ধূমকেতু ----- গল্পকার ঋত্বিক ঘটক
ঋত্বিক ঘটক সিনেমাপ্রেমী মানুষ মাত্রই তার নাম জানে । সে কাজে তার স্বীকৃতি আজ সর্বজন বিদিত। যদিও সিনেমার শুরুর আগে অনেকদিন ধরে একটু একটু করে নিজেকে , আর নিজের মধ্যে শিল্পসত্তার বিকাশ ঘটিয়েছে। নানা শিল্পমাধ্যমে নিজেকে একটু একটু করে মেলে ধরেছে। তা গনণাট্যেই হোক কিংবা গণসংগীত । সবেতেই তার কাজকে কিন্তু একটা উচ্চকোটির আসনে অনায়াসেই বসানো যায় । আরও একটা অদ্ভুত বিস্ময়কর ব্যাপার হলো সে প্রতি ক্ষেত্রেই প্রথম পদক্ষেপে এতটা উচ্চপর্যায়ের কাজ দিয়েছে যে প্রথম দৃষ্টিতেই বাজিমাত। তার কাজকে অগ্রাহ্য করার কোন উপায় নেই পছন্দ-অপছন্দ ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু তা যে এক সুউচ্চ পর্যায়ভুক্ত তা এককথায় অনস্বীকার্য আর তাই সব ক্ষেত্রেই তার প্রকাশ অনেকটা ধূমকেতুর মতো , এক উজ্জ্বল বর্ণচ্ছটায় উদ্ভাসিত করে। তার স্বল্প জীবনবিস্তার যে বিশালত্বের দানবীয় প্রজ্ঞার বিস্তার ঘটেছে তাই সবথেকে অবাক করে । আর সেই বর্ণছটার এক রশ্মি হচ্ছে সাহিত্য।যা কিছু ছোট ও মাঝারি আকারের গল্পের ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কিন্তু তার সেই আত্মমগ্ন ভবঘুরে স্বভাবটাই যদিও আমাদের বঞ্চিত করেছে তার সমস্ত কাজকে আমাদের কাছে পৌঁছাতে। কত লেখা যে, কত কাজ যে কালের অতলে হারিয়ে গিয়েছে তা আমাদের জানা নেই কিন্তু যেটুকু পেয়েছি তা আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপেই প্রতিক্ষণেই অবাক করে । কখনো বিস্মিত করে, কখনো শব্দ সুষমায় সাজানো বাস্তবে আছড়ে ফেলে। তাই হয়তো "গল্প ভারতী " থেকে প্রকাশিত প্রথম গল্পে নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় তাকে শক্তিমান নবীন লেখক বলেই পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। যতদূর খবর পাওয়া যায় তা হল ১৯৪৭ সাল। হ্যাঁ ঠিক যে সময় আমাদের দেশ এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, ঠিক তখনই যেন একরাশ দেশ ভাঙ্গা কান্না নিয়ে অগ্নিবলাকার মতো আবির্ভাব ওর সাহিত্যের আঙিনায় । ওই সালেই রাজশাহী থেকে প্রকাশিত "অভিধারা" সম্পাদনার মধ্যে দিয়ে। পরে অবিশ্যি কলের শহর কলকাতা থেকেও "অভিধার"এর আরো কয়েকটি সংখ্যা বের হয় ওঁরই সম্পাদনায়। যদিও এখনো পর্যন্ত রাজশাহীতে ও কলকাতাতে সম্পাদিত অভিধারার একটি করে সংখ্যা পাওয়া গেছে। বাকিগুলো এখনো অব্দি কালের অতলের আবডালে মুখ লুকিয়েছে। "দেশ", "অগ্রণী", "শনিবারের চিঠি", "নতুন সাহিত্য" ও নানা পত্র-পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়।
যদিও এসব লেখালেখি ১৯৫০ এর আগের কথা। কারণ ১৯৫০ থেকে দীর্ঘ বছর ঘটক মহাশয় কোন নিখাদ গল্প লেখেননি, বা তার কোনো গল্পের হদিস পাওয়া যায় না ওই সময়টাতে । আবার যা হদিশ পাওয়া যায় ১৯৬২,১০ই অক্টোবর । তিনি একটি উপন্যাস এর ছক তৈরি করেন। আর ওই উপন্যাসের যা বিষয়বস্তু তা সত্যি সত্যিই যদি লেখা হতো তা আমাদের কাছে তথা বাংলা সাহিত্যের এক মাইলফলক হয়ে থাকত , তা বলা বোধহয় অত্যুক্তি করা হবে না। কারণ গল্পের পটভূমি ছিল ওঁর নিজেরই ছেলেবেলা। যদিও আপনভোলা, আত্মমগ্ন--- উদাসী ঋত্বিক ওই এক কষার প্রায় তিন বছর পর এক বড় গল্প লেখেন । নাম তার "পন্ডিতমশাই" । কিন্তু হায় কপাল ! কেউ যদি যত্ন করে কুড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখবার মতো থাকতো , ওই "পণ্ডিতমশাই" কতকটা অবহেলায়, অযত্নে উইয়ে কাটে। কিন্তু একটাই যা বাঁচোয়া দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো এক ব্যবস্থা আছে। কারণ ওই একই বিষয়বস্তুর উপর ওই গল্প থেকে তিনি একটি চিত্রনাট্য রচনা করেন যা "জন্মভূমি" নামে ১৯৬৮তে "অভিনয় দর্পণ" পত্রিকা থেকে প্রকাশিত হয় । তবে এ কথা বলছি না যে সাহিত্যের স্বাদ চিত্রনাট্যে মেলে। তা কখনোই সম্ভব নয়। দুটি স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম । তবে তার রচিত গল্প গুলি পড়লে তার সিনেমায় যে মূল বক্তব্য প্রতিভাত হয় , যেন সেই মূল সুরটি অন্তঃসলিলার মত তাতেও প্রবহমান। ভিন্ন রূপে, ভিন্ন পরিবেশে ,ভিন্নতর আঙ্গিকে। সেই সাম্য আদর্শের ভিত্তিতে সংকটাকীর্ণ জৈবিক ঘটনার ঘনঘটায় যেন তাঁর গল্পগুলোর শিকড় প্রথিত। নাতিদীর্ঘ জীবনের আরো ছোট সাহিত্যিক জীবন , কিন্তু তার বর্ণচ্ছটায় আজও আমরা সঞ্জীবিত, সরসিত । অক্লান্ত জীবনী শিল্পী শ্রীঋত্বিক কবিতায়, গল্পে, নাটকে আরো কত কাজে যে সে দীপ্যমান তাই আমাদের চমকৃত করে। তার গল্প "মার" হোক বা "ঝড়ের পাখি" । যেমন ধরা যাক "গাছটি" নামক গল্প। একখানা বুড়ো গাছ গ্রামের শেষের সীমানায় দাঁড়িয়ে। সে যেন ওই গ্রামের প্রাচীনত্বের প্রতিনিধিত্ব করছে । একদিন সে যখন শেষমেশ পরাজয় স্বীকার করে কাটা পড়ে, তখন যেন হঠাৎ করেই সম্বিত ফেরে মানুষের ওই গাছটার প্রতি। আবার "অয়নান্ত" গল্পে যে অমোঘ কথা নির্দেশিত হয়েছে বারংবার তা যেন কোনভাবেই উপক্ষেণীয় নয়। আর তার গল্পে , গল্পের প্রয়োজনে তার জ্ঞানের বিস্তারের বিশালত্বের পরিচয় পাওয়া যায় , তা যেন সত্যিই আক্ষরিক অর্থে দানবীয় । যেমন একখানি ফরাসি কবিতার ব্যবহার যেন গল্পের ঐ ক্ষনকে, যেখানে ওই কবিতাটি ব্যবহৃত হয়েছে, তা সেই মুহূর্তকে দ্বিগুণ মহিমান্বিত করে। আবার একই সাথে যুগপৎ ক্রিয়ায় আলোকিত করে তার নাতিদীর্ঘ জীবনের অমোঘ অনস্বীকার্য উপস্থিতিকে
"La vie est breve ------
Un peu despoir
Un peu de reve ------
Et pois----bonjoir"
( জীবন সংক্ষিপ্ত
সামান্য আশা,
ক্ষনিকের একটি স্বপ্ন----
তারপর বিদায়। )
আবার একইভাবে উঠে আসে কালিদাস, গল্পের মূল সুর কে বেঁধে দিতে
" কশ্চিৎকান্তা বিরহগুরুনা স্বাধিকার প্রমত্ত
শাপেনাস্তঙ্গমিতমহিমা বর্ষভোগ্যে ন ভর্তুঃ ।।"
আবার কিছু রচনায় প্রকৃতির নানা রূপকে এমন ভাবে জীবনের ঘটনার সাথে, তার মনের ভাবের সাথে সম্পৃক্ত করেছে যে , তা এককথায় অনবদ্য। যদিও আলোচনা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে পারে, কিন্তু সংগত কারণেই আর দীর্ঘায়িত করা এক্ষুনি অনর্থক। তাই অহেতুক গল্পের নাম আর আর তার পংক্তি উল্লেখ করে সময় নষ্ট করছি না। এ প্রবন্ধ ঋত্বিকের জীবনের মতন নাতিদীর্ঘ। কিন্তু শেষমেশ দুটি কথা আমি নাম উল্লেখ না করেই পারছিনা এক ঋত্বিকের রচনা গুলির মধ্যে রোমাঞ্চকর পরিবেশ এমন ভাবে আছড়ে পড়েছে যে তার সত্যিই যেনো বুকে , মনে এক অমোঘ বজ্রের আঘাত হানে। গল্পের নাম "প্রেম" এক প্রেমিকাকে তার প্রেমিক মেয়েটির লম্বা চুলের বিনুনি দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করে । অথচ সেই নির্মম হত্যাকান্ডের পটভূমি এত রোমান্টিক! প্রকৃতি যেন সেই মুহূর্তে সেই বিশেষ লগ্নকে নিজের সমস্ত উজাড় করে সাজিয়েছে ,ওই আবহকে পরিস্ফুটন করতে । এমন কনট্রাস্ট, এমন বৈপরীত্য সত্যিই সাহিত্যের বিরলতম মুহূর্তের রচনা করে। অথচ শুরু থেকেই একজন আরেকজনের সাথে মিলনপিয়াসী। তারা নিজেদের দূরত্বের ব্যবধান ঘুচাতে অতিতৎপর। শেষ একটা ব্যাপার বলে আজকের মত ইতি টানবো । শ্রী ঘটকের প্রত্যেক গল্পেই কোথাও যেন শুরুর দিন থেকেই সিনেম্যাটিক রূপ নিহিত হয়ে রয়েছে। হয়তোবা তার অজান্তেই নিহিত হয়েছিল বিধাতার অমোঘ নির্দেশে। কারণ সে যে ভাবীকালের জগৎবিখ্যাত সিনেমাকরিয়েদের একজন। চলচ্চিত্র জগতের লোক হয়ে , এক চলচ্চিত্র সমালোচক হয়ে, এক চলচ্চিত্রের ছাত্র হয়ে এই ব্যাপারটা সত্যি সত্যি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। কিন্তু আরো পাঁচজনকে তা ভাবিয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই।
সত্যিই সে এক অদ্ভুত মিশেল, এক দেহে ভিন্নরূপ। একদিকে তার গল্পগুলি যেমন শুধুমাত্র সাহিত্যকর্ম হিসাবে রসোত্তীর্ণ, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। ঠিক তেমনভাবেই কোথায় যেন তাতে এসে মিশেছে চিত্রনাট্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ, যাকে ডিটেলিং এর গুন বলা চলে । আমরা চিরকালই প্রকৃতিপ্রেমিক সাহিত্যিক হিসেবে বিভূতিভূষণের কথাই বলে এসেছি । জেনে এসেছি। কিন্তু বিভূতিভূষণকে ছোট না করেই আমি একটা কথা বলছি দয়া করে বিচার করবেন। ঋত্বিক বাবুর লেখা পড়ে---- ঋত্বিকের প্রকৃতির বিবরণ যেন অন্য কোন সুরে বাজে যা অন্য তালে অন্য রাগে বাঁধা। আর ওই প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপট আর তাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার মধ্যে এত বৈপরীত্য সত্যিই চমক লাগিয়ে দেয়। আর একটা দুটো বাক্য চয়ণে জীবনবোধের এক গভীর বোধকে কোন ঘটনার আলিঙ্গনে প্রতিষ্ঠা করা তাও এককথায় অনবদ্য । একদিকে যেমন তাঁর লেখায় উঠে এসেছে বর্তমান সমাজের সমস্যা । এবং সামনাসামনি লড়ে সংসার এই সমাজে সেই চির কাঙ্ক্ষিত সাম্যের প্রতিষ্ঠা করা। যেমন "রূপকথা" গল্পের কথাই বলা যাক । লড়াইয়ের ময়দানে নেমে সম্মুখ সমরে নিজেকে এ যোদ্ধা রূপে প্রতিষ্ঠা করা। ঠিক তেমনি চূড়ান্ত বিপরীত চিন্তায় ডুব দিয়ে সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে, পুরোপুরি তথাকথিত সভ্য সমাজ কে বর্জন করা। যদিও শেষ বাক্যে একটা সন্দেহ নিজের মনে ফুটে উঠেছে , সত্যিই কি সম্ভব একজন তথাকথিত সভ্য এর পক্ষে আদিম সমাজের অংশ হয়ে জীবন কাটানো। কারণ তথাকথিত সভ্যতা যে তার মজ্জায় মজ্জায়। গল্পের নাম "এক্সট্যাসি " । আবার তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে গ্রাম বাংলার মেয়েদের করুণ দশার কথা । অভাবের তাড়নায় তারা তাদের থেকে অনেক বড় নিষ্ঠুর অত্যাচারী বিকালঙ্গ কে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। সে দুঃখ দুর্দশার কাহিনী। যদিও এই ঘটনার প্রেক্ষাপট অনেক আগের। আজ সমাজ পরিবর্তিত, কিন্তু ও ঘটনা অপ্রাসঙ্গিক আজকের দুনিয়ায় তা কি আমরা সবাই হলফ্ করে বলতে পারি? যাকগে,যে কথায় ছিলাম , ওই গ্রাম বাংলার মেয়েদের এখানে দুর্দশার কথা। কিন্তু তা থেকে পরিত্রাণের এমন পন্থা সত্যিই বিরল। ওই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন না "কুড়ানি" গল্পে--"মরিয়া সে বাঁচিল" ,এখানে হয়তো কথাটি একটু অন্যভাবে বলা যেতে পারে" মারিয়া সে বাচাইলো"। ভাই তার বোনের দুর্দশা দেখতে না পেরে প্রথমে তাকে পালাবার কথা বলে , তা নাকচ্ হলে তাকে আত্মহত্যার পরামর্শ দেয়। শেষটায় নিজেই বোনকে হত্যা করে মুক্তি দেয় । এই পরিণতিকে আপনারা কি বলবেন, তা আপনারাই ঠিক করুন। কিন্তু বাঁচবার এও যে এক পথ, তাকে অস্বীকার করার উপায় আছে ! ভালো কি মন্দ পরের ব্যাপার। গল্পের নামঃ "এজাহার"। আমাদের মত মধ্যবিত্ত মানুষ , বিশেষ করে বর্তমান সমাজের প্রাইভেট কোম্পানি বা ছোট সংস্থায় কর্মরত মানুষগুলো। একদিকে যেমন নিজের জীবন যৌবন নিঃশেষ করে ওই সংস্থার কর্মক্ষেত্রেই । প্রতি মুহূর্তেই নিজের প্রতিটি ইচ্ছাকে গলাটিপে মারে অথচ তার সাথেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে শোনে কটুবাক্য। করতে হয় অনেক অনৈতিক কাজ ওদের অঙ্গুলিহেলনে। দিনশেষে তারাই আবার ছুঁড়ে ফেলে আস্তাকুড়ে। তেমনই এক সম্পাদকের কথা বলছেন ঋত্বিক। কিন্তু এখানে যে কাণ্ড ঘটিয়েছেন সম্পাদক তার মালিকের সঙ্গে তা আদৌ বাস্তবে অসম্ভব । তাই গল্পের নাম "রূপকথা"। যদি তেমনটি হত! নামকরণেও কি অপার মুন্সিয়ানার বিস্তার করে । যাইহোক ,ঋত্বিক গল্প বহুল পঠিত তা তো বলা যায় না। তাই আশা রাখবো চলচ্চিত্রশিল্পী সত্তার পাশাপাশি সাহিত্যিক ঋত্বিক কুমার ঘটকও পরিচিত হোক জনসমাজে একইভাবে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন