রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০২৪

রজতকান্তি সিংহচৌধুরী-র নিবন্ধ

কবিতার জন্মকথা 


কবিতা আসলে জীবনযাপনেরই এক শিল্পিভ নির্যাস। গজদন্তমিনারবাসীর ছলাকলা বা মৃণালভুকের স্বেচ্ছাচার নয়। সমকালের উৎসার  তো সে বটেই, কিন্তু সর্বোপরি, চিরকালীন। কথিত আছে, স্বাতী নক্ষত্রের জল বিশেষ মুহূর্তে শুক্তিতে পড়লে মুক্তোর জন্ম হয়। কবিতার জন্মকথাও তেমনি রহস্যচঞ্চল কোন্ রসায়নে কবিচিত্তে একটি অনুভূতি কবিতায় স্পন্দিত হয়ে ওঠে সেই রহস্যের চাবিকাঠি চির-অজানা। সৃষ্টিতে একধরনের স্বতঃস্ফূর্ততাও কবিতার অঙ্গাঙ্গী। শ্রেষ্ঠ কবিও বোধ হয়, ‘আসুন একটা কবিতা লিখি’, বলে পরিকল্পনা মাফিক কবিতা লিখতে পারবেন না। মনের আলো-আঁধারির ছন্দোস্পন্দ স্বয়ং কবিরও অজানা।কিমিদং ব্যহৃতং ময়া’ - বিস্ময় শুধু আদি কবি বাল্মীকির নয়, আবহমানের কবিপ্রজন্মের।


ফিরছিলাম রেল পথে। ব্যাঙ্গালোরে কনফারেন্স সেরে। ২০ জানুয়ারী, ১৯৯৮ মাঘ মাসের সূচনা। পৌষ সংক্রান্তি সদ্য অতিক্রান্ত৷ দক্ষিণাপথে ট্রেনের জানালায় দেখে এসেছিপোঙ্গলউৎসবের আলপনা প্রতিটি গৃহদ্বারে আমাদের মকরসংক্রান্তির মতো দাক্ষিণাত্যে পোঙ্গল। দীর্ঘ যাত্রার শেষে ট্রেন ঢুকল বাংলায় মেদিনীপুরে। মেদিনীপুর স্টেশন ছেড়ে ট্রেন গড়িয়ে চলল ঢালু হয়ে নেমে আসা কাঁসাই নদীর সেতুর দিকে। যাত্রাপথ খড়্গপুর হয়ে কলকাতা। সেই পুরাতন শস্য শ্যামল বঙ্গভূমি গোধূলি আলোতে নদীচরে দান-কাটা খেত। কোথাও সর্ষেফুল, শীতের আনাজের চাষ। মনে হল, এই যে মেদিনীপুর শহরের নতজানু হয়ে নদীর কাছে নেমে আসা - তো আজকের নয়। সিন্ধু সভ্যতা থেকে সমস্ত নদীমাতৃক সভ্যতার মূলমন্ত্র : ‘দেখনি নগরগুলি নতজানু নদীর নিকটে কাগজ কলমে উঠে এলফেরাকবিতাটি -


ফেরা 


যেখানে মেদিনীপুর ঢালু হয়ে নেমে আসে কাঁসাইয়ের বুকে 

মোরাম-মেদুর মাঠ মোলায়েম হয়ে আসে গোধূলি-আলোতে 

চরে দানকাটা খেতসর্ষেফুল-কাদাখোঁচা-শীতের আনাজ তোমাকে ফিরতে হবে একদিন 

এইখানেএই কথা জেনো 

মাধুকরী শেষ করে গ্রাম থেকে,বার হয়ে আসে ওই হাতি মাহুত 

এত ধান হয়েছে যে গৃহস্থ দুমুঠো দিতে পারে অতিথি পশুকে।


কত যুদ্ধ জয়-পরাজয় পার হলে তবু বুঝতে পারনি 

শস্য না ফলাতে পারলে সব মাটিগোলাঘর শূন্য পড়ে থাকে দেখনি নগরগুলি চিরকাল 

নতজানু নদীর নিকটে 

ওখানে ফিরতে হবে তোমাকেও একদিন এই কথা জেনো। 

(নামকবিতা : কাব্যগ্রন্থ- 'ফেরা')


  কবিতা লিখতাম। খাতায় পড়ে থাকত।বাঙালি ছেলেঅল্প বয়সে অমন কবিতা তো সবাই লেখে ! বহু পরে ২০০৮ সালে কবিতাটি যখনদেশপত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তখন কৌতুককর ঘটনা ঘটেছিল একটি। বন্ধুভাগ্য আমার বরাবরই ভালো। কবিতাটিদেশ’-এর পাতায় পড়ে আমার এক সহৃদয় বন্ধুবর এস এম এস করেছিলেন, 'বিষয়টি কি নন্দীগ্রাম? ধরতে পেরেছি?' আমি সবিনয়ে জবাব দিলাম, 'কবিতাটি ১৯৯৮ লেখা। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের বহু আগে। তবে রাম জন্মাবার আগেই বোধ হয় রামায়ণ রচনার রীতিচিরকালই।' আর কবিতার মানে নিয়ে মনান্তর করবার আগে মনে রাখা দরকার কবি আর্কিবল্ড ম্যাকলীশের সদুক্তি, 'A poem should not mean / But be' (Ars poetica, 1926) মানে বোঝানো নয়, হয়ে ওঠাটাই কবিতার ভবিতব্য।


1 টি মন্তব্য: