘বাংলা ভাষা’
কবিতাটি তার একটি নজির হয়ে আছে।


 

1 টি মন্তব্য: