রবিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৩

ঋতম্ মুখোপাধ্যায়-এর ধারাবাহিক গদ্য : "কবিতার বাতায়ন"

স্বেচ্ছাচারী আলোময় অদ্ভুত আঁধার


আমি একজন কবি। তাতেই আমি আলাদা। কবিতাই আমার বিষয়বাকিটা শুধু ভাল শব্দ খুঁজে পাওয়া।’  (ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি)  

যে যাই ভাবুক, আমাকে বলতেই হবে,

জীবনানন্দের থেকে অনেক অনেক দূরে সময় সরেছে

তবু কিছু জমা থাকে কোল্ড স্টোরেজেই।


ক্ষমা করো।


গভীর প্রেমের মতো আলোড়ন, অবচেতনার ছায়া, রহস্যের ঘেরাটোপে সেসব

কবিতা অদ্ভুত শীতল,

অন্য মহাদেশ।                   (জীবনানন্দ, বর্ণময় পৃথিবী, ২০১৩)


রবীন্দ্রোত্তর নয়, আমরা কি তবে জীবনানন্দোত্তর বাংলা কবিতার কথা ভাববো এখন? ষাটের অশীতিপর কবি গণেশ বসুর উৎকলিত কবিতাটি পড়লে তেমন একটা আভাস যেন টের পাই আমরা। তাঁর সাম্প্রতিক দুটি কাব্যে (বর্ণময় পৃথিবী, বল্‌গা হরিণের শিং) যে অদ্ভুত আঁধারের কথকতা, তাকে তিনি উত্তর-জীবনানন্দীয় প্রেক্ষাপটে স্থাপন করতে চান। আসলে গণেশ বসুর কবিতাবলী প্রেম রাজনীতিকে একবৃন্তে ধারণ করে হয়ে উঠতে চায় তীক্ষ্ণ আয়ুধ।বনানীকে কবিতাগুচ্ছ রোম্যান্টিক উত্তরাধিকার আপাতত শেষ কাব্যেও বহন করে বলেন কবিতোমার জন্য রেখেছি নক্ষত্রপুঞ্জ বন্দি করে আমার অস্থিতে অন্যদিকে স্বেচ্ছাচারী শাসকের প্রতি আনুগত্যে নয়, শিরদাঁড়া খাড়া রেখে তিনি প্রতিবাদের অঙ্গীকার করেন : ‘কোমায় আচ্ছন্ন শুভবোধ, ভবিষ্যৎও ভয়ঙ্কর, তবু যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাতে পারি না ব্যক্তিগত জীবনে মার্ক্সবাদী রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত কবি শিল্প সৌন্দর্যকে নিছক আনন্দের উপকরণ ভাবেন নি, তিনি সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ। ক্ষমতার কাছে নত হয়ে নয়, ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে তিনি আমাদের বিবেকের সহচর হয়ে ওঠেন। দেশজোড়া উন্মাদ আশ্রমের মধ্যে দাঁড়িয়েও ভাঙাচোরা আলো হয়ে জেগে থাকে কবি কবিতা। 


২। 

ক্ষমতার কাছে গেলে কবি আর কবি- থাকে না’ (দ্র. বর্ণময় পৃথিবী) অমোঘ এই উচ্চারণে গণেশ বসু সমকালীন সাহিত্যজগতে আনুগত্যের রাজনীতিকে বিদ্রুপ করেন। যদিও সেই বিদ্রুপে মিশে থাকে নিবিড় বেদনা। তাঁরঅথ প্রভুপাদকথাকবিতাটি ক্ষমতাবান জনৈক কবির দ্বিচারিতাকে ঠাট্টা করেছেনহিসেব কষেও কেউ মিথ হতে কখনো পারেনি প্রভু, অথবা কিন্নর, পারেনি কখনো হতে / আলোর উন্মাদ। / আমার প্রভুকে আমি চিনি, আবার চিনি না একই সুর শোনা যায় তাঁরজেব্রারা বেরিয়ে পড়েএবংঘুঙুরকবিতায়। এই চিড়িয়াখানার মতো সমাজে মেধাজীবীরাও রঙ বদলায়, তাই শাসকের বৃত্তের ভিতরে পৌঁছে গেলে পাওয়া যায় সব। কিন্তু সেইভাবে পায়ের ঘুঙুর হয়ে বেঁচে থাকা কবির কাছে গ্রহণীয় নয়। বরং মানুষকে পাশে নিয়ে মানুষকে ভালোবেসে তিনি সাদামাঠা জীবনকে বরণ করে নেন, বলনভাঙা কাপ আমার ঈশ্বরবল্‌গা হরিণের শিংকাব্যের প্রথম পর্বে ছোট-বড় একাধিক কবিতায় তাঁর রাজনীতি সচেতন মনের প্রকাশ ঘটেছে। সেখানে সাম্প্রতিক শাসক, তাপসী মালিকের মৃত্যু, সিঙ্গুর-লালগড় মিলেমিশে আমাদের শোনাতে চায় এক ছিন্নমস্তা শাসনতন্ত্রের গল্প। যেখানে টেনিসবলের মতো মানুষের মাথা নিয়ে খেলে শাসকহৃদয়।এইভাবে বাঁচা আর না-বাঁচা সমান অর্থহীনবলে তিনি হাহাকার করেন। উজ্জ্বল এই নৈরাজ্য যেন ইয়েট্‌সেরদি সেকেন্ড কামিং’-এর সেই উচ্চারণ ‘Mere anarchy is loosed upon the world’  তবু ওরই মাঝে মুক্তির পথ  খোঁজেন দ্রষ্টা কবিরা, আস্তিক ইয়েটস্‌খ্রিস্টীয় পুনরাবির্ভাবের ইঙ্গিত দিয়েছেন। আর নিরীশ্বর এই বাঙালি কবি যে কবিতালোক সৃজন করেন, তার গভীরে সাহসী হৃদয় নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন রচিত হয়।  


৩।

প্রথম কাব্যে যিনি উচ্চারণ করেছিলেনআমরণ সে রহিবে অশ্রুময় হৃদয়ে আমার’, তিনিই বার্ধক্যে এসে বলেনতবু যদি দিতে চাও শেষ উপহার / দিতে পারো তোমার বাহুর মধ্যে ছুটে যেতে কবিতার পঙ্‌ক্তির মতো বৃষ্টিকে শিকড়ে ধারণ করে কবি প্রেমহীনতার দাহ ভুলতে চান। যদিও তিনি বিশ্বাস করেন, পৃথিবী শাসন করে ভালোবাসা আর অশ্রুময় অনুশোচনা। তাঁর কবিতায় শূন্যতার নানা স্বর শুনতে পাই দ্বিতীয় কাব্য থেকে আপাতত শেষ কাব্যে। সীমাহীন অন্ধকারের মধ্যে ভয়ংকর শূন্যতাকে পাশে নিয়ে কবি হেঁটে চলেন, যেখানে বোবা না হয়েও বোবা সময়, স্বদেশ, আবেগ আগুন। কবি দেখেনবোবা না হয়েও বোবা রাস্তা পতাকা তবু স্মৃতিচিহ্ন রূপে ধরে রাখেন শূন্যতাকেই। সেই শূন্যতার রঙ খুঁজতে গিয়ে তিনি দিশেহারা হয়ে বলেনশূন্যতার রঙ বুঝি শূন্যতাই চেনে এই শুন্যতার বোধ তাঁর মনে মৃত্যুচেতনাকে জাগিয়ে তোলে। মৃত্যুকেই একামাত্র সত্য ভাবেন কবি, সস্মভ্রমে বলেন : ‘মৃত্যু হলো মন্দাক্রান্তা ছন্দের দোসর / রহস্যের সেরা শিল্প, নিবিড় সম্ভ্রম জিজ্ঞাসাচিহ্নের মতো অসীম আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃত্যুকে বিশল্যকরণী বলেন। শ্মশানস্থলীতে নিজেকে নিঃস্ব করে দিতে চেয়ে  কবি একতারা হাতে বিনীত বিদায় চান। এইসব শূন্যতার বোধের মাধ্যমে একাকিত্ব মার্ক্সীয় বিযুক্তিকে ছুঁয়ে কবির লেখনী নিরন্তর ক্রিয়াশীল থাকে।নাথিংনেসনামক যে-শূন্যতার দর্শনের সঙ্গে আমাদের পরিচিয় করিয়ে দিয়েছেন অস্তিত্ববাদীরা, তাকেও যেন কবিতায় রূপায়িত করেন কবি। এই শূন্যতার দর্শন আমাদের অস্তির নিরিখেই বিচার্য। হাইডেগার বলেন : ‘Human existence cannot have a relationship with being unless it remains in the midst of nothingness’ (What is metaphysics, 1929) আর জাঁ পল সার্ত্র তাঁর অস্তিত্ববাদে অস্তির (thingness/being) এর বিপরীতে এই নাথিংনেস-কে স্থাপন করেন। আবার অ্যাবসার্ডবাদী কাম্যু দেখেন, এই অমূর্ততা ব্যক্তিমনে বা বস্তুতে নেই, তা উদ্ভুত হয় চারপাশের পরিস্থিতি থেকে, সঙ্ঘাতের ভিতরেই এর জন্ম। যদিও শেষ পর্যন্ত অস্তিত্ববাদ চায় অস্তিত্বের সংকটকে দূর করে মানুষের স্বাধীনতা বা মুক্তি। রবীন্দ্রনাথের অন্ত্যপর্বের কবিতাপ্রথম দিনের সূর্য’ ‘তোমার সৃষ্টির পথইত্যাদিকে সত্তাবাদের নিরিখে পড়াই যায়। অবশ্যই পড়া যায় জীবনানন্দেরবোধবাআট বছর আগের একদিন’-এর মতো কবিতাকেও। আর তাঁদের উত্তরজাতক গণেশ বসু লেখেন : 

প্রার্থনার মতো সব শূন্য আজ

অথচ আমিও মোটে শূন্য নই, অবাধ অসীম

ভাঙাচোরা আলো।   (ভেঙে ভেঙে যায় আলো)   

আরেকটি নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন জীবনানন্দের মতো দেখতে পারেন না কবি। খড়ির গণ্ডিতে বন্দি হয়ে হারানোর ভয় তাঁকে তাড়া করে ফেরে। তবু জানেনকেবল দেয়াল নেই শিশুদের, কেবল দেয়াল নেই প্রজাপতিদের সেই মুক্তির আস্বাদটুকু মনে লেগে থাকে তাঁর। এমন এক উজ্জ্বল নৈরাজ্যপীড়িত সময়ে এও একরকম আত্ম-উন্মোচন বলা চলে।  


৪।

বর্ণময় পৃথিবী’ (২০১৩) থেকেবল্‌গা হরিণের শিং’(২০১৫) – আপাতত শেষ এই দুই কাব্যে গণেশ বসুর কবিতা যেমন সময়ের জ্বলন্ত অভিজ্ঞান তেমনই আঙ্গিক সচেতন। বিশেষত পাহাড়ী বল্‌গা হরিণের শিঙের আঁকাবাঁকা গঠন আর লড়াকু স্বভাব তাঁর কবিতার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে দেখতে পাই। কখনো এক বা দু-লাইনের অণুকবিতা, কখনো বা দীর্ঘ কবিতা লিখেছেন কবি। ছোট লিরিক তো রয়েইছে একাধিক। বিদ্রুপ আর বেদনা যুগপৎ তাঁর কবিতাকে হৃদয়গ্রাহী করেছে। জখম বেঞ্চি আর জংধরা ক্রাচউভয়েই তাঁর কবিতার বিষয় হয়েছে। টীকাসহ ১৬০ পাতা ব্যাপীবল্‌গা হরিণের শিং’- অতিকথনের দোষ যে নেই, তা বলা যায় না। মোটামুটি সমগ্র কাব্য জুড়ে প্রতিবাদ, প্রেম আর  কবির বেদনা বিকীর্ণ হয়েছে দেখি। তবে ভালো লাগে পর্যায় বিভাগ করে কবিরতাগুলির সজ্জা : 

) হাঙরের দাঁতে দাঁতে উদারীকরণ খেলে উদরীকরণে  

) সারাটা জীবন যেন তুষের আগুন

) যত মানচিত্র থাক অন্ধকারে সবই অর্থহীন

) মহাভাষ্য বৃদ্ধাশ্রম বিস্মৃতিই অজেয় আশ্রয়

) প্রজ্ঞা নেই, অন্ধকার / রহস্যটাই সভ্যতার

পর্যায়ের নামকরণগুলি কবিতাগুচ্ছের মেজাজকে চিহ্নিত করতে চেয়েছে। কবি এই কাব্য উৎসর্গ করেছেন পঞ্চাশের মেধাবী কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে, যাঁর কবিতায় বিশ্বের মানচিত্র পাঠকের মনচিত্রে ধরা পড়ে। আর হয়তো সে-কারণেই -কাব্যে বিশ্বকবিতা দেশ-বিদেশের অনুষঙ্গ এসে পড়েছে। গ্রন্থ শেষে টীকা সংযোজনের উদ্দেশ্যও বোঝা যায়। গ্যালিলিও, মেকিয়াভেলি, মার্ক্স, এঙ্গেলস্‌, মাও, কুইসলিং, রাজকার, হিলারি ক্লিন্টন, মেরিলিন মনরো, শেক্সপিয়র, শেলি, কবি চার্লস বুকোওস্কি, সুইডিশ কবি এভা স্ট্রম, মার্ক্স পত্নী জেনি, বিষ্ণু দে, বেগম রোকেয়া, বুনো রামনাথ, যামিনী রায় প্রমুখ তাঁর কবিতার অনুষঙ্গে এসেছেন; যাঁদের অনেকেরই সংক্ষিপ্ত পরিচয় টীকায় রয়েছে কবিতা ধরে ধরে। এমনই একটি কবিতাআলোকস্তম্ভের মতো সেখানে মার্ক্স তাঁর পত্নী জেনি মার্ক্সের সমাধি খুঁজতে খুঁজতে কবি  মার্ক্সের কবিতায় আশ্রয় খোঁজেন আর শেষে মোবাইলের আলো জ্বেলে অবহেলায় পড়ে থাকা সমাধি খুঁজে পাওয়া যায়, কবি পড়েন সমাধিলিপিও। প্রশ্নাতুর হনএখানে য়েনির সমাধি ছিল কি কোনোকালে’? শোনা কথা, চুরি হয়ে গিয়েছিল মার্ক্সের কফিন। কবির প্রশ্নচুরি হয়ে গেলেও কফিন মনীষা কি চুরি যায়, মার্কসের মগজ’? মার্ক্স তাঁর বিচক্ষণ পত্নীর সমাধিভূমিতে কবি খুঁজে পানআলোকস্তম্ভের মতো জীবনের প্রার্থনা 

এমনই আরও কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা আমরা পাই, যেখানে কবির কলমে বিশ্বকবিতা রাজনীতির প্রসঙ্গে শিল্পিত ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। যেমন : ক্ষমতা, অথ মেষতন্ত্রকথা, চোখে চোখ রেখে, দাঁড়াও পথিক বর। কয়েকটি পঙ্‌ক্তি ইতস্তত চয়ন করা যেতে পারে :

) ঢেউয়ে ঢেউয়ে ফসফরাস মানুষের মুখ,

নক্ষত্রপুঞ্জের মতো মানুষের চোখ

আগে আগে

স্বপ্নের ব্যানারে যায় ঢেউ

লাঠি হাতে কবি

গান্ধি নেমেছেন যেন পুনরায় ডাণ্ডি অভিযানে

‘Poets are the unacknowledged legislators of the world’.  (ক্ষমতা)


) মানুষের প্রজ্ঞা

              মেধা

                  বোধ

এভাবেই একরঙা বলয় ঘিরেই

                        দেশে দেশে মেষতন্ত্র পুঁজির খোঁয়াড়ে... (অথ মেষতন্ত্রকথা) 

) চীনে নয়া পুঁজিবাদ

ইতালিতে মাফিয়া বিস্তার

সাহিত্যে এখনও সেই পশ্চিমের ছোঁয়া

কবিতার মতো কোনো কবিতাই নেই

মানমন্দিরের চুড়ো খাঁ খাঁ করে

ঝরে পড়ে তারার যন্ত্রণা

যা নেই তা নিয়ে হোক সকলের শিল্প সাধনাই [লাও-ৎসে     (চোখে চোখ রেখে)

) বাতাসে কম্যান্ড দার্ঢ্য, দাঁড়াও পথিক-বর! দাঁড়িয়ে পড়তেই

অবাধ বিদ্যুৎ জ্বলে বৃষ্টির ভিতরে

অসংখ্য বৃষ্টির ফোঁটা এদেশের শিকড়ে শিকড়ে

বৃষ্টির ভিতরে তীব্র আর্তনাদ, অসীম শূন্যতা

Out, out brief-candle

Life is but a walking shadow.      (দাঁড়াও পথিকবর) 

লক্ষণীয়, ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি বা আন্তর্বয়ানযোগ্যতাকে তাঁর কবিতার অনিবার্য অঙ্গ করে নিয়েছেন গণেশ বসু। তাই মার্ক্স, এঙ্গেলস, হাইনে, শেলি, শেক্সপিয়র, লাও-ৎসে,লেনিন, কাস্ত্রো, চর্যাপদের পঙ্‌ক্তি অনায়াসে তাঁর কবিতায় স্থান করে নেয়। এসে যায় রাজনীতিবিদ হিলারি কিংবা নরেন্দ্র মোদীর বাচনও। আবার জীবনানন্দ দাশের একাধিক পঙ্‌ক্তিকে পুনর্নির্মাণ করেছেন তিনি তাঁর কবিতায়, কয়েকটি দৃষ্টান্ত এইরকম : 

) যাঁদের ধর্মই আছে শকুনের খাদ্য হল তাঁদের হৃদয় (প্রার্থনা)

) গভীর গভীরতর অসুখ তখন নামে আমাদের চিড়িয়াখানায়া।  (জেব্রারা বেরিয়ে পড়ে)

) তুমি কি কখনো লেখা ভুলেও পড়েছো বলো পিত্তল প্রতিমা? (কিছুই করার নেই) 

) এরই মাঝে / কবিতার / ক্রমমুক্তি ঘটে / এরই মাঝে / ফণা তোলে মেঘ... (চোখে চোখ রেখে)

) কল্লোলিনী আমাদের অশ্রু ঘাম ভালোবাসা বিবাহবিচ্ছেদ।  (ক্ষমতা)   

) অবাধ ক্ষমতা পেয়ে কমিশন স্বেচ্ছাচারী আলোময় অদ্ভুত আঁধার (নির্বাচন এসে গেলে) 

কবিতায় পূর্বজদের আত্মস্থ করে কবি সময়ের চোখে চোখ রাখেন, হাহাকার করে বলেনরবীন্দ্রনাথের দেশে লাশ হয়ে পড়ে থাকে গণতন্ত্র আজ।তবু লেনিনের কণ্ঠে সুর মিলিয়ে মার্ক্সবাদী কবি বিশ্বাস রাখেনকল্পনার বসন্ত আদতে / এক পা এগিয়ে, দুই পা পিছিয়ে [লেনিন / স্বাধীনতা / এবং কবিতা   


৫।  

স্যুররিয়ালজম যেমন অবচেতনের তথা মগ্ন চৈতন্যের ভাষাকে চিত্রে কবিতায় ধরে দেয়, তেমনি কিউবিজম চায় রেখা রূপের আশ্চর্য সম্মিলন। উনিশ শতকের ফরাসি কবি আপলিনের ঘোড়া কিংবা বৃষ্টি নিয়ে লেখা কবিতাকে চিত্রময় করে তুলেছিলেন। আমাদের ষাটের বাংলা কবিতার জগতে শ্রুতি আন্দোলনের রূপকারেরা কবিতা দিয়ে ছবি আক্ষরিকভাবেই ছবি আঁকতে চেয়েছিলেন। আমাদের গণেশ বসু ষাটের কবি। তাঁর এই আপাত শেষ কাব্যের একদম শেষ অংশে এমন পাঁচটি চিত্রল কবিতার দেখা মেলে। যেমন, সেমিকোলন আর নিম্নমুখী তীরচিহ্ন সাজিয়ে লেখেনএবং মেঘেরাকবিতা, যার একটিই পঙ্‌ক্তিমরমি মেঘেরা খোলস ছাড়ে’ – মেঘ এখানে মানুষের রূপক। আবারভালোবাসাকবিতায় জিজ্ঞাসাচিহ্ন, বিস্ময়চিহ্ন এবং ঊর্ধ্ব নিম্নমুখী তীরচিহ্নগুলির এলোমেলো বিন্যাসে জানিয়ে দেনউপেক্ষার অদ্ভুত সরণি অনুরূপভাবেসংবিধান’, ‘বুদ্ধিজীবী’, ‘স্বর্গ পুড়ে যায়কবিতা তিনটিতে যথাক্রমে অসমান বৃত্ত,  উল্লম্ব আনূভূমিক ড্যাশ, তীর, কোলন ইত্যাদি চিহ্ন এবং অন্ধকার ঘনক এঁকে অর্থকে পরিস্ফুট করতে চেয়েছেন। প্রতিটি কবিতার নাম একটি লাইন নিয়ে দুটি মাত্র লাইন প্রতীকী চিত্রের মাধ্যমেই পূর্ণভাবে বোঝা সম্ভব। (এখানেভালোবাসাস্বর্গ পুড়ে যায়কবিতা দুটির ছবি দেওয়া হলো।) একালের পোস্টমডার্ন কবিদের কবিতাতেও এই চিত্রময়তার প্রয়াস লক্ষ করা যায়, এতে আঙ্গিকের নতুনত্ব আছে। চিলির নেরুদা-পরবর্তী কবি অ্যান্টি-পোয়েট্রির অন্যতম প্রবক্তা নিকানোর পাররাকেও আমরা -জাতীয় কবিতা লিখতে দেখেছি। এছাড়াও আবার কোথাও বা শব্দসজ্জা দিয়েই আঁকেন নিঃসঙ্গতার ছবি :

চৌকাঠের ওপর দাঁড়িয়ে ...

নিঃসঙ্গ বয়স        

               

               

                        (বয়স) 

তবে এই চিত্রল কবিতা ছাড়াও আঙ্গিকের ক্ষেত্রে গণেশ বসু পুনরাবৃত্তির নীতিতে বিশ্বাসী। শৈলীতত্ত্বে একে চল চালকের বিন্যাস (PCOB) হিসেবে দেখানো হয়। যেখানে বাক্যের একটা অংশ অপরিবর্তিত রেখে অপর অংশটিকে পালটে পালটে কবি তীব্র অভিঘাত নির্মাণ করেন। তাঁর কবিতা থেকে পাওয়া দুটি দৃষ্টান্ত এইরকম : 

) আমাদের জানা আছে কীভাবে মিডিয়া নাচে পুঁজির বিলাসে

আমাদের জানা আছে গণতন্ত্রে স্বৈরাচার কীভাবে পতাকা তুলে ধরে

আমাদের জানা আছে সংকটের মধ্য সিয়ে কীরকম এদেশ চলেছে  (কুশল কামনা করি)

) কৃতজ্ঞতা ফিরে আসে সমুদ্রের কাছে;

কৃতজ্ঞতা ফিরে আসে পাহাড়ের কাছে;

কৃতজ্ঞতা ফিরে আসে জীবনের কাছে।  (দাঁড়াও, পথিক-বর)  

এছাড়াও গজল্লা, খচরামি -জাতীয় মুখের চলতি শব্দকে তুলে আনেন কবিতায়। পদ্য ছন্দের চেয়ে আস্থা রাখেন গদ্যছন্দে, মাঝে মাঝে লেখেন দীর্ঘ পঙ্‌ক্তির কবিতাও।  বর্ণপ্রতীকের ব্যবহারেও তিনি সাবলীল; তাইবর্ণময় পৃথিবীনীলকবিতার নীল বর্ণ হয়ে ওঠে প্রথাগতভাবেই বেদনার অভিজ্ঞান (‘এখন শরীর নীল, নীলপদ্ম থরে থরে মর্গের চাতালে’) অন্যদিকেবল্‌গা হরিণের শিং’-লালকবিতায় লাল রঙকে সর্বত্রব্যাপী দেখেন, যা তাঁর মার্ক্সীয় বিশ্বাস বিপ্লবী চেতনার চিহ্নবাহী হয়ে ওঠে (‘লাল নেই? লাল আছে সর্বত্রই, এবং রয়েছে  তা- / জ্বলন্ত চাকায়’)   


৬।

বল্‌গা হরিণের শিংকাব্যে এই বিশেষ রূপকল্পটি বেশ কয়েকবার ফিরে এসেছে বিভিন্ন কবিতায়। কখনো লেখেনঘড়ি ছিল প্রতিপক্ষ, প্রতিটি দরোজা ছিল বল্‌গা হরিণের শিং’, কোথাও বা বলেনমৃত্যু যেন খেলা করে হরিণের তরবারি শিঙেকিংবাবল্‌গা হরিণের শিং হয়ে আছি, ভালো নেই, বিশল্যকরণী নেই, কণ্ঠে মিশে আখ্‌তেওন আছে আখতেওনের মতো বীর শিকারীর অভিশাপে হরিণ হয়ে যাওয়া যেন আমাদেরও নিয়তি। শিং হয়তো আত্মরক্ষার সহায়ক কিন্তু সভ্যতার ক্রুর নেকড়েরা হরিণকে খাদ্য বানাতে সদা উৎসুক। কাব্যের শুরু হয়নেকড়ের দাঁতের মধ্যে শাসকের সূর্যোদয় চিরকাল ঘটেআর শেষে পাইনেকড়েরাও লজ্জা পায় সভ্যতার আশ্চর্য আঁধারে প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ সন্ত্রাসের চোখরাঙানি দেখতে দেখতে কবি স্বর্গ পুড়ে যাওয়ার বেদনায় ব্যথার্ত হন। নেরুদার মতো কবিতাকে প্রতিটি লোকের জন্য জরুরি অন্ন ভেবেও বিশ্বাস করেনশব্দই কবিতার কারু সমকালের বিভীষিকাই আমাদের ভবিষ্যৎ মেনে নিয়েও শেলির মতো কবিতায় ধরে দিতে চান নিজের বিশ্বাস আর হৃদয়ের নন্দিত মুহূর্তমালাকে, হতে চান কালের শিক্ষক।  বলেন, এক পা এগিয়ে আর দুই পা পিছিয়ে কবিতা মগজ হৃদয়ের যুগলবেণী রচনা করে। কবির এই উচ্চারণে আমরাও তাঁর সহপথিক হই : 

কী দেয় কবিতা?

              কবিতা তো রুটিভাত নয়।

              কবিতাই ধরে দেয় সমস্ত আকাশ।

              আবার কুড়িয়ে নেয় বিষণ্ণ ঋতুর ঝরাপাতা।

কবিতা তাঁরজীবনের বেলাশেষের ধুলোবালির কিছু আলো-অন্ধকার’, মানেন কবি। তবু এই মহাবিশ্বে ঈশ্বর আদৌ আছেন কিনা এই প্রশ্নও জাগে তাঁর মনে। এই অসুখী সময়ে তাঁর দেখা নেই কেন তবে? পূর্বজ ঈশ্বর-ভাবুক কবি অলোকরঞ্জনও এই মিলেনিয়ামে ঈশ্বরের ভাবমূর্তি বজায় রাখা নিয়ে চিন্তিত দেখি। প্রথম যৌবনেবন্ধুরা বিদ্রুপ করে তোমাকে বিশ্বাস করি বলেউচ্চারণের পরেও একুশ শতকে এসে তাঁকেই বলতে হয় : ‘একটু একটু অনীশ্বর হয়েছি, এখন অস্থি জুড়ে / প্রেতপিশাচের দল ডম্বরু বাজায় শর্বরীতে’ (ভাবমূর্তি) অনুজ কবিরও মনে হয়দেখেছি ঈশ্বর গড়াগড়ি খাচ্ছে ধর্ষিতার চোখের তারায় কবি চলার রাস্তাকে ঈশ্বর ভাবেন কিংবা বলেনমৃত্যুই ঈশ্বর যদি মৃত্যু ধ্রুবপদঅথবামানুষ থাকে মানুষ, / ঈশ্বর মারা যান, / মিথ্যে কথার ফুলঝুরিতে দিনগুলি খানখান [এখানে তাঁকে কিছুটা মায়াকোভস্কির  সঙ্গে তুলনা করা যায়। তিনিও ভাবতেন সম্মিলিত যাত্রার কথা, সেখানে দৈবকে অগ্রাহ্য করেছেন এবং বলেছেন ‘Our God is speed / The heart is our drum.’] আমাদের মানবপ্রেমিক কবি বল্‌গা হরিণের শিঙের অদ্ভুত প্যাঁচে খুঁজে পান জীবন-মৃত্যুর অগ্নিদহন। আর সেই দহনদানে কবি গণেশ বসুও আমাদের সহনশ্বর হয়ে ওঠেন। কারণ তিনি সেই শব্দের কারিগর, যিনি এই অদ্ভুত আঁধারেও সাহসী মন নিয়ে ভাবতে পারেন :‘লেখা ছাড়া কিছুই করার নেই নিরন্তর উপেক্ষায়, লিখে যাব ততদিন যতদিন মৃত্যু এসে থাবা না বসায়!’।। 



ঋণস্বীকার :

) বল্‌গা হরিণের শিং। গণেশ বসু। ২০১৫। কবিতা সীমান্ত। কলকাতা

) গণেশ বসুর কবিতা সংগ্রহ। জয়গোপাল মণ্ডল সম্পাদিত। জানুয়ারি ২০২০। দিয়া পাবলিকেশন। কলকাতা 

) সত্তাবাদের প্রেক্ষিতে কিয়েরকিগার্দ, রবীন্দ্রনাথ সার্ত্র। সান্ত্বনা মজুমদার। জুলাই ২০১২। দি এশিয়াটিক সোসাইটি। কলকাতা

) আধুনিক কবি, কবিতার শৈলী। উদয়কুমার চক্রবর্তী। ১৯৯৭। উত্থক প্রকাশনী। কলকাতা

) পদ্যপত্র : শ্রুতি   সম্পাদক : অর্পণ পাল। ২০১৪ (বিশেষ সংখ্যা) 

এবং উইকিপিডিয়া এবং অনলাইন এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা।     


[ষাটের বিশিষ্ট বামপন্থী কবি পেশায় বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক গণেশ বসু (১৯৪০-২০২৩) সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন।বনানীকে কবিতাগুচ্ছ’ (১৯৬৪) দিয়ে তাঁর আত্মপ্রকাশ। প্রেম-সমাজ-রাজনীতি তাঁর কবিতার কেন্দ্রীয় বিষয়। বিদ্রুপতিক্ত স্বর প্রতিবাদী চেতনা তাঁকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য কাব্য : অন্ন অশ্রু ভায়োলিন (২০০৫), ভাসান দরিয়া (২০১১), বলগা হরিণের শিং (২০১৫) কাব্য সংখ্যা বারো, তাঁর কবিতাসমগ্রও প্রকাশিত হয়েছে, তাঁকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ পেয়েছে একাধিকবার। সম্প্রতি সাহিত্য অঙ্গন পত্রিকা তাঁকে দিয়েছে উজ্জ্বলকুমার মজুমদার স্মারক সম্মান ২০২৩। গত ১০ নভেম্বর আকস্মিকভাবেই কবি প্রয়াত হলেন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে জয়গোপাল মণ্ডল সম্পাদিতসাহিত্য অঙ্গনপত্রিকার গণেশ বসু সংখ্যা (২০২০) থেকে এই প্রবন্ধটি পুনর্মুদ্রিত হলো।] 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন