মঙ্গলবার, ২৫ জুন, ২০২৪

সুরজিৎ কুন্ডু-র প্রবন্ধ


'পুরান কলকেতের নববর্ষ'

হুতুম বলছে --- "বাঙালিরা বছরটা ভালো রকমেই যাক্ আর খারাবেই শেষ হক্সজনে চিবিয়ে ঢাকের বাদ্যি আর রাস্তার ধুলো দিয়ে পুরান্ কে বিদায় দ্যান্। কেবল কলসি উচ্ছুগগু কর্তারা আর খাতাওয়ালারাই নতুন বৎসরের মান রাখেন।"

হুতুমের-----'হুতুম প্যাঁচার নকশা' বইয়ের ওই কথাগুলোই আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় সেকেলে কলকাতা নববর্ষ উদযাপনের সাথে। নতুন বছরের এই উন্মাদনা সেকালে যে খুব একটা ছিল না সেটা বেশ বোঝাই যায় এখান থেকে বরং রঙ ধরত নববর্ষের আগের দিনমানে চৈত্র সংক্রান্তিতে। চড়ক পূজায় সন্ন্যাসীর গাজন, রাস্তায় সঙ্ বেরোনকে কেন্দ্র করে বেশ উৎসবের দিনে পর্যবসিত হতো গোটা কলকেতেটাই বাইরে থেকে লোকও আসতো মোটর চেপে বা পায়ে হেঁটে, রাস্তার পাশে করা সামিয়ানা টাঙ্গানো ছাউনিতে রংবেরঙের শরবতে গলা ভিজিয়ে তারা কলকাতার রাজপথে সঙ্ দেখতো আর ধুনোর ধোঁয়ায় ভরা কলকাতায় সন্ন্যাসীদের নৃত্য উপভোগ করতো রাস্তার পাশের দোতালা তিনতলা বাড়ির ছাদ থেকে। হামলে পড়ে সেসব চাক্ষুষ করতো সেকালের বউ ঝিয়েরাও ভোরবেলা থেকেই জমায়েত  শুরু আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠতে চারদিক ঢাকের বাদ্দি, ধুনোর ধোঁয়া আর মদের গন্ধে এক অন্য জগতেই তখন সেকেলে শহরটা , শুধু কি আর গৃহস্থ বাড়ি! বেশ্যালয় গুলোর বারান্দায়ও ইয়ারগোচর ভদ্রলোকে পরিপূর্ণ গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করে সাতটা বাজলো , কী শুরু হলো সে উৎসব আর সঙের উৎসব একপ্রকার বাবু কালচারেরই দান, অন্যান্য পূজা-পার্বণে দেখা গেলেও চৈত্রসংক্রান্তিতে এর ব্যাপারটা চরমে উঠতো। নানা জায়গা থেকে সঙ্ বের হলেও 'কাঁসারি পাড়ার' প্রভাবশালী ব্যক্তি তারকনাথ প্রমাণিক হিন্দু পেট্রিয়টের কৃষ্ণদাস পালের পরিচালনায় যে সঙ্ যাত্রা বের হতো তার খ্যাতি ছিল বেশ বেশি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র চুরি হলে সঙরা বিশ্ববিদ্যালয় স্যার আশুতোষকে নিয়েও ছটা কাটতে ছাড়েনি, -------

"বিদ্যার মন্দিরে সিঁদ কেটেছে কোন চোরে,

সখিরা নেকি নাকি পড়ল ফাঁকি

কেউ দেখেনি ঘুমের ঘোরে  

...................

বিদ্যা নিত্য পূজে আশুতোষে "


এছাড়াও সঙ্গেরা যেসব ছড়া কাটতো আর যা শুনে সবাই আমদ করত সেই শহরটাতে , তা কখন যেন সেসব শ্রমজীবীদের মুখ থেকে উঠে আমাদের মার্জিত ভাষার অঙ্গ হয়ে গেছে আর অচিরেই হয়ে উঠেছে তা বাংলার প্রবাদ প্রবচন , তারই একটা দুটো উদাহরণ দেওয়া যাক। -----

"এলোমেলো করে দে মা লুটেপুটে খাই", "মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায়!" , " ঘুটে পড়ে গোবর হাসে..." ইত্যাদি যা ছিল সঙেদের মুখের গান    যদিও পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাপে আর প্লেগ মহামারীর কবলে শহরের রুচিবোধেও আসে পরিবর্তন লুপ্তপ্রায় হয় ঐতিহ্যশালী সঙ্ যাত্রা। 

মহেন্দ্রনাথ দত্ত, আমাদের সকলের সম্মানীয় শ্রদ্ধেয় স্বামী বিবেকানন্দের ভ্রাতা, তার 'কলিকাতার পুরনো কাহিনী প্রথা' বইতে এই চড়ক পূজার সন্ন্যাসী নিয়ে এক অনবদ্য প্রায় অশ্রুত ছড়ার হদিশ দিয়েছেন। ঘটনাটা ঘটতো অনেকটা এরকম, সন্ন্যাসী রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন , গলায় ধরা আর হাতে দানপাত্র মুখে বলছে---' বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে ---মহাদেএএএএএএএব !' তা হতো কী, ছেলের দল রাস্তায় দাগ কেটে পথ আগলে দাঁড়াতো সন্ন্যাসীর, করত প্রশ্ন! চাইতে উত্তর ! উত্তর দাওতবে যাবি আর সেই প্রশ্নটা করা হতো এক মজার ছড়ায় ----

"শূন্য রে সন্ন্যাসী ভাই আমার বাখান ,

উত্তর দিয়া তুমি যাও অন্যস্থান

এরন্ড আর থাম খুঁটি, ভেরেন্ডার বেড়া ;

তার মাঝেতে পড়ে আছে মস্ত এক নোরা ।।

বাটনা বাটিতে শিবের পুটকি হল ক্ষয়

সেই শিফটকে গড় করিলে কি পূণ্য হয়?"


যাইহোক নববর্ষ বলতে গিয়ে তার গৌড়চণ্দ্রিকা অর্থাৎ কিনা চৈত্র সংক্রান্তির দিন নিয়ে অনেক ধান ভানলাম আর নয় এবার সত্যি করে সেকালের কলকাতার নববর্ষ উদযাপন নিয়েই দুচার কথা বলা যাক শোনা যায় বাংলা নববর্ষ নাকি এক্কেবারেই হাল আমলের উৎসব। সম্রাট আকবরের আমলেই এর সূত্রপাততাহলে যে প্রশ্নটা প্রায় সাথে সাথেই উঠে আসতে বাধ্য তা হল---- তবে কি আগে বাংলা নববর্ষ ছিল না ? ছিল  ঠিকই , কিন্তু এমন ভাবে ছিল না। মানে এই যে পয়লা বৈশাখ, বছরের প্রথম দিন--- নববর্ষ, ঠিক এমনটা ছিল না শুরুতে। কৃষির প্রথম যুগে মৌসমের শুরুর দিন টা সামাজিক ভোজের মাধ্যমে নববর্ষ পালিত হতো বলেই জানা যায়। জমিদাররা প্রথম দিন হিন্দু মুসলমান জাতপাত ভুলে, বাকি আদায়ের মাধ্যমে পালন করতো। অবিশ্যি পরবর্তীতে দোকানী ব্যবসায়ীরা এই উৎসবে যোগ দেওয়ায় তাতে জোয়ারের ঢেউ লাগে কলকাতার বাবুরা বড় বড় দোকানে যাচ্ছেন মিঠাই খেতে, দোকানীরাও কম চালাক নয় --- তারাও ঝোপ বুঝে কোপ মারতো, সারা বছরের ধারের কিছুটা যদি শোধ করিয়ে নেওয়া যায়।এব্যপারে একটা মজার নাটকের কথা মনে পড়ছে। সালটা ১৮৭৮ , মহেশ চন্দ্র দাস দে প্রণীত "প্রণয় পরীক্ষা" প্রহসনের  মধ্যের অংশ---

"ধারী বাবু---' ধার ধার ধার ধারে দুনিয়া চলিতেছে, আপনি না ধার দিলে অপর দোকান খোলা আছে! হাঁকিতেছে ,হাতছানি দিতেছেচলিয়া যাইবার সমস্ত পথ খোলা !'

দোকানী বাবু---' ধার দেবো, মিষ্টান্নও খাওয়াইব! আপনি প্রণয়নী আমার , টাকা না দিলে বিবাহ ভাঙ্গিয়া দিব! আগে ধার মেটান, তারপর জবান ফুটান !"

আরো দেখতে পাই বাবু কালচারের কলকাতার সেকেলে নব্য বাবুরা কোঁচানো ধুতি পড়ে, পুরনো ঝাড় লন্ঠন খুলে নতুন ঝাড় ঝুলিয়ে আর বাটির পুরনো রঙ ধুইয়ে ফেলে নতুন রঙয়ের প্রলেপ চড়িয়ে , ইংরেজ সাহেব সুবোদের নিমন্ত্রণ করে, সঙ্ নাচিয়ে অতিথিদের খানাপিনায় আপ্যায়ন করতেন। আর সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল বাবুদের মধ্যে রেষারেষির। কে কত টাকা খরচ করে জাঁক্ জমক্ করল তা নিয়ে। আর সেই ব্যাপারে ,মানে নববর্ষের বাবুগিরিতে যে দুজন নাম কিনেছিল এই শহরে, তারা হলেন ----হাটখোলার বিখ্যাত সমৃদ্ধ দত্ত পরিবারের তনুবাবু আর পোস্তার রাজা সুখময় রায়। এখানে একটা খবর জানানোর লোভ সামলাতে পারছি না। যদিও হয়তো কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক , তবুও বলছি কারণ তা আপনাদের ভালই লাগবে বলে। এই রাজা সুখময় রায় ছিলেন 'বেঙ্গল ব্যাংক' যা কিনা অধুনা 'স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া' নামে প্রসিদ্ধ তার প্রথম বাঙালি ডিরেক্টর। হাটখোলার দত্ত বাড়ির মদনমোহন দত্তের প্রথম পুত্র তনুবাবু, যাকে বলে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো ! এনার ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থের তাই আর সেজন্যেই হয়তো সে অর্থের কদর তেমন বুঝতেন না   পয়লা বোশেখে প্রচুর টাকা পয়সা ব্যয় করে বিলাসিতা করতেন আর তাতেই তিনি মানসিক তৃপ্তি পেতেন সুবিশাল অট্টালিকা  তনুবাবুরা নববর্ষ উপলক্ষে পুরো উপর থেকে নিচ অব্দি সুগন্ধি গোলাপ জলে আর দামি ইরানি আতরে ধুইয়ে দিতেন আতর আর গোলাপ জলের মিশ্রিত মদীর সুবাসে পুরো মহল্লা মদিত ঘর, বারান্দা সর্বত্র ছাড় লন্ঠন ঝুলিয়ে অসংখ্য ঝাড়বাতি রঙিন ঝলকানিতে রাত্রিবেলায় দূর থেকে সাত মহলা বাড়ি স্বর্গপুরী হয়ে উঠতো। তনু দত্ত নিজে যেমন খেতে ভালোবাসতেন তেমনি খাওয়াতেও ভালবাসতেন , পাড়া-প্রতিবেশী, হিন্দু-মুসলমান, খ্রিস্টান-পার্সি সবার জন্যই অঢেল খাবারের ব্যবস্থা, খাবার পর গান বাজনা আর রঙ তামাশার আয়োজন। আরেকটা বাবুগিরির পরিচয় থাকতো তাঁর অকাতর দানে। নববর্ষের দিন কেউ গিয়ে হাত পাতলে তাকে ফেরাতেন না তিনি , আর মেজাজ যদি থাকত খুশ্ ! তবে তো আর কথাই নেই, পকেটে হাত ঢুকিয়ে যা উঠত তাই দিয়ে দিতেন শহরে কথা চাউড় ছিল --- 'নববর্ষে নিজের টাকায় অনেকেই ফুর্তি করে, 'জন আর তনু বাবুর মত পরের জন্য টাকা উড়ায় !' আর পোস্তার রাজা সুখময় রায়ের খাওয়া-দাওয়ার মেনু ছিল কি জানেন ? 'লুচি, মাংস, কোপ্তাকারি , আর পাটালি গুড়ের পায়েসভরা চৈত্র মাসেএছাড়াও নীলমণি হালদার, গোকুল চন্দ্র মিত্রছাতু সিংহ এই নববর্ষ উৎসবের রোশনাই টেনেছিল সেকালে এতো গেল সেকেলে কলকাতার কিছু খবর , নাহ ব্যোমকেশের 'কালকেতুদেয়নি এসব আরো একটা ঐতিহাসিক খবর দিয়ে আজকের মত ইতি টানবো, সম্রাট অশোক বছরের শেষ দিনে সংবৎসরের যে খাজনা হিসাবের বন্দোবস্ত করেছিলেনমানে আজকের দিনের ক্লোজিং এর মত খানিকটাতার নাম দিয়েছিলেন প্রিয়দর্শী "পুণ্যাহ" ঠিক তেমনি। বর্তমানে নববর্ষের আরেকটা নাম প্রচলিত আছে--- "হালখাতা"----' নতুন খাতা' ।যদিও 'হাল' কথাটা কিন্তু কোন ভাবেই বাংলা বা সংস্কৃত তো নয়ই , কোন দেশি ভাষাও তা না বরঞ্চ এটি হলো ফরাসি শব্দ যার অর্থ হলো--- 'নতুন' "হালখাতা"---' নতুন খাতা'  হিসেবের যেমন হালফ্যাশন যাইহোক , সবাইকে হালখাতার শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলাম। আর সবার হালখাতা খুশির হিসাবে ভরে উঠুক। তো সব বাঙালি মাত্রেরই উৎসব।।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন