এসেছো কবিতা
বিয়ে হল। শ্বশুরবাড়ি নৈহাটিতে, সেখানে অনেক আদর, শ্বাশুড়ির অঢেল ভালবাসা। আমার মতো মেয়ে, বাপের বাড়িতে যে চিরদিন অবাঞ্ছিত উপদ্রব, তার কাছে সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। কিন্তু স্বামী কাজ করেন অনেক দূরে, উত্তরবঙ্গে। তাই শ্বশুরবাড়িতে থাকার সৌভাগ্য হলনা, সোজা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে চলে এলাম। শিলিগুড়ির কাছে দারুণ সুন্দর পরিবেশে ক্যাম্পাস। বিশাল ছড়ানো ক্যাম্পাসের মধ্যে শালবন, বহতা নদী। শিলিগুড়ি আমার দারুণ ভালো লেগে গেল, যেন হারানো ছেলেবেলা ফিরে পেয়ে শিলিগুড়ির আশেপাশে সমানে ঘুরে বেড়াতাম। ঘন শালবনের ধারে রাস্তার উপর বোর্ডে লেখা থাকত, ‘এলিফ্যান্ট ক্রসিং জোন’, আমার গায়ে কাঁটা দিত। নেহাৎ কলকাতার মেয়ে তো! চা-বাগানগুলো অদ্ভুত, গাছগুলোর মাথা কেমন ছেঁটে সবাইকে সমান করে রেখে দেওয়া হয়, কেউ বলতে পারবে না আমি কত বড়। সমান উচ্চতার অজস্র টেবিল পাতা আছে, সেখানে বুঝি চাঁদের আলোয় পরীদের চায়ের পার্টি হয়! ছোট বড় অজস্র নদী শিলিগুড়ি জুড়ে। তাদের চওড়া খাত, অগভীর জল, জলে নেমে বিশাল বিশাল বোল্ডারের উপর বসে থাকা জলে পা ডুবিয়ে! সে যে কি অভিজ্ঞতা! এখানে থাকতে দারুণ ভালো লাগত। তখন তো নেহাৎই কমবয়স, বুদ্ধিশুদ্ধি এমনিতেই কম, তাই এই কাছেপিঠে বেড়াতে গিয়েও একবার একটা খুব মজার ব্যাপার হয়েছিল। আমার যে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দারুণ কিছু পরিবর্তন হয়নি সেটা জানানোর জন্যই গল্পটা বলা দরকার। তখন সবে একাত্তরের বাংলাদেশ যুদ্ধ শেষ হয়েছে। শিলিগুড়ির অনতিদূরে ফাঁসিদেওয়া সীমান্ত। সেখানে মহানন্দা নদীর এপারে ভারত, ওপারে বাংলাদেশ। আমরা একদিন স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে সেখানে গিয়ে অগভীর নদী পেরিয়ে নেহাৎ কৌতূহলের বশে সোজা বাংলাদেশ চলে গেছি। ওপারে মনে আছে দুচারজন আমাদের বেশ আদর করে গ্রাম দেখাতে নিয়ে গেছিলেন। কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসবার সময় দেখি এ কি কান্ড! এইটুকু সময়ের মধ্যে নদীর অন্যপারে দারুণ ভিড়, একেবারে জনতা। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। কি ঘটল আবার? যাইহোক এপারে তো এলাম, এসে শুনি কোন এক মহিলা ওপারে গেছেন, তিনি নাকি আবার কি সব প্যামফ্লেট বিলি করছেন, এইসব নানা রটনা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। পুলিশ অফিসারকে কি করে বোঝাই যে রাজনীতির ধার আমি কোনওদিনই ধারি না। যাইহোক বেশি ঝামেলা হয়নি আর, কোনওমতে সেযাত্রা রেহাই পেয়ে গেছিলাম।
এইসময় সংসারে তো আমি আর আমার স্বামী, দুটি মোটে মানুষ। কাজ বেশি থাকার কথা নয়, কিন্তু দেওর ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ছে, এক ননদের বিয়েতে নেওয়া ধার শোধ হয়নি, অন্য এক ননদের বিয়ে বাকি। তাই আমাদের গ্যাস ছিল না, ফ্রিজ ছিল না, অথচ নিজেই রান্না করতাম, তাই একটু ঝামেলা ছিলই। কিন্তু তার মধ্যে লাইব্রেরির বই ছিল মনের খোরাক। বিশাল মোটা সাহিত্যের বিদেশি তত্বের বই বহুদিন বাড়িতে রেখে নোট করে পড়েছিলাম মনে আছে। ফরাসী ভাষা শেখার শুরুও সেইসময়, যদিও এখনো আমি ফরাসী পড়তে পারলেও সে ভাষায় কথাবার্তা কখনও বলার সুযোগ পাইনি বলে নেহাৎ মোটামুটি চালাতে পারতাম এইটুকুই (এখন হয়তো সেটুকুও পারব না)। শব্দভান্ডারেও ঘাটতি আছে যথেষ্ট। যাইহোক, বই পড়ার ব্যাপারে আমার স্বামীর ভূমিকা বেশ মজার ছিল। আমি হঠাৎ কখনও তেমন কিছু আলোচনা শুরু করলে তিনি একটু সময় ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করতেন কখন আমার বলা শেষ হবে, আর যেই আমি একটু বিরতি নিতাম তৎক্ষণাৎ ঘরকন্নার সামান্য কিছু কথা জিজ্ঞেস করতেন। তাঁকে বইপত্র ব্যাপারে কিছু বলা বন্ধ করবার আগে পর্যন্ত বহুদিন আমি এতে প্রচন্ড ক্ষেপে যেতাম। একবার অবশ্য তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল আমার বইপড়ার ব্যাপারে । তখন আমি রাশিয়ান নোবেল লরিয়েট অ্যালেকজ্যান্ডার সলঝেনিটসিন-এর বইগুলো সব পড়া শুরু করেছি। ‘দ্য ফার্স্ট সার্কল’ হল, তারপর ‘ওয়ান ডে ইন দ্য লাইফ অফ আইভ্যান ডেনিসোভিচ’-ও পড়া হল, মনটা ভার হয়ে থাকলেও বিপত্তি কিছু ঘটল না। কিন্তু এরপর যে বই-এর জন্য সলঝেনিটসিন দেশ থেকে বিতাড়িত হন সেই ‘দ্য গুল্যাগ আর্কিপেলাগো’ পড়ে সেই ভয়াবহ অত্যাচারের কাহিনি আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয় নি। খাওয়া ব্যাপারটা প্রায় অসম্ভব হয়ে গেছিল আমার পক্ষে। খেতে বসি, একটু নাড়াচাড়া করি খাবার নিয়ে, আর উঠে যাই। এইবার আমার স্বামী একদিন ফেটে পড়লেন, ‘এ আবার কি, একটা বই পড়ে খাওয়া দাওয়া বন্ধ এমন উদ্ভট ব্যাপার কিছুতেই চলবে না’। তখন আমাকে এভাবেই খাওয়ানো দরকার ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু এখনও আমি অবাক হই যে কি এমন বই যা পড়ে বৌ খাওয়া দাওয়া বন্ধ করতে পারে সেটুকু খুলে দেখার কৌতূহলও তিনি বোধ করেন নি।
এসব ছেড়ে দিলে ঐ সময় মজা আর বেড়ানো ভালোই হত। ফিল্ম ক্লাবের মেম্বার হয়ে ভালো সিনেমা দেখাও শুরু হয়েছিল ঐসময়। কিন্তু ছোট জায়গা, নানা ঘোঁট, নানা ক্ষুদ্রতা, লিঙ্গবাদের দাপট। আমার চাকরি পেতে বেশ কিছু বাধা এসেছিল। আবার বহুদিন টানা পড়াশুনা। মনে আছে এই সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে বই এনে প্রচুর ফরাসী কবিতা আর উপন্যাস পড়েছিলাম। প্রুস্তের ‘রিমেম্ব্রান্স অফ থিংস পাস্ট’-এর মতো বিশাল বই পড়ে শেষ করতে পেরেছিলাম অখন্ড অবসর ছিল বলেই। এখানেও সেই একই সমস্যা, মেয়ে। তাতে আবার অল্পবয়স। আমার আবার একটু সাজগোজের শখ ছিল, সেও আর এক সমস্যা। সুতরাং আমি কি করে পড়াব, ছেলেরা পড়বে, তারা আমাকে মানবে না, ইত্যাদি। যাই হোক অবশেষে ছ’বছর অপেক্ষার পর শিলিগুড়ি কলেজে কাজ পেলাম। সেখানে এবং তার পরে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। অধ্যাপনার কাজ করি মোট তিরিশ বছরের বেশি সময়।
ক্রমশ...
খুব ঝরঝরে গদ্য। ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন