চা-পর্ব সেরে আবার গাড়ি চলা শুরু হলো। মতিদা মৌজ-সে একটা বিড়ি ধরিয়ে ছই-এ গিয়ে বসল আর গাড়ি গড়াতে লাগল নিজের তালে। এরপরের গ্রামের নাম ‘বড়ঢ়া’। আগে নাম ছিল-‘ভদ্রা’। আসলে ঐ ভদ্রা-ই গোরা সাহেবদের কিম্ভুতকিমাকার ইংরেজি বানানে আর উচ্চারণের দোষে ‘বড়ঢ়া’ হয়ে গেল। বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। বেশ কিছুটা রাস্তা পেরিয়ে এলাম। জনজীবনের দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ছে। একটা ছাড়া -পাওয়া হাঁসের দল খুব ব্যস্ত হয়ে প্যাঁক-প্যাঁক শব্দ করতে করতে রাস্তা পেরিয়ে ঐ পারে চলে গেল। একে অপরের সঙ্গে যেন কম্পিটিশন। কে আগে গিয়ে পুকুরে ঝাঁপ দেবে। ডানা উঁচিয়ে সে কি প্রাণপণ দৌড়। সারা রাত একটা খুপরিতে বাঁধা থাকে তাই সূর্যের আলো দেখলেই ওরা চঞ্চল হয়ে পড়ে। এখন বাকি সারাটা দিন তারা জলেই চরবে। নিজের খাবার ওরা নিজেরাই খুঁজে নিয়ে খায়। গৃহস্বামীদের উপর ওদের ভরসা কম। আবার দিন ফুরোলে মালকিনের ‘তই-তই’ ডাক শুনেই আবার বাড়িমুখো ছুট। যেন জেনারেল শিফট ডিউটি। বাকি কাজ রইল- ‘ডিম পাড়া’; ওই কম্মোটি অবশ্য মালিকের খুপরিতেই সারতে হয়। আর মালিকের কাছে তো এটার জন্যই ওদের এত কদর। ‘তই-তই’ বলে ডাক। বছরের এই সময়টা বড্ড ‘খরা’ মাস। খুব হিসেব করে চলতে হয় ধান ঘরে না-আসা পর্যন্ত। ততদিন কার্যত ওরা বেকার। এই কর্মহীন বন্ধ্যা সময় আর রোজগারহীন জীবনে টানাটানি নিত্যসঙ্গী। এই অভাবের টানে তাদের অপরাধ-প্রবণ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। শোনা যায়, এই অতিবড় সামাজিক সমস্যার দাওয়াই হিসেবে কিছু-কিছু লোকসংস্কৃতির আগমন ঘটে। তর্কসাপেক্ষে অনেকের মতে, এ অঞ্চলে ‘ভাদুগান’ এমনই এক সমাধানের হাত ধরে লোকজীবনে প্রবেশ করেছে। ভাদু নাচ-গান রাঢ়বাংলার এক জনপ্রিয় লোকসংস্কৃতি। এর উৎসমুখের পিছনে বহু মতভেদ রয়েছে। ভাদু আসলে ‘প্রতীকি’ পুতুল। কাপড় বা খড়ের উপর কাপড় পেঁচিয়ে রঙ দিয়ে পুতুলের আকার দেওয়া হতো। মেয়ের মুখ-চোখ এঁকে হাতে ধরে বা কাঁধে চাপিয়ে গান-বেঁধে, গান গেয়ে, ওরা স্বচ্ছল মালিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিছু ধান-চাল টাকা-পয়সা আদায়ের জন্য যেত। তারপর সেইসব আদায়ীকৃত খোরাক নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিত। সেইদিনটা ওদের খাওয়া হয়ে যেত। শুধু এই আর্থ সামাজিক কারণেই, 'ভাদু'-র ভূমিকার গুরুত্ব। গান ওরা যেমন বছর-বছর নিজেরাই বাঁধত আর সুর তো একটাই। তার মধ্যে সূক্ষ হিউমারও থাকত। যেমন-
‘ভাদু লেলে লে পয়সা দু-আনা
কিনে খাবি মিছরির দানা…’
সাধারণতঃ একটি কেন্দ্রীয় সুরে ভাদুগান বাঁধা থাকে। অবশ্য গান বলতে দু-চার লাইনেই বেশির ভাগ সীমাবদ্ধ। দোহার গোত্রীয়। বৈচিত্র যা কিছু লিরিক্স এ থাকত। আর একটা বৈশিষ্ট্য ছিল প্রতিটী থিমের পরপরই এই লাইন দুটি দিয়ে দোহারি শেষ হতোঃ-
‘তুরে পেঁয়েছি নৈনো বাজারে
নৈনা হমারা রে…’
এর সারমর্ম আমার জানা নেই। তবে লক্ষণীয়, এই গানটি রাঢ় বাংলার নিজস্ব ঘরানার লোকসংস্কৃতি যদি ভাদুপরবের উৎস বলে ধরা হয়, তাহলে লিরিক্সে হিন্দীভাষার অনুপ্রবেশ কিভাবে ঘটল। এমন একটা যুক্তিগ্রাহ্য যুক্তি খাড়া করা যায়- নৈনো কোনো এক চালু বাজারের নাম, যেমন ধরা যাক, ‘বরেলি কি বাজার’, মীনাবাজার ইত্যাদি যেমন নাম তেমনি ‘নৈনো বাজার’ তেমনই কোনো এক বাজার আর সেখান থেকে কিনে আনা হয়েছিল ভাদুর পুতুল। অতঃপর ‘নৈনা’ হমারা রে অর্থাৎ ও ভাদু, তুই আমাদের দু-নয়নের মণি। হিন্দীর প্রভাব মানে এই গানে হিন্দী ভাষাভাষী এলাকা প্রতিবেশী খনি অঞ্চল থেকে আসার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায়না। আরেকটি তুমুল জনপ্রিয় ভাদুগানের দোহা আমরা পেয়েছি- যা বিষেশভাবে দিশানির্দেশ করে উৎস-অভিমুখে। পদগুলি এমনঃ-
‘চল ভাদু চল খেলতে যাব রাণিগঞ্জের বড়তলা
আর ঐ পথেতে দেখে আসব কয়লাখাদের জল-তুলা’
তুরে পেঁয়েছি নৈনো বাজারে……’
সে সময় রাণিগঞ্জের (আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় ৪০ কি মি দূর) বড়তলায় (চলতি ভাষায় বটতলার অপভ্রংশ) একটি বড়মাপের ফুটবল টুর্নামেন্ট হতো। ফুটবল খেলা দেখে আসার ফাঁকে খনি অঞ্চল ঘুরে আসার ইঙ্গিত তো লিরিকস-এ রয়েছে। অনুমান করা যায় সেই সময় ঐ অঞ্চলে প্রথম কয়লাখনির নির্মাণকার্য চলছিল। কয়লাখনি নির্মাণের জন্য প্রথম পর্বে খনিমুখে খনন কার্য চলে মাটির গভীর পর্যন্ত। সেইসময় স্বাভাবিক ভাবেই প্রাকৃতিক নিয়মে খনিগর্ভের সঞ্চিত জলকে পাম্পের সাহায্যে উপরে তুলে ফেলতে হয়। গানে এই ‘কয়লাখাদের জলতুলা’-র কথা উল্লেখ রয়েছে। আর কোলিয়ারিতে মজদুরির কাজে হিন্দি-ভাষাভাষীদের প্রাধান্য থাকত মূলত বিহারের অধিবাসীদেরই। কাজেই গানের উৎপত্তি নিয়ে একটু প্রশ্ন থেকে যায়। যাকগে, এই ক্ষুদ্র পরিসরে এমন আলোচনা কোনো আলো যে দেখাতে পারবে না, তা ধরেই নেওয়া যায়। আসলে গ্রামের বাগদি সম্প্রদায়ের মধ্যে একটু আধটু লোক-সংস্কৃতির রেওয়াজ ছিল। মনসার গান, লেটো গান ইত্যাদির চল ছিল।এরা মূলত জমিদারদের মাসল্ পাওয়ার ছিল; লেঠেল। প্রজাদের মধ্যে যারা নিয়মিতভাবে কর,খাজনা দিতে পারত না, এদের বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হতো আর ওরা লাঠির জোরে সে সব আদায় করত। এছাড়া জমিদারদের পালকি-বাহকের কাজও এই বাগদি সম্প্রদায় করত। তাই এরা ছিল জমিদারদের ‘জো হুকুম’ বাহিনী। সব কিছুতেই এরা জমিদারদের কৃপাধন্য ছিল, তাই তাদের গায়ে-গতরে পরিশ্রম করে তাদের জীবিকা অর্জন করতে হতো না। অন্নচিন্তে তাদের ছিলনা। উপরন্তু জমিদারদের পুজো-উতসব-সামাজিক লোকাচারের অনুষ্ঠানে এদের অবাধ যাতায়াত ছিল। এর ফলে এরা হয়ে উঠল এক অলস-প্রকৃতির, শ্রমবিমুখ জাত। উপরোক্ত কাজগুলি না থাকলে এরা শুয়ে-বসে, ফূর্তি করে সময় কাটাত। ফলে যা হবার তাই হলো। উত্তরকালে যখন জমিদারি প্রথা উঠে গেলো, তখন ওরা কর্মহীন হয়ে পড়ল। না-ঘরের, না-ঘাটের। গতরে খেটে মজদুরি করে তাদের জীবিকা অর্জন করার ক্ষমতা নেই। ওদিকে সমাজে এতদিন তারা সমীহ পেয়ে এসেছে। কিন্তু এখন তাদের পুছবে কে ? সমীহ করা তো দূরের কথা। পারলে দু-চার ঘা যে বসিয়ে দিচ্ছে না, আগের অত্যাচারের বদলা নিতে এই যথেষ্ট। তবে ওদের দলটা তো আর ভেঙ্গে যায় নি তায় তারা একাট্টা হয়ে থাকত, তাই রেহাই। কিন্তু তা তো হলো কিন্তু সংসারের চাকাটা চলবে কি করে ? ঠিক এইখানেই বাগদি সমাজজীবনে এক নিঃশব্দ নারী-বিপ্লব ঘটে গেল। এটা বাগদিদের নিরক্ষর মেয়েরা যে খুব জেনে বুঝে করেছে তা নয়, একেবারেই স্বতঃস্ফুর্তভাবে, অন্তরীন প্রয়াসে, বেঁচে থাকার তাগিদেই করেছে। তারা যখন দেখল আগের সুখ আর নেই, এদিকে মরদ-রা সব আগের অভ্যাস মতোই দিন কাটাচ্ছে। গতর খাটিয়ে মেহনত করে দু-পয়সা আয় করার তাগিদ নেই, মেয়েরা মাছের জালি তুলে নিল কাঁধে। তারা প্রতিদিন ভোরে অন্ধকার থাকতেই দলবেঁধে নদী-নালা_পুকুর-খাল-বিল-ডোবায়, যেখানেই জলাশয়, সেখানেই হানা দিয়ে মাছ ধরে আনতে লাগল। সূযয্যি ওঠার আগেই তার বাড়ি। সেই মাছ নিয়ে ঘরে ঘরে বিক্রি করে দু-পয়সা আসতে লাগল। সেই পয়সায় দিনের খোরাকির যাইহোক একটা হিল্লে হতে শুরু করল। মরদের সাথে কোনো ঝগড়া নেই, ঝাঁটি নেই, অভিযোগ নেই, অনুযোগ নেই, শুধু সংসার নামক গাড়িটাকে সচল রাখতে ওরা এভাবেই এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এলো। এবং অবস্থা কিছুটা এদিক-ওদিক হলেও, এখনো বাগদি মেয়েদের জালি, বাগদি-সংসারে এক জীবনের প্রতীক।
রাস্তায় বহু জায়গায় গত বছর, অর্থাৎ ১৯৭৮-এর বিধ্বংসী বন্যার কিছু কিছু স্মৃতিচিহ্ন এখনো বিদ্যমান। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল হিংলোনদীর লাগামছাড়া বন্যার জলে। রাস্তার ধারে বহু দীর্ণ বাড়ি, স্কুলঘর সেই ভয়ানক স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করে দঁড়িয়ে রয়েছে আজও। আমাদের গ্রামটিও সেই ধ্বংসলীলা থেকে রেহাই পায়নি। গাঁয়ের কুলি দিয়ে ৫-৬ ফুট উঁচু উন্মত্ত জলের তোড় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সামনে যা পেয়েছে। গবাদি পশুর প্রাণহানিই বেশি ঘটেছে। আর নষ্ট হয়েছে দেদার ফসল, চাষের জমিন। আগ্রাসী জলের তোড়ে সাঁইপাড়ার রেলসেতু সাফ, রেললাইন ঝুলছে শূন্যে। অবশ্য একজন মানুষেরই মৃত্যু হয়েছিল। রসনি বুড়ি ভেসে গিয়েছিল বেনোজলে। নিয়তি যাকে বলে। একলা মানুষ রসনি বুড়ি-র কয়েকটি দুধেল গাই ছিল। বেচারা সেই দুধ বেচে তার একার জীবন বইত নিঃসঙ্গে। সেই দুর্যোগের দিন, বানভাসির দিন, বেনোজল হামলা করেছিল পথের ধারে তার উঠোনেও।
তার দুধ-দুইবার, বড় সাধের, একমাত্র বড় কাঁসার বাটি-টি জলের টানে ঘরের বাইরে ভেসে গেল। রসনি হাঁ-হাঁ করে তার পিছনে ঘটী-উদ্ধারে আকূল জলে ছপ-ছপ পায়ে যেই উঠোনে পড়ল, নিঠুর জলের আছাড়ি-পিছাড়ি স্রোতে, রসনি ভেসে গেল বানের জলে। ডুবিয়ে-ভাসিয়ে এই দেয়াল-সেই দেয়াল, এই খুঁটী-সেই থাম্বা করে ঝুলিয়ে দিল রেলপারের মদ-দোকানের বাঁশের ঝাড়ে। সেখানেই রসনির দেহ ঝুলে রইল জল-নামা অব্দি। বড়ই করুণ সে মরণ।
ক্রমশ...
অসাধারণ মন ছুঁয়ে যাওয়া নির্মম বাস্তব অতীতের এক টুকরো ফিরে এলো মনে।
উত্তরমুছুন