মঙ্গলবার, ২৫ জুন, ২০২৪

ঊর্মিলা চক্রবর্তী-র ধারাবাহিক গদ্য : "এসেছো কবিতা"

এসেছো কবিতা

কিন্তু এখন তো অনেকেই জানেন যে বেশি বয়সে হলেও একদিন সেই সাহস আমার যুগিয়েছিল। এবার তবে সেই সাহস পাবার গল্পটুকুই ফাঁদতে বসি। তখন কলেজে পড়াই, আমার ছেলে ছোট, সবেমাত্র আড়াই বছরের, এমনসময় এক সহকর্মী বন্ধু হঠাৎ মাথায় ভূত চাপিয়ে দিলেন, পি,এইচ,ডি করতে হবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজি সাহিত্যে  প্রথম শ্রেণীতে এম, পাশ করার পর এক শিক্ষক আমাকে রিসার্চ ফেলোশিপ নিয়ে গবেষণা করতে বলেছিলেন, কিন্তু আমার তো ততদিনে বিয়ে হয়ে গেছে, আমার স্বামী কলকাতা গিয়ে গবেষণা করতে দেননি। এতদিনে সেই ইচ্ছেটা পূরণ করার কথা আবার মনে হল। এবারও স্বামীর প্রচন্ড আপত্তি এবং অসহযোগিতা ছিল, কিন্তু এতদিনে আমি অনেক বেশি জেদ আয়ত্ত করতে পেরেছি। তবু সময় আর সুযোগ, দুটোরই একান্ত অভাব। কার কাছে গবেষণা করব সেটাই প্রথম সমস্যা। দ্বিতীয় নিশ্চয়ই সময়। যাই হোক একদিন সাহসে ভর করে সোজা সম্পূর্ণ অচেনা এক খ্যাতনামা অধ্যাপকের বাড়িতে গিয়ে হানা দিলাম। নাম শুনলে সকলেই তাঁকে চিনবেন। তিনি স্বনামধন্য প্রয়াত শ্রীমতী যশোধরা বাগচী। তিনি তো অবাক। চেনেন না, শোনেন না,  কোনও পরিচয়পত্র নেই, একেবারে সরাসরি তাঁর কাছে কাজ করবার প্রস্তাব! স্বাভাবিকভাবেই তিনি আমাকে পরিষ্কার বলে দিলেন যে তিনি ভীষণ ব্যস্ত, আমাকে কাজ করানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। অচেনা মেয়ে, এতদূরে শিলিগুড়িতে থাকে, ফুলটাইম চাকরি, তার উপর আড়াই বছরের বাচ্চা ছেলে। সে কাজ করবেই বা কি করে, আর তাকে সময় দেবেন কেন তাঁর মতো মানুষ? কিন্তু আমি তো আহ্লাদ পেয়ে মানুষ নই, স্রোতের বিরুদ্ধে চলেই আমার অভ্যেস, আর শাশুড়ি যতই ভালোবাসুন, স্বামীর কাছেও আমি কোনও কাজে সহযোগিতা পাই নি। তাই আমাকে অত সহজে তো নিরস্ত করা যায় না। আমি বললাম, আমি আর কিছু চাইনা, আপনি কেবল আমার সঙ্গে পাঁচমিনিট কথা বলুন। মনে আছে তখন আমার পরিকল্পনা ছিল ডি,এইচ,লরেন্সের কবিতার আঙ্গিকের উপর কাজ করব। তাই নিয়েই কথা বলা শুরু হল। কিছু সময় বাদে উনি একবার বলেছিলেন যে কোনও বিষয়ের উপর তাৎক্ষণিক কিছু লিখতে বলবেন, যাতে উনি বুঝতে পারেন আমার প্রকাশক্ষমতা কতখানি। কিন্তু সেপর্যন্তও যেতে হয়নি। কথাতেই কাজ হয়েছিল। কিছুক্ষণ কথা বলার পরে উনি শুধু বললেন যে উনি ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরাজি উপন্যাস নিয়ে কাজ করান, তাই কবিতার আঙ্গিকের উপর কাজ করানো ওঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তখন বুঝলাম কেল্লা ফতে। আজ বুঝি উনি সেদিন কতখানি মহানুভবতার কাজ করেছিলেন। মজার কথা এই যে পরে যশোধরাদিও বলেছিলেন যে সম্পূর্ণ অচেনা একটি মেয়ে, কোথাকার কোন শিলিগুড়ি কলেজে পড়ায়, সে সরাসরি বাড়িতে এসে পাকড়াও করে বলল আপনার কাছে কাজ করব, শুধু অদ্ভুত কেন, রীতিমতো এক অসম্ভব ঘটনা। উনি নাকি একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছিলেন। কিন্তু আমার কাজ তো হয়ে গেল, আর আমাকে পায় কে?


কিন্তু কাজ করি তবে কার উপর? কবিতা লেখার সাহস তখনও যোগায়নি, কিন্তু কবিতার উপর ছাড়া অন্য কোনও কিছু নিয়ে কাজ করার কথাও ভাবিনি। লরেন্সের কবিতা নিয়ে একটু আধটু পড়াশুনা করছিলাম তখন, তাই তাঁর কবিতার আঙ্গিক নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যশোধরাদি তো কবিতার আঙ্গিক নিয়ে কাজ করাতে রাজি নন। অন্য কোনও কাজের কথা তখনই ভাবতে হল। ভাবলাম আর কোনও কবির উপরে কাজ করব, তবে আঙ্গিক নিয়ে নয়। আমার চিরদিনের প্রিয় কবি কীটস আর এলিয়ট, কিন্তু কাজ করতে গেলে একটু নতুন কিছু ভাবতে চাইছিলাম। পরে এমিলি ডিকিনসন আমার অত্যন্ত প্রিয় কবিদের মধ্যে একজন হয়েছেন, কিন্তু তখনও তো তাঁকে ভালো করে চিনি না কারণ আমেরিকান কবিতার জগৎ তখনও খুব একটা চেনা নয়। আমাদের ছাত্রজীবনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমেরিকান সাহিত্য পড়ানো হত না।  উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়ে তবেই সেই সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়। তবু কার উপর কাজ করব তাঁর নাম মনে এসে গেল সহজেই। কিছুদিন আগেই আমি একটা সংকলনে বিশ শতকের আমেরিকান কবি সিলভিয়া প্ল্যাথের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তাঁর সম্বন্ধে তখনও কিছুই জানিনা, কিন্তু কবিতা পড়ে মনে হয়েছিল যে তিনি নিঃসন্দেহে একজন বড় কবি। তাঁর সম্বন্ধে বা আমেরিকান কবিতা সম্বন্ধে কিছু না জেনেই যশোধরাদিকে চট করে নামটাই বলে দিলাম। একটুও ভাবলাম না যে গবেষণা করতে হলে কি বিশাল এক অচেনা সাহিত্যজগতের মধ্যে প্রবেশ করতে হবে। উনিও আমারই মতো বিশেষ কিছু না জেনেই সামান্য কিছু কবিতাপাঠের উপর নির্ভর করে খুশি হয়ে তাঁকে পছন্দ করে ফেললেন, কিন্তু বললেন যে কাজটা মোটামুটি আমাকেই করতে হবে কারণ তিনি নিজে কবিতার লোক নন। ব্যস, হয়ে গেল। সেখানেই যেন আমার আবার এক নতুন জীবনের শুরু। যশোধরাদির মতো মানুষের কাছে পেয়েছিলাম শ্রেষ্ঠ পথনির্দেশ, আর বিশেষ করে উনি কবিতার লোক নন বলেই হয়ত আমার নিজের কাজে ছিল সম্পূর্ণ মুক্তি। আমারই মতোন যশোধরাদি কবিতার কোনও সীমিত সংজ্ঞায় বিশ্বাস করতেন না, আর কবিতাকে এক শ্রেষ্ঠস্তরের শিপকর্ম হিসেবেই দেখতেন, তাই কাজ করবার সময় তাঁর সঙ্গে কোনও মতবিরোধ হয়নি কোনওদিন। 


এখানে তাঁর কথা আরও একটু বলতে ইচ্ছে করছে।  কেবল গবেষণার ক্ষেত্রে নয়, এরপর যতদিন যশোধরাদি  ছিলেন তিনি সব ব্যাপারে আমাকে সাহস যুগিয়েছেন, সববিষয়ে সাহায্য করেছেন। আমি যাতে জীবনে দাঁড়াতে পারি  তার জন্য তাঁর এতটাই চিন্তা ছিল যে আমি অবাক হয়ে যেতাম। তাঁর কাছে কাজ শুরু করবার পর থেকে সর্বক্ষেত্রে তিনিই আমাকে চালনা করেছেন। তাঁর নিজের দুটি মেয়ে থাকা সত্বেও এবং আমার চেয়ে বয়সে  তেমন কিছু বড় না হলেও তিনি আমাকে প্রায় কন্যাস্নেহ দিয়েছেন অকৃপণভাবে। উনি চলে যাবার আগে পর্যন্ত আমার আর কোনওদিন একা মনে হয়নি। তিনি চলে গিয়ে যেন আমার মাথার উপর থেকে মমতার ছায়াটুকুই হারিয়ে গেছে। আজ সর্বত্র এক বিপুল শূন্যতা।  আমার চিন্তা, আমার অনুভূতি কার কাছে প্রকাশ করব? তাঁর অভাব আমার জীবনে কোনওদিন পূরণ হবে না।


যশোধরাদির কাছে কাজ করার সময় দারুণ এক মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলাম। এই মুক্তিই বুঝি আমার কাব্যপথের পাথেয় ছিল। সিলভিয়া প্ল্যাথের কবিতা চিনতে চেয়ে, বুঝতে চেয়ে নিজে নিজে রাস্তা খুঁজে খুঁজে কবিতার যে গভীরে আমি প্রবেশ করলাম সেখানে আগে তো কখনও যাবার সুযোগ হয়নি। আজন্ম কবিতাকে ভালোবেসেছি। কত দেশের কত কবিতা পড়ে জেনেছি তার নানা রূপ, নানা বিষয়, নানা ভঙ্গিমা, নানা আঙ্গিক। কত ভেবেছি যে কবিতাকে কোনও ছোট গন্ডিতে বাঁধা যায় না, তার ব্যাপ্তি তার গভীরতার মতোই অমেয়। তবু এতদিন যেন কবিতাকে শুধু বাইরে থেকে চিনতাম, মুগ্ধ হতাম তার বহিরবয়বের সৌন্দর্যে। এবার তাকে ভিতর থেকে চিনতে শুরু করলাম, যেন অন্ততঃ উঁকিঝুঁকি মারতে পা্রলাম তার অন্দরমহলে। আর তখনই কি যেন একটা ঘটে গেল আমার ভেতরে। আমি কোনওদিন বুঝিনি যে ঠিক কি হল। হয়তো মনে হল, তাকে তো চেনা গেল, তবে তাকে ধরা যাবেনা কেন? কোন মন্ত্রবলে আমার মধ্যে কোথায় এক স্ল্যুস গেট খুলে গেল, ঝর্ণাধারার মতো উৎসারিত হতে থাকল কবিতার পর কবিতা। মনে আছে মাঝেমাঝেই এমনও হত যে গভীর রাত্রে কবিতার কোনও পংক্তি মনে এলে বিছানা থেকে উঠে খাতায় লিখে রেখেছি, কারণ পরদিন সকাল পর্যন্ত তো সেটা আর মনে থাকবে না। অত বেশি বয়সে নতুন করে কবিতার মতো কঠিন শিল্প আয়ত্ত করবার চেষ্টা যে কি মর্মন্তুদ হতে পারে তা যাঁরা তা করেন নি হয়তো বুঝবেন না। এছাড়া আমার বিষয় ইংরেজি বলে বাংলা লেখার অভ্যাসও বহুদিন ছিল না।  কিছুতেই তো শব্দবন্ধ পছন্দমতো হয় না, ছবিগুলো মনের মতো করে আঁকতে পারিনা, কি যে বলতে চাই তাই ধরতে পারি না। ঘন্টার পর ঘন্টা কেবল যুদ্ধ। এছাড়া বিশেষ করে মেয়েদের ঝামেলা তো অনেক বেশি। সংসারের কাজে তো ছুটি নেই, তাই ছমাস গবেষণার কাজ বন্ধ রেখে চলল শুধু কবিতার পিছনে ছোটা। কাজ বন্ধ রেখে কবিতা লেখার কথা যশোধরাদিকে বলতে সাহস পাইনি, তাই কাজে গাফিলতির জন্য জুটল বকুনি। এর মধ্যে আবার বাড়িতে  সমস্যা। এক গবেষণায় রক্ষা নেই তার উপর আবার কবিতার উপদ্রব। সে যে কি গেল গেল রব! কবিতা অনেকেই দুচারদিন লিখে ছেড়ে দেন। অন্ততঃ এতটা বেশি বয়স পর্যন্ত লেখেন না। আমাকে বহুদিন আগে থেকেই অনেক পরিচিত মানুষ জিজ্ঞেস করছেন আমি এখনও লিখি কি না। অনেকেরই হয়তো মনে হয় যে এক সাময়িক ঝোঁক, সময় পূর্ণ হলে কেটে যাবে। কিন্তু আমাকে বোধহয় এই নেশা পেয়ে বসেছে। আজও তাই আমি লিখে চলেছি। 


কবি তো একান্ত একা এক ভিন্নগ্রহের মানুষ নন, তিনি সামাজিক জীব। অনেক মানুষের সঙ্গেই তাঁর বাস। তিনি যা দেখেন, যা শোনেন, যে পৃথিবীতে বাস করেন তাতে তো বিশেষত্ব কিছু নেই, আর সেখান থেকেই তো উঠে আসে কবিতা। কত অজস্র মানুষ সেখানে তাঁর সঙ্গী। জীবনের সঙ্গে যে কবিতার যোগ নেই, যা কেবল কবির কল্পলোকের ফসল, তা শ্রেষ্ঠ কবিতার মর্যাদা পায়নি কোনওদিন। তাকে চিরদিন পলায়নবাদী কবিতা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সব মানুষই তো এই একই মাটির পৃথিবীতে বাস করেন, তবু সবাই লেখেন না। কবিতা লেখার মূল কথা কবির নিজস্ব বোধ, নিজস্ব দেখার চোখ আর তার সঙ্গে নিজের শিল্পবোধ, চেষ্টা আর পরিশ্রম। সেসব যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁদের সবার ক্ষেত্রেই একই কথা। কতটুকু কি লিখতে পারি তা জানিনা, কেবল এইটুকু জানি যে না লিখে থাকতে পারিনা।

 


সমাপ্ত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন