কবি সোনালি বেগম
আশির দশক থেকেই কবিতা লেখা শুরু। নব্বই দশকের কবি সোনালি বেগম। জন্ম ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে। ১৯৯১ সাল থেকে নিউ দিল্লিতে এবং বর্তমানে গাজিয়াবাদে থাকেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লুৎফান্নেসা বেগম নামে সুপরিচিত। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে এম.এসসি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিয়ন ক্রিশ্চিয়ান ট্রেনিং কলেজ থেকে বি.এড। মূলত কবি, গদ্য ও গল্পও লেখেন। বাংলা ভাষার প্রায় সমস্ত উৎকৃষ্ট পত্রিকাতেই লিখেছেন। এবং কয়েকটি উচ্চমানের সংকলনে। কিছু সাহিত্য-সম্মাননা পেয়েছেন। এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৮টি (ক্লাভিকর্ড ২০০২, জেনেসিস ২০০৫, পতঙ্গবাজি ২০০৬, অস্তিত্ব ২০০৭, মোম ২০০৮, ট্যাটু ডিজাইন ২০০৯, সুর ২০১০, ক্ষেত্র ২০১১, হান্টিং ট্রিপ ২০১২, সাইকো ২০১৩, পরাবাস্তব চাঁদ ২০১৩, কথোপকথন ২০১৪, বালিঘড়ি ২০১৫, হলরেখা ২০১৬, মেঘমল্লার ২০১৭, বুলফাইট ২০১৮, ক্রিস্টাল অপারেশন ২০১৯, রসধারা ২০২০)।
অভিযান পাবলিশার্স থেকে প্রথম ১২টি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে মেগা কালেকশন ‘কবিতা সংগ্রহ’ ২০১৫।
ই-বুক কাব্যগ্রন্থ ‘বৃষ্টিস্নাত জিরাফ’ ২০১৩ এবং ঝুরোগল্প সংকলন ‘পোস্টমর্টেম’ ২০১৮। ভারত বাংলাদেশসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁর গুণগ্রাহীর সংখ্যা কিছু কম নয়।
২০২০ সাল থেকে ‘রঙিন ক্যানভাস’ ওয়েবজিন-এর যুগ্ম সম্পাদক সোনালি বেগম (সম্পাদক রোশনি ইসলাম)।
বিদগ্ধ সমালোচকবৃন্দ সোনালি বেগমের লেখনীর মধ্যে সেই নারীবাদ পেয়েছেন যা পুরুষ ও নারীর সমন্বয়বাদী চেতনাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। যা সুস্থ সমাজের এগিয়ে নিয়ে যাওয়াকে সুচিহ্নিত করে।
খড়কুটো
পরিশ্রমী যন্ত্রমানবী ঘুরে বেড়ায়। অগ্নিদগ্ধ
নদীগর্ভ রাজপথ অবলম্বন করে। কঠোর
নিয়ন্ত্রণে নৃপতিশাসন। লাগামহীন ঝড় ও
গর্জন। ভুলত্রুটির দুঃখপ্রকাশ কখনো কখনো
মঠজীবন আঁকড়ে ধরতে চায়। নিঃস্ব হাত।
পণহীন মিলন-অনুষ্ঠানে চালাক পাথর-হৃদয়
লাভ-ক্ষতির হিসেব কষে। অর্থনৈতিক
স্বাধীনতার পাঁচালি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত পৃষ্ঠায়
আকাশ আঁকতে চায়।
লুঠের সামগ্রী ঘিরে প্রজ্বলিত প্রদীপ
হাঁসফাঁস দামি শিকার শিকারির জালে
আত্মগোপন করে। সপাং সপাং চাবুকের
শব্দ কিছুটা বেমানান ঢংয়ে স্থান করে
নিলে মমতার খড়কুটো মুখে কপোত
কপোতী উড়ে যায় —
সুন্দরবন
এক জোড়া ঘুঘু জল-এর নল ছুঁয়ে ছুঁয়ে
উত্তপ্ত বিন্দু খুঁজছে।
উর্দু কবি মির্জা গালিব-এর গজল, পারসিয়ান
কবি রুমি, হাফিজ এবং ওমর খৈয়াম — পড়ে
পড়ে যৌবনপ্রাপ্ত মানসিক ব্যায়াম।
মার্কারি ধীরে ধীরে উপরের দিকেই উঠছে…
মধুসংগ্রহকারী-র দল পাখিরালা নদী-তীরে
এগিয়ে চলেছে গহন সুন্দরবন
নতজানু
সিরিয়াল ধামাকা। দাউ দাউ আগুন।
ছন্নছাড়া মোটরবাইক, বাস, হাত পা
শরীরের খন্ড খন্ড টুকরো। হাসপাতাল
ভরে ওঠে ঘায়েল মানুষের আর্তনাদ।
বাতাসে বারুদপোড়া মাংসের গন্ধ।
এমন ছবি আঁকতে বসে কাঁপে হাত
বিবশ নার্ভতন্তু।
মুদ্রিত নয়ন নতজানু প্রার্থনা সভাঘর
অণুপরমাণুর জটিল কর্মকান্ড আরও
একটু স্পষ্ট চিত্রে আত্মসমালোচনা মুখর…
অকুণ্ঠ প্রেমনিবেদন শ্রদ্ধা ভালোবাসাজ্ঞাপন
উদ্বেলিত অশ্রুবিহ্বল মনুষ্য-পরিবার।
বৃষ্টির তোড়
নেপাল-ইউপি সীমায় লক্ষীমপুর খিরি জেলায়
শারদা নদীর জলস্তর রেড-পয়েন্ট পার করে
তবাহি করতে ছুটছে। বিখ্যাত দুধওয়া ন্যাশনাল
পার্ক — বিপন্ন অসংখ্য পশুপাখি এবং সংলগ্ন গ্রাম।
দিল্লির রিংরোড বাইপাস এবং মিলেনিয়ম পার্কের
কাছে ট্রাফিক জ্যাম — হাঁসফাঁস বৃষ্টির তোড় আর
মোবাইল রিং-টোন ভেসে যায়…
তোমার জন্য
যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে এসো, ধরো হাত
শুধু তোমার জন্য এনে দেবো শান্তিজল
পাহাড়চুড়োয় বিশুদ্ধ বরফ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা
পাখির পালকে ঝরে বিষাদহীন গান।
জলরঙের ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে নির্বাসন কখনও —
শূন্য অনুভবে লীন মুদ্রিত চোখ স্মৃতির পথ ধরে…
বিনাশহীন মমতায় জড়িয়ে যায় বিশ্বাসী হাওয়া
ফিরে দেখা কিছু মুহূর্ত জন্ম-মৃত্যু-ক্ষণ।
কোহিনুর হিরের ঝলমল আলোর ঝলক
নিয়ে আসে দুঃখদুর্দশা যুদ্ধের দামামা।
ফিরে চলো, স্বর্গসুখ নয়, মাটির শস্যদানার কাছে
অতি সাহসে বানাই পোট্রেট এই ভ্রমরগুঞ্জিত সকালে।
নদীর বাঁক
সময়কে কিড্ন্যাপ করে জীবন সমাপ্ত
হওয়ার আগে একবার খাদান-শ্রমিক হতে
চাই। দুপুরের রোদ চোলাই-গ্রহণে ভুলে
যাই সেইসব হাসিমজা ধূর্তচালাকি ধর্ষণ —
জমানা বদলে যায়।
এখন পারফিউম নয়, মহুয়ার গন্ধে হালকা
পালকের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে মাটি বালি
নদীর বাঁক…
এই রাত
শীত কত সাহস জানে। হিনডন নদী এক ডিগ্রি
তাপমাত্রায় পড়ে আছে। স্থির ডালহ্রদ জমে বরফ।
ঘরের কোণে উত্তপ্ত রুম-হিটার। ঘন কুয়াশার চাদর।
অস্থির নিথর ট্রেনের কামরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
নাইট শেলটারে মানুষগুলো রাত কাটাচ্ছে,
কম্বল গরম হচ্ছে
দিল্লির রাস্তায় গহন শীতের রাতে নারীটির
চোখে জল জমে যাচ্ছে —
অপেক্ষার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পুরুষটির কণ্ঠস্বর
বেশ তীব্র ও কর্কশ…
না, আজ আর শেলটার নয়,
হাতে কুঠার কিংবা ক্যারাটে দেখবে ও
দেখাবে এই রাত
হাঁটতে হবে
দ্বন্দ্বের পটভূমি নির্মাণ ক্রোধী বিদ্রোহ
আঁধার পেরিয়ে জেনে নিতে হচ্ছে কব্জা কৌশল
স্বতন্ত্র বিচরণ জাগে জন্ম উপকথা —
স্বচ্ছন্দ মুক্তির পরশে যুদ্ধ অনিবার্য
ডাইনি তুই, বঞ্চিত হবি সুগন্ধ পৃথিবীর হাওয়ায়
স্বাধীন কণ্ঠ পেতে হাঁটতে হবে শতসহস্রকাল।
অর্জনযোগ্য দমন ক্ষমতায় উদ্ধৃতি উপাখ্যান
জোরকদমে লিঙ্গবৈষম্যের লড়াই অনুবাদ।
নির্ভরতার আলোকে কাঁপে গহনপাতার ঝোপ
অর্থনৈতিক সামাজিক অধিকারে সিক্ত হৃদয়গাথা
অপলক
হাঁটুমুড়ে বসে মেঝের উপর
এককাপ কফি ভাগ করে ধোঁয়া-ধোয়াই।
অসংখ্য ঘর শরীরজুড়ে আলপিন
দৃঢ় গাছের পাতায় আঁকা উপত্যকা।
ঝোপঝাড় ঘুরে ঘুরে হাজার বছর হয়তো
শস্যদানা ইঁদুরশাবক আর অসংখ্য গর্ত।
লিউকোমিয়া নিয়ে আর কত দিন!
হেসে উঠছে রাত, দিন ছোটো হয়ে আসছে
অপলক দূরত্বে দ্রুতগামী অশ্ব —
মৃত্যু খুব সুন্দর।
ধূমকেতু, আলিঙ্গন
ঝড়ের মধ্যে উড়ে যাচ্ছে রঙিন মেঘ।
রাঙা মাটির দেশ নুড়িপাথর আর
প্রবাহিত নদী, নীল ছায়ার মতো সরে
যেতে থাকে বাতাসের গতি।
ঢেউ ফিরে যায় সমুদ্রের বুকে। ধূমকেতু-ধুলোয়
আমাদের আদিম আত্মীয়তা
প্রাচীনতম আলিঙ্গন ভাসতে থাকে।
Khub bhalo.
উত্তরমুছুন"ধূমকেতু-ধুলোয় / আমাদের আদিম আত্মীয়তা /
উত্তরমুছুনপ্রাচীনতম আলিঙ্গন ভাসতে থাকে।"
দারুণ সব কবিতা!
সুন্দর লিখেছেন কবিতাগুলো। ভাষা ভাবনার সঙ্গে এগিয়েছে। অভিনন্দন জানাই।
উত্তরমুছুননিটোল কবিতা। প্রত্যেকটি কবিতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে গেলাম। শব্দ চাতুরী আর নতুন নতুন শব্দের কাজ অসাধারণ। প্রতিটি কবিতা দারুণ সুন্দর। নতুন স্বাদের কবিতা উপহার দেওয়ার জন্য কবিকে ধন্যবাদ জানাই। হার্দিক শুভেচ্ছা প্রিয় কবির সমীপে।
উত্তরমুছুন'খড়কুটো', 'সুন্দরবন', 'নতজানু', 'বৃষ্টির তোড়', 'তোমার জন্য', 'নদীর বাঁক', 'এই রাত', 'হাঁটতে হবে', 'অপলক', 'ধূমকেতু, আলিঙ্গন', প্রত্যেক কবিতা স্বতন্ত্র স্বাক্ষর রেখে গেল। 🙏
উত্তরমুছুন