রবিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৩

ঐন্দ্রিলা তেওয়ারী-র প্রবন্ধ

মৃত্যু নেই শুধু থাকে একটি হৃদয়


সাল ১৯৪৫, শেষ হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাপানের বোমারু বিমানের আক্রমণের ভয়ে কলকাতা ছেড়ে কুমিল্লায় চলে যাওয়া কবি-সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য (১৯০৯-১৯৬৯) আবার ফিরে এসেছেন কলকাতায়। তবে যেন এক অন্য মানুষ, এক অন্য সঞ্জয়। কলকাতায় পুনারাগমনের এই দ্বিতীয় পর্বে একদা ট্রটস্কি-পন্থী তিনি মুগ্ধ মহাত্মাতে, অনুপ্রাণিত তাঁর আদর্শে। তবে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও কলকাতা  তখন স্বাধীনতা আন্দোলন, আজাদ হিন্দ্‌বাহিনীর সেনাদের মুক্তির দাবিতে উত্তাল, এমত পরিস্থিতিতে গান্ধীজি স্থির করলেন  তিনি সোদপুরে থাকবেন কিছুদিন, তবে ছিলেন প্রায় এক বছর ২রা ডিসেম্বর ১৯৪৫ থেকে নভেম্বর ১৯৪৬ পর্যন্ত। সোদপুরে খাদি আশ্রমে গান্ধীজি আছেন অগণিত মানুষের সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করছেন, এই সংবাদ পেয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি তরুণ সঞ্জয়-ও। তাই ২রা ডিসেম্বর তিনি পৌঁছলেন গান্ধী-দর্শনে, সোদপুরে। পৌঁছে দেখেন সে এক বিশাল আয়োজন। বিশাল পুলিশ বাহিনী ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে, চারিদিকে পুলিশি পাহারা, একটা বিশাল মাঠে শুধু গাড়ি পার্কিং-এর সুব্যবস্থা। আশ্রমে ঢুকতেই কবির চোখে পড়লো যে মাঠে প্রার্থনা হবে, সেখানে লোক জড়ো হওয়া শুরু হয়েছে। এরপর তিনি আর সময় নষ্ট না করে পাঁচ টাকা একটি বই জমা দিলেন গান্ধীজির স্বাক্ষরের জন্য। তারপর কানু গান্ধীর সহায়তায় পৌঁছলেন বাপুজির ঘরে। ঘরের মধ্যে গিয়ে বাপুজির প্রথম দর্শনে স্তম্ভিত তিনি : ‘পা থেকে বুক পর্য্যন্ত একটা সাদা আলোয়ানে মোড়া গান্ধীজিগলার দিকটাতে খদ্দরের একটা বড় রুমাল, একগুচ্ছ চরকায় সুতোয় একটি বাহু জড়ান মনে হল৷ গান্ধীজির মুখে বার্ধক্য-শ্রী। আপাত মসৃণ মুখ, নাকের দুধার থেকে চিবুক পর্য্যন্ত যে গভীর রেখা এখন আর তা রুক্ষ, প্রখর নয়মাংসের স্তবকে সুডৌল৷ নিজের দিনলিপিস্মরণী সরণি’-তে সঞ্জয় লিখেছেন : ‘গান্ধীজির স্বাস্থ্য দেখে মনে আশা আর আনন্দ হল। কিন্তু তারার ঘোলাটে নীলাভায় মনে হল বৃদ্ধ তিনি সত্যি  হয়েছেনএখনো চল্লিশ কোটি লোক অন্ধকারে --- গান্ধীজি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন।মাটিতে খদ্দরের চাদরের ওপর বসে এরপর সঞ্জয়ের পর্যবেক্ষণ - গান্ধীজি শুয়ে শুয়ে স্বাক্ষর দিচ্ছেন, হিন্দিতে টুকটাক কথাও বলেছেন। তাঁর মাথার কাছে একটা কাঠ গদির মত মোড়া, উঠে বসলে হয়তো ওটাতে হেলান দেন। ভূমিশয্যার পাশে এক-দেড় হাত উঁচু একটা সেলফ, যাতে নানা জিনিস রাখা। এভাবে মিনিট কুড়ি বাপুজির সান্নিধ্যে কাটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি এবং কানুজির হাতে তুলে দিতে চান সঙ্গে ২টি কমলালেবু আর একটা আপেল। তবে কানুজি তা নিজে না নিয়ে দিতে বললেন বাপুজিকেই। সঞ্জয় ডায়েরিতে লিখেছেন : ‘উবু হয়ে সামান্য তিনটে ফল গান্ধীজির দিকে তুলে ধরলাম। তিনি হাত বাড়িয়ে তা গ্রহণ করলেন।...কে ভাবতে পেরেছিল আট আনার 'টা ফলের এমন সদগতি হবে!’ এই অমূল্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে প্রার্থনা সভা শেষে কবি ফিরে এলেন বাড়ি।   যে মহাত্মার দর্শন তাঁর জীবনের একটা স্বপ্ন ছিলো তা যে এভাবে কখনো পূরণ হবে তা ভাবতেও পারেনি নি তরুণ কবি, ‘পূর্ব্বাশা সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য। সেই গান্ধীজি ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮ আততায়ীর হাতে নিহত হলে তিনি শোকাহত হয়ে লেখেনএকটি মনের মৃত্যু হল।মার্চ-১৯৪৮ ডায়েরিতে লিখেছিলেন : ‘আজ আমরা কি কাঙাল! রাজনীতিতে আর উৎসাহ নেই।এরপর এপ্রিলে লেখেন চারটি কবিতা, যার একটি আজও প্রাসঙ্গিক : 

তোমার স্বপ্নের আলো কতো দূর নক্ষত্রের ঘ্রাণ

কতো নীল তোমার আকাশ! 

তোমার একটি প্রাণ পার-হয়ে এলো কতো ইতিহাস

ভেঙে দিলে ভূগোলের সীমা! 

কী এক সমুদ্র-মন,

পাহাড়ের কী এক পিপাসা

আভা হয়ে, আশা হয়ে

অগণন রাত্রিতে জাগর!   (গান্ধীজি) 

পাশাপাশি তাঁর সম্পাদিতপূর্বাশাপত্রিকার ফাল্গুন ১৩৫৪ সংখ্যাটির প্রচ্ছদ গান্ধীজির ছবি দিয়েই তৈরি করা হয়, শিল্পী ছিলেন বীরু হালদার। এখানেস্মরণেনামক ক্রোড়পত্রে গান্ধীজির একটি বাণী, যার মূল সুরঅহিংসা-ধর্ম্মে ভারতবর্ষকে সেবা করিবার জন্য আমার জীবন উৎসর্গীকৃতছাপার পর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণলেখমহাত্মাজী-স্মরণেএবং পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা মুদ্রিত হয়। ছিল পূর্ব্বাশা লিমিটেড প্রকাশিত গান্ধী-সাহিত্যের বিজ্ঞাপনও। মুদ্রিত কবি কবিতার নাম ক্রমান্বয়ে এইরকম : মহাত্মা গান্ধী : জীবনানন্দ দাশ, মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যু : অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, গান্ধীজি : অজিত দত্ত, ৩০শে জানুয়ারি : সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য, তিনটি গুলি : প্রেমেন্দ্র মিত্র।  

সঞ্জয়ের এই কবিতাটির তিনটি উজ্জ্বল পঙ্‌ক্তিও স্মৃতিধার্য হতে পারে :

ভয় নেই আছে শুধু একটি হৃদয়

মৃত্যু নেই শুধু থাকে একটি হৃদয় 

একটি হৃদয় তার অন্ধকার নেই।   

তবে গান্ধীজির মৃত্যুর পর রাজনীতিতে একেবারেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন সঞ্জয়, বিশ্বসাহিত্য পাঠ মৌলিক সাহিত্য-চর্চায় আরও ডুবে যান ক্রমশ। তিরিশের অগ্রণী লিরিক কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য-এর কাছে গান্ধীজি এমনই আলোকিত প্রেরণা হয়ে উঠেছিলেন, যা আজও পাঠকের কৌতূহল জাগায়।।   




ঋণস্বীকার : 

স্মরণী সরণি, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, ধানসিড়ি, জানুয়ারি ২০১৭, কলকাতা

পূর্ব্বাশা, সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত, ফাল্গুন ১৩৫৪ / ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ (পিডিএফ) 



 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন