অনিন্দ্য রায়ের কবিতা : পাঠক প্রতিক্রিয়া
প্রখ্যাত কবি মণীন্দ্র রায়ের সুযোগ্য পুত্র অনিন্দ্য রায়। আর এক পুত্র অনন্য রায় অকালমৃত। দুই ভাইয়ের পেশা যা-ই হোক, তাঁদের রক্তে ও হৃদয়ে কবিতা বহমান। শ্রীঅনিন্দ্য রায়ের সাম্প্রতিক কাব্যসংকলন ‘নির্বাচিত কবিতা’ পড়তে গিয়ে শুরুতেই চমক :
যখন নিমগ্ন আমি আনন্দিত সুন্দরের স্তবে
গুলির আওয়াজে মন জেগে ওঠে বীভৎস বাস্তবে। (যখন)
এই বিভাব-কবিতা তাঁর সমস্ত কবিতার সুর বেঁধে দিয়েছে। উত্তরসূরি হিসেবে তিনি কবিতা বয়নে মণীন্দ্র রায়, সমর সেন, বিষ্ণু দে, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে হয়তো ঋণী, কিন্তু কারো প্রতিধ্বনি নন। প্রথম কবিতা ‘সুলেখা সেনকে খোলা চিঠি’ কী নির্মেদ, স্পষ্টবাক; অমোঘ বেদনার সঙ্গে কিছু কৌতুক যেন মিশে আছে। ‘ইও ইও প্রেম’ তো অন্যরকম প্রেমের ভাষায় লেখা কবিতা। প্রেমানুভব, প্রেমপ্রস্তাব, অভিজ্ঞতা মিলে কবির স্বীকারোক্তি, ‘তোমারই চাঁদ আর সূর্যে ভরে আছে আমার আকাশ।‘ ‘প্রেমের ১-২-৩’ পড়তে গেলে ঈষৎ সমর সেন উঁকি দেন :
তুমি সুখনিদ্ৰা যাও
আমি সারারাত জাগি
বিছানায় ছটফট; ঘেমে।
‘ঘাম’ বাস্তব ও অবাঞ্ছিত প্রেমের স্মরণ আনে। এই ধাক্কাটা কবি দেন। ‘ঘুম যে আসে না প্রেমের দেবতা’ তাই সারারাত সিগারেট খান সমর সেনও। কখনো বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ঢঙে বলেন,
মৃত্যুকে গিললুম আমি ঢক ঢক বাংলার মতো
ঈশ্বর ভয়ে থতমত
খুব স্মার্ট কবিতা। সেই সঙ্গে অন্ত্যমিলের চমৎকারিত্ব তৃপ্তি দেয়।
২.
অনিন্দ্য রায়ের কবিতা যতখানি ব্যক্তিগত তার চেয়ে বেশি সমাজগত। তাঁর ভিতরে যে ক্ষোভ-ক্রোধ-প্রতিবাদ-যন্ত্রণা, তা ফুটে ওঠে বক্রোক্তিতে। কখনো কবি বলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো তির্যক উক্তিতে। ‘ময়দানের জনসমাবেশে’ কবিতায় পড়ি,
আমি একাকার হয়ে গেছি
ময়দানের জনসমাবেশে।
ব্যক্তিগত খিদে, প্রেম
জ্বলন্ত সোনার মতো মিশে গেছে।
ক্রোধে চিৎকারে
বুলেটে রক্তাক্ত দেহে, ‘ইনকিলাব-এ আর ‘জিন্দাবাদ’-এ।
‘প্যারাডক্স’ কবিতাটি পড়লে আত্মসমালোচনা কতখানি তীব্র, তা বোঝা যায়। একদা দেশলাই জ্বেলে তথাকথিত বিপ্লবীরা ট্রাম-বাস পোড়াতেন। অনিন্দ্য রায় সখেদে বলেন :
অথচ আজ পর্যন্ত আমরা
ফুটপাতের একটি শিশুরও
পেটের আগুন নেভাতে পারিনি।
যে মহানগর ‘লিবিয়ার জঙ্গলের মতো’ জীবনানন্দ দাশ বলেন, সেখানে কবি অনিন্দ্যর উপলব্ধি— ‘নিজেকে বেবুন মনে হয়।’ অন্যস্বাদের কবিতা ‘ছোট্টো মোনালিসা’। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির অমর শিল্প ‘মোনালিসা’ চিরপ্রিয়া। অথচ কবি তাকে কন্যারূপে দেখে চমক ও বাৎসল্যরস সৃষ্টি করেছেন— “দা ভিঞ্চিকে ‘বাবা’ বলে কেউ কি ভালোবাসত?” উপমা প্রয়োগেও স্বতন্ত্র তিনি। ‘ভি.আই.পি রোডের ফেরিওয়ালা’-তে লেখেন,
পাকা ডালিমের মতো শূন্যগুলো খসে গেছে
পৃথিবীর বাগানবাড়িতে।
কবিতার স্তবক, পঙ্ক্তি নির্মাণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখি ‘রাস্তায়, গুলিবিদ্ধ লাশের মুখ’ বা ‘প্রসঙ্গ মৃত্যুর অঙ্ক’ কবিতায়। ‘ডিজিটাল ছন্দোচ্ছেদ’-এর মতো তাঁর কবিতায় ভাষা ও বাকচাল ডিজিটাল। জানি না কেন, অনিন্দ্য রায় কবি হিসেবে তেমন প্রচার ও স্বীকৃতি পাননি। এটা পাওয়া জরুরি। তাঁর ‘নির্বাচিত কবিতা’ পাঠ কবিতাপ্রেমী পাঠকদের নতুনরকম স্বাদ দেবে, আমার বিশ্বাস।।
নির্বাচিত কবিতা, অনিন্দ্য রায়, আলোপৃথিবী প্রকাশন, জুলাই ২০২৩, মূল্য : ১৫০ টাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন