মঙ্গলবার, ২৫ জুন, ২০২৪

রঙিন ক্যানভাস ।। বর্ষ ৪ ।। সংখ্যা ৪২-৪৪ (এপ্রিল-জুন সংখ্যা) ।। এপ্রিল-জুন সংখ্যার প্রচ্ছদ {২৫শে বৈশাখ সংখ্যা}


 

সম্পূর্ণ সূচি ১ (বর্ষ ৪ ।। সংখ্যা ৪২-৪৪) [এপ্রিল-জুন সংখ্যা] {২৫শে বৈশাখ সংখ্যা}


 

সম্পূর্ণ সূচি ২ (বর্ষ ৪ ।। সংখ্যা ৪২-৪৪) [এপ্রিল-জুন সংখ্যা] {২৫শে বৈশাখ সংখ্যা}


 

সম্পূর্ণ সূচি ৩ (বর্ষ ৪ ।। সংখ্যা ৪২-৪৪) [এপ্রিল-জুন সংখ্যা] {২৫শে বৈশাখ সংখ্যা}

 


সম্পাদকের নিবেদন

সম্পাদকের নিবেদন

প্রাচ্য তথা ভারতীয় চিত্রকলার বিশেষত্বই হচ্ছে রেখা, যার কাছে অনেক ক্ষেত্রে রঙ গৌণ। রেখার প্রধান্যই বেশি, তার কাছে মডলিং, শেডিং, পারস্পেক্‌টিভ, রঙ সবই গৌণ হয়ে যায় কখনও কখনও। আমাদের মতো গরমের দেশে প্রখর সূর্যের আলো ছবির উপর পড়লে রঙ খুব নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। তখন পড়ে থাকে শুধু বাউন্ডারি অর্থাৎ সীমারেখা। যেমন মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গবাদ জেলায়ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটঅজন্তার গুহার ছবি ভাস্কর্যের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। অজন্তার ছবির প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে তার রেখার দক্ষতা। ভারতীয় শিল্পী মডলিং, পারস্পেকটিভ খুব ভালোভাবে শিক্ষা করেছিলেনতার প্রমাণ মেলে ভারতীয় ভাস্কর্যে, যার উপরে সূর্যের আলো পড়ে বিভিন্ন রঙের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়অজন্তার গুহার ভেতরে ছবি দেখতে গেলে বাতির সাহায্যেই দেখতে হবে, সেখানেই শুধু অজন্তার চিত্রকর মডলিং বা পারস্পেকটিভ অর্থাৎ দূর-কাছের আভাস এনেছেন রঙ গাঢ়-ফিকে করে। কিন্তু গুহার বাইরে যেখানে সূর্যের আলোয় ছবি দেখতে হবে, সেখানে মডলিং বা পারস্পেকটিভ নেই, আছে শুধু রঙিন নকশা। অজন্তা-শিল্পীর কালজয়ী ছবির উৎকর্ষতা তাঁদের নিজস্ব প্রজ্ঞার উপর প্রতিষ্ঠিত। চারুশাস্ত্রের বহুমুখী দৃষ্টি তথা মাল্টিপ্‌ল্‌ ভিশন টেকনিকের সঙ্গে অজন্তা-শিল্পীর টেকনিকের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। কথা অনায়াসে বলা যায়, অজন্তা-শিল্পীর সৃষ্টি হচ্ছে বস্তুকে নিজের মত করে দেখার অভিজ্ঞতার ফল।


অবশেষে এই নাতিদীর্ঘ আলোচনার ইতি টেনে বলা যায়অজন্তাচিত্রে যে ধরণের কম্পোজিশন পারস্পেকটিভ আছে, সেটাই ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে গেছে। 


প্রিয় লেখক এবং পাঠকরঙিন ক্যানভাস২৫শে বৈশাখ সংখ্যা প্রকাশিত হল। সকলকে শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানাই। ভালো থাকুন সবাই। 


রোশনি ইসলাম

সোনালি বেগম

ঋতম্ মুখোপাধ্যায়-এর ধারাবাহিক গদ্য : "কবিতার বাতায়ন"

রাজা রানীথেকেতপতীএবং এলিয়ট 


রাজা রানী আমার অল্প বয়সের রচনা, সেই আমার প্রথম নাটক লেখার চেষ্টা। সুমিত্রা বিক্রমের সম্বন্ধের মধ্যে একটি বিরোধ আছেসুমিত্রার মৃত্যুতে সেই বিরোধের সমাধা হয়। বিক্রমের যে প্রচণ্ড আসক্তি পূর্ণভাবে সুমিত্রাকে গ্রহণ করবার অন্তরায় ছিল, সুমিত্রার মৃত্যুতে সেই আসক্তির অবসান হওয়াতে সেই শান্তির মধ্যেই সুমিত্রার সত্য উপলব্ধি বিক্রমের পক্ষে সম্ভব হল, এইটেই রাজা  রানীর মূল কথা। রচনার দোষে এই ভাবটি পরিস্ফুট হয়নি   (ভূমিকা তপতী রবীন্দ্রনাথ )


মনে পড়ে যাচ্ছে সেই ছাত্রজীবনের কথা। তুলনামূলক সাহিত্য বিশেষপত্রে আমাদের পাঠ্য ছিল এলিয়টের বিখ্যাত কাব্যনাটকমার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল’ (১৯৩৫) চার্চের সঙ্গে রাজশক্তির দ্বন্দ্ব এবং যাজক বেকেটের শহীদত্ব নিয়ে রচিত এই কাব্যনাট্যের সঙ্গে প্রতিতুলনায় পড়ানো হতো রবীন্দ্রনাথেরবিসর্জন রাজা গোবিন্দমাণিক্যের অহিংসার নীতির সঙ্গে রাজপুরোহিত রঘুপতির অধিকারের দ্বন্দ্ব উনিশ শতকে রচিত হলেও, মেজাজের দিক থেকে এলিয়টের সঙ্গে মেলানো যায়। অথচ সে বছরের প্রশ্নপত্রে সবিস্ময় লক্ষ করি, ‘রাজা রানী’ (১৮৮৯) সঙ্গে এলিয়টের উক্ত নাটকের সাদৃশ্য নির্ণয় করার কথা বলা হয়েছে। প্রশ্নের অসঙ্গতি তখনই স্যারেদেরে জানাই তাঁদের নির্দেশমতোরাজা রানী সঙ্গে অমিল দেখিয়ে বিসর্জনের কথাই টেনে এনে উত্তরটি শেষ করি। মনে আছে, যৌবনের স্পর্ধায় এই প্রশ্নের এই ত্রুটি দেখিয়ে তিনটি বিস্ময়চিহ্ন দিয়েছিলাম। পত্রে ৭০ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলাম, পরে জানতে পারি পরীক্ষক ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক (বর্তমানে বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য ) . দেবনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। 


২।।

আটবছর কেটে গেছে। পাঠপরিধির পাশাপাশি চিন্তার বলয়ও প্রসারিত হয়েছে। নেট পরীক্ষার জন্যরাজা রানীএকাধিককবার পড়েছি, ভেবেছি। কিন্তু সার্বিকভাবে ভালো লাগেনি। বরং এই নাটকেরই গদ্যরূপান্তরতপতী’(১৯২৯)-কে অনেকাংশে সংহত পরিণত লেগেছে। ব্যক্তিগত প্রেম রাজধর্মের দ্বন্দ্বে রানী সুমিত্রা রাজা বিক্রমের যে সংঘাত রবীন্দ্রনাথ দেখাতে চেয়েছেন, তা যেন এখানেই পরিণতি লাভ করেছে। ত্রিবেদী দেবদত্তএই দুই বিপরীত স্বভাবের ব্রাহ্মণ-কে দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃত জ্ঞানী আদর্শবাদী দেবদত্তের পাশেই থাকতে চান, একথা আমরা বুঝতে পারি।রাজা রানীনাটকে কুমারসেন ইলার উপকাহিনিটিকে পাশে রেখে এবং কুমারের বীভৎস মৃত্যু দিয়ে নাটক শেষ করে রবীন্দ্রনাথ যে অতিনাটকীয়তা সঞ্চার করেছিলেন, তাতপতীতে সচেতনভাবে বর্জন করেন। কুমারসেন, বিপাশা, নরেশ রয়েছে, ইলা নেই। শেষাংশে সুমিত্রা-দেবদত্তের যুগল প্রতিবাদ এবং বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ভার্গবের উপস্থিতিতে সুমিত্রার আত্মাহুতি প্রতীকী হয়েছে। মার্তণ্ডদেবের আশ্রিতা সুমিত্রা নিজেই তপতী (= সূর্য-কন্যা)  হয়ে উঠেছে তার দয়ালু স্বভাবে, তেজে আর অগ্নিস্নানে। বিক্রমের রাজকীয় দর্প চূর্ণ হয়েছে।রাজা রানীতে বিক্রমকে এই বলে হাহাকার করতে শুনি : 

দেবী, যোগ্য নহি আমি  তোমার প্রেমের

তাই লে মার্জনাও করিলে না? রেখে

গেলে চির-অপরাধী করে? ইহজন্ম 

নিত্য অশ্রুজলে লইতাম ভিক্ষা মাগি

ক্ষমা তব; তাহারও দিলে না অবকাশ?

দেবতার মতো তুমি নিশ্চল নিষ্ঠুর,

অমোঘ তোমার দণ্ড কঠিন বিধান!

তপতী রাজা বিক্রম কিন্তু আদৌ অশ্রুভারাতুর হননি। বরং তিনি সুমিত্রা তার ভাই যুবরাজ কুমারসেন-কে বন্দি করে কাশ্মীরের গর্ব চূর্ণ করতে চেয়ে বলেন, 

অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে। মন্দিরের দুর্গমতা লৌকিক হোক অলৌকিক হোক, ভৌতিক হোক দৈবিক হোক, কিছুতে মানব না। সুমিত্রার পক্ষে কাশ্মীরের আশ্রয় চূর্ণ চূর্ণ করব এই শপথ আমি নিয়েছি। 

এই সংঘাত শেষাবধি যেন হয়ে ওঠে রাজশক্তি মন্দিরের বিরোধ। সুমিত্রার আরাধ্য মার্তণ্ডদেব তথা সূর্যদেব। রাজার শাসনে দুষ্টের পালন আর শিষ্টের দমন দেখে বেদনায়, ক্ষোভে সুমিত্রা জালন্ধর ত্যাগ করে জন্মস্থান কাশ্মীরে এসেছে। কিন্তু রাজা তার প্রেমের দাবি আর রাজকীয় দম্ভ দিয়ে এই বিজিত রাজ্যকে যে-কোনো প্রকারে উৎপীড়ন করতে চান। মন্দির দেবতাকেও ছাড় দেন না।  ঠিক এইখানেই আমরা এলিয়টের উত্তরকালে লেখা নাটকমার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল’-এর সঙ্গে এই গদ্যনাটকের দূরান্বয় খুঁজে পাই। 


৩।।

 ১৯৩৫ সালে প্রকাশিতমার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল’ (যার বঙ্গানুবাদগীর্জায় খুন’) ক্যাথলিক আদর্শবোধের প্রেরণায় উজ্জ্বল। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র টমাস বেকেট রাজার বন্ধু এবং একজন আদর্শবাদী যাজক। অথচ তাকে রাজশক্তির কোপে পড়তে হয়। শুনতে হয় : Power is present. Holiness hereafter. একদিকে রাজার বন্ধুত্বের স্মৃতি, ক্ষমতা আর প্রাচুর্যের মোহ আর অন্যদিকে আত্মদানের মাধ্যমে মহৎ হয়ে থাকার প্রলোভন। এই দুইকেই জয় করেন বেকেট। তিনি কোনো লোভ, ক্ষমতা, বন্ধুতা কিংবা শহীদ হওয়ার গৌরব চান না। ঈশ্বরের ইচ্ছের কাছে নিজেকে বিলীন করে দেওয়াতেই তাঁর মুক্তি। দুর্দশাভোগেই তিনি জয়ী হতে চান। তাই হত্যাকারী চারজন নাইটের জন্য দ্বার খুলে দেন, হত্যা সম্পূর্ণ হয়। রাজশক্তির আপাত বিজয় আসলে পরাজয়। ঈশ্বরের ইচ্ছায় এই আত্মদান মনুষ্যরচিত নিয়মের ঊর্ধ্বে, অধিকতর গৌরবময়। এই নাট্যকাহিনির পাশে আমরারাজা রানীবাতপতীকে সাধারণভাবে মেলাতে পারি না। কিন্তু একটি সূত্র দ্বার খুলে দিয়ে রাজশক্তিকে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়ার মধ্যে যে আত্মসমর্পণ নয়, রয়েছে বিজয়ের পদক্ষেপ, তা সুমিত্রা দেখিয়েছেন। আমরাতপতীএবং এলিয়টের এই কাব্যনাট্যের তুলনীয় অংশ বিশেষ এখানে উদ্ধার করতে চাই :


তপতী


ভার্গব : মহারাজ বিক্রম অনতিদূরে, এই শুনি জনশ্রুতি। আদেশ করো, সমস্ত দ্বার রুদ্ধ করে দিই।

সুমিত্রা : খুলে দাও, খুলে দাও সমস্ত দ্বার খুলে দাও, আসবার দ্বার এবং যাবার দ্বার। যাও যাও ভার্গব, তাকে আমন্ত্রণ করে আনো। 

ভার্গব : তাঁর প্রতিজ্ঞা, দেবতার কাছ থেকে তিনি তোমাকে কেড়ে নিয়ে যাবেন। আমি মন্দিরের পুরোহিত, আমার কর্তব্য করতে হবে তো।

সুমিত্রা : তোমার কর্তব্যই করো। দেবতার পথ রোধ কোরো নাযে পথ দিয়ে রাজার সৈন্য আসবে সেই পথ দিয়ে আমার দেবতা আমাকে উদ্ধার করতে আসবেন। যাও তুমি এখনই, মন্দিরের সিংহদ্বার খুলে দাও।   


মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল


Unbar the door!

You think me reckless, desperate and mad,

You argue by results, as this world does,

To settle if an act be good or bad…

I give my life

To the Law of God above the Law of Man.

Unbar the door! Unbar the door!

We are not here to triumph by fighting, by straighten, or 

by resistance,

Not to fight with beasts as men. We have fought the beast

And have conquered. We have only to conquer

Now, by suffering. This is the easier victory.

Now is the triumph of the Cross, now

Open the door! I command it. OPEN THE DOOR!  (Part 2) 


দ্বার উন্মোচন করে নির্ভয়ে বিপদকে আহ্বান জানানো এই দুই উদ্ধৃতির মধ্যে বিশেষ সাদৃশ্য লক্ষণীয়। তবে এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথেরতপতীকেই পূর্বজ বলতে হবে, কারণ এর রচনাকাল ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ তথা ১৯২৯ সাল। রাজার ব্রাহ্মণ-বন্ধু দেবদত্ত-কে আমরা বেকেটের সঙ্গে কিছুটা তুলনা করতে পারি। রাজার সখ্য রাজপুরোহিত হওয়ার প্রলোভন সেও ত্যাগ করেছে; রানী সুমিত্রার পক্ষ নিয়ে  হয়েছে রাজার বিরাগভাজন। রাজদ্রোহী বেকেটের হত্যার জন্য নাইটেরা আসে আর এখানেও দুর্বৃত্তদের হাত থেকে প্রজাদের বাঁচাতে চেয়ে রানী দেবদত্ত বিদ্রোহী হিসেবে আখ্যাত হন। রাজধর্ম পালনে অক্ষম রাজা অস্ত্রের অধিকার ফলাতে চান। আর সুমিত্রা জেনেছেন : ‘মৃত্যু দিয়ে যাঁরা সত্যকে পান তাঁদের জন্য শোক কোরো না আমরা বেকেটকেও দেখেছি প্রলোভন জয় ঈশ্বরের ইচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে নিতে। রাজশক্তির থেকে সে ঈশ্বরকে বড় বলে মানে। এলিয়ট খ্রিস্টীয় শহীদত্বের আদর্শকে বড়ো করে তুলেছেন, নাটকের শেষে কোরাসে শোনা যায় ঈশ্বরের করুণাভিক্ষা আর ধর্মনিষ্ঠ মানুষের জন্য টমাসের প্রার্থনার অনুরণন,  

That the sin of the world is upon our heads; that the blood 

of the martyrs and the agony of the saints

Is upon our heads.

Lord, have mercy upon us.

Christ, have mercy upon us.

Lord, have mercy upon us.

Blessed Thomas, pray for us.    [Chorus : 9)

রবীন্দ্রনাথের এই রচনায় বৈদিক মন্ত্রের ব্যবহার হয়েছে বারংবার। রাজাকে দ্বার অর্গলমুক্ত করে প্রবেশাধিকার দিয়ে চিতাগ্নিতে প্রবেশ করেন সুমিত্রা। সূর্যবন্দনায় পাপবিনাশের প্রার্থনা করেন তিনি আর পবিত্র অগ্নির স্পর্শে তাঁর প্রাণবায়ু ভস্মে মিলিত হওয়ার মন্ত্র ধ্বনিত হয় :

বায়ুরনিলমমৃতমথেদং ভস্মান্তং শরীরম্‌।

ওঁ ক্রতো স্মর কৃতং স্মর।

ক্রতো স্মর কৃতং স্মর।

অগ্নে নয় সুপথা রায়ে অস্মান্‌

বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান্‌।

যুযোধ্যস্মজ্জুহুরাণমেনো

ভূয়িষ্ঠাং তে নম উক্তিং বিধেম।    (ঈশোপনিষৎ : ১৮)

পাপবিনাশী এই প্রার্থনা উভয় নাটকের শেষেই আমরা খুঁজে পাই। তবে রবীন্দ্রনাটকটি এলিয়টের থেকে সাহিত্যিক তাৎপর্যে অনেকখানি ভাবনার পরিসর রেখে যায় পাঠকের জন্য। রাজশক্তি আর দেবতার বিদ্রোহী হয়ে ওঠার মধ্যেতপতী নাট্যদ্বন্দ্ব জমে ওঠে। মানুষের অসম্মানেই দেবতা রুষ্ট, একথাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর নানা সাহিত্যকর্মে বারংবার বলেছেন। সুমিত্রার আত্মদান সেই রাজধর্ম অবহেলা উৎপীড়নের পাপবিনাশের প্রতীক। বেকেটের আত্মদানেও রয়েছে মহৎ আদর্শের কথা, কিন্তু সেখানে রাজশক্তির জ্ঞানোদয় কতখানি হলো তা দেখাননি এলিয়ট।  রবীন্দ্রনাথ তা না দেখালেও শেষে ইঙ্গিত রেখেছেন। তবে উভয় নাটকে মুক্তি শান্তির আশ্বাসে শেষ হওয়ায় ট্র্যাজেডির লক্ষণ থাকলেও, শেষে আর ট্র্যাজেডি হয়নি। 


৪।।

১৯৯১ সালে কাব্যনাট্য গবেষক . তরুণ মুখোপাধ্যায় তাঁর পিএইচ-ডি গবেষণাপত্রে এবং ১৯৯৬ সালে কবি-প্রাবন্ধিক শঙ্খ ঘোষ একই ভাবনা ভেবেছেন দেখা যায়।বিসর্জন নাটকে জয়সিংহের সেই বিখ্যাত সংলাপ : 

চিন্তা কেন দেব? এমনি বিশ্বাস বলে

মোরাও করিব কাজ। কারে ভয় প্রভু!

সৈন্যবলে কোন্‌কাজ? অস্ত্র কোন্‌ছার!...

চলো প্রভু বাজাই মায়ের ডঙ্কা, ডেকে

আনি পুরবাসীগণে, মন্দিরের দ্বার

খুলে দিই...   (/)

এই অংশের সঙ্গে বেকেটের অনুগামী যাজকদের ভূমিকাকে শঙ্খ মেলাতে চান। বেকেটের সংলাপে পাই : আনবার দ্য ডোরস্‌! থ্রো ওপেন দ্য ডোরস্‌! / আই উইল নট হ্যাভ দ্য হাউস অব প্রেয়ার, দ্য চার্চ অব ক্রাইস্ট, / দ্য স্যাংচুয়ারি টার্নড ইনটু ফোর্ট্রেস / দ্য চার্চ শ্যাল প্রোটেক্ট হার ওন, ইন হার ওন ওয়ে শঙ্খ ঘোষ এখানে পেয়েছেনদৃঢ় বিশ্বাসের চেহারা তবে তাঁর আগেই তরুণ মুখোপাধ্যায় লক্ষ করেছিলেন  :

‘... সত্য চিরত্ব হলো বিশ্বাসের পুনর্জন্ম। এলিয়টের নাটকটির সঙ্গে বিসর্জনের তুলনা এই প্রসঙ্গে করা যায়। দুটি নাটকেই আছে আত্মদান। টমাস বেকেট কোনো মোহ বা লোভের কাছে পরাভূত হননি। জয়সিংহও অপর্ণার প্রেমে মগ্ন হয়েও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। বেকেট জয়সিংহ দুজনেই ঈশ্বরে বিশ্বাসী, মানবতার পূজারী। সত্যি তাদের লক্ষ্য। অবশ্য বেকেট প্রাণ দেয় শান্তি, স্বাধীনতা চার্চের জন্য। কিন্তু জয়সিংহ সর্বশূন্যমাঝে বিলীন হয়েছে। এদিক থেকে ভাবলেবিসর্জন হতে পারতো সার্থক কাব্যনাটক। তা হলো না। বেকেটের আত্মবিসর্জন যে মহত্ত্বের জন্য, তা আমাদের মনে  হৃদয়ে এক অভিঘাত তৈরি করে। কিন্তুবিসর্জনশেষ পর্যন্ত ধর্ম, প্রথা প্রেমের দ্বন্দ্বচিত্র হয়েই থেকে যায়  


৫।।


রাজা রানী থেকে তপতী এবং এলিয়টএই আলোচনা প্রসঙ্গে এই বিসর্জন কেন্দ্রিক এই তুলনাসূত্রটি কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। তবে আমার উদ্দেশ্য ছিলরাজা রানীথেকেতপতীতে পৌঁছনোর যাত্রা পথেবিসর্জন’, ‘মালিনীনাটকগুলি তিনি লিখেছেন। তাঁর নাটকে রাজা চরিত্র বারংবার নানা ভূমিকায় এসেছে। রাজশক্তির উৎপীড়নের সঙ্গে ধর্মের বিরোধ, তা সে প্রেমধর্ম কিংবা মানবধর্ম যাই হোক না কেন, তা তাঁর তত্ত্বনাটকেও বারবার ফিরে এসেছে [আমরামুক্তধারারক্তকরবী’-কে -প্রসঙ্গে স্মরণে আনতে পারি]  উত্তরজাতক ইংরেজি ভাষার উজ্জ্বল আধুনিক কবি নাট্যকার টি এস এলিয়টের সঙ্গে  প্রতীচ্যের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উত্তমর্ণ সম্পর্কটি এখানে চিহ্নিত করা যায়। যদিও এলিয়ট রবীন্দ্র-নাটকগুলি পড়েছিলেন, নাকি নিছক চিন্তনের ঐক্য, তা স্পষ্ট করে বলা আজ সম্ভব নয়।।  



ঋণস্বীকার :

) রাজা রানী, তপতী, বিসর্জন ইত্যাদি টেক্সট্‌।

) মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল টি এস এলিয়ট

) বাংলা কাব্যনাট্য : রূপ রীতি তরুণ মুখোপাধ্যায়

) ভিন্নরুচির অধিকার শঙ্খ ঘোষ