মঙ্গলবার, ২৫ জুন, ২০২৪

তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী-র প্রবন্ধ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ঐন্দ্রজালিক প্রতিভার দ্যুতি


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বাংলা সাহিত্যে এক কালজয়ী প্রতিভা। তাঁর সৃষ্টি সম্ভারের বৈচিত্র ব্যাপ্তি বিশাল। তাঁর কবিতাগানপ্রবন্ধগল্পউপন্যাসনাটকগীতিনাট্যনৃত্যনাট্যপত্রাবলীপ্রহসনভায়ণভ্রমণ কাহিনীগদ্যকাব্যস্মৃতিকথাচিত্রকলা  ইত্যাদি বিশাল  সৃষ্টি- সমুদ্রের সামগ্রিক রুপ অবলোকন  সহজসাধ্য নয়।  কারণ এর মাধ্যমে তিনি স্বদেশসমাজমানুষপ্রকৃতিজীবনজগৎ--- সবকিছু স্পর্শ করেছেন। কবি নিজেই বলেছেন ,

" মহবিশ্বে মহাকাশে মহকাল মাঝে,  /

আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে ভ্রমি বিস্ময়ে  "  /

হয়তো কারণেই তিনি এক জীবনে অসাধারণ নৈপুণ্যে  বিস্ময়কর সৃষ্টির এমন বিশাল সমাবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেনযা বিশ্বে খুব কম কবি- সাহিত্যিকই করতে পেরেছেন।  ১৮৭৮ সালে প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্হ  ' কবি--কাহিনী ' থেকে মৃত্যুর পূর্ববর্তী  কবির শেষ জন্মদিনে ১৯৪১ সালে প্রকাশিত কবির জীবদ্দশায় গ্রন্থিত শেষ কাব্য  ' জন্মদিনেপর্যন্ত দীর্ঘ ছয় দশকের সৃষ্টিশীল জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্য যেমন সমৃদ্ধ করেছেনতেমনি  বিশ্ব সাহিত্য ভাণ্ডারও করেছেন ঐশ্বর্যশালী। তিনি বাংলা সাহিত্য ভুবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাপূর্ণতাপন্থী শিল্পী   তাঁর শিল্প তথা সৃষ্টি কালোত্তীর্ণ।  গবেষক কবি আবদুল মান্নান সৈয়দও  মনে করেছেন,  " রবীন্দ্রনাথ এক পূর্ণতাপন্থীশিল্পীযিনি তাঁর প্রায় প্রত্যেকটি রচনা গ্রন্থকে  দান করেছেন এক সম্পূর্ণতা  ;  তাঁর প্রত্যেকটি  রচনা গ্রন্থ হয়ে উঠেছে এক আত্নসম্পূর্ণ  জগৎ পরিধি ; আবার এই প্রত্যেকটি রচনা গ্রন্থ ক্রমারোহী এক সিঁড়ির মতো নব- নব উত্তরণে নিয়ে গেছে রবীন্দ্র শিল্পকে। সমস্ত মিলেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমহান শিল্পী রবি ইন্দ্র " ( দশ দিগন্তের দ্রষ্টা --- আবদুল মান্নান সৈয়দ। বাংলা একাডেমীঢাকা। প্রথম প্রকাশ-- নভেম্বর ১৯৮০। পৃষ্ঠা--২৬)

                              সমগ্র রবীন্দ্র জীবন সৃষ্টি অবলোকনে এটা মনে করা যেতে পারে যেরবীন্দ্রনাথ তাঁর নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্য সাধনামেধা শ্রমে  নিজেই ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করেছেন।  রবীন্দ্রনাথের সাফল্যের এই ক্রম-উত্তরণ কিন্তু একদিনে   ঘটেনি। একদিনে তিনি ' বিশ্বকবিবা   ' কবিগুরু ' হয়ে উঠেন নি। এর পিছনে রয়েছে তাঁর সৃষ্টির দীর্ঘ অবিশ্রান্ত পথ চলা।  জীবনে " প্রথম যে কবিতা লেখার খবর তিনি নিজে দিয়েছেনতার নাম ' পৃথ্বীরাজের পরাজয় ' ,  সে সময় কবির বয়স ১২।  অবশ্য তারও আগে ভাগিনেয় জ্যোতি প্রকাশের খাতায় অনেক কবিতা লিখেছিলেন  তিনি। সেগুলো সবই আজ লুপ্ত। তাঁর প্রথম প্রকাশিত যে কবিতাটির সঠিক খবর পাওয়া যায়তার নাম ' অভিলাষ '  ; এটি ১৮৭৪ সালে ' তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়' বেনামে ( দ্বাদশ বর্ষীয় বালকের রচনা  নামেছাপা হয়েছিল।  তাঁর স্বনামে প্রকাশিত প্রথম কবিতার  নাম ' হিন্দুমেলার উপহার ' ,  ১৪ বছর বয়সে লিখিত কবিতাটি ছিল স্বদেশ প্রেমমূলক কবিতা " ( বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস তথা (আধুনিক পর্যায়) -- ভূদেব চৌধুরী। দে' পাবলিশিংকোলকাতা।  পৌষ ১৩৯৫ বাংলা। পৃষ্ঠা-- ৮৬/৮৭) কবি নিজেই তাঁর প্রথম জীবনের কবিতাগুলোকে (১৮৮১--'৮৬) দুর্বল বলে চিহ্নিত করলেও মাত্র ১৯/২০ বছর বয়সে লিখিত তাঁর ' সন্ধ্যা সংগীত ' ( প্রকাশ ১৮৮২) গ্রন্থের মাধ্যমেই তিনি তাঁর কবিতার স্বাধীন স্বতন্ত্র ধারার সূচনা ঘটান।  তারপর পিছনে ফিরে তাকান নি। তাঁর সৃষ্টির ফাল্গুধারা  দু'কূল  প্লাবিত করে নিরবচ্ছিন্ন  বয়ে চলে আমৃত্যু।  এই প্রবাহ বাংলা সাহিত্যের প্রায় নবকটি শাখায় নিশ্চিত করেছে তাঁর সমুজ্জ্বল উপস্হিতি। রবীন্দ্রনাথের এই বিরামহীন দীর্ঘ  প্রচেষ্টা সফল প্রাপ্তি অবলোকন করেই ' রবীন্দ্র মানস বিশ্লেষণের  ভূমিকা  ' প্রবন্ধে ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় হয়তো বলেছিলেন,  " রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন  'বেঁচেছিলেন  "

                                বলা হয়ে থাকেবাংলা সাহিত্যে ১৯১৩ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত সময়কাল 'আধুনিকতারসূচনাপর্ব। এসময় দুটি  গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আধুনিক সাহিত্য নির্মানে অনবদ্য অবদান  রাখে। হায়াৎ মামুদ এর কথায় ,  " তা হলঃ  নতুন গদ্যভাষায় কথ্যরীতির প্রতিষ্ঠা এবং গদ্যছন্দে নতুন কাব্যভাষা নির্মাণ। উভয় চেষ্টারই নান্দীপাঠ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে " ( সাহিত্যঃ কালের মাত্রা হায়াৎ মামুদ। দিব্যপ্রকাশ।ঢাকা। প্রকাশ--২০০৩।পৃঃ-- ১২)

                            কবিতার ক্ষেত্রে  মাইকেল মধুসুধন দত্ত বিহারী লাল সূচিত আধুনিক - কাব্য প্রবাহ রবীন্দ্রনাথে এসে বেগবান হয়। মধুসূধন দত্ত প্রথাগত বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে কবিতার বিষয় আঙ্গিকে রুপান্তর ঘটান   ; তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কবিতায় ভাষা প্রয়োগের পথ সুগম করেন।  রবীন্দ্রনাথ এক্ষেত্রে পরিশীলিত পথ অনুসরণ করেন।  বিহারী লাল বাংলা গীতি কবিতায় যে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেনরবীন্দ্রনাথ তাকে শীর্ষ সীমায় উন্নীত করেন। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের ' উর্বশী' কবিতার কথা বলা যেতে পারে।  গীতাঞ্জলীসোনার তরীচিত্রামানসীবলাকাকণিকা ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ রবীন্দ্রনাথের অনবদ্য সৃষ্টি।

                          রবীন্দ্রনাথ কবিতার সাবলীল মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে গিয়ে নির্মাণ করেন এক সুন্দরের ভুবন ---- যেখানে ঝর্ণাধারা থেকে অনবরত চুঁয়ে চুঁয়ে ঝরছে মুগ্ধতার বিস্ময়। প্রকৃতির রুপ- রস-স্পর্শ সবকিছু এতে একীভূত।  তাঁর সব কবিতায় প্রকৃতি এমনভাবে একাত্ন হয়ে আছে যেসেগুলোকে প্রকৃতি থেকে আলাদা করা যায় না  ; যদিও তাঁর কাব্যে বিশেষ প্রকৃতি বিষয়ক কবিতা নগণ্য।  তাঁর কবিতার কাব্যগুণ  অনন্য সাধারণএর মাঝে আছে রবীন্দ্রনাথের ঐন্দ্রজালিক প্রতিভার  দ্যুতি। তাঁর সব ধরনের কবিতাই মানব চিত্তকে নাড়া দেয়। এমনকি অলন্কারবিহীন কবিতাও। অবশ্য প্রসঙ্গে বলতে হয়তিনি ' অলন্কারমুখর কবি ননবর্ণণা ব্যঞ্জনামূলক কবি  ' কবিতায় অলন্কারের প্রয়োগ না করে সহজ- সরল ভঙ্গিতে মানবচিত্তকে আলোড়িত করার মত শক্তিমত্তা তাঁর মধ্যে লক্ষণীয়।  তাঁর কবিতার চবণ ,

হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি,   /

জগৎ আসিয়া সেথা করিছে কোলাকুলি "   /

এখানে অদৃশ্য  'কোলাকুলি'  মাঝে যে আবেগ অনুভুতি  কল্পনার বিস্তারতা অভূতপূর্ব আবার তাঁর কবিতায় উপমা উৎপ্রেক্ষার উপস্হিতি কম হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে এসবের ব্যবহারে দর্শনীয় বস্তুকে তিনি যেভাবে উপলবধি করতে চেয়েছেনতা তার কবি স্বভাবমুলক ভাবনারই ফসল। যেমন  ,

                                  "   অর্ধমগ্ন বালুচর  /

দূরে  আছে পড়ি , যেন   দীর্ঘ     জল চর  /

                          রৌদ্র  পোহাইছে  শুয়ে "    /

                   রবীন্দ্রনাথের কবিতা আমাদের অনুভবের  জানালা খুলে দেয়।  লুকোচুরি খেলে একেক সময় একেক বোধের গহীনে। কবিতায় তিনি বিচিত্ররুপে ফুটে উঠেন। কবি যখন বলেন ,

" পথের শেষ কোথায়শেষ কোথায়কী আছে শেষে  !   /

এত  কামনাএত সাধনা কোথায়  মেশে ?  "  /

তখন আমরা  জীবনের মহাসড়কে পথ চলা  পথ-শ্রান্ত  এক অচেনা কবিকে খুঁজে পাই।  কিন্তু যখন তিনি বলেনপথের শেষে নয়পথ পার্শ্বেই তাঁর দেবালয়।  অথবা 

" দ্যুলোক মধুময়মধুময় পৃথিবীর ধূলি  /

 অন্তরে নিয়েছি   আমি  তুলি  " /

তখন অন্য এক রবীন্দ্রনাথ  এসে ধরা দেয়।  জীবনবাদী রবীন্দ্রনাথ জানতেন,

" মৃত্যুকে যে এড়িয়ে চলে  মৃত্যু তারেই টানে ,  /

মৃত্যু যারা বুক পেতে লয় বাঁচতে তারাই জানে  "   /

আসলে জীবনে টিকে থাকতে হলে মৃত্যুর সাথে লড়ে বাঁচতে হবে। সে বেঁচে থাকা অবশ্যই মানুষ হিসেবে মানুষের জন্য।  বস্তুত বোধই তাঁর মাঝে জাগিয়ে তোলে মানুষের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস।  কারণে জীবন সায়াহ্নে এসে ২৯৪১ সালে ' সভ্যতার সংকটবিষয়ে জীবনের সর্বশেষ ভাষণে বলতে পেরেছিলেন ,  " মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ "

                         বাংলা গদ্যে রাজা রামমোহন রায়ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরবন্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় বিশিষ্টতার দাবিদার হলেও

রবীন্দ্রনাথ শিক্ষিত বাঙ্গালির মুখের ভাষাকে লেখ্য ভাষায় ব্যবহার  করে বাংলা গদ্যের পূর্ণতার ধারায় নতুন মাত্রা যোগ করেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গদ্যে কথা বলেন তথ্যতত্ত্ব যুক্তির আলোকে আপন আত্নচেতনার নিবিড়ে প্রবেশ করেযা পাঠক চৈতন্যকে সমগ্র সত্ত্বায় জাগাতে সহায়ক।  তাঁর গদ্যে দেশপ্রেমসমাজকল্যাণসমাজচিন্তাশিক্ষাচিন্তারাষ্ট্রচিন্তা --- সবকিছুর উপস্হিতি লক্ষ করা যায়। তাঁর গদ্যকে তার  ' কবি দৃষ্টিনিরন্তর অনুসরণ করেফলে তাঁর  গদ্য  বা প্রবন্ধে  এক ধরনের  ' কাব্যময়তা ' অনুভুত হয়।

                         রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীত সাধক। সঙ্গীতে তাঁর অবদান অতুলনীয়। তাঁর আশ্চর্য প্রাণ-শক্তিতে ভরপুর  স্বরচিত ' রবীন্দ্র সংগীত ' শুনে অবাক বিস্ময়ে কবি নিজেই বলেছেন ,  " তাই ফিরে শুনি যখন বিস্মিত হই এবং আমি নিজেকে বলিএই রইল তোমার গান  ,  যা কাল অপহরন করতে পারবে না  "   কবির এই উক্তি দম্ভোক্তি নয় কবির বিশ্বাস।  এর ভিত্তি কত সুদৃঢ়  তা বুঝা যায়  বাঙ্গালির নিত্য জীবনচর্চা অবলোকনে।

                           বাঙ্গালির নিত্যদিনের  জীবন চর্চার সাথে মিশে আছে রবীন্দ্র সঙ্গীত। রবীন্দ্র সংগীত শুধু  গান নয়সংস্কৃতিও। তিনিই একমাত্র কবিযিনি একই সাথে  দু'টি স্বাধীন দেশের জাতিয় সংগীত রচয়িতা।  রবীন্দ্র সংগীত কালোত্তীর্ণ হওয়ার  বিষয়ে  নিশ্চিত ছিলেন বলেই হয়তো কবির প্রত্যাশা , ' তার গান  বাঙ্গালীকে  গাইতেই হবে '

                      ছোটগল্পউপন্যাস, নাটকেও ছিল রবীন্দ্রনাথের সদম্ভ পদচারণা।  বাংলা সাহিত্যে তাঁকে  ছোটগল্পের পথ- প্রদর্শক বলা যেতে পারে।  পোষ্টমাস্টার , ক্ষুধিত পাষাণঅতিথিনষ্টনীড়তাসের দেশনিশীথেগুপ্তধনব্যবধান, মধ্যবর্ত্তিণী  ইত্যাদি তাঁর পাঠক নন্দিত ছোটগল্প।  উপন্যাসের মধ্যে  শেষের কবিতানৌকাডুবি ,   চোখের বালিগোরাঘরে বাইরেচার অধ্যায় ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। তবে এগুলোর মধ্যে চোখের বালি  ঘরে বাইরে শ্রেষ্ঠত্ব বিচারে সার্থক উপন্যাস। রক্তকরবী অচলায়তনচিত্রাঙ্গদাবিসর্জনচিরকুমার সভাডাকঘর  প্রভৃতি  নাটকে  রবীন্দ্রনাথের  অসামান্য  মৌলিকত্ব দৃষ্ট হয়। চণ্ডালিকাশ্যামা  নৃত্যনাট্য  তাঁর অপূর্ব  সৃষ্টি।

                             রবীন্দ্রনাথ একজন প্রতিভাধর চিত্রশিল্পীও। তাঁর মূর্ত-বিমূর্ত শিল্পকর্ম  কিন্তু তাঁর  কবি সত্তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তিনি চিত্রকর্মে যা বলেছেনকবিতায় তা বলেন নি। কবি চিত্রী রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ আলাদা ধাঁচের।  একই সত্তার এই দুই ভিন্ন প্রকাশ রবীন্দ্রনাথের বেলায় সম্ভব হয়েছে।

                         বিশ্ব পরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর নানাঘাটে তরী ভিড়িয়েছেননানা  জায়গায় গেছেন। নতুন অভিঞ্জতানতুন উপলব্ধি সঞ্চয়  করেছেন। কিন্তু তার অঙ্গীকার ছিল তাঁর জন্মভূমির কাছে। তাঁর সব কর্ম-আনন্দের পেছনে ছিল তার স্বদেশ চেতনা।  স্বদেশ- মানুষ-প্রকৃতি থেকে কবির কাব্য-প্রবাহ এগিয়েছে বিশ্বানুভবে। তাঁর ভ্রমণ কাহিনিতে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে বিশ্ব-চেতনাইতিহাস - চেতনামানবপ্রীতি  রম্যকথার উজ্বল  দীপ্তি। অতলান্ত অন্তর্দৃষ্টির কারণে তিনি বাংলা ভাষা সাহিত্যের স্বর্ণভাণ্ডারের প্রতি  বিশ্বের সশ্রদ্ধ ষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। একটি আঞ্চলিক সাহিত্যকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্ব- সাহিত্যের অঙ্গনে।   মূলত তার  হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য বিশ্বের সব সমৃদ্ধ সাহিত্যের সমান্তরালে পৌঁছে  যায়। তাঁর ' গীতাঞ্জলী ' (ইংরেজীতে অনুদিতকাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯১৩ সালে তিনি পান সাহিত্যের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার  ' নোবেল পুরস্কার '  গীতাঞ্জলী সম্পর্কে রবীন্দ্র-গবেষক আবু সায়ীদ আইয়ুবের উপলব্ধি     " গীতাঞ্জলী পড়বার সময় সবিস্ময়ে অনুভব করিআমরা যেন দুই জগতের মধ্যবর্তী সীমান্ত রেখা ধরে হাঁটছি। একটু এদিকে সরলে পা পড়ে সত্যলোকের মাটিতেএকটু ওদিক সরলে বাতাসে পাই অমৃতলোকের গন্ধ "

                              রবীন্দ্র জীবন সাহিত্য প্রবল প্রতিভাদীপ্ত  হওয়া সত্বেও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কুৎসাও কিন্তু কম হয় নি।  সজনীকান্ত দাশ তার সম্পাদিত ' শনিবারের চিঠি' তে  কবি নজরুলের মত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকেও আক্রমণ করতেন। ঐতিহাসিক নলিনী কান্ত ভট্রশালী ' ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ ' স্মৃতিকথায় জানান,  " দলে মিলিয়া আমিও রবীন্দ্র- নিন্দুক  সম্প্রদায়ের একজন হইয়া দাঁড়াইয়াছিলাম  "  কবি জীবনান্দ দাশের মতে,  " রবীন্দ্রনাথের কবিতার চর্চা আধুনিক বাঙ্গালি কবিদের তেমন মন যোগাত না "  ; যদিও অন্যত্র তিনি বলেছেন,  " বৈষ্ণব  যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমাদের  কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি হচ্ছেন  রবীন্দ্রনাথ "  কবি ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়  কোলকাতার ' আনন্দবাজার  ' পত্রিকায় ' রবীন্দ্র মাফিয়া ' শীর্ষক ফিচারে (২৭ মে ১৯৯৫ সালে  প্রকাশিতলিখেন ,  " রবীন্দ্র সঙ্গীত মডার্ন জেনারেশনের কাছে বোরিং। একই সুরকোন রকমফের নেই। বড্ড স্লো। আধুনিক জীবনের গতির সঙ্গে যায় না  " প্রচলিত আছে,   পূর্ব  বাংলায় রবীন্দ্র প্রভাব কাটিয়ে উঠতে "পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্ণর মোনায়েম খান  নাকি একবার বুদ্ধিজীবিদের ' রবীন্দ্র সংগীতলেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারপরও রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথই। নানা  বাক- বিতণ্ডা সত্ত্বেও তার সাহিত্য আজো আবেদনময়ী প্রাসঙ্গিক।

                            দীর্ঘ ছয়   দশকের সৃষ্টিশীল জীবনে কবি নিজে যা লিখেছেনআমার ধারণা তাঁর ' জীবন সাহিত্য ' সম্পর্কে অন্যরা লিখেছেন তার চে' বেশী।  আমার মনে হয়রবীন্দ্রনাথের  কালজয়ী সাহিত্য-কর্মের মাঝে এমন উপাদান আছে , যা অন্যদের রবীন্দ্র-চর্চা করতে অনুপ্রাণিত করে। প্রসঙ্গে অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ এর একটি বক্তব্য তাৎপর্যময় মনে হয়েছে,  " কারণ আশি বছরের জীবনে ( ১৮৬১--১৯৪১) রবীন্দ্র নাথ তাঁর ভাষা- শিল্পনৃত্য- সঙ্গীতচিত্রকলামঞ্চভাবনাসমাজকল্যাণবিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা,   জনশিক্ষারাজনৈতিক আদর্শ ইত্যাদি অজস্র কর্ম- প্রবাহের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালি জাতি সংস্কৃতিকে যেভাবে নবরুপ দান করেছেনপৃথিবীর যেকোন দেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে তা কয়েক' বছরের অগ্রগতির সঙ্গে তুলনীয়। ইংলণ্ডের যেমন শেক্সপিয়র, জার্মানির যেমন গ্যেটেরাশিয়ার যেমন পুশকিনবাঙ্গালির তেমনি রবীন্দ্রনাথ ---- এতটুকু বললে কিছুই বলা হলো নাপ্রকৃতপক্ষে বাঙ্গালির কাছে রবীন্দ্রনাথ আরো অনেক সর্বব্যাপীআরো বেশী সর্বগ্রাসী। সভ্যতার কোন্ স্তরে কোন্ জাতি আছে তার সূচক (INDEX)  যদি হয় সংস্কৃতিতাহলে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গ  সংস্কৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয় " ( বাংলাদেশে রবীন্দ্র চর্চা -খণ্ডিত জরিপ--(প্রবন্ধ)---হায়াৎ মামুদ---কালের খেয়া। দৈনিক  সমকাল  সাময়িকী -৪৪। মে ২০০৬)

                                    রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীল জীবন সাহিত্যের নানা মাধ্যমে পরিব্যাপ্ত। তাঁর সৃষ্টিশীলতার বহুমাত্রিকতা বিস্তৃতি এত ব্যাপক ছিল যেসৃষ্টির প্রসব বেদনা কাতর  কবি এক সময়  নিজেকে নিজে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন ,  " আমি বাস্তবিক ভেবে পাইনে  কোনটা আমার আসল কাজ "  সঙ্গত কারণে রবীন্দ্রনাথ আজ নানাজনের কাছে নানা বর্ণে  বর্ণিল , নানাভাবে প্রতিভাত। তার সাহিত্য যেমন ব্যাপকতেমনি রহস্যময়।  তিনি আমাদের চৈতন্যেচিন্তায়সংস্কারেমননে মিশে আছেন।

                                 তাঁর মাঝে বহুমাত্রিক প্রতিভার সমন্বয় ঘটলেও তিনি নিজেকে পরিচয় করতে চেয়েছেন  'কবি' হিসেবে। শেষ বয়সে বলেছিলেনতাঁর ' একটিমাত্র পরিচয় ' আছেতিনি  ' কবিমাত্র ' কিন্তু মহাকালের প্রবহমান ধারায় তিনি শুধু কবিমাত্র ননতিনি আজ ' কবিগুরু',  ' বিশ্বকবি'


 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন