মঙ্গলবার, ২৫ জুন, ২০২৪

রন্তিদেব সরকার-এর ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী "ঢাকার ডায়েরি"


ঢাকার ডায়েরি


একদিন বাংলাদেশ ঘুরতে যাবসত্যিকথা বলতে কিএমন সংকল্প কস্মিনকালেও ছিলনা। তেমনি আবার একটা সুপ্ত ইচ্ছের ধারা অন্তলীন হয়ে মনের অন্তরতম স্থলে ফল্গু-নদীর মত নিঃশব্দে বইত। মানে আমার ওপার বাংলায় যাওয়া-না-যাওয়ার মধ্যচরে ছিল বাস। পূর্ববঙ্গীয় না হয়েওমানে জন্মভূমি বা ভিটেমাটির অনিবার্য টান ছাড়াও কোথায় যেন এক গোপন তন্ত্রীতে,অবচেতনে বেজেই চলত আবহসঙ্গীতের মত। নিছক কৌতূহলবশতঃ বা কোন এককালে সেই ‘সুজলাং সুফলাং শষ্য শ্যামলাং’ দেশটা আমাদেরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এটা ভাবলেই এক আত্মিক সত্ত্বা জেগে উঠত। কিছু মতলবি লোকেদের কারণে দুটি ধর্মের বিভাজন সৃস্টি করা হলো। কত পরিবারের উপর ঝড় বয়ে গেলটুকরো-টুকরো হয়ে ভেঙ্গে গেল কত একান্নবর্তী পরিবারতার ইয়ত্তা নেই। সেই বেদনার ছড় কেউ যেন এখনও টেনে চলেছে ‘দরবারিকানাড়ায়।এ বেদনা বঙ্গহৃদয়ে বহুদিন এক দগদগে ঘা-এর মত থেকে যাবে। যাইহোক দুইবাংলার অনেক ভাবাবেগ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এই দেশভাগের যন্ত্রণা। তারপর মুক্তিযুদ্ধ এসে জুড়ে দিল আরেক সহমর্মিতার ভাবাবেগ। চিরশত্রু পাকিস্তানের কব্জা থেকে যুদ্ধ-জিতে বেরিয়ে আসতে পারা-টা এক ঐতিহাসিক জয় এবং সেই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশের ভূমিকা বিশাল বড়। তাই সেই জয়ের ভাবাবেগে আমরাও সামিল হয়েছিলাম।            ১৯৭১-এর পর আমাদের মত একরাজ্য-একটি-রাষ্ট্রে পরিণত হল। স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের কৌতূহল বাড়ল। একটা নতুন দেশ অনেক স্বপ্ন নিয়ে গড়ে উঠতে লাগল। তাই সেই নতুন দেশ কি রূপ পেল তা চাক্ষুষ করার এক সুপ্ত ইচ্ছে অন্তরে বাড়তে লাগল। তাই যেদিন ভগ্নীপতি পলু আচমকা গাড়িতে যেতে যেতে বলল- ‘বাংলাদেশ’ যাবে নাকি ?’ প্রশ্নটা শুনে একটু যে চমকে যাইনিবললে মিথ্যে বলা হবে। তবে সম্মতি জানাতেও বেশি সময় নেইনি। জানা গেল এই প্রস্তাবনা আমাদের আবাসনের প্রবীণ ‘হুজুগে’ মিথিলেশ-এর। এই যাত্রার উৎসমুখ-   একদিন টিভি-তে চাঁদপুরে ইলিশ মাছ ধরা  দেখাচ্ছিল। এক বাংলাদেশী প্রবীণ  ভদ্রলোক নদীর উপর নৌকায় দাঁড়িয়ে আছেন আর তাঁর হাতে ধরা সদ্য-ধৃত পেল্লায় সাইজের রুপোলি ইলিশ দেখে-উনি প্রচন্ড রকমের উত্তেজিত হয়ে ঠিক করে ফেললেন যে উনি এইরকম ইলিশ মাছ আনতে বাংলাদেশ যাবেন। এই তৎকাল প্রকল্পে তখনো পর্যন্ত পলু-কাজল-কে নিয়েথ্রি-ম্যান-আর্মি। ‘আমি এতে সামিল হবার পর আর  যে কাউকে নেওয়া হবেনা এটা আমরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। আর এই ‘জয়বাংলা’ প্রকল্পে যার নেপথ্য ভূমিকাসেই বুয়ামানে  মিথিলেশের ছেলেপুরো ট্যুর-এর নীল-নকশা তৈরির দায়িত্ব নিয়ে নিল নিজের কাঁধে। তার অভিজ্ঞতা যে বেশ কাজে আসবেতা বলাই বাহুল্য। যেই ভাবা সেই কাজ। ঝপাঝপ ভিসার আবেদন করে ফেলা হলো, বাংলাদেশ হাই-কমিশন অফিসে গিয়ে। কাছেইবেকবাগানের কাছে। কিছু পেশাদার ছেলে মাথাপিছু ১০০টাকার বিনিময়ে সব কাজ ছবির মত সাজিয়ে দেয়।আধঘন্টার মধ্যে সবকিছু গুছিয়ে আমাদের হাতে তুলে দিলআমাদের কাজ শুধু কাউন্টারে জমা করা।  দিন পর একটা ডেট দিল। আমরা গিয়ে শুধু নিয়ে এলাম। এরপর দল বেঁধে ফেয়ারলি প্লেস বুধবার দশটায়। যেহেতু ট্রেনে যাত্রা -  ‘মৈত্রী এক্সপ্রেস এখানে সব দিন আবার টিকিট দেয়না। কিন্তু রক্ষে  টিকিটের কোন হাহাকার নেই। আমরা বুধবার গিয়ে শুক্রবারের টিকেট পেয়ে গেলাম। এক্সিউটিভ ক্লাস (EC)  আর চেয়ার কার (CC) – কুল্লে এই দুটি ক্লাস। গোটা ট্রেনটি বাতানুকূল শ্রেণী (AC) গোটা চারেক ইসি বাকিটা সবটাই সিসি। কিন্তু বেশ হতাশ হলাম – সিনিয়র সিটিজেন-দের জন্য এই ট্রেনের টিকেটে কোনরকম ছাড় নেই!মাশাআল্লাহইসি ক্লাসের পুরো দুই হাজার একশ কুড়ি টাকাই নিষ্ঠুরের মত কেটে নিল তাও আবার ট্রেনে যা কিছু খাবার তা সব কিনে খেতে হবে।                                                                                                                                       ডাবল-ট্রাবল। ৪০%  লোভনীয় প্যাকেজও গেল আবার রেলের রান্নাকরাখাবারওগেল।প্রাতরাশ১০০ + মধ্যাহ্নভোজ১৫০অর্থাৎ বাড়তি ২৫০ টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে গেল। কি আর করা- কথায় আছে-‘পড়েছি যবনের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে তখন কিন্তু যাবার আনন্দেতা তা থই থই’ – যা খুশি ওরা বলে বলুক- গোছের অবস্থা। ভেবেছিলাম সংক্ষিপ্ততম সফর মানে শুক্রবার গিয়ে শণি-রবি থেকে আবার সোমবারের ফিরতি ট্রেনের টিকেট। কিন্তু দুঃখের বিষয় সোমবার কোন ফেরার ট্রেন নেই, আছে বুধবার। এদিকে মিথিলেশদার আবার কিসের যেন এক মীটিং আছে মঙ্গলবার, তাই প্ল্যানমত হলো না, পরের ট্রেন আবার সেই বুধবারে। তাই রবিবারের সকালের টিকেট কাটতে বাধ্য হলাম। কিন্তু যে বললাম, একে তো বাংলাদেশ যাবার আনন্দ তার উপর এই প্রথম বিদেশ-যাত্রা। ভাবা যায় ! মনে মনেযাক,  এতদিন পর আমার ১৪-সালে করা পাশপোর্ট-এরগায়ে একটু অক্সিজেনপাত হলো। তার সদগতি হলো। সে বেচারার স্কিন-ডিজিজ হয়ে যাবার যোগাড় ! সেও যেন আমাকে দু-হাত তুলে আশীর্বাদ করল তার বন্দীমুক্তির জন্য। এবার আর কোন সন্দেহ রইল না। যাওয়া হচ্ছেই। দুটো আশু কর্তব্য রয়ে গেছে। এক, বাংলাদেশী কারেন্সির ব্যবস্থা, দুই যাত্রার দিন টালিগঞ্জ থেকে কলকাতা স্টেশনের জন্য একটা গাড়ির ব্যবস্থা করা ভোর ৪টের সময়, কেননা আমাদের কলকাতা স্টেশনে রিপোর্টিং ভোর ৫টায়। যদিও ট্রেন ছাড়বে সেই সকাল -১০ মিঃ কিন্তু ট্রেনে ওঠার আগে বিস্তর কাজ। পাসপোর্ট-ভিসা চেক। মালপত্তর চেক, ইমিগ্রেশন ইত্যাদির জন্য ওরা হাতে দুই-ঘন্টা সময় ধার্য করেছে।

 

                                                                            

যেহেতু কোনদিন         বিদেশে যাইনি, তাই যাবার আগে যতটা পরিমাণ নিজের খোল-নলচে পালটানো দরকার এবং যে গতিতে পালটানো দরকার, সেই গতি সেই চেনা  জীবনের ছক বা রুটিন ভেঙ্গে বেরুনো যে সহজ নয় তা একটু একটু করে অনুভব করেছিপদেপদে।। এদিকে ঘড়ির কাঁটা তরতর করে এগিয়ে চলছে। তাকে তো ধরাই মুস্কিল। তাই এখনপ্রায়োরিটি’- তালিকা বানানো দরকার। প্রথম তো অবশ্যইভিসা সেটা সোমবার বিকাল পাঁচটায় দেবে। সেজন্য অবশ্য সবার যাওয়ার দরকার নেই; আমাদের চারজনের মধ্যে যে কেউ একজন রসিদগুলো নিয়ে গেলেই হবে। তাই সোমবার বিকাল-‘ভিসাতেইআবদ্ধথাকল।মঙ্গলবারদিন টিকেট দেবেনা, সেই বুধবার টিকেট কাটার দিন। বুয়া- লোক সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবে। তার ফোন নাম্বার পাওয়া গেল। টিকেট কাটতে কিন্তু সবাইকে যেতে হবে। দুটো জায়গায় টিকেট দেওয়া হয়- কলকাতা স্টেশনের বুকিং কাউন্টার এবং ফেয়ারলি প্লেস। আমাদের এলাকা থেকে কলকাতা স্টেশন বেশ খটমটে এক গন্তব্য। তাই ফেয়ারলি প্লেস যাওয়ার ঠিক হলো, মিথিলেশ গাড়িতে নিয়ে গেল আমাদের সবাইকে। বুকিং অফিস ১০টায় খোলে। বাইরে থেকেই ঘরে ঢোকার লাইন দিতে হল। রেলপুলিশ নিয়ন্ত্রণে। এবার হাতে পাশপোর্ট উঁচিয়ে ঢুকতে হল। গেটেই চেক। উটকো লোকনোএন্ট্রি। তাই কোন টিকিটের দালালের টিকিটি দেখতে পেলাম না। বুয়ার লোক দাঁড়িয়েছিল কিন্তু তার যত কারিকুরি গেটের বাইরে। সে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে বাইরেই থাকল। একজন পুলিশ গেটে পাশপোর্ট দেখে নিচ্ছে আরেকজন চেয়ারে বসে টিকিট-রিজার্ভেশন ফর্ম দিচ্ছে। মাথাপিছু একটি ফর্ম নিজেদেরই ভর্তি করে লাইনে দাঁড়াতে হবে। ঘোষণা হল এড্রেস সিস্টেমেতিনটি কাউন্টারে টিকিট দেওয়া হবে২২২৩ এবং ২৪। এখানেই একটি ভুল হয়ে গেলঅজ্ঞতার জন্য। যদি রিটার্ণ জার্নির টিকিট করতে হয় তাহলে দুটি ফর্ম লাগবে। আমরা সেটা না জানার জন্য একটি ফর্ম ভর্তি করে লাইনে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু রিটার্ন ডেট দেবার কোন অপশন না থাকায় জিজ্ঞেস করতেই জানা গেলতার জন্য আরেকটি ফর্ম ভর্তি করতে হবে। সেই ফর্ম চাইতেই জানা গেলপ্রথমেই বলেননি কেনতা আর এখন পাওয়া যাবে না২২নং কাউন্টারে লাইনে দাঁড়ান। বেলা ১২টায় খুলবে। আমরা মাথা চাপড়াচ্ছি। এখন উপায় ? তার মানে দু-দুবার লাইন ? সব্বোনাশের মাথায় বাড়ি। তাও ভাগ্য ভাল যে আমাদের  ফর্মে সিরিয়াল নাম্বার ছিল ৭৭-৮০ তাই সেই নাম্বার আসতে তখন ঢের দেরিততক্ষণে আশা করা যায় ১২টা বেজেই যাবে। আমাদের দুর্দশার কাহিনী শুনে নিয়ন্ত্রণকারী আরক্ষা বাহিনীর সেই যুবা-পুলিশ ভাইটিই আমাদের সান্ত্বনা দিতে লাগল। আর হলোও তাই। যখন ৬০-এর ঘরের ডাক চলছে সেই সময় খুলে গেল রুদ্ধ বাতায়ন। কাঙ্ক্ষিত ফর্ম হাতে পেতেই যে গতিতে কলম চলল আমাদের, মনে হলো, পরীক্ষার হলে ১৫মিনিট আগে এলার্ম-ঘন্টা পড়ে গেছে আর তখনও দুটো ১৫ নম্বরের উত্তর লেখা বাকি। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই সমাধা হলো আমাদের ফর্মপূরণ টিকিট-প্রাপ্তি এবং স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন। এতো গেল বুধ-এক্কে-বুধ শুক্রবারে  জার্নি। হাতে রইল বিষ্যুদ। আর সময় নেই। যুদ্ধকালীন  তৎপরতা চাই। দুপুরে খেয়েদেয়ে আর অন্যদিনের মত ভাতঘুম না দিয়ে গাড়ি বের করে দৌড়লামথমাস কুক লর্ডস মোর পেরিয়ে বাঁদিকে একটু গেলেই দোতলায় অফিস। চাই বিদেশি মুদ্রা। বাংলাদেশি টাকা। সুভদ্র মেয়েটি কাউন্টারে মুচকি হেসে মোলায়েম গোলায় জানাল- ‘বাংলাদেশি টাকা তো আজ  স্টক- নেই। ডলার পেয়ে যাবেন আগামীকাল পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতেই জানালেন-‘কোন সম্ভাবনা নেই। আপনি স্যর ডলারই নিয়ে যান কি লাভ ? সেগুলোও তো বাংলাদেশি টাকায় কনভার্ট করতে হবে ? চলে এলাম। নিচে নামতেই তেড়ে বৃষ্টি। নিচে নেমে একটা চায়ের দোকানে শেল্টার নিলাম। আর তক্ষুণি চোখে পড়ল পাশের একতলা অফিসটায় ঝোলানো সাইনবোর্ড-টা।ফরেন এক্সচেঞ্জ কি আশ্চর্য ! এর অস্তিত্বই আমি জানতাম না এতদিন। ফোরেক্স কোম্পানির অফিস। এরাও তো নামি বিদেশি মুদ্রার ডিলার। সঙ্গে সঙ্গেই দরজা ঠেলে অপেক্ষাকৃত অপরিসর অথচ ছিমছাম অফিসটায় ঢুকেই প্রার্থিত সম্পদের খোঁজ করতেই জানাল –‘হ্যাঁ পাওয়া যাবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আপনার কত লাগবে ? কমপক্ষে ২৫ হাজার।টিকিট-কাটা-ভিসা ইত্যাদি পর্ব সারা ?’ আমাকে আশ্বস্ত করে জানাল যে সেই টাকা তাদের স্টক- আছে। কাল পেয়ে যাবেন। এর থেকে বেশি লাগলে আজই ফোন করে কনফার্ম করতে হবে। যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। 



ক্রমশ...


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন